ইউসুফ কামাল : দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা রাজধানী এক্সপ্রেস তখন দিল্লীর কাছাকাছি। আর কিছু পরেই আমরা ঢুকে পরবো দিল্লীর প্ল্যাটফর্মে। নীচের সীটে আমার উল্টো দিকে শুয়ে আছে সিকো। সব কাজেই একটু ঢিলে স্বভাবের, ডেকে বাথরুমে পাঠালাম আর একটু পরে সবাই উঠে পরবে। আগে রেডী হয়ে যাওয়াই ভালো। এ্যাটেনডেন্ট ব্রেক ফাস্ট দিয়ে গেলো, চারজনের চার প্যাকেট। ভারী পর্দা সরিয়ে দিতেই সারা কম্পার্টমেন্ট আলোয় ভরে গেলো। উপর থেকে ওরা দু’জনও নেমে এলো। পার্টিশনের ওপারের সবাই উঠে পরছে আস্তে আস্তে বাথরুমের লাইনে ভীড় বাড়ছে। এখনো ঘন্টা দেড়েক লাগবে দিল্লী পৌঁছতে। ঐতিহাসিকভাবে দিল্লী এত সমৃদ্ধ স্থান যে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন স্থান খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। পাক-ভারত উপমহাদেশের মধ্যে দিল্লীর অবস্থান সব সময়েই ভিন্নতর ছিলো। দিল্লীর শাসনকে পর্যায়ক্রমে কয়েকটি আমলে ভাগ করা যায় যেমন দিল্লী সালতানাত, মোঘল সাম্রাজ্য, ব্রিটিশ অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানী ও অন্যান্য। সুদীর্ঘ ৩২০ বছরের অধিক ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম শাসনামলকে দিল্লী সালতানাত বলা হতো। এদের সুবৃহৎ রাজত্ব ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও নেপালের কিছু অংশ নিয়ে বিস্তৃত ছিলো। মামলুক, খিলজি, তুঘলক, লোদী বংশধরেরা বংশ পরম্পরায় সালতানাতের শাসকের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়। শাসকদের সুবিধাক্রমে তারা একেক সময় দিল্লী, লাহোর, আগ্রাকে রাজধানী তৈরী করে শাসন কাজ চালিয়ে গেছে। কুতুবুদ্দিন আইবেক দিল্লী সালতানাতের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা। বিচিত্র ঘটনাবহুল জীবনের অধিকারী ছিলেন এই কুতুবুদ্দিন। বাল্যকালে ক্রীতদাস হিসাবে মঈজ উদ্দীন ঘোরীর হাতে পরার পরেই তার জীবনের উত্থান শুরু হয়। জন্মস্থান ছিলো উজবেকস্থান, সেনাবাহিনীতে কাজের পাশাপাশি ঘোরী তাকে রাজার ঘোড়ার আস্তাবলের দায়িত্বে নিয়োজিত করেন। নিজ মেধা ও অধ্যবসায়ের ফলে সেনাবাহিনীতে পদোন্নতির মাধ্যমে একসময় জেনারেল পদে উত্তীর্ণ হন এবং মঈজ উদ্দিন ঘোরীর মৃত্যুর পর কুতুবুদ্দীন আইবেক মামলুক বংশধারার শাসনের গোড়াপত্তন করেন। ১২১০ সালে ষাট বছর বয়সে কুতুবুদ্দিন আইবেক লাহোরে মারা যান। তখন লাহোর ছিল দিল্লী সালতানাত এর রাজধানী। মৃত্যুর পর তাকে লাহোরের আনারকলি বাজারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।

১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধের মাধ্যমে জহির উদ্দিন বাবরের হাতে ইব্রাহিম লোদীর পরাজয়ের মাধ্যমে দিল্লী সালতানাতের সুদীর্ঘ শাসনের পরিসমাপ্তি ও মোঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। ১৫২৬ থেকে ১৭৬১ সাল দীর্ঘ ২৩৫ বছরাধিক মোঘল শাসনের শেষ হয় ব্রিটিশ দের হাতে। মোঘল সাম্রাজ্য চলাকালীন সময়ে দিল্লীর কলেবর বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় । দিল্লী কেন্দ্রিক বৃহৎ সমস্ত ঐতিহাসিক স্থাপনা মোঘলরাই করে গেছেন। কার্যত ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর পর ব্রিটিশ রা পুরোদ্যমে রাজত্ব শুরু করে আর ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশের আনুষ্ঠানিক বিদায় হয় পাক-ভারতের জন্মের মধ্য দিয়ে। কোলকাতা থেকে ১৯১১ সালে রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তরের ঘোষণা হলেও স্থাপনার কাজ বিশ্বযুদ্ধের কারণে দেরী হয় এবং সেটা ১৯৩১ সালে উদ্বোধন করা হয়। পুরোপুরি দিল্লী থেকে ঐ সময়ই শাসন কার্য পরিচালনা শুরু হয়। তখনও ব্রিটিশদের দখলেই কার্যত: ভারতবর্ষ। এগারোটার দিকে ট্রেন পৌঁছে গেলো দিল্লী ষ্টেশনে, শুরু হয়ে গেলো কুলি হকারের উৎপাত। কোলকাতা হোটেল থেকেই সুকুমার বাবু কারল বাগের ত্রিভুবন গেষ্ট হাউসের দুইটা রুম বুক করে দিয়েছিলেন। আবারো কৃতজ্ঞ হলাম একজন ভালো মানুষের জন্য, বহির্বিশ্বের বিষয়ে চারজন অনভিজ্ঞ যুবকের প্রতি তার মমত্ববোধের জন্য। ভাগ্যান্বষনে যে মাতৃভূমি ত্যাগ করে চলে এসেছেন সেই নিজ দেশের ভ্রমণ পিপাসু চার যুবকের প্রতি ভালোবাসার সত্যিই কোনো তুলনা নাই। ঠিকই বুঝেছিলেন কি কি সমস্যা হবে সামনে আর সেটার নিরাপত্তার ব্যবস্থা উনি নিজেই যতটুকু সাধ্যানুযায়ী করে দিয়েছিলেন।

কারল বাগ দিল্লীর ব্যাস্ততম মাঝারি ধরনের বাণিজ্যিক কাম রেসিড্ন্সিয়াল এলাকা, দিল্লী রেলস্টেশন থেকে ৩/৪ কিমি দূরত্বে। মোটামুটি টুরিস্টদের জন্য একটা সাশ্রয়ী এলাকা। দোতলার পাশাপাশি দুটো রুম, ভালোই লাগলো। বিদ্যুৎ আলমের সাথে বসে সম্ভাব্য দর্শনীয় স্থানগুলোর একটা লিষ্ট তৈরী করতে বসে গেলাম। খাওয়া দাওয়ার জন্য বাইরের হোটেলেই সাশ্রয়ী হবে মনে হলো। এখানকার ছোট হোটেল ও গেষ্ট হাউসের ম্যানেজাররা সাধারণত: খুবই যতœশীল হয়। টুরিস্টদের প্রতি এরা বেশ যতœবান, যারা নতুন আসে সেটা বুঝে এরা ঘোরাঘুরির জন্য গাড়ি ঠিক করাসহ প্রসিদ্ধ স্থান সম্মন্ধে একটা ছোটখাটো ধারণাও দিয়ে দেয়। যার কারণে ভারতে টুরিস্টদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সারারাত ট্রেনের জার্নির পর সবারই বিশ্রামের দরকার, কাছের খাবার হোটেলে খেয়ে সবাই রুমে ফিরে ঘুমিয়ে নিলাম। ঠিক করলাম বিকেলে কারল বাগের আশেপাশে ঘুরবো আর কাল সারাদিনের জন্য বাইরে ঘুরবো। পরদিন গেষ্ট হাউসের ম্যানেজারই তার পরিচিত ড্রাইভার ঠিক করে দিলেন কিলোমিটার হিসাবে। ড্রাইভারকে সম্ভাব্য যাওয়ার স্থানগুলো বলে দেওয়াতে সে একটা প্ল্যান করে ফেল্লো, কোথা থেকে শুরু করা যাবে।

ইন্ডিয়া গেট দিয়ে শুরু করলাম প্রথম দিনের ঘারাঘুরি। দিল্লীর কেন্দ্রস্থলে ভারতের জাতীয় স্মৃতি সৌধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তৃতীয় ঈংগো আফগানযুদ্ধে ৯০,০০০ ভারতীয় সেনা জওয়ানদের স্মৃতি রক্ষার্থে এটি নির্মিত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে কর্নাট প্লেস নয়াদিল্লীর বৃহৎ আর্থিক, বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক কেন্দ্র। কর্নাট প্লেসের বড় বড় কোম্পানীর শো রুমের মধ্যে টাইমেক্স কোম্পানীর শোরুম নজরে পরতেই বিদ্যুৎ আমাকে টেনে নিয়ে গেলো ওদিকে। ওর মুখের দিকে তাকাতেই বল্লো, একটা ভালো ঘড়ি নাও। বুঝলাম ও বুলার কথা বলছে। নিজেই পছন্দ করা শুরু করে দিলো। ওর স্নেহের পরিমাণটা আঁচ করতে আমার দেরী হলো না। সিকো অতটা না বুঝলেও স্মার্ট আলম ঠিকই বুঝে ফেলেছে, দেখলাম ওর মুখে মৃদু হাসি। সোনালী রং কালো ডায়ালের একটা ঘড়ি ও পছন্দ করলো। বুঝলাম কালো ডায়াল বুলার হাতে মানাবে ভেবেই বিদ্যুৎ পছন্দ করছে। রসিকতা করে বল্লাম, দামটা কি ভাই-ই দিবে নাকি?

বিদ্যুৎ এর সপ্রতিভ উত্তর, সমস্য নাই দিতে পারি। মাঝে মাঝে ভাবি, স্নেহের বন্ধনে কে যে কখন কোথায় বাঁধা পড়ে সেটা হয়তো সৃষ্টিকর্তাই ঠিক করে দেন।
(চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউস্টন, টেক্সাস, ইউএসএ