অনলাইন ডেস্ক : নিজেদের কাজের জন্য একজন এডিটর খোঁজ করা, প্রোডাকশন প্রোপোজালের নমুনা চাওয়া, আবার ঈদুল আজহার দিন তাঁরা বিরিয়ানি রান্না করে খাবেন, এমন অনেক কিছু নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান, সাহেদুল ইসলাম সিফাত, শিপ্রা রানী দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নূর। কিন্তু ঈদের ঠিক আগের রাতের ঘটনায় তাঁদের সবকিছু পাল্টে যায়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা। শিপ্রা মাদক মামলায় আর সিফাত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন। শুধু ছাড়া পান তাহসিন। তবে পরিবার, সহপাঠী, শিক্ষক, চলচ্চিত্র নির্মাতারা বলছেন, যে অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, তাঁর সঙ্গে তাঁদের চেনাজানা শিপ্রা, সিফাতকে মেলাতে পারছেন না। দ্রুত মুক্তিও চেয়েছেন তাঁরা।
গত ৩১ জুলাই রাতে সিনহা ও সিফাত কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে যাচ্ছিলেন। বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের ভাষায় ‘আত্মরক্ষার্থে’ ছোড়া গুলিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সিফাতকে। এ ছাড়া এ তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে তাঁরা যে রিসোর্টে উঠেছিলেন, সেখান থেকে স্ট্যামফোর্ডের আরেক শিক্ষার্থী তাহসিন রিফাত নূর ও শিপ্রাকেও আটক করা হয়। পরে তাহসিনকে ছেড়ে দেয় পুলিশ কিন্তু শিপ্রাকে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।
সিফাত, শিপ্রা ও তাহসিন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। সিফাত ও শিপ্রা ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগে তৃতীয় বর্ষে এবং তাহসিন চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন। এ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাকিরা পারভীনের বিশ্বাস হচ্ছে না তাঁর নিজের শিক্ষার্থীরা এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর আন্তবিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য ফোরাম প্রতিযোগিতায় তাহসিনের লেখা গল্প প্রথম হয়। ও ভীষণ চুপচাপ স্বভাবের ছেলে। ও কক্সবাজারের ওই প্রজেক্টে এডিটর হিসেবে কাজ করছিল। শিপ্রা ঈদের এক দিন বা দুদিন আগে মেসেঞ্জারে নক দিয়ে আমার কাছে প্রোডাকশন প্রোপোজাল চেয়েছিল। ও খুব পড়ুয়া ছিল। প্রাণচঞ্চলে ভরা এক মেয়ে। সে ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার স্বপ্নে এখানে পড়ছে। ঘটনার আগের দিন ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিল এডিটর চেয়ে। এমনকি আমাকেও কক্সবাজার যাওয়ার জন্য বলেছে যে ম্যাডাম আপনি আসেন, আমার একটা রিসোর্ট নিয়েছি, আপনার অনেক ভালো লাগবে। তার মানে কী? ওর ভেতরে যদি কোনো অন্যায় বা অপরাধবোধ থাকত ও কিন্তু আমাকে সেখানে যাওয়ার জন্য বলত না। সিফাত খুব হাসিখুশি ছেলে। কথা কম বলত। ঈদের আগের দিন সিফাত তার মাকে বলেছে, ঈদের দিন ওরা বিরিয়ানি রান্না করে খাবে। এই সব বাচ্চার নামে যদি মাদকের মামলা দেওয়া হয়, তা মানা যায় না।’
চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘পাপ পুণ্য’ নামে যে চলচ্চিত্র সামনে আসবে, সেখানে শিপ্রা স্ক্রিপ্ট সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করেছেন। শিপ্রা সম্পর্কে এই নির্মাতা বলেন, ‘ও খুবই মেধাবী এবং ভীষণ চলচ্চিত্রপ্রেমী। কাজের কোনো সুযোগ হলে তা মিস করত না, ওর স্বপ্ন চলচ্চিত্র নির্মাতা হবে।’ শিপ্রার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে গিয়াস উদ্দিন সেলিম বলেন, ‘ও দীর্ঘদিন আমার সঙ্গে কাজ করেছে। ওর মধ্যে যদি কোনো সমস্যা থাকত তা তো আমরা বুঝতাম। কিন্তু ও তো সে রকম না। এ ঘটনার নিন্দা জানাই। ওরা এখনো শিক্ষার্থী। আমি ওদের দ্রুত মুক্তি দাবি করছি।’
চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকীসহ চলচ্চিত্রাঙ্গনের অনেকেই শিপ্রা–সিফাতের মুক্তি দাবি করেছেন।
শিপ্রা ও সিফাতের মুক্তির দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছে। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা চারটি দাবি তুলে ধরেন—শিপ্রা ও সিফাতের সার্বিক নিরাপত্তা এবং নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে, মেজর (অব.) সিনহা হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং মানসিক প্রহসন থেকে মুক্তি দিতে হবে।
আতঙ্কে পরিবার
শিপ্রার বাড়ি কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার হাজরাহাটি গ্রামে। আর তাহসিনের বাড়ি মেহেরপুর গাংনী উপজেলার বামন্দী গ্রামে। তাঁদের বাড়িতে গেলে কোনো পরিবারই কথা বলতে রাজি হয়নি। এমনকি তাহসিনের বাড়িতে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। ছাড়া পাওয়ার পরেই তিনি গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। উভয় পরিবারের সদস্যরা অজানা আতঙ্কে রয়েছেন।
গত মঙ্গলবার রাতে শিপ্রার বাবা বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা নবকুমার দেবনাথ বলেছিলেন, তাঁর মেয়ের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সেটা একদম অসত্য ও পুলিশের সাজানো। তিনি আরও জানান, কক্সবাজারের শুটিংয়ে তাঁর মেয়ে পরিচালকের কাজ করছিলেন। প্রায় মাসব্যাপী সেখানে কাজ করছিলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকায় ফেরার কথা ছিল। শিপ্রাকে আটকের সময় নাকি পুলিশের সঙ্গে তাঁদের তর্কাতর্কিও হয়েছে। মেয়ের বিরুদ্ধে মাদকের যে অভিযোগ আনা হচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণ সাজানো। এই ঘটনায় তাঁরা হতভম্ব। মুষড়ে পড়েছে পুরো পরিবার। পরিবারের সবাই এখন আতঙ্কগ্রস্ত।
রাজশাহী থেকে গোলাম রাব্বানী নামের এক ব্যক্তি ফোন করে বলেন, তিনিও সিনহার টিমের একজন সদস্য। শিপ্রা একসময় রাজশাহী পলিটেকনিকে পড়তেন। সে সময় পরিচয়। চলতি বছরেই আড়াই মাস ধরে সিনহাসহ পুরো টিম রাজশাহীতেও শুটিং করেছে। গোলাম রাব্বানী জানান, দশম পর্বে ডকুমেন্টারি তৈরি করা হচ্ছিল।
এদিকে তাহসিনের বাবা বামন্দী গ্রামের বাসিন্দা নূরুল হুদার সঙ্গে মুঠোফোনে গত বুধবার কথা হলে তিনি জানান, তাঁর ছেলে খুব ভয়ের মধ্যে আছেন। ১ আগস্ট তাহসিনকে কক্সবাজার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় দুদিন থাকার সময় চারজন সাদাপোশাকের সদস্য তাঁকে নিয়ে যান। ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর তাঁকে ছেড়ে দেন। এরপর তিনি বাড়ি চলে আসেন।
তাহসিনের এক নিকটাত্মীয় বলেন, তাহসিন খুব ভালো এডিটিং করতে পারেন। তিনি কোনো শুটিং স্পটে যেতেন না। সারা দিন ও রাতে রিসোর্টে বসেই এডিটিংয়ের কাজ করতেন।
শিপ্রা ও সিফাতের সহপাঠীরা এবং কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীরা এ দুজনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে হয়রানি বলছেন। এ দুজনের সহপাঠী ফয়জুল ইসলাম বলেন, ‘সিফাত–শিপ্রা আমার ব্যাচমেট। আমরা একসঙ্গে অনলাইনে মিডটার্ম পরীক্ষাও দিলাম। সিফাত ও শিপ্রার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তা মিথ্যা। ওরা এ রকম না। এটা সাজানো গল্প। আমাদের দুজন বন্ধুকে ফাঁসানো হয়েছে। দ্রুত ওদের মুক্তি চাই। ওদের ভবিষ্যত আছে। ওদের যেন হয়রানি করা না হয়। আমরা সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।’
স্ট্যামফোর্ডের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগেরই শিক্ষার্থী সানাউল কবীর শিপ্রা ও সিফাতকে কাছ থেকেই চিনতেন। শিপ্রার সঙ্গে কয়েকটি প্রোডাকশনে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ওদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তার সঙ্গে আমার চেনা শিপ্রা–সিফাতকে মেলাতে পারছি না। এটা সাজানো ঘটনা। সিফাত ভদ্র ছেলে এবং শিপ্রা খুবই কর্মঠ এক মেয়ে। যা করতে চায়, সেটা করে ছাড়ে।’