Home কলাম হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-৫১

হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-৫১

ইউসুফ কামাল : কি যে করি ভেবে পাচ্ছি না, প্রায় মানসিক বিধ্বস্ত বুলাকে কি বলবো আমি নিজেই ভেবে পাচ্ছি না। পাশে বসে আছে পাথরের মত নিশ্চুপ, দুচোখ দিয়ে জমে থাকা কষ্টগুলো যেন গলে গলে পড়েছে। কোনো কথা বলতে পারছি না, আজ প্রথম বার নিজে থেকে ওর হাতটা ধরলাম, আমার স্পর্শে চেপে রাখা কষ্টটা আর ধরে রাখতে পারলো না। মুখ ঘুরিয়ে তাকালো আমার দিকে, চোখ দু’টো লাল। টপ টপ করে আরো কয়েক ফোটা নোনা জল গড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। চোখ নামিয়ে ওর ধরে থাকা হাতটার দিকে তাকিয়ে ভাংগা গলায় বল্লো, ‘আজ প্রথম নিজে থেকে আমার হাতটা ধরেছো কিন্তু কতক্ষণ ধরে রাখতে পারবে? তোমার উপর আমার অগাধ আস্থা, অনেক বিশ্বাস করি তোমাকে। আমি তোমাকে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারছি না কারণ জানি আমার কিছু বলা লাগতো না, তুমি নিজের থেকেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দিতে’। তুমি কিছু বলতে পারছো না। ঠিক এই অবস্থায় বড় কোনো সিদ্ধান্তে তুমি আসতে পারছো না। কেন পারছো না সেটাও বুঝি।

আমি তোমার জায়গায় হলে হয়তো আমিও তোমার মতোই কিছু বলতে পারতাম না। সামনের একটা বছর আমাদের জীবনে দু:স্বপ্নের বছর। কি ভাবে যে কাটবে তোমার আমার এ বছরটা সেটা ভেবে আমি শংকিত। অন্য কেউ হলে হয়তো তোমার উপর চাপ সৃষ্টি করতো, কিন্তু সেটা করে সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা কি সম্ভব হবে? আর সেটার পরিণতিই যে ভালো হবে তার নিশ্চয়তা কি? তোমার এখনো পড়াশুনা শেষ হয়নি, তারপর কিছু একটা তো করতে হবে, বিদ্রোহী হওয়া সব বিষয়ে যুক্তি সংগত না আর তার জন্য যুক্তি সংগত একটা সময় দরকার সেটা আমি বুঝি। কি বলবো, অপর পক্ষ যখন অসুবিধার মূল বিষয়টা নিজেই বুঝতে পারে সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রশ্নই আসে না। নিরবতাই সেখানে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। বল্লাম, তুমি বলো তা হলে আমার করণীয় কি? একটা বড় দীর্ঘ:শ্বাস ছেড়ে বল্লো, আমরা দু’জনেই তো অসহায়, তোমাকে আমি আর কি বলবো বলো? আর এই দু:সময়টা তো আমার দিক থেকেই শুরু হয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উঠে দাঁড়ালো বল্লো, চলো একটু হাঁটি। টিএসসি’র গেট পার হয়ে ডান দিকের সেই চির পরিচিত রাস্তা, আনবিক শক্তি কমিশন, বাংলা একাডেমি পেরিয়ে সামনেই দোয়েল চত্বর। কর্ম ব্যাস্ত রাস্তা দিয়ে উর্ধশ্বাসে ছুটে চলেছে সারি সারি যানবাহন।

বিকেল পার হয়ে যাচ্ছে, ফিরতি পথ ধরলাম আবার উল্টো পথে। চির পরিচিত পথ কতদিন এ পথে হেঁটেছি, হেঁটেছি শুধু হাঁটার জন্যেই। সাথে সংগতিহীন, এলোমেলো কিছু কথাবার্তা যেন নিছক ভালো লাগার জন্যই। বুলাকে হল গেটে পৌঁছে দিয়ে বল্লাম, সারা দিন তো রেষ্ট নাওনি, গোসল খাওয়া দাওয়া করে ঘুমাবে। কাল সকালেই ডিপার্টমেন্টে চলে এসো। গেট দিয়ে হলের ভিতরে ঢুকতে যেয়ে না ঢুকে বেড়িয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো আমার সামনে আস্তে আস্তে বল্লো, বাসায় যাও। তোমারও রেস্ট এর দরকার আছে। তুমি শক্ত না হলে আমিও তো ভেংগে পরবো। তোমার দিকে তাকিয়েই তো আমি অনেক ভরসা পাই। আর হাঁটতে ইচ্ছে করলো না, রিক্সা নিলাম। একা হয়ে পড়ায় যেন সমস্ত ক্লান্তি এসে ভর করলো, মনের জোরটাও হঠাৎ করেই যেন নি:শেষ হয়ে পড়লো। তবে কি একাকিত্বই আমার শরীরের সমস্ত শক্তিকেই অবলুপ্ত করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট? বুলা আমাকে শক্ত হতে বল্লো, তবে ওর কাছেও কি মনে হচ্ছে আমি ভেংগে পড়েছি? যে দু:স্বপ্ন আমাকে তাড়া করছে তার প্রতিফলন কি আমার মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে? বাসায় চলে এলাম। সন্ধ্যে হয়ে গেছে, গলির মোড়ের চা’য়ের দোকানের ভীড় জমে উঠছে। পুরোন ঢাকার সর্বত্র এই এক চিত্র। সন্ধ্যার চা এদের দৈনন্দিন রুটিনেরই একটা অংশ। চা দোকানে সামশাদ বেগমের সেই পুরনো দিনের সাড়া জাগানো হিন্দি গান,
সাইয়া দিল মে আনা রে আ কে ফির না যানা রে
ছম ছমা ছম…
(এখানেও প্রেমিকাকে ফিরে না যাওয়ার চিরাচরিত আকুতি)

রুমে ঢুকে আলো নিভিয়ে ঐভাবেই শুয়ে পড়লাম। আমার রুমে ঢোকা দেখে পিছন পিছন জিলু চলে এলো ওকে বল্লাম, শরীরটা ভালো না আমি একটু শুয়ে থাকি, পারলে মজনু’র দোকান থেকে একটু চা এনে খাওয়াতে পারবি? ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু ভাবলো বল্লো, দুপুরে খাওয়াদাওয়া হয়েছে তো? ডালপুরি খাবেন, আনবো? বল্লাম, দুপুরে খেয়েছি , সমস্যা নাই। ডালপুরি হলেই চলবে। পুরনো ঢাকার ডাল পুরি সবারই পছন্দ। পাচ’টা টাকা বের করেদিলাম। বল্লাম, চা কিনে বাকী টাকার পুরি। ও চলে গেলো চা আনতে। সারাদিনের ঝামেলায় ক্লান্তই হয়ে পরেছিলাম। চোখটা বন্ধই হয়ে এসেছিলো। পায়ের শব্দে চোখ খুলে দেখি চা পুরি নিয়ে জিলু দাঁড়িয়ে। বল্লো, জামা কাপড়ও তো বদলান নাই এভাবেই শুয়ে পরেছেন? বল্লাম, ভালো লাগছে না, আমাদের জন্যে রেখে বাকীগুলো আপাকে দিয়ে আয়। উঠে বসলাম, চা খাওয়ার পর অনেক খানি ঝর ঝরে বোধ করলাম। বয়সে ছোট হলেও আমার সব বন্ধুদের সাথেই জিলুর অনেক সখ্যতা ছিলো। ও তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রথম বর্ষ অনার্সের ছাত্র। মনের দিক থেকেও অনেক সংস্কার মুক্ত হওয়ার কারণেই সবাই ওকে স্নেহ করতো।

বুলা চলে যাবে, ওর বাবা বিমানের টিকিট পাঠালেই। আর তখনই ওর লন্ডন যাবার নির্ধারিত তারিখও জানা যাবে। মনে হচ্ছে সময়টা যেন দ্রæতগামী সোনালী ডানার চিলের মতই দ্রæত শেষ হয়ে যাচ্ছে। টুকিটাকি কেনাকাটাসহ বাকী সময়টাও ইচ্ছা করেই যেন আমার সাথে কাটাতে চায়। ডিপার্টনেন্টে যেয়েও ক্লাশে ঢুকতে চায় না, বোঝা যায় ও মনটা স্থির করতে পারছে না। সেদিন দুপুরে ও বল্লো, বায়তুল মোকারম যেতে হবে একটা বড় লাগেজ কিনতে, আমার যাওয়ার সময় লাগবে। পছন্দ করে কিনতে অনেকটা সময় লেগে গেলো। আরো কিছু টুকিটাকি জিনিষ কিনতে দুপুর হয়ে গেলো। বুলা বল্লো, এত কাছে এসে প্রভিন্সিয়ালে যাবো না তাই কি হয়! আসলে ওর মতো আমারও ক্ষিধেও লেগে গিয়েছিল। আর আমার মতোই ওটাও ওর সব চেয়ে প্রিয় খাবারের দোকান। কেমন যেন একটা হারানোর বেদনা কাজ করছে ওর বুকের মধ্যে বুঝলাম ওর কথায়, আর কবে এখানে আসতে পারবো তাও বলতে পারছি না। সব কিছুর মধ্যেই ওর একটা হারিয়ে ফেলার শংকা যেন কাজ করছে। প্রভিন্সিয়াল থেকে বের হয়ে বল্লো, সেই দিনের মতো মিষ্টি পান খাওয়াবে না। বল্লো কিছুটা কৌতুহলী ভঙ্গিতেই কিন্তু সাথে সাথেই আবার দৃষ্টিটা ভারী হয়ে এলো যেনো। কাগজে মোড়া দুইটা মিষ্টি পান ওর হাতে দিলাম, হাত বাড়িয়ে নিলো ঠিকই কিন্তু সারা পথ পান দুইটা হাতে করে রিক্সায় বিষন্ন মনে বসে থাকলো। হলে লাগেজটা রাখতে যাওয়ার সময় বল্লো, শরীফে চা খাবো তুমি থাকো আমি এটা রুমে রেখে আসি। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে আমার সংগ ছাড়তে চাইছে না, যতক্ষণ সম্ভব কাছে কাছে থাকতে চাইছে। এমনই হয়, দূরে যাওয়ার আগেই সবার অনুভূতিগুলো যেমন প্রবল হয়, দু:খ ব্যাথার আগমনী বার্তাটাও তেমনি মনের মধ্যে জাঁকিয়ে বসতে চায়। হারানোর বেদনা যেন সমস্ত মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

Exit mobile version