ভজন সরকার : অফিসের পিওনের সাথে বিরাট দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলাম। বেশ মানানসই অফিসে দশাসই এক ভদ্রলোক বিরাট টেবিলের ওপাশে বসে আছেন। সারাক্ষণ দরজা-জানালা বন্ধ ঘরে এক ধরণের ভ্যাপসা গন্ধ থাকে। সে গন্ধ নিয়েই সালাম দিলাম। ভদ্রলোক বেশ খানিকক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে দেখলেন। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে হাতের ইশারায় টেবিলের এপাশের এক চেয়ারে বসতে বললেন। আমি ভদ্রলোকের সামনাসামনি চেয়ারে বসলাম।
এক সাথে ছয় জন চাকুরীতে যোগ দিলাম একই অফিসে। ছয় জনই বন্ধু। দু’এক জনের সাথে বন্ধুত্বের বয়স প্রায় নিজেদের বয়সের সমান। তাই শিক্ষা জীবন থেকে কর্ম জীবনে প্রবেশের যে আবেগ অনুভ‚তি, তার লেশমাত্র নেই।
নিয়মানুযায়ী প্রধান করোনিকের কাছেই যোগদান পত্র দিলাম। বাবার বয়সের বেশী বয়সী ভদ্রলোকের কন্ঠে স্যার সম্বোধনে অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল। কিন্তু এটাই সরকারী নিয়ম।
সব কাজ শেষ হ’লে আমার ডাক পড়লো এক ভদ্রলোকের রুমে। ওই ভদ্রলোক অফিসের দায?িত্বরত ইঞ্জিনিয়ার। আমার বস। উনার অধীনেই কাজ করতে হবে। ভয়-ডর আমার তেমন নেই ছোটবেলা থেকেই। তাই কে বস আর কে সাব-অর্ডিনেট সে নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। জীবনকে কখনোই খুব সিরিয়াসলি নিইনি। ইচ্ছের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কাজ বা সিদ্ধান্ত নিতে হয় নি। এ সুবিধেটি জন্মগত, নাকি অর্জন তা মাঝেমধ্যেই ভাবি। উত্তর পাই না।
মুখোমুখী বসার পর ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দিলেন টেবিলের ওপর দিয়ে। আমিও চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে হাত মেলালাম। ভদ্রলোক বললেন, চা খাবেন, নাকি কফি?
আমি উত্তর দিলাম, চা হলেই চলবে।
ভদ্রলোক বেল বাজিয়ে পিওন ডেকে দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিলেন। আমিও চাইছি একটু সহজ হ’তে। তাই আমিই কথা বাড়ালাম। বললাম, স্যার আজই জয়েন করলাম।
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বোঝালেন উনি সেটি জানেন। আমি বললাম, স্যার নতুন চাকুরী তাই সব কিছু শিখতে একটু সময় লাগবে হয়ত, সে পর্যন্ত আপনার সহায়তা চাই।
আমাকে অবাক ক’রে দিয়ে ভদ্রলোক বললে, শুনুন, এটা ইস্কুল -কলেজ কিংবা ট্রেইনিং সেন্টার নয় যে, আপনাকে শিখিয়ে নেবো। এটা অফিস। আপনার কাজ আপনাকেই করতে হবে। না পারলে ট্রান্সফার করে দেব”।
ভদ্রলোকের সাথে আমার কথোপকথনের প্রথম বাক্য এমন হ’লো, এ কথা মনে করতেই বেশ হতাশ হলাম। তবুও হাল ছাড়ার মানুষ আমি নই। তাই বেশ সহজভাবেই নানা কথা বলতে লাগলাম।
চা শেষ করতে না করতেই আমার স্যারের যিনি স্যার, সেই বড় স্যারের টেলিফোন এলো। বড় স্যার মানে বড় ইঞ্জিনিয়ার আমাদের সাথে পরিচিত হ’তে চান। আমি আমার স্যারের সাথে বড় স্যারের অফিসে ঢুকলাম।
বড় স্যারের অফিস আরও বড়। বড় স্যারের অফিসের সামনে আবার আমার স্যারের সম-মর্যাদার এক স্যারের অফিস। সেই স্যারের অনুমতি নিয়েই বড় স্যারের রুমে ঢুকতে হয়। আমি আমার স্যারকে নিয়ে বড় স্যারের টেবিলের এ পাশে বসলাম।
শিক্ষক বাবা-মায়ের সন্তান। তাই অফিসের নিয়ম-কানুন তেমন জানি না। কিন্তু বইপত্র আর সংবাদপত্র পড়ে সরকারী চাকুরীর কিছু আমল্তাান্ত্রিক নিয়ম-কানুন জেনেছি। প্রথম দিনেই সেগুলোর অনুশীলন করার চেষ্টা করলাম। আমার স্যার চেয়ারের বসার পর আমি চেয়ারে বসলাম। বড় স্যার অর্থ্যাৎ বড় ইঞ্জিনিয়ার জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় লেখাপড়া করেছি। রেজাল্ট জিজ্ঞাসা করলেন। রেজাল্ট শুনেই ভদ্রলোক একটু রাগান্বিত হলেন।
বললেন, এমন রেজাল্ট নিয়ে সরকারী চাকুরীতে ঢুকেছো কেন? সরকারী চাকুরী করতে এসেছো কি এই রকম ঝামা হ’তে?
ইট-সুড়কির যে কালো-পোড়া টুকরো সেটিই ঝামা। ভাবলাম, হয়ত বড় স্যার তাঁর অফিসে রাখা কোনো ঝামার টুকরো দেখিয়ে বলছেন এ কথা। আমি এদিক-ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে ঝামা খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু না, কোথাও ঝামা নেই।
বড় স্যার আমাকে প্রচন্ড এক ধমকে দিয়ে বললেন, আরে, তুমি আমার রুমে ঝামা খুঁজছো কেনো? তুমিই তো চাকুরীর প্রথম দিনেই দেখি এক মস্ত ঝামা হয়ে গেছো। তোমার পাশেই তো এক জীবন্ত ঝামা বসে আছেন।
বুঝলাম, বড় স্যার আমার পাশে বসা আমার স্যারকেই ঝামা বলছেন। পাশে বসা আমার স্যারের মুখের দিকে তাকাতে সাহস হলো না। কিন্তু অনুমান করতে পারলাম, আমার স্যারের মুখের অবস্থা। একজন ভদ্রলোককে তার অধস্তন কর্মকর্তার সামনে এমন ক’রে অপমান করা যায় সেটি অনুমান ক’রেই শিউরে উঠলাম।
সরকারী চাকুরীতে উর্ধ্বতনদের হাতে অধস্তনদের এ হেন হেনস্তার কথা শুনেছি কিন্তু প্রথম চাক্ষুষ করলাম। বেশ অস্বস্তি তো বটেই একটু ভয়ও লাগলো। এই প্রথম অনুভব করলাম, চাকুরী শব্দটি চাকর থেকে এসেছে। কিন্তু সরকারী অফিসের চাকুরী ক্রমেক্রমে জনগনের চাকর থেকে উর্ধ্বতন ও ক্ষমতাশালীদের চাকরে রূপান্তরিত হয়েছে, সেটিও বুঝতে সময় লাগলো না; প্রথম দিনেই সেটি আত্মস্থ করলাম।
বেশ ঘটনাবহুলই মনে হলো সরকারী চাকুরীর প্রথম দিনটি। বড় স্যারের অফিস থেকে ফিরে আসার পর আমার স্যারের মধ্যে এক আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। প্রথম সাক্ষাতের সে রাগান্বিত চেহারা হঠাৎ কর্পূরের মতো উবে গেল। আমার স্যার এখন আমার মেন্টরের ভুমিকায়। আমিও ক্রমশঃ আমলাতন্ত্রের তন্তুজাল ভেদ ক’রে বসের কাছাকাছি চলে আসতে শুরু করলাম। আমার স্যার ভদ্রলোকও একজন বিশ্বস্ত অধস্তন কর্মকর্তা পেয়ে তার দুঃখের ঝাপি খুলে বসলেন।
আমার স্যার ভদ্রলোক বিচিত্র চরিত্রের মানুষ। বাইরে থেকে প্রচন্ড রাশভারী মানুষ। সব সময় এক ধরণের কৃত্রিম আভিজাত্য নিয়ে থাকেন। বরিশালের আঞ্চলিক বাংলায় কথা বলেন। কিন্তু সারাক্ষণ ভাবেন, তিনি বিশুদ্ধ ও প্রমিত বাংলায় কথা বলছেন। এ নিয়ে যিনি কথা বলবেন তিনিই প্রচন্ড বিরাগভাজন হবেন। আমি সৌভাগ্যবশত রক্ষা পেলাম স্যারের বিরাগভাজন হওয়া থেকে। কিন্ত আমার আরেক বন্ধুর কপাল মন্দ, সে সত্যিই ধরা খেলো প্রথম দিনেই।
আমরা সবাই বসে আছি। আমার সেই বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলো, স্যার, আপনার বাড়ি কি বরিশাল?
আমার স্যার প্রচন্ড বিরক্তিতে বরিশালের প্রমিত উচ্চারণে রাগান্বিত হয়ে বললেন, শুনুন রাহাত সাহেব, আপনার বোধবুদ্ধি কেমন জানি না, তবে আপনার ভাষা জ্ঞান খুবই কম। আমার কথা শুনে কি মনে হয়, আমার বাড়ি বরিশাল?
আমার বন্ধু রাহাত তো হতবাক। বেচারা মাথা নিচু করে বসে আছে। আমার স্যার সুযোগ বুঝে ঝাড়ির মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন। পাশে বসা আমাকে দেখিয়ে বললেন, দেখুন, এই পিন্টু সাহেবকে। উনি বাংলায় এতো অভিজ্ঞ, উনি কিন্তু ঠিকই বুঝেছেন যে, আমার বাড়ি বরিশাল সেটা আমার ভাষায় বোঝা যায় না। নাকি বোঝা যায়?
আমার দিকে তাকিয়ে স্যার সম্মতি জন্য তাকিয়ে রইলেন। কী বলবো বুঝতে না পেরে আমিও মাথা নিচু করেই বসে রইলাম। থমথমে অবস্থা কাটাতে আমি সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। সেই মুহূর্তেই এক ঠিকাদার হাতে ফাইল নিয়ে স্যারের রুমে প্রবেশ করলেন।
দুর্ণীতিবাজদের চরিত্র গল্প-উপন্যাস-নাটকে যা জেনেছিলাম, আমার স্যারকে তা থেকে কোনো ব্যতিক্রম মনে হলো না। প্রচন্ড ধর্মভীরু ভদ্রলোক সারাক্ষণ স্রষ্টার দোহাই পাড়েন। মহান স্রষ্টা সব দেখছেন, বিশ্বাসও করেন কিন্তু দুর্ণীতিতে পিছপা নন । আর সবার মতোই নিজে নিজে দুর্ণীতির স্বপক্ষে কিছু যুক্তি দাঁড়ও করিয়েছেন। জীবনযাপনের অতি উচ্চ মূল্য তো আছেই। সেই সাথে উর্ধ্বতনদের মাসোহারা দে’য়া ।
মাঝে মাঝেই বলেন, শুনুন পিন্টু সাহেব। ওই যে চারিদিকে দালান ঘেরা অনেকগুলো বড় বড় গেইটওয়ালা এলাকা দেখছেন, ওখানকার ইট-পাথর পর্যন্ত ঘুষ খায়। আপনি একটু ধারণা করুণ তো, এই চেয়ারে বসে আছি, এর বিনিময়ে প্রতি মাসে কতো টাকা ওখানে দিতে হয়?
আমি বুঝলাম স্যার সচিবালয়ের কথা বলছেন। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি স্যারের মুখের দিকে।
স্যার বলতে থাকেন, আমরা হলাম কালেক্টর। কালেক্ট করি, নিজে কিছু রেখে বাকীটা ঘাটে ঘাটে বিলিয়ে দিই। তাই বলছিলাম, হয় আপনাকে দুর্ণীতিতে নামতে হবে কিংবা মুখ বুঝে অন্যেকে দুর্নীতি করতে দিতে হবে। এর মাঝামাঝি কিছু নাই। আপনাদের সাহিত্যিকদের ভাষায়, আলো আর অন্ধকারের মাঝামাঝি রেখা আর কী! হা হা …
আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। ভাবি এ আমি কোথায় এলাম? এ তো চাকচিক্যময় দালানের ভিতরের এক অন্ধকার জগত। সবাই জানে, কে কতো পার্সেন্টেজ পায়। এই পার্সেন্টেজের বাইরেও কার উপরি কতো। অথচ সবাই এক ধরণের না-জানা না-দেখা অবস্থানে। সবারই এক ভদ্রলোকের মুখোশ। নীতিবাক্য, ধর্মকর্ম এসবেও কেউ কারোর চেয়ে পিছিয়ে নেই।
আমার স্যারের রুম থেকে বেরিয়েই কোনো কোনো ঠিকাদার জানান দেয়, বড় স্যার- মেঝো স্যার-ছোটো স্যারকে কত পার্সেন্ট দিয়ে এলেন। আমার স্যারের নাকি ঘুষের টাকা গ্রহনের অভিনব কৌশল । প্রথমে টাকা হাতে নেবেন, তারপর জুতায় ঠেকাবেন, তারপর প্যান্টের পকেটে ঢুকাবেন।
টাকা নে’য়ার সময় বলবেন, শুনুনু, এই যে আপনার কাছ থেকে টাকা নিলাম এই ঘটনার সাক্ষী আমরা তিন জন। আমি, আপনি এবং মহান সৃষ্টিকর্তা। সৃষ্টিকর্তার সাথে আমি কথা ব’লে হিসেব মিটিয়ে নেবো। আপনি কিন্তু বাইরের কাউকে বলবেন না।
ঠিকাদার ভদ্রলোক রুম থেকে বাইরে এসেই সবাইকে বলে বেড়ান, কতো টাকা স্যারকে দিলেন। স্যার যে এটা জানেন না, সেটা কিন্তু নয়। এ নিয়ে স্যারের এক সুক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণও আছে।
আমার স্যার বলেন, শুনুন পিন্টু সাহেব, কাউকে বলতে শুনেছেন পুলিশকে কতো টাকা, কবে ঘুষ দিয়েছেন? শুনেননি। কারণ কি জানেন? পুলিশ শুধু ঘুষ নেয় না, সাথে কিছু উত্তম-মধ্যমও দেয়- সে যতো বড় ক্ষমতাশালীই হোক না কেনো। এর ফলে হয় কী, মাইরের ভয়ে ঘুষের কথা কেউ প্রকাশ করে না। আর আমাদের বেলায়? যদি এক টাকা ঘুষ দেয় , বাইরে গিয়ে বলে বেড়ায় স্যারকে দশ টাকা দিয়ে এলাম।
স্যারের যুক্তিটি আমার কাছে বেশ চমকপ্রদ মনে হয়। মনে মনে ভাবি, স্যারের সাথে দেখা না হলে অনেক কিছুই বাকি থেকে যেতো এই বিশ্ব-সংসারে।
যেমন বাকী থেকে যেতো গাড়িতে বসা নিয়েও কতো ধরণের স্ট্যাটাস সমস্যা দেখারও। ট্রাইভারের পাশে সামনের আসনে উচ্চপদস্থ কেউ বসেন না। একই মর্যাদার কর্মকর্তারা একই সারিতে পাশাপাশি বসেন। একদিন আমার অধনস্থ একজনের সাথে গাড়ি থেকে নামতে দেখেছেন আমার স্যার। একটু পরেই স্যারের রুমে আমার ডাক।
স্যারের জিজ্ঞাসা, এটা কী করলেন পিন্টু সাহেব?
কী করেছি স্যার? আমি উত্তর দিই।
আজই দেখলাম অমুক সাহেবকে আপনার পাশে বসিয়ে নিয়ে এলেন গাড়িতে। শুনুন সব সময় সাব-অর্ডিনেটদের সামনে ড্রাইভারের পাশের আসনে বসাবেন।
স্যারের জোড়ালো হুকুম। আমিও অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, সরি স্যার। বসাবো।
আমার স্যারের উপদেশটি যে কী ভয়ঙ্কর হয়ে স্যারের নিজের ঘাড়েই পড়বে, সেটার জন্য বেশী দিন অপেক্ষা করতে হলো না।
স্যার একদিন জরুরী তলব করলেন তাঁর রুমে।
স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, পিন্টু সাহেব, গাজীপুর শহরের বাইরের ওই সাইট তো আপনার অধীনে? আপনি কি সাইটটি ভিজিটে গিয়েছিলেন?
আমি বললাম, জ্বী স্যার। অনেকবার গিয়েছি। কেন বলুন তো?
স্যার বেশ ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, বড় স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি গিয়েছি কিনা? আমি তো যাই নি তবুও মিথ্যে বলেছি, গিয়েছি। কিন্তু স্যার তো আজই সাইটটি ভিজিটে যাবেন।
আমি বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম, আমি সাথে যাব স্যার। আপনার কোনো অসুবিধে নেই। বড় স্যারের ড্রাইভারকে আমি রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবো।
কথায় ব’লে ভাগ্যে দুর্ভোগ থাকলে এমনই হয়। বড় স্যার, আমার স্যার ও আমি দুপুরে রওনা দিলাম একই গাড়িতে। বড় স্যারের গাড়িতে পদমর্যাদা অনুসারে আমিই ড্রাইভারের পাশের সিটে বসার কথা।
বড় স্যার গাড়িতে উঠেই বললেন, পিন্টু সাহেব, আপনি আমার সাথে বসবেন। যেতে যেতে টুকটাক কাজ করবো। আর রহমত সাহেব ,আপনি ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসুন।
বড় স্যারের হুকুম। আমার স্যার আপত্তি জানাতে গিয়েও কিছু না ব’লে মুখ ভার করে ড্রাইভারের পাশের সিটে সামনের আসনে গিয়ে বসলেন।
এই পদমর্যাদার উপর ভিত্তি করে গাড়িতে বসার ব্যাপারটি আমার কাছে তেমন গুরুতে পায়নি। তাই আমিও প্রথমে খেয়াল করিনি। গাড়ি গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বড় স্যারের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে গাড়ি এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে টংগীর দিকে চলতে শুরু করেছে। দুপুরের এই সময়টিতে কোথাও তেমন ট্রাফিক নেই। গাড়ি আধাঘন্টার মধ্যেই গাজীপুর চৌরাস্তার কাছাকাছি চলে এসেছে। ভ্যাপসা গরমের দিনে গাড়িতে চালানো এসির বাতাসে বেশ শীত অনুভব করছি আমি।
হঠাৎ সামনে বসা আমার স্যার ,মানে রহমত সাহেবের দিকে চোখ পড়ল আমার। গাড়ির ভিতরের ফুলস্পিডে চালানো এয়ারকন্ডিশনের বাতাসেও রহমত সাহেব দরদর ক’রে ঘামছেন।
স্যার কি অসুস্থবোধ করছেন? এ কথা জিজ্ঞাসা করার মুহূর্তেই মনে পড়লো রহমত সাহেব তো সাইটই চেনেন না। অথচ বড় স্যারকে বলেছেন যে, তিনি অনেকবার সাইট পরিদর্শনে গেছেন। যে ক’রেই হোক বড় স্যার আমার স্যার মানে রহমত সাহেবের এই মিথ্যে কথা বুঝতে পেরেই তাঁকে ড্রাইভারের সামনে বসিয়েছেন।
গাড়ি তখন বোর্ড বাজার ও এরশাদপল্লী ছাড়িয়ে গাজীপুর চৌরাস্তার কাছাকাছি। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে বড় স্যারের ড্রাইভারকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে হবে, সেই আশঙ্কাতেই আমার স্যার, রহমত সাহেব দরদর ক’রে ঘামছেন।
(ভজন সরকার: কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)