ইউসুফ কামাল : ঈদের ছুটিও শেষ হয়ে গেলো। আমার এখনো মনে হয় ঈদের ছুটির সবচেয়ে বড় পাওনা হলো পুরাতন বন্ধুদের সাথে লম্বা আড্ডায় সেই পুরনো দিনে ফিরে যাওয়া। এর থেকে অতীতে অবগাহন করার আর কোনো ভালো পথ আছে বলে আমার মনে হয় না। কেউ জীবিকায় ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে আবার কেউ লেখাপড়ার শেষ স্তরে। বন্ধুদের সংগই মনকে ভালো করার সর্বোত্তম উপায়, এর কোনো বিকল্প নাই। সদ্য ভারত ঘুরে আসার গল্প তখনো কথার মধ্যে ঘুরে ঘুরে আসছে। তাজমহলের গল্প সবার মধ্যে বেশি রকমের কৌতুহল সৃষ্টি করতে পেরেছে। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য হিসাবে স্থান পেয়েছে। তখন গর্বই লাগছিলো যে এমন একটা জিনিষ দেখতে পেরেছি বলে। ইতিহাসের এই অমর সৃষ্টি সারা পৃথিবীর মানুষকে আকৃষ্ট করে। তাইতো সারা পৃথিবীর মানুষ এখানে ছুটে আসে। একটা অমর কির্তি দেখতে পাগলের মতো জীবনের সঞ্চয় ব্যায় করে ছুটে আসে। তখনও রাজধানী এক্সপ্রেস এর নাম মানুষের মুখে মুখে, দিল্লীমুখী মেইল ট্রেন, এটাই তখন পর্যন্ত সবচেয়ে দ্রæতগামী। যার যার সীটে বসেই খাবার পাওয়ার ব্যবস্থা এটা একটা অন্যরকম নতুনত্ব কাজ করেছিলো। স্লিপিং বার্থে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার মধ্যেও একটা আলাদা আমেজ কাজ করে। পরের দিন সকালে আর ঘুম ঘুম ভাব থাকে না, সকাল থেকেই কাজে নেমে পড়া যায়। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে গল্পের ভিতরে খেই হারিয়ে ফেলতাম, মনে হতো কোথায় যেন হারিয়ে যাই। কারণটা কি সেটাও বুঝতে পারতাম না। মনের ভিতর কি তখন অন্য কোনো স্মৃতি কাজ করে! অথবা অন্য কেউ সার্বক্ষণিক মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে। দীর্ঘ ছুটির প্রভাব সবার মধ্যেই চলমান স্বাভাবিক কর্মধারার মধ্যে একটা ছন্দ পতনের মতো কাজ করে। প্রাত্যহিক কাজে মানুষ এক ধরনের নিয়মের ভিতর পড়ে যায়, যখনই সেটার ব্যাত্যয় ঘটে তারপর পূর্বাস্থায় ফিরে যেতে কিছুটা সময় লাগে বৈকি। দীর্ঘ ছুটির পর আবার ক্লাশ শুরু হয়ে গেলো, সবাই পুরনো বন্ধুদের ফিরে পেয়ে নতুন উদ্যমে মেলামেশা শুরু করে দিলো। সবার মধ্যে আবার নতুন করে যেন ঈদোন্মোদনা শুরু হলো। বন্ধুদের মধ্যে কোলাকুলি করতেও দেখা গেলো কড়িডোরে, হলগুলো সব খুলে গেছে, পদচারণায় মুখর হয়ে উঠলো কলা ভবনের কড়িডোর। মল এলাকায় কয়েকটা ছোট ছোট গ্রæপ বসে গেছে, দূর থেকেও সরব কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। এ যেন প্রাণোচ্ছল জীবনেরই এক চিত্র। চির তরুণের মেলা এমনি হয় যেখানে থাকে না কোনো রকমের ভয় শংকা দ্বিধা।
এক কোনা থেকে ভেসে আসলো তখন কার হিট্ ফিরোজ সাঈয়ের গান
স্কুল খুইলাছে রে মওলা স্কুল খুইলাছে
গাউসুল আজম মাইজ ভান্ডারী
স্কুল খুইলাছে।
ঢাকা ছেড়ে যায়নি বিদ্যুৎ, আলম চলে এসেছে খুলনা থেকে, তখনো আসেনি সিকান্দর ভূরুঙ্গামারী থেকে। দুপুর পার হয়ে গেলো, কিন্তু বুলার দেখা নাই। বিদ্যুৎকে বল্লাম, কি ব্যাপার মেঘের দেখা নাই যে? বিদ্যুৎ বল্লো, আমিও তো আশে পাশে লক্ষ্য করেছি দেখলাম না তো। বল্লাম, সীমাকে দেখেছো? সেই ভালো বলতে পারবে। ও বল্লো, সীমাকে জিজ্ঞেস করেছি, সেও কিছু বলতে পারলো না। এখনো হলে আসেনি, বাড়িতে কোনো সমস্যা হলো না তো! ঘড়িতে বারো’টা বাজে। সেদিন আর ক্লাশ খুব একটা হবে না বোঝা যাচ্ছে। দু’একজন স্যারও আসেননি। সাফায়েত ভাইকে দেখলাম ডিপার্টমেন্ট লাইব্রেরি রুমে বসে গল্প করছেন সবার সাথে। আমাকে দেখেই ইশারায় ডাকলেন। বল্লেন, তোমাকেই খুঁজছি। জিজ্ঞেস করলেন আমি ফ্রী আছি নাকি, এক জায়গায় যেতে হবে। বল্লাম, আছি আপাতত। বল্লেন তা হলে চলো। কলাভবনের নীচে উত্তর পাশে সাইকেল ষ্ট্যান্ডে উনার নতুন কেনা ‘হোন্ডা বেনলী’ মোটর সাইকেল দাঁড় করানো, কাছে যেতেই চাবিটা হাতে দিয়ে বল্লেন, রমনা ভবনে যাবো, তুমি তো ভালো চালাও জানি। বলে হেসে দিলেন। বুঝলাম না ওখানে কি কাজ উনার।
সাফায়েত ভাই বাসা থেকে কলাভবনে এসে সাইকেলের চাবি বেশির ভাগ সময় আমার কাছেই দিয়ে রাখতেন, নিজের কাছে রাখতে চাইতেন না। অনেকে চেয়ে বসে, না দিয়েও পারা যায় না তাই আমার কাছে চাবি থাকলে উনার জন্য নিরাপদ। আমার নাম বলে চালিয়ে দিতেন। চাবি সারাদিন আমার কাছেই থাকতো পরে বাসায় ফিরে যাবার সময় নিয়ে যেতেন। অপরাজেয় বাংলার পাশ দিয়ে সোজা দক্ষিণের পথ দিয়ে ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরির গেটের কাছে যেতেই মুখামুখি দেখা হয়ে গেলো বুলার সাথে, তড়িঘড়ি করে কলাভবনে ঢুকছে। জোরে হেঁটে আসার জন্য একটু হাপাচ্ছে, কপালে মৃদু ঘাম, অসাধারণ লাগছে। মনের তাড়নায় একটা মানুষ কতটুকু উদগ্রীব হলে ছুটে আসে সেটা বুঝতে বাকী থাকলো না কারোই। ব্রেক করে দাঁড়িয়ে পড়লাম, পিছনে বসা সাফায়েত ভাই। দু’জনের মুখ চোখের ভাব দেখে উনি সব বুঝে ফেল্লেন। এতদিন শুনেছেন এর ওর মুখে কিন্তু আজ একেবারে সামনা সামনি দেখে ফেল্লেন। বুলা অপ্রস্তুত হয়েও সামলে নিলো। আবেগের কাছে সব কিছুই ¤øান হয়ে পড়ে। বল্লাম, লঞ্চ দেরী করেছে নাকি? কখন এসেছো? বল্লো, লঞ্চেই দেরী হয়েছে। এই মাত্র এসেছি। হলে ব্যাগ রেখেই চলে এসেছি, এখনো ফ্রেশ হইনি। পরে তোমরা চলে গেলে যদি দেখা না হয় তাই। চোখ মুখে নির্ঘুম রাতের ছাপ সাথে উদ্বিগ্নতার স্পষ্ট ছাপ। দেখে খুব মায়া লাগলো। বুঝলাম সাফায়েত ভাই ওর বড় ভাইয়ের বন্ধু তবু এধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষ সত্যিই ডেসপারেট হয়ে যায়। সাফায়েত ভাই হেসে বল্লেন বুলা, আমরা আধা ঘন্টার মধ্যেই ঘুরে আসছি। তুমি ডিপার্টমেন্টে যাও।
রমনা ভবন থেকে পছন্দ করে দুইটা পাঞ্জাবী কিনলেন। একটা আমার জন্য বাকীটা উনার নিজের জন্য ঈদ উপলক্ষ্যে। বল্লেন, আমিও ঈদে নতুন পাঞ্জাবী নিই নাই। তখন ভেবেছিলাম তুমি ঢাকা ফিরে এলে তোমাকে নিয়েই কিনবো। হাই কলারের ক্রীম কালারের পাঞ্জাবীর স্মৃতিটা আমার কাছে এখনো অমলিন। কারো গায়ে ঐ রকমের পাঞ্জাবী দেখলে এখনো আমার সাফায়েত ভাইয়ের স্মৃতি ভেসে ওঠে। মনে হয় আমাকে স্নেহ করার একটা মানুষ চলে গেছেন অবিনশ্বর এই পৃথিবী ছেড়ে। শুধু দোয়া করি আল্লাহ্ উনাকে রহমতের চাদর দিয়ে ঢেকে রেখো। তাড়াহুড়ো করে বাইকের চাবীটা উনার হাতে দিয়ে উঠে এলাম ডিপার্টমেন্টে। দুপুর পার হতে চল্লো প্রায় কারোই খাওয়া হয় নাই, দেখি বিদ্যুৎ বুলার এর সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে কড়িডোরে। বল্লাম চলো টিএসসিতে যাই দেখি খাবার পাওয়া যাওয়া কিনা। কারোরই তো খাওয়া হয় নাই মনে হয়, বলে তাকালাম বুলার দিকে। অনিদ্রার সাথে অযতেœর ছাপ চেহারায় স্পষ্ট। বল্লাম, ভালো আছো, কিন্তু কেমন ভালো আছো? কোনো কথা বল্লো না, চুপ করে থাকলো একটু তারপর একটা হাসি দিয়ে বল্লো, কেনো, খুব ভালো, দেখে বুঝছো না? খুশীর ঝিলিক বয়ে গেলো চোখে মুখে।
বল্লাম, দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে খুব ভালো আছো। তাই তো মুখটা শুকনো লাগছে। ক্যাফেটেরিয়া ঢুকে কোণার দিকের টেবিলে যেয়ে বসলাম, যথারীতি বিদ্যুৎ তিনটা স্লিপ নিয়ে কাউন্টারে দিয়ে আসলো। খাওয়া শেষে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরোনোর সময় ও বল্লো চলো লনে যেয়ে বসি। টিএসসি’র লন আজকে মোটামুটি ফাঁকা। সবুজ ঘাসগুলো আজকে অনেক বেশি সবুজ মনে হচ্ছ।
দীর্ঘ বন্ধে লনে মানুষের স্পর্শ পড়েনি, লনের শেষ মাথার বিদেশীর স্মৃতি স্তম্ভের পাশে যেয়ে বসলাম। বিদ্যুৎ বল্লো, তুমি বসো আমি সিগারেট নিয়ে আসি। দীর্ঘ দিনের পর আমাদের একা হবার একটু সুযোগ করে দিয়ে গেলো বোধ হয়। প্যাকেটটা বুলার হাতে দিয়ে বল্লাম দেখো তো পছন্দ হয় নাকি! প্যাকেটটা খুলে ঘড়িটা বের করে দেখলো, চোখে মুখে একটা সন্তষ্টির ছায়া ছড়িয়ে পরলো। বাম হাতে ঘড়িটা ধরে ডান হাতসহ দুই হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো… চোখে মুখে হাসি।
(চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউষ্টন, টেক্সাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র