Home কলাম হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-১৪

হারিয়ে যাওয়া জীবনের চালচিত্র-১৪

ইউসুফ কামাল : পথে নামলেই যেমন পথ খুঁজে পাওয়া যায়, নির্দিষ্ট পরিসীমার মধ্যে এক সাথে চলাফেরা উঠাবসা করলে অনেক বন্ধু খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু অন্তরঙ্গতার মাত্রা স্বভাবতই সবার সাথে এক হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশের সহপাঠী ছিলো আনুমানিক জনা চল্লিশেক তার মধ্যে বন্ধু হলো দশ জন আর অন্তরঙ্গতা হলো তিন/চার জনের সাথে। এমনিই তো হয়। সবার সাথে কি মনের মিল হয়? উচ্চ শিক্ষা নিতে আসা সবার আর্থিক সংগতি একরকম না সেটা কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে ফেললাম। বন্ধু সিকান্দরের টাকা মাসে দুইবার আসার পরও ওকে আবার হাওলাত করতে হতো। আবার বন্ধু হারিসকে দুই ব্যাচে ছাত্র পড়িয়ে তার হলে থাকার খরচসহ সব কিছু মিটাতে হতো। কত রকমের বন্ধু চরিত্র যে দেখেছি জীবনে সেটা নিয়ে লিখতে গেলে হয়তো একটা মহাকাব্যই হয়ে যাবে। তবে বন্ধু বন্ধুই, একবার বন্ধু মানে সারা জীবনের বন্ধু। বন্ধুত্ব মানে যেন পবিত্রতম একটা সম্পর্কের সেতুবন্ধন।

মনে আছে এলিফ্যান্ট রোডের আইভিশন থেকে একটা রে -বান সানগ্লাস কিনলাম শখ করে। পছন্দ হলো সোনালী চিকন ফ্রেমের জন্য। অনেক শখ ছিলো তাই হঠাৎ করেই কিনে ফেললাম। তখনকার সময়ে বাংলাদেশে নতুন এবং যথেষ্ট মূল্যবানও ছিলো ওটি। ছাত্র হিসাবে এটা আমার জন্য একটা দু:সাহসিক কাজই হয়েছিলো। দুপুরে ক্লাশ শেষ করে সব বন্ধুরা বসে গল্প করছি ডিপার্টমেন্টের সামনের করিডোরে। কোথা থেকে যেন বাবু এসে হাজির। আমার দিকে তাকাতেই বল্লো সুন্দর তো চশমাটা। দাও তো দেখি। চোখে দিয়ে বল্লো, ভালোই তো। বুঝলাম ওর পছন্দ হয়েছে কিন্তু ঝামেলা বাধালো ওটা ফেরত চাইতে গেলেই। দেবে না, সবাই বলছে কিন্তু কেনো যেনো কি ভেবে বলছে দেবে না।

বিদ্যুৎ বল্লো দিয়ে দাও, ও বাসায় যাবে। পরিণামটা আরো খারাপই করলো ও। দেবোই না বলে হঠাৎ করে আছাড় দিয়ে ভেংগে ফেল্লো। সবাই স্তম্ভিত ও হতচকিত। সমুহ বিপদের আশংকা করে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, না জানি আমি কি করে বসি? মারাত্মক একটা পরিস্থিতির আশংকা করছিলো সবাই। কেন যেন আমার তখন মনে হোল আমারই মনে হয় ভুল হোল, কালকে নিলেই পারতাম। হয়তো বেশি ভালো লেগে গিয়েছিলো তাই।
বিদ্যুৎ আমার রাগের বিষয়ে জানে আশংকা করছিলো মারাত্মক একটা কিছুর। বাবু নিজেও কাজটা করে মনে হয় পরিবেশটা জটিল করে তুল্লো বলে কিছুটা অনুমান করতে পারলো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে খুব ধীর স্থিরভাবে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো। যা বোঝার আমরা উপস্থিত সবাই সেদিন বুঝে ফেলেছিলাম। আমিও কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম। পরে কেনো যেনো একটু অনুশোচনা বোধ করলাম, ওর জন্য। দুই একদিনের জন্যে ব্যবহার করতে দিলেই পারতাম। কেমন যেনো নিজেকেই বন্ধুত্বের জন্য যোগ্য করলাম না। সব কিছুই যেন তালগোল পাকিয়ে গেলো।

কেনো সেদিন কিছু বললাম না এ নিয়ে সবার মধ্যে কৌতুহলের সীমা ছিলো না। এখনো কানাডা প্রবাসী বন্ধু বিদ্যুৎ, বাবুর প্রসংগ আসলেই ঐ কথা স্মরণ করে। মোটামুটি ভাবে সবার মনেই ঘটনাটা খুব রেখাপাত করেছিলো। বাবু নিজেও খুব প্রাণোচ্ছল একজন মানুষ আর সবাইকেই খুব হাসাতেও পারতো। ঘনিষ্ট ৪/৫ জন এক সাথে থাকলে তো আমরা কোথায় আছি সেটা ভুলেই যেতাম।

প্রতি একুশে মেলার রেস্টুরেন্টের চা এর আড্ডায় বাবু সব সময়েই থাকতো মধ্যমণি হয়ে। এবং এখনো সে তার ঐ একই অবস্থানটা সযত্নে লালিত করে চলেছে। পারভিন আপার ক্লাশে একদিন আমরা পিছনের দিকে বসে গল্প করছিলাম।

উল্লেখ্য যে বাবুই বক্তা আর আমরা শ্রোতা। আপার ক্লাশে আমরা সব সময়ই একটু অমনোযোগী থাকতাম। স্বাভাবিকভাবেই একটু বয়স্ক আর রাশভারী শিক্ষক না হলে যেন শিক্ষক হিসাবে মেনে নিতেই মন চায় না। সেই আঙ্গিকে পারভিন আপা হয়তো বয়সে দু, এক বছরের বড় হবেন এর বেশি না। ফাইনালে খুব ভালো রেজাল্ট করাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে জুনিয়র শিক্ষকের পোষ্টে আপার চাকুরী হয়ে গিয়েছিলো বলে জেনেছিলাম। মানুষ হিসাবেও খুব নরম প্রকৃতির ছিলেন। আমাদের মধ্যের অনেককে আপনি বলেও সম্মোধন করতেন।

কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে আপা বল্লেন, তোমাদের আমার ক্লাশ পছন্দ না হলে চলে যেতে পারো, আমি কিছু বলবো না বা মনেও করবো না। অন্যদের অসুবিধা না করলেই খুশী হবো। সমগ্র ক্লাশে পিনপতন নিরবতা। আমরাও সবাই চুপ, হঠাৎ বাবু দাঁড়িয়ে পড়লো সবার মধ্য থেকে, কোনো কথা না বলে পাতলা খাতাটা পিছনের পকেটে ঢুকিয়ে ক্লাশ থেকে বের হয়ে গেলো যেনো কিছুই হয়নি। আপাও চুপ করে গেলেন। কেমন যেন একটা বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হলো। আপাও আর বেশিক্ষণ ক্লাশ নিলেন না। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে শিক্ষকদের কমন রুমের দিকে চলে গেলেন।

আমার সেই বন্ধু বাবু পরবর্তি জীবনে বাংলাদেশের নামকরা ইংরেজি দৈনিক ডেইলি ষ্টার পত্রিকার সিনিয়র এডিটর হয়ে অবসর গ্রহণ করে। এখনো সে বন্ধুর লিষ্টে সরব। এখনো ফোন করলে গল্পই শেষ হয় না। দিল খোলা একটা জীবন্ত বন্ধুই বটে। কথার যেনো কোনো শেষ নাই ওর কাছে। বন্ধু বাবুর হাতে এখনো সেই আগের মতোই কিছু একটা থাকতেই হবে যেনো। হয় সিগারেট না হয় চা না হয় অন্য কিছু।
(চলবে)।
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, আমেরিকা

Exit mobile version