ইউসুফ কামাল : (বন্ধু শেষ পর্ব)
জীবনের নির্মম বাস্তবতার কাছে কোনো রকম সাধ আহ্লাদের যে জায়গা নাই সেটার উদাহরণ জানিয়ে গেলো ফিরোজ। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া নিয়ে ব্যাস্ত। মাস ছয়েক পরে শুনলাম ও পড়াশুনা বন্ধ করে রাজশাহী থেকে চলে এসেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো কিন্তু কিই বা করতে পারি। রাজশাহীর পাট চুকিয়ে চলে এলো বাড়িতে। মাস দুই পর পর শুনলাম জহুরুল ইসলামের ‘মিলনার্স’ এ চাকুরী পেয়েছে, ঢাকায় পোষ্টিং। ভালোই লাগলো। ঢাকার বাসায় এলো, বল্লো বন্ধু পড়াটা চালিয়ে যেতে পারলাম না, আসলে দ্বারে দ্বারে হাত পেতে পড়াশুনা করা যায় না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম – কি বলবো, বলার মতো কোনো শব্দ তো আমার নাই। আমিও তো তখন ছাত্র।
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এ ওর কর্মস্থল। সম্ভবত বাসাবো’র ওদিকের মেসে থাকে। অপিসের ফোনে কথা হতো মাঝে মাঝে- দেখাও হতো। বৃহস্পতিবার অপিস করে দুপুরের পর গুলিস্তান থেকে বাস ধরে রাজবাড়ী চলে যেতো। ব্যাচেলর মানুষের জীবন যেমন হয় তেমন আর কি। মাঝে মাঝে বিকালের দিকে চলে যেতাম ওর কাছে, এক সাথে বায়তুল মোকাররম, রমনা ভবন ঘুরে টুকিটাকি কেনাকাটা করতাম ফুটপাত থেকে। আসল উদ্দেশ্য ঘোড়াঘুড়ি। বেশ কিছুদিনের জন্য ওর সাথে কথা হচ্ছিলো না, অপিসে ফোন করতেই বল্লো, দোস্ত বিয়ে করে ফেলেছি। নিতান্তই ঘরোয়া ভাবে, দু’একজন নিকটাত্মীয় নিয়ে শুভ কাজ শেষ করে ফেলেছে। কোনো রকম আনুষ্ঠানিকতাও হয়নি। ওর কথায় বেশ খুশিই মনে হলো। মাস ছয়েক পর একদিন রাতে বাসায় আসলো। ছোটো খাটো হাল্কা মানুষটাকে কেমন যেন একটু রোগা রোগা মনে হলো। বল্লো, কালকে বাড়ি যাওয়া দরকার, শেলী যেতে বলেছে। কিন্তু সমস্যা হলো মাস শেষ হতে এখনো তো দশ দিন বাকি, কি যে করি! বুঝলাম ওর না বলা কথার মানে বল্লাম, আচ্ছা সমস্যা নাই। সাধ্য মত কিছু টাকা দিয়ে বল্লাম নতুন ভাবীর জন্য পছন্দ করে একটা শাড়ি কিনে নিও। বন্ধুর নতুন বউ বলে কথা। খুব খুশীই হলো মনে হয়। হাসলো, বল্লো নিয়েছি। বুঝলাম এ জন্যেই হাতটান পড়েছে। সীমিত আয়ের মানুষের অনির্ধারিত খরচে এমন হয়। তাছাড়া বন্ধুদের মধ্যেও কথাবার্তায় যেমন কাটখোট্টা, হিসেব নিকেশেও তেমনই। বাহুল্য কোন কথা অথবা খরচ কিছুই ও পছন্দ করতো না। বাস্তববাদী মানুষ, উল্টো আমাকে মাঝে মাঝে জ্ঞান দিতো, হিসেবী হওয়ার জন্যে। তবু বন্ধু হিসাবে ভাল ছিল। আমার সাথে কথা বলে রাতে বাসাবো চলে গেলো, সকালে বাড়ি যাবে। ও যাওয়ার পর মনটা একটু খারাপই হয়ে গেলো। রাতে খেয়ে একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পরলাম। পরের সপ্তাহেও কোন খবর নাই, একটু চিন্তা হলো, শরীর বেশি খারাপ হলো না তো! কেনো যেনো মনে হলো একটু খবর নেওয়া দরকার।
অনুমান সঠিক – পরের সপ্তাহে খবর পেলাম, ও জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে কুষ্টিয়ার এক কবিরাজের চিকিৎসা নিচ্ছে বাড়িতেই। মানে হাতুড়ে চিকিৎসা, ফলে যা হবার তাই হোল। ৪/৫ দিন পর শুনলাম অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। পিজি’তে নিয়ে এসেছে। কবিরাজীতে কোনো উন্নতি হয়নি বরং অবনতিই হয়েছে। জন্ডিস থেকে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়েছে। খবর পেয়ে জিল্লুকে নিয়ে ছুটলাম পিজিতে। বেডে শুয়ে আছে ছোটখাটো মানুষটা, মনে হলো যেনো আরো ছোটো হয়ে গেছে। সারা শরীর হলুদ হয়ে গেছে। ডাকতে চোখ খুলে তাকালো বুঝলাম চিনতে পেরেছে। কথা বলার শক্তিও তেমন নাই। পাশে ওর বউ শেলী বসে আছে। সারাক্ষণ ছুটোছুটি করা মানুষটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে হাসপাতালের বেডে। নিজেকেও কেমন যেন অসুস্থ মনে হলো ওর এই অবস্থায় দেখে। হাই স্কুল থেকে কলেজ, জীবনের কতগুলো লম্বা সময়, চিন্তাহীন জীবনের খন্ড খন্ড মূহূর্তগুলো এই মানুষটার সাথেই তো অবিরাম কাটিয়েছি অকৃত্রিম বন্ধুর মতো। রাখঢাক না করে সত্য কথা বলে দেওয়ার যে কি সাহস ওর ছিলো সেটা বলার না। কোনো কিছু ঝুলিয়ে রাখার বিষয়টা ওর মধ্যে কখনোই দেখিনি। কিছু কিছু বিষয়ে ছোট শিশুর মতোই নিজের বোঝটা বুঝে নিতে চাইতো।
পালাক্রমে কয়েকদিন সকাল বিকাল পিজির পাঁচ তলায় যাওয়া আসা করলাম। বেশি দিন আর আমাদের কষ্ট করতে দিলো না। চলেই গেলো একদিন। পুনুকে জহুরুল হক হল থেকে নিয়ে গেলাম ফিরোজকে দেখতে, তখনো বুঝিনি ওটাই ওর জীবনের শেষ বিকেল হবে। রুমে ঢুকেই বুঝলাম পারিপার্শিক অবস্থা ভিন্নতর।
সিরাজ ভাই (ডা:) মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরে আছেন। বুঝলাম হার্ট বিট দেখছেন, গম্ভীর মুখটা ধীরে ধীরে আরো যেন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। বেডের পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, খালি গা শুয়ে আছে লম্বা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে চোখটা পুরোপুরি বন্ধ। ওর এক ভাইকে দেখলাম দূরে দাঁড়িয়ে আছে, সবাই বুঝে গেছে ওর অন্তিম মূহূর্ত। যেনো পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে চরম সেই মহেন্দ্রক্ষণ, চির তরে হারিয়ে যাবে আমার বন্ধু, একটা প্রাণ, একটা মানুষ, একজন সন্তান, একজন ভালোবাসার স্বামী। পাথরের মতো বসে আছে শেলী একটা টুলের উপর। সবাই স্থির নির্বাক হয়ে আছে কোনো কথা নাই কারো মুখে। আমি তাকিয়ে আছি ওর বুকের দিকে, দীর্ঘায়িত লয়ে উঠা নামা করছে। সারা শরীরটা স্থির, একমাত্র ভরসাই যেন ঐ বুকের নড়াচড়া টুকুই। লক্ষ্য করলাম দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হচ্ছে নিঃশ্বাসের সময়ের তারতম্যে। তাকিয়ে আছি ওর মুখের দিকে।
এখনো মনে পড়ে হার্টটা শেষ বার লম্বা নিঃশ্বাস নিলে ঠিকই কিন্তু সেটা আর ছাড়ার মতো শক্তিও পেলো না। নিঃশ্বাস আনা নেওয়া করার যন্ত্রটাও বোধ হয় আর পারছিলো না তার কর্তব্য করে যেতে। নির্জীব হয়ে গেলো সারা শরীরের সাথে সর্বশেষ যন্ত্রটাও।
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম কেমন করে সব কিছু নাই হয়ে যায়, দূর থেকে দূরে চলে যায় স্মৃতি-মায়া-মমতা। হারিয়ে গেল আমার আবাল্য বন্ধু, আমার হিসেবি বন্ধুটা খুব বেহিসেবি সময়ে। হারিয়ে গেল সব কিছু ফেলে চিরতরে। হারিয়ে গেলো আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু, আমার বাল্যবন্ধু ফিরোজ। যার সাথে কত স্মৃতি, কত সুখ দু:খ, কত শৈশবের পাগলামী সব যেন এক নিমিষে নিভে গেলো এক ফুৎকারে। হায়রে জীবন, এত সহজে নিভে যায়। দুঃখের বিষয়টা শুরু হল এর পর, বড় ভাইরা কেউই ওর মৃতদেহ বাড়িতে নিতে চাইলো না। সবার এক কথা উনাদের সন্তানেরা হয়তো বা ভয় পাবে। কত বড় পাষন্ড, কত বড় জ্ঞান পাপীর দল। এরা কি ভাই? আমি, পুনু, সামদু ভাই সিদ্ধান্ত নিলাম যা করার আমরাই করবোনে। কোন ভাইদের দরকার নাই।
হায়রে ভাই আর ভাইয়ের ভালোবাসা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার শেষ আব্দারটাও যেমন রাখেনি জীবনের শেষ মূহূর্তের স্মৃতিটুকুও যেন অবলীলায় দূরে সরিয়ে দিলো। মানুষ কি এত নির্মম নিষ্ঠুর হতে পারে। বুঝলাম তারাও হয়তো একদিন এমনি প্রতিদান পাবে নিজেদের সন্তানাদির কাছ থেকেও। অগত্যা বাধ্য হয়েই পিজির নীচে আমতলায় নিয়ে আসা হলো ওঁকে গোসলের জন্য। পাশের মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে পুনু আর আমি তিনজন গোসল করালাম। রাত হয়ে যাচ্ছে। ওর মা’ কে ভাইয়ের বাসা থেকে ছামদু ভাইয়ের বাসায় নিয়ে আসা হলো শেষ দেখানোর জন্য। সামদু ভাই, খুব ভাল মনের একটা মানুষ ছিলেন। এই একটা লোকের চরিত্র আমি জীবনে ভুলবো না ভাই না হয়েও অনেক ঋণী করে গেছেন আমাদেরকে। রাজবাড়ীর অনেকেই তার কাছে ছুটে গেছে বিপদে, কাউকেই নিরাশ করেননি। আজিমপুরের ঘটনাও ঐ একই, পুনু আর আমি ওঁকে কবরে নামিয়ে যখন গেট থেকে বের হলাম তখন রাত বারোটার কাছাকাছি।
(হিউষ্টন, টেক্সাস)