Home কলাম হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-৫৯

হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-৫৯

ইউসুফ কামাল : উড়ন্ত পাখীর ডানার মতো দেখতে দেখতে দিনগুলো যেন খুব তাড়াতাড়িই চলে যেতে লাগলো। কয়েক দিনেই যেন মনে হলো যেন কয়েক বছর পার হয়ে গেছে। পৃথিবীর নিয়মই যেন এমন, কারো জন্যেই কিছু বন্ধ থাকে না। গৎবাধা নিয়মে যেমন ক্লাসে হাজিরা দিতে থাকলাম, আবার তেমনি তার বিপরীতে টিএসসি’র দুপুরের খাবারের হাজিরাও বদলে যেতে লাগলো। কেন যেন আর আগের মতো যেতেও ইচ্ছা করতো না। ও খানে ঢোকার আগ্রহটাই যেন কমে আসতে শুরু করলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া আসার সময় অজান্তেই বুলার হলের গেটের দিকে চোখ চলে যেতো, জানি ও এখন ওখানে নাই তবু কেন যেন চলে যেতো। কেন এটা হয় ভেবেও উত্তর পাইনি কখনোই।

দিন দুই পর পুনু আসলো ডিপার্টমেন্টে বেশ কয়েকদিন দেখা হয় না। বুলা চলে যাওয়ার পর ওর সাথে এই দেখা, সব কিছু শুনলো, বুলা কেমন আছে, কথা হয় কিনা সব শুনলো। বল্লো, ও এরপর ফোন করলে বলবে আমি ওর জন্য সব সময় দোয়া করি। সাবধানে থাকতে বলবে। এক শুক্রবার বাদ দিয়ে পরের শুক্রবার সকালে বুলার ফোন এলো। কেন শুক্রবার ফোন করতে পারেনি কন্ঠে যেন তার-ই কৈফিয়তের সুর। গত শুক্রবার বাবা ওকে নিয়ে চল্লিশ মাইল ড্রাইভ করে তার চাকুরী জীবনের এক পুরনো বন্ধুর বাসায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ওকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো আর এই সুযোগে এখানকার জায়গাগুলোও ঘুরে দেখানো। বুলার কাছে বেড়ানোটা খুব ভালো লেগেছে ওর কথাতেই বুঝলাম। পথে দিগন্ত বিস্তৃত ভুট্টার আর যবের ক্ষেত। এত বড় বড় ফসলের ক্ষেত দেখে ও মনে হলো আশ্চর্যই হয়েছে। উচ্ছ¡সিত হয়ে বল্লো, এতবড় ক্ষেত আমি জীবনের প্রথম দেখলাম। আর এখানের গ্রামগুলোও ভারী সুন্দর, সাজানো গোছানো। শহরের মতো সব সুবিধাই এখানে পাওয়া যায়।

দুপুরের পর থেকে স্টোরে বসা শুরু করে দিয়েছে। মনে হলো ওর যেন একটু একটু করে ঐ দেশের জীবন যাত্রার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করেছে। আর সবার মতোই বাবা মাসিক বেতনের ব্যাবস্থাও করে দিয়েছেন যাতে কাজের প্রতি আলাদা একটা উৎসাহ বাড়ে। বাবা মেয়ে দু’জনে মিলে মিশে রান্না করা থেকে শুরু করে ঘর গৃহস্থালীর সব কাজ যৌথভাবে সম্পন্ন করে চলেছে। ওর বাবার শরীরের অবস্থাও এখন অনেক ভালো তবুও ওর কথায় বুঝতে পারলাম বুলা বাবা’কে কোন অনিয়মই করতে দিচ্ছে না। সাব ওয়ের এক স্টপেজ পরেই ওর বাসার স্টপেজ। বল্লো, বাবা মান্থলি টিকিট করে দিয়েছেন তাতে আর বার বার টিকিট কাটার ঝামেলা করতে হয় না। পরে দেখলাম প্রাত্যাহিক আসা যাওয়া করা সব যাত্রীরা এটাই করে। লাষ্ট ষ্টপেজ থেকে বাসা তিন মিনিটের হাঁটা পথ। বাবা দুইদিন সাথে থেকে দেখিয়ে দিয়েছেন এখন আর সমস্যা হয় না। বুলা রাতে ফিরে আসার আগে বাবা ডিনারের সব আইটেম টেবিলে সাজিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। বল্লাম, তোমার কথায় মনে হচ্ছে তুমি আমাদের সবাইকে দিব্যি ভুলেই গেছ। ভালোই তো আছো, কয়েক দিন পর আবার বলবে না তো -আপনাকে চেনা চেনা লাগছে, কোথায় যেন দেখেছি মনে করতে পারছি না তো। বলেই আমি হেসে দিলাম।

আমার কথায় বুলা যেন একটু থমকে গেল, দম নিয়ে বল্লো, তোমাকে ভুলে যাবো তাও কি হয়? তুমি না থাকলে তো আমার জীবনের কিছু মুহূর্ত অধরাই থেকে যেত। এখানে আসাই হতো না, আর আমি তো আসতেই চাইনি তুমি ও তোমরাই তো আমাকে পাঠালে জোর করে। মনের ভিতরের ঝড়টাকে কমানোর জন্যই তো ব্যাস্ত থাকতে চাই। সারাক্ষণ তোমাদের কথাই মাথার মধ্যে শুধু ঘুরপাক খায়। আমি তো তোমাদের কথা রেখেছি এখন তুমি তোমার কমিটমেন্টটা ঠিক রেখো না হলে কিন্তু …..

প্রথম কয়েক দিন তো রীতিমত বসে বসে কাঁদতাম। বাবা সেটা খেয়াল করেই ষ্টোরে বসিয়ে দিয়েছেন। উনি বুঝেছেন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মানুষ এমনি করে বদ্ধ অবস্থায় থাকতে পারে না। মানুষ জনের মধ্যে থাকলে একাকীত্ব বোধটা কেটে যাবে আর বেশি চিন্তা করার সময় পাবে না।

বাবা বলেছিলেন তোমার মা শেষ পর্যন্ত যখন আসলেই না, আমি এমনি করে তোমাদের কথা মনে করে মন খারাপ করে চুপ চাপ থাকতাম। তখন আমার বন্ধুরা বল্লো তোমাকে লোকজনের মধ্যে থাকতে হবে তাতে একাকীত্ব বোধটা ধীরে ধীরে কমে আসবে। ভাবলাম বুলাও কি ওর বাবা’র পথচাই অনুসরন করতে চাচ্ছে? তাতে যদি মনে কিছুটা শান্তি পায় তাতে আমার তো ভালো লাগাই উচিত। ধীরে ধীরে সবার কথা খুটিয়ে খুটিয়ে জানতে চাইলো। বল্লাম সীমা অনেক দৌড়াদৌড়ি করে তোমার সার্টিফিকেটটা এনে দিয়েছে। ওকে বল্লাম কয়েকদিনের মধ্যে একটু বাড়িতে যেতে হবে। তুমি তো জানোই আমার বাবা সরকারি চাকুরী করেন, কয়েক মাস পরে উনার রিটায়ারমেন্ট। মা’র সাথে পারিবারিক কিছু বিষয়ে জরুরি আলোচনা আছে। পিতামাতার বড় ছেলে তো, মা আমার সাথে কিছু বিষয় শেয়ার করেন। বুলা বল্লো, যাও তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। সামনের সপ্তাহে আমি আবার ফোন করবো। সীমাকে আমার কথা বলে ভালো একটা গিফ্ট দিও। এখন আমি তো বেতন পাবো তোমার কিছু লাগলে বলবে। বল্লাম, তুমি কিন্তু কিছু পাঠাবে না খবরদার, তাহলে কিন্তু আমি রাগ করবো। বুলা বল্লো, আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আসার সময় সীমা অনেক কাদাকাটি করেছে। সেই জন্যও আমার খুব খারাপ লাগে। ও খুব ভালো মনের মানুষ, ওর দিকে একটু খেয়াল রেখো। তাহলে তোমাকে আমার বাসার ঠিকানাটা দিই তুমি একটু কষ্ট করে লিখে নেবে? কাগজ কলম নিয়ে বল্লাম, বলো আমি লিখে নিচ্ছি….
……..Northwood ct
Dublin 9 . Ireland.
বল্লাম ঠিক আছে তোমার সার্টিফিকেট আমি দু/একদিনের মধ্যে পাঠিয়ে দেবো। সময়মতো কোর্সে ভর্তি হয়ে যেয়ো।
(চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ

Exit mobile version