ইউসুফ কামাল : মোহনা থেকে মোহনা এভাবেই ঘুরতে থাকে জীবন। এমনি করেই চলতে থাকবে জীবনের বাকী পথগুলো। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বন্ধুদের বন্ধুত্বের স্মৃতি এখনো অমলিন। মনে হয় একদিন তো মিলিত হয়ে ছিলাম, এক সাথে পথ তো চলেছিলাম! এক সময়ের বন্ধু মানেই তো চিরদিনের বন্ধু। বন্ধুত্ব অমলিন।
ডিপার্টমেন্টের ইন্টার্নশীপে ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সাইকোলোজীর দশ দিনের ট্যুরে চট্টগ্রামে গেছি বিশ জনের দল। তিন/চার ভাগে বিভক্ত হয়ে আমাদের পাঁচ জনের ভাগে পড়লো চট্টগ্রাম ষ্টীল মিল আর ইষ্টার্ন ক্যাবলস্। ষ্টীল মিলের অফিসার মেসে থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা। উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে মিটিং করা, শিল্পের উৎপাদন দেখা, নোট নেওয়া (আর পরে ডিপার্টমেন্টে রিপোর্ট সাবমিট করা) ফ্যাক্টরী ঘুরে দেখা। ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলা, সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে এই মোটামুটি কাজ।
পাঁচ দিন দুই প্রতিষ্ঠানের কাজ শেষ করে রাঙ্গামাটি, সর্বশেষ কক্সবাজার ঘুরে আবার ঢাকা ফিরে আসাই ছিল মূল প্রোগ্রাম। সাথে নতুন নতুন কিছু দেখার বিষয়ই ছিলো মুখ্য। ষ্টীল মিলে আমদানীকৃত ‘ইনগট‘ (আকরিক লোহা যা পূর্বে ব্যাবহ্রত হয়নি) ফার্নেসে গলিয়ে রডসহ করোগেটেড ও ষ্টীল শীট তৈরী তখনও দেশে প্রথম ছিলো। যা গুনগত মানে তখন ছিলো দেশের শীর্ষে। মিলের শ্রমিকদের কাজের জন্য সবচেয়ে অমানবিক ছিলো বয়লারের সামনে দাঁড়িয়ে কাজ করা। বয়লারের ঐ তাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাজ করা যে কি কষ্টের সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। পনেরো ফুট দুরেই দাঁড়ানো যায় না সেখানে চার ফুটের দূরত্বে কেমন করে দাঁড়িয়ে অনবরত কাজ করে সেটাই আশ্চর্যের বিষয়। উপরন্ত তাদেরকে তাপরোধক তেমন কোনো পোষাকও দেওয়া হতো না।
সবচেয়ে সুন্দর আর ছিমছাম ছিলো ইষ্টার্ণ কেবলস্ এর ফ্যাফ্টরী। তখন দেশের বৈদ্যুতিক তারের প্রধান কারখানাই এটি। চট্টগ্রামের শিল্প কল কারখানার প্রোগ্রাম শেষ করে ঘুরতে গেলাম রাঙামাটি। উঠলাম কর্নফুলি পেপার মিলের রেস্ট হাউসে দুই দিনের জন্য। বিভিন্ন স্পটের অন্যতম ছিল রাজা ত্রিদিব রায়ের বাড়ী। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই রাজার জীবনের মতো ঘটনাবহুল জীবন খুব কমই পাওয়া যায়। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত মনোনয়ন গ্রহণ না করে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে বিজয়ী হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্থায়ীভাবে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে স্থায়ী হন। পাকিস্তান সরকার তার আনুগত্যের কারণে বিশেষ সন্মাননার প্রকাশ হিসেবে পরবর্তিতে ভুট্টো সরকারের সময় আর্জেন্টিনা, পেরুসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদুতের দায়িত্ব পালন করেন। ত্রিদিব রায় বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে বিরোধিতা করে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে জাতিসংঘে উপস্থিত হন আর এদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ত্রিদিব রায়ের মা রাজমাতা বিনিতা রায়কে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রাখতে জাতিসংসঘে পাঠান তখনকার বাংলাদেশ সরকার।
১৯৭১ সালে স্থায়ীভাবে দেশত্যাগের প্রাক্কালে নিজ পুত্র দেবাশীষ রায়কে চাকমা রাজার উপাধি ন্যস্ত করেন।
পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের কারণে ভুট্টো সরকার তাকে আমরণ মন্ত্রীর পদমর্য্যাদা প্রদান করেন। ভুট্টোর ক্ষমতা চ্যুতির পর জিয়াউল হকের আমলেও তিনি মন্ত্রিত্বসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানের বৌদ্ধ স¤প্রদায়ের প্রধান হিসাবে কার্য্য চালিয়ে গেছেন। সুদীর্ঘ জীবনের পরিসমীপ্তি ঘটে ২০১২ সালে। রাওয়ালপিন্ডিতে হ্রদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান স্বীয় কর্মে উজ্বল এক বীর পুরুষ। (চলবে)
(উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া)