Home কলাম হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-৫২

হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-৫২

ইউসুফ কামাল : সকালে আপার ডাকে ঘুম ভাঙলো। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞাস করলো কি হয়েছে? রাতে নাকি না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলি? বুঝে ফেল্লাম জিলু হয়তো কিছু বলেছে, আশেপাশে তাকালাম জিলু তো রুমেও নাই। আপার কথায় বুঝলাম, যা সন্দেহ করেছি তাই। কালকে রাতে না খেয়ে শুয়ে পরছি সেটা ঐ বলে দিয়েছে। বল্লাম, না কিছু হয়নি তো, এমনি ভালো লাগছিলো না তাই শুয়ে পড়েছিলাম। মাঝে মাঝে রাতে পুনু’র সাথে হল থেকে খেয়ে আসি সেটা বাসায় সবাই জানে তাই আর তেমন খোঁজ করে না রাতের খাবার সময়। কিছু একটা চিন্তা করে বল্লেন, হাত মুখ ধুয়ে আয় নাস্তা করে নে। সকালে গোসল করা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস, একেবারে তৈরী হয়ে নাস্তা করে নিলাম। জিলু’কে দেখলাম না বাসায়, মনে হয় সকালেই ক্লাস করতে চলে গেছে। চিন্তা করলাম ক্লাসে যাওয়া দরকার, কয়েকদিন ঠিক মতো ক্লাস করা হয় না। কলাভবনে পৌঁছতে একটু দেরীই হয়ে গেলো, ডিপার্টমেন্টে ঢুকতেই দেখি রোকেয়া আপা সবে মাত্র ক্লাসে ঢুকছেন, পিছন পিছন আমিও ঢুকে পড়লাম। ক্লাসে সবাইকেই দেখলাম- সেকান্দর আলম বিদ্যুৎ সবাই আছে। ইশারায় আলম ডাকলো একটু সরে পাশে বসতে দিলো। কয়েকদিন কেন ঠিক মতো ক্লাস করছি না বিষয়টা ও জানে বল্লো, এখন খুব জরুরি কোন ক্লাস হচ্ছে না, কিছু থাকলে আমি তোমাকে বলবো। ক্লাস শেষে বেড়িয়ে এলাম আলমকে নিয়ে, ডিপার্টমেন্ট কেন্টিনে ঢুকলাম। সকালে চা খাওয়া হয় নাই বয়কে চা দিতে বল্লাম।

পিছন পিছন বিদ্যুৎও চলে আসলো, চা এর কথা বলে পাশে এসে বসলো। বল্লো, তোমাকে তো খুঁজে গেছে। কোথায় ছিলে? বল্লাম, এত সকালে ক্লাসে করতে এসেছে? বিষয়টা কি? আমার ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়েছে। বল্লাম, ক্লাস করার ইচ্ছেই ছিলো না ওর, তারপর হঠাৎ করে এত সকালের ক্লাসে? যাহোক দেখা যাবে বিষয় কি?

পর পর আরো দুইটা ক্লাস। শেষেরটা চেয়ারম্যান ড: রওশন আলীর, সবাই এটাকে জরুরি ক্লাস মনে করে থাকে। স্যারের পড়ানোর ধারাটা খুবই ভালো যে কারণে সবাই উপস্থিত থাকতে চায়। উনার সাথে আমাদের কয়েকজনের খুব ভালো সম্পর্ক, ওটাও ক্লাসে থাকার অন্যতম কারণ। প্রত্যেক স্যারেরই নিজস্ব পছন্দের কিছু ছাত্রছাত্রী থাকে, আর আমাদের স্যারের পক্ষে থাকার কারণ ছিলো সাফায়েত ভাই।

অনেক বার জরুরি কাজে স্যারের সাথে উনার ফুলার রোডের বাসায় রাতে গিয়েছি। ডাকসু নির্বাচনের দিন সন্ধ্যার পর স্যারের ফুলার রোডের বাসায় বিশেষ জরুরি মিটিং করেছি আমরা কয়েক জন। এর দুইদিন পরে আমাদের ডিপার্টমেন্টের নির্বাচনের ফলাফলের উপর কোর্টের স্থগিতাদেশও জারি করা হয়েছিলো। ক্লাস শেষে টিএসসি’তে যাবো, বারান্দায় বেড়িয়েই দেখি রেলিংয়ের গায়ে হেলান দিয়ে বুলা দাঁড়িয়ে আছে। সপ্রতিভ ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো বল্লো, চলো। বুঝতে পারছি না ঘটনা কি, আবার স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞাসও করতে পারছি না। এ সময় রোজ এক সাথেই টিএসসি’তে দুপুরের খাওয়ার পাট শেষ করি। বিদ্যুৎ একটু পিছনে, কিছু ধারণা করছে কিনা এখন তো জিজ্ঞাসাও করা যাবে না। তাকালাম বুলার দিকে, ও খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছে, বিগত কয়েকদিনের মতো না। ওর ভিতরে বিগত কয়েকদিনের ঘটনার কোনো চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না। মুখ দেখেও কিছু বোঝার উপায় নাই। সহজ সরলভাবেই কথা বলে চলেছে।

টিএসসি’র ক্যাফেটেরিয়ার কাছে যেতেই বিদ্যুৎকে বল্লো, দাদা আজকে আমি স্লিপ আনবো, আপনিই তো রোজ আনেন। বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই স্লিপ আনতে সামনে এগিয়ে গেলো। দাঁড়িয়ে পড়লাম, বিদ্যুৎ কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, কিছু হয়েছে নাকি? হেসে বল্লাম, বুঝছি না, অপেক্ষা করো একটু পরেই বোঝা যাবে। স্লিপ খাবারের কাউন্টারে দিয়ে বুলা আমাদের টেবিলে এসে বসলো। সেই আগের মতোই হাল্কা মেজাজে আছে, মাঝের কয়টা দিনের মন মরা ভাবটা এখন যেন হাওয়া হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ আর কৌতুহল চাপতে পারলো না বল্লো, তোমার যাওয়া বাতিল করে দিলে নাকি, খুশী খুশী লাগছে যে। হেসে বল্লো, কিছুটা তাই। বড় ভাই ফোন করেছিলো, বাবা বলেছেন আমাকে ওখানে ‘জেরেন্টোলজী’র উপর একটা ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি করে দিবেন। উন্নত বিশ্বে সোশ্যাল সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট সিনিয়র সিটিজেনদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সেল্টার দেয়। ওখানে তাদেরকে চিকিৎসাসহ মানসিকভাবে সাপোর্ট ও সঙ্গ দেয়া হয়।

ক্লিলিনিক্যাল সাইকোলজি বিষয়টা ‘জেরেন্টোলজী’র সাথে অনেকাংশে সংশ্লিষ্ট বলা চলে। সেটার স্প্রিং সেমিষ্টার শুরু হতে মাস তিনেক দেরী আছে। ছয় মাসের কোর্স, পাশ করলেই চাকুরী। সে জন্যে এখানের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স কোর্সের একটা সার্টিফিকেট লাগবে। তবে আমি যদি এখনই যেতে চাই তবে তাও পারি আর যদি দেরী করে যেতে চাই তাও পারি, কি করবো বাবাকে জানাতে বলেছেন। আমি ভাবছি যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিলই করে দিই, কি বলো‘’? একটু সিরিয়াস হয়েই যেন বলে ফেল্লো। বলেই আমার দিকে তাকালো হয়তো প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। বিদ্যুৎ আর আমি দু জনই হেসে ফেল্লাম স্বস্তি পেলাম ওর কথায়, সময় যেহেতু আছে এর মধ্যে ধীরে ধীরে ওর মনটা কিছুটা হলেও সহজ হয়ে আসবে। বল্লাম, আমার মনে হচ্ছে তুমি না যেতে পারলেই বেঁচে যাও। জোরে হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বল্লো এ কয়েকদিন তোমার চেহারা যা হয়েছে আমার তো দেখে মায়াই লাগছিলো, যদিও কিছু বলিনি। পাশে থেকে বিদ্যুৎ যোগ করলো, আর তোমার চেহারাও কিন্তু বেশ একটা দেখার মতো ছিলো, আমার তো তোমাকে নিয়ে চিন্তাই হচ্ছিলো। বিদ্যুৎ এর কথায় সবাই আরো একবার হেসে উঠলো। আনন্দঘন মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ এর প্রস্তাব, অনেক দিন তোমার গান থেকে কিন্তু আমরা বঞ্চিত। হবে নাকি?

খাওয়া শেষে লনের এক কোণায় যেয়ে বসলাম, আজকে ছাত্রছাত্রী কম মনে হলো, নতুন করে ক্লাস শুরুর পর এখনো পুরোপুরি ছাত্রছাত্রীর সমাগম বাড়েনি। একদিনের মধ্যেই সবার মনটা ভালো হয়ে উঠলো যেনো। একটা ফুরফুরে ভাব। বুলা বল্লো আজকের গানটা দাদার সৌজন্যে। স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে প্রতিদিনের মতোই গানের মাঝ খান থেকেই ও গান শুরু করে আজকেও তার ব্যাত্যয় ঘটলো না শুরু করলো ….
তুমি যদি না দেখা দাও করো আমায় হেলা
কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল বেলা
দূরের পানে মেলে আখি কেবল আমি চেয়ে থাকি।।
পুরান আমায় কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে
আমায় কেনো বসিয়ে রাখো একা দ্বারের পাশে
মেঘের পরে মেঘ জমেছে আধার করে আসে’’।

সম্মোহিতের মতো গানটা শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। গানের শেষে বল্লো, তোমার আশায় তো বসেই আছি, তুমি যদি না দেখা দাও করো আমায় হেলা। ওর কথায় হেসে বল্লাম, বিষয়টা তো এখন আমার কাছে উল্টো মনে হচ্ছে। অপেক্ষার প্রহর গোনা তো এখন থেকে আমার জন্যই শুরু হলো। তুমি চলে গেলে হয়তো দেখবে বিরহ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে পনের দিন পরই আমি হাজির হয়ে যাবো, বিষয়টা হাল্কা করার জন্য বলে হেসে বল্লাম। লক্ষ করলাম বুলা কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো, স্বরটা নীচু কররে বল্লো, আমি সেটা জানি, তুমি আমাকে কতটুকু চাও আমি সেটা বুঝতে পারি। আমি চলে গেলে তোমার যে কষ্ট হবে সেজন্যেই আমি যেতে চাই না। তোমার কেমন অবস্থা হবে সেটা আমি কিন্তু এখনই টের পাচ্ছি, তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন তার পরিস্কার একটা ছবিও দেখতে পাচ্ছি। তুমি পরীক্ষা দিয়ে চলে এসো, আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো। তোমার মতো আমারও কষ্ট হবে তোমাকে ছেড়ে থাকতে, তুমি চলে এসো প্লিজ।

আজকে যেন বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো, পুরনো দিনের কথা মনে করে বল্লো, সম্পর্কের সূত্রপাত তো আমিই ঘটিয়েছিলাম, কেনই বা পিকনিকে অমন ঘটনাটা ঘটলো? অমন কিছু না হলে তো আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। কেউ কাউকে চিনতাম না, যার যার মতো থাকতাম। তারপরও আমার পারিবারিক দুর্ঘটনা আমার জীবনটাকে ভিন্ন পথে নিয়ে চল্লো। প্রসঙ্গটা স্বাভাবিক করার জন্য বিদ্যুৎ বল্লো, চলো একদিন সোনারগাঁও যাই। ওখানে ঐতিহাসিক অনেক কিছুই জানার ও দেখার আছে। বিশেষ করে পানাম সিটি তাদের মধ্যে অন্যতম। পানাম সিটির কথা আসতেই বুলা উৎসাহ নিয়ে বল্লো, আরে তাইতো পানাম সিটির কথা তো বান্ধবীদের কাছে অনেক শুনেছি কিন্তু যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। মনে হয় ভালোই লাগবে সবার। একটা ভিন্নতা আসবে সবার মধ্যেই। বিদ্যুৎকে বল্লাম, কবে যাবে দিন ঠিক করো, আমি গাড়ির ব্যবস্থা করবো। ভালো প্রস্তাব, এই গুমোট অবস্থার পরিবর্তনে হয়তো সবার জন্যই একটু ভালোই হবে।
সর্বান্তকরণে চাইছিলাম ওর যাওয়ার আগ পর্যন্ত পরিবেশটা যেন এমনই থাকে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

Exit mobile version