ইউসুফ কামাল : ডিপার্টমেন্ট পিকনিক শালনা :
‘আপনার কি প্লেট দরকার? লাগলে এটা নিতে পারেন’। ডান পাশে তাকালাম। দেখি হাল্কা লাল প্রিন্টের জামা পড়া একটা মেয়ে। তাকাতেই অসম্ভব মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বল্লো, ‘প্লেট খুঁজছেন তো তাই বল্লাম’। ডেকোরেটর মনে হয় প্লেট কম এনেছে। অসুবিধা নাই আপনি আগে খেয়ে নিন, আমি পরের গ্রæপে খেয়ে নেব’। এক রকম জোর করে প্লেটটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বল্লো ‘লাইনে দাঁড়িয়ে যান দেরী করবেন না’। চিনি না জানি না এ যে দেখি সরাসরি হুকুম! ভাবনার বিষয়। মনটা স্বভাবতই কৌতুহলী হয়ে উঠলো। কথাগুলো বলেই পাশের বান্ধবীদের ভীড়ে হারিয়ে গেলো। ন্যূনতম ভাব বার সময়ও দিলো না। ভালো করে তো চিনতেও পারলাম না চলে যাওয়ার সময় শুধু হাল্কা লাল প্রিন্টের জামাটা চোখে পড়েছিলো। ব্যাস ঐটুকুই। তবে জামার রংটা মনে আছে। দাঁড়িয়ে চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। আঁশে পাশে তাকালাম বন্ধুরা সব কোথায় গেলো? বাবু বলেছিলো একটু চা পেলে ভালো হতো, বাউন্ডারীর বাইরে আসার সময় একটা টোং ঘর দেখেছিলাম। চলো, ওদিকে গেলে মনে হয় পাওয়া যাবে। বাবু যে একটু বেশি পরিমাণে চা খায় এই নিয়ে আমরা মাঝে মাঝেই ওঁকে খোঁচা দিতাম। চা আর সিগ্রেট হলেই ওর মনে হয় ভাত না হলেও চলবে। শুনে ওর সেই লম্বা মোচের নীচে দিয়ে সশব্দ হাসি এখনো মনে পড়ে। সেই বাবু এখনো সেই চেহারাতেই আছে শুধু চুলের রংগুলোই পরিবর্তিত হয়ে সাদা হয়ে গেছে। মগবাজার দিলু রোড়ের বাবু এখনো অত্র এলাকার অত্যন্ত পরিচিত একটা চরিত্র। কাদের, আরিফদের সাথে ঐ এলাকা থেকে এক সাথে গড়ে ওঠা মানুষ। কাদের আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বেলজিয়াম চলে গিয়েছিল তাই ওঁকে আমি বেলজিয়াম কাদের বলতাম।

মোটামুটি নাসিম আলাদা হওয়ার একটা সুযোগ খুঁজছিলো, এই মহা সুযোগটা সে হাত ছাড়া করতে চাইলো না। বাবু, চলো তো যাই – বলে গেটের দিকে হাঁটা দিলো পিছনে সায়মা, লিটন। ওরা গেছে তাও তো মনে হয় প্রায় ত্রিশ মিনিট হবে। এখনো ফিরছে না কেনো, ফেরার সময় তো হয়ে গেছে। কয়েক মিনিট হয়তো ভাবছিলাম বিদ্যুতের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম, আরে প্লেট পাইলা কই? আমি প্লেট আনতে শেডে গেলাম। ওরা বল্লো বাস থেকে নাকি ভুলে নামায় নাই, গেটের বাইরে বাস ওখানে আনতে গেছে। বল্লো লাইনে দাঁড়ান সবাই প্লেট হাতে হাতে পৌঁছিয়ে দেবে।

প্লেট রহস্যের ঘটনাটা খুলে বল্লাম। কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে চোখ বড় বড় করে, যেন বিশ্বাস করতে চাইছে না আমার কথাটা। বিজ্ঞের মতো একটা হাসি দিয়ে বল্লো, কোথায় দেখাও তো কে? দেইখ্যা লই। বল্লাম চিনি না তবে সম্ভবত অনার্সের মেয়ে হবে। এখন চলো খাবার নিয়ে আসি। নাছোড় বান্দা বন্ধু বিজ্ঞের হাসি দিয়ে বলে, সত্যি করে বলো তো কবে থেকে? আমি কিন্তু সবতেরে কইয়া দিমু! কোনো মতেই বুঝাতে পারলাম না ওরে। কি দিয়ে কি হয়ে গেলো। লাইনে দাঁড়াতেই বাস থেকে প্লেটের বাক্স এনে সবার হাতে একটা করে প্লেট ধরিয়ে দিলো ডেকোরেটরের লোক। খাবার নিয়ে দুইজন একটু দূরে মাঠের মধ্যে বসে পড়লাম। শালনার গজারি বনের মাঝে বন বিভাগের একটা বাংলো। অদ্ভুত মায়াবী একটা পরিবেশ। রাতের নিরিবিলি পরিবেশ চিন্তা করতেই আমার গা শিউরে উঠলো। আর যাই হোক এখানে কোনো রাতেই যেনো না থাকতে হয় তা সাথী যেই হোক না কেনো!

খাওয়ার মধ্যে সাফায়েত ভাই এসে হাজির। সহাস্যে বল্লো তোমারেই তো খুঁজছিলাম। বাস থেকে নেমে হাওয়া হয়ে গেলে। লিটনরা কই? বল্লাম ওরা চা খেতে গেছে। এইটা রাখো বলে এক প্যাকেট ৫৫৫ সিগারেট প্যান্টের পকেট থেকে বের করে হাতে ধরিয়ে দিলেন। এক ক্লাশ সিনিয়র হলেও বন্ধুর মতোই সব সময় এক সাথেই থাকি। মানুষটা আমারে খুব ভালোবাসতো। ভালোই হলো, বিদ্যুৎ তো মহা খুশী সিগারেটের প্যাকেট পেয়ে। কয়েক মাস আগে সেই সাফায়েত ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ জানালো বন্ধু আলম। শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম দীর্ঘক্ষণ। কেনো যেনো মনে হয় আমার পছন্দের মানুষগুলো খুব তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে যায়, বুঝি না। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর আর দেখা হয়নি তবু বেঁচে আছেন জানতাম, ভাবতাম হয়তো কোনো একদিন পথেই দেখা হয়ে যাবে কিন্তু এখন তো সেই সম্ভাবনাটাও আর থাকলো না।
ঘন্টা খানেক পার করে নাসিমরা এসে দাঁড়ালো পাশে। মুখ চোখে সবার কেমন যেন একটু চিন্তিত মনে হলো। বাবু এসে পাশে বসে পড়লো। চা’য়ের দোকানে নাসিম রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে বলতে একজনের সাথে একটু মতানৈক্য হয়েছে। বিশ্ববিদ্যলয়রে ছাত্র বলাতে বল্লো, পিকনিক পার্টি তো আচ্ছা। বোঝা গেলো ঐ ব্যাক্তির কথাতে ওরা একটু ভীত হয়ে পড়েছে। কাছেই রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাস, সম্ভবত সেখানকার কোনো সদস্য হতে পারে। যাই হোক পরে আর কোনো ঝামেলা হয়নি।

বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ ভাগ হয়ে সবাই একটু নিরিবিলি খুঁজতে ব্যাস্ত। চারপাশটা একটু হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে বাংলোর পিছন দিকে চলে এলাম। পিকনিক পার্টির কথাবার্তা হৈচৈ এই দিকটায় নাই বলা চলে। বাম দিকটায় অনার্সের মাসুম দীপু মিনুবিল্লাহ্ দীপা’রা বসে জমজমাট গল্প জমিয়ে নিয়েছে। অনার্সের দলটা তখন একটু আলাদা আলাদাই থাকতো। ধীরে ধীরে সেটা আর থাকেনি, পরে সবাই এক সাথেই থাকতাম। বছর দুই আগে শুনলাম মাসুমও নাই চলে গেছে না ফেরার দেশে।

সময় গড়িয়ে দুপুর পার হয়ে বিকেল হয়ে এলো গজারি বনের অন্ধকার ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেবে বাকি আলোটুকুও। সবাইকে তাড়া দিলো শহীদুল্ল্যা স্যার, পিকনিকে আসা একমাত্র শিক্ষক জহুরুল হক হলের তৎকালীন হাউসটিউটর। বাসের যার যার সীটের পাশের সাথী আছে কিনা জেনে বাস ছাড়ার নির্দেশ দিলেন। কেউ যেন বাদ না পড়ে যায়। হঠাৎ করেই মনে হলো সেই প্লেট ওয়ালীর কথা, তাই তো দেখতে হয়। মনের কথাটা বিদ্যুৎকে বলতেই ও লাফ দিয়ে উঠলো, আরে তাই তো। পিছনের ৩নং বাসে আমরা এসেছিলাম, একটু নেমে দাঁড়ালাম। দেখি দেখা যায় কিনা লাল জামা। সাফায়েত ভাই এগিয়ে এলো আমাকে বাস থেকে নামতে দেখে, কিছু হয়েছে? নামলে কেনো? কেউ আসেনি নাকি?

কথা বলার সময় খেয়াল করলাম পিছন থেকে আমাদের পাশ দিয়ে সামনের বাসের দিকে এগিয়ে গেলো কয়েকজন তার সাথে লাল জামা। আড় চোখে মনে হয় আমাদের দিকে একটু খেয়াল করলো। সাফায়েত ভাইয়ের সাথে ওর চোখাচোখি হতেই বোঝা গেলো পরিচিত। মৃদু হাসি দিয়ে সামনের বাসের দিকে এগিয়ে গেলো। ফর্সা গোল গাল চেহারা, অনিন্দ্য সুন্দরী না হলেও সুন্দরী। খুব ভালো লাগলো।

আমার দিকে খেয়াল করছিলো সাফায়েত ভাই। মৃদু হেসে বল্লো কাকে দেখছো? বিদ্যুৎ বল্লো ঐ লাল জামা। সাফায়েত ভাই ক্ষণিক কি যেন ভাবলেন, বল্লেন- ও তো অনার্সের বুলা। তুমি চিনো না? একটু চুপ থেকে বল্লাম- না, তো। একটু আগেই তো গান গাইলো তুমি ওর গান শোনোনি? সাফায়েত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম বল্লাম- না তো, আমরা কয়েকজন বনের ঐ দিকটায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। মুখে বল্লাম কথাটা কিন্তু ভাবছিলাম অন্য কিছু।
হয়তো মিষ্টি হাসিটা … (চলবে)