সাজ্জাদ আলী : সে ঠিক বোবা না, বাধো বাধো করে কথা বলতে পারে। তবে বলতে বেশ খাটুনি হয় তার। কন্ঠ থেকে অনেকটা আমের আঁটির বাঁশির মতো শব্দ বের হয়। যেন ভ্যাপু বাজানোর শব্দ। তার কথা কেউ বুঝতে চাইলে বেশ বুঝতে পারবে। শুধু একটু বাড়তি মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে, এই যা। মুখভঙ্গি, ঠোঁটের নড়াচড়া, চোখের ইশারা ইত্যাদি লক্ষ করলেই বোঝা যায় সে কী বলতে চায়। বয়স ১৬/১৭ বছরের বেশি হবে না। মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি, পরনে মলিন একটা লুঙ্গি। গায়ের গেঞ্জিটার ফুটো দিয়ে বুক পেটের দু-এক জায়গা দেখা যাচ্ছিলো। গৌর বর্ণ তার। বেশ নাদুসনুদুস দেখতে। মুখের হাসিটি লেগেই আছে। সফেদা ফল ভর্তি ঝাকাটা গলায় ঝুলিয়ে ফেরি ঘাটে বিক্রি করছে।

ঘাটে আজ যানজটের বালাই নাই। আমাদের গাড়িখানা তরতর করে ফেরিতে উঠে পড়লো। বাস বা ট্রাক এ ফেরিতে পার হবে না। সব ছোট ছোট গাড়ি লোড হচ্ছে। ব্যস্ত ধুলিময় ফেরিঘাট! গাড়ি, যাত্রী, ফেরিওয়ালারা সবাই হুড়মুড় করে উঠছে ফেরিতে। ওই আধো-বোবা সফেদাওয়ালা ফেরিতে উঠতেই একজন ফেরি-কর্মচারি তাকে ঠেলেঠুলে নামিয়ে দিলো। চিৎকার করে সে আপত্তি জানালো। তবে সে চিৎকারের ভাষা বোঝা গেল না। কিন্তু তার প্রতিবাদটা স্পষ্ট বুঝলাম। একজন পুলিশ কনষ্টেবল ফেরি কর্মীকে ধমকে বললো, ওই তুই জানোস না ও কোরানে হাফেজ? ওরে উঠতি দে, ফাজিল কোথাকার!

ফেরি ছেড়েছে অনেকক্ষণ। পদ্মা সেতুর ২০ এবং ২১ নম্বর পিলারের মাঝ দিয়ে জাহাজখানা মাওয়া ঘাটের দিকে এগুচ্ছে। সেতুর কাজ তো দেখি প্রায় শেষ। এ পথে এটাই হয়তো শেষ ফেরি যাত্রা। পরের বার ৫/৭ মিনিটে পদ্মা পেরিয়ে যাবো আশাকরি। ব্রীজের তলা দিয়ে যেতে যেতে খুব গর্ব হলো। তলাবিহীন ঝুড়ির বাঙ্গালী নিজের টাকায় এত্ত বড় একটা ব্রিজ বানিয়েই ছাড়লো!

পাটাতনে দাঁড়িয়ে পদ্মাকে বাগে আনা সেতুর কাঠামো দেখছিলাম। সেতু ছাড়িয়ে অনেক দূরে যাবার পরে গাড়িতে এসে বসলাম। ড্রাইভার শাওনকে গাড়ির এয়ারকন্ডিশন বাড়িয়ে দিতে বলে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যটা শাওন দেশ কেমন চলছে?

স্যার এই দ্যাশটা শ্যাষ। খালি ঘুষ আর ঘুষ। ঘুষ ছাড়া কিচ্ছু হয় না। শাওন যেন ক্ষোভে ফেটে পড়লো। বললো, আপনি যদি দুইডা মিনিট শোনেন তো আমার নিজির এট্টা ঘটনা কই?

ভেবেছিলাম পদ্মার জলের ঝাপটা শুনবো। গাড়ির জানালা দিয়ে চেয়ে চেয়ে দু-চারশ’ ঢেউও গুনে ফেলবো। কিন্তু শাওনের ঘটনাটা শুনতে ইচ্ছা হলো। মনে হলো এগুলোই তো দেশের চলমান ছবি। গত প্রায় ৩০ বছর আমি নর্থ আমেরিকায় থাকি। এই সময়ে চারপাশে কোনো ঘুষখোর দেখিনি। অসততা বা অন্যায়ও তেমন একটা চোখে পড়েনি। তাই শাওনের ‘রিয়েল লাইফ স্টোরি’ শোনার বেশ আগ্রহ হলো। বললাম, বলো শাওন শুনি তোমার কথা।

স্যার, দুই দুইবার পুলিশের চাকরীর ইন্টারভিউতে টিকে গেছি। তয় আমাগো এমপি সাব হইলো চাকরি দেওনের মালিক। হ্যার কথায়ই এলাকার সব কিছু হ্যালে দোলে। তার খাস লোক পরথমবার চাইছে আট লাখ, আর পরেরবার ১২ লাখ। টাকা দিতি পারলাম না বইলা হওয়া চাকরিডা হইলো না স্যার। আইচ্চা কনতো কনষ্টেবলের চাকরীর জন্যি ১২ লাখ টাকা ঘুষ? এইডা কোনো কতা হইলো? এত টাকা আমি পাবো কই?

ছেলেটার হতাশা আমার মর্মে বিধলো। সুঠাম দেহী উদ্দিপ্ত এই যুবক রাষ্ট্রের কাছে একটা পুলিশের চাকরিতো চাইতেই পারে। সোনার বাংলায় শাওনদের আজ ঘুষ দিয়ে চাকরি পেতে হয়। ১২ লাখে চাকরি কিনে ওরা নাগরিকদের সার্ভিস দেবে কীভাবে? চালানটা তো অন্তত ওঠাতে হবে! ঘুষ না খেয়ে ১২ লাখের পুলিশদের উপায় কী?

শাওনের হতাশায় আমার মনটা খুব উদাস হয়েছে। এক ধ্যানে চেয়ে আছি জলের দিকে। সে দিন পদ্মায় কত না ঢেউ। কিন্তু আমি যেন একটিও দেখতে পাচ্ছি না। আসলে চেয়ে থাকলেই সব সময় সব কিছু দেখা যায় না। এমন সময় হঠাৎ গাড়ির জানালায় টোকার শব্দে সম্বিত ফিরলো। চেয়ে দেখি সেই বাক-প্রতিবন্ধী সফেদাওয়ালা যুবকটি দাঁড়িয়ে। ঝাকা ভর্তি বড় বড় গাছপাকা সফেদা। ফলগুলো একটির ্ওপর আরেকটি রেখে শৈল্পিকভাবে সাজানো। কাঁচ নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার ফল কি মিষ্টি হবে? দাম কত?

কাটা কাটা উচ্চারণে সে বললো, ভারি মিডা স্যার, খাইয়া দেহেন। এই বলে সে একটা ফল আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো। ফলের দামও সে বলেছে, কিন্তু তার কন্ঠ-জড়তার কারণে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। আবারও দাম জানতে চাইলাম।

এই ফাঁকে কথার মাঝে শাওন ঢুকে পড়লো। বললো, স্যার এক ডজন ১৬০ ট্যাকা চায়। ও বেশি দাম চাইতেছে। আপনি দাম কইয়েন না। আমি দাম-দর ঠিক কইরত্যাছি। বেশ রুক্ষ স্বরে শাওন বললো, তুমি ১৪০ কইরা রাখবা। দুই ডজন নেবো আমরা।

ভাই, দামাদামী কইরা মাল বেচি না। চাইয়া দেহেন কত্ত বড় বড় সফেদা! আমি ন্যায্য দামই চাইছি। আপনে নেন, আমি বাইছা বাইছা ভালো ভালোডা দিত্যাছি।

শাওনের তাতে মন গলে না। সে মহা উদ্যোমে দামাদামি করে চললো। বললো, ১৪০ ট্যাকার বেশি তোমার সফেদার দাম নাই। তুমি না দিলি আরেক সফেদাওয়ালারে ডাক দেবো কলাম।

শাওনের এই হুমকিতে ফলওয়ালার মুখখানা মলিন হলো। এই বুঝি ব্যবসাটা হাতছাড়া হয় ! আরো একবার শেষ চেষ্টা করলো সে। খাকারি দিয়ে গলাটা একটু পরিস্কার করে আমার দিকে চেয়ে বললো, এমন মিডা ফল কিন্তু এই ফেরিতে আর নাই স্যার।

আমি আস্তে করে শাওনকে বললাম, এক ডজন নিয়ে নাও ব্যটা। আর দামাদামি কোরো না।
কিন্তু শাওন কী সে কথা শোনে? সে বললো, দেখো ভাই ম্যালা কতা ওইছে, তোমার ফলের শ্যাষ দাম ১৫০ ট্যাকা। দিলি দেও, আর না দিলি যাও।

মুখখানা ব্যাজার করে অনিচ্ছা সত্তে¡¡ ফলওয়ালা গুনে গুনে এক ডজন সফেদা শাওনের হাতে দিলো।

আমি মানিব্যাগ থেকে ১৬০ টাকা বের করে ফলওয়ালাকে দিলাম। সে ১০ টাকা আমাকে ফেরত দিয়ে পরবর্তী খরিদ্দারের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলো। পেছন থেকে ডেকে বললাম, অ্যাই টাকা ফেরত দিলে যে? এটা রাখো।

সে বললো, না স্যার দাম তো দেড়শো ঠিক হইছে।
কিন্তু তুমি তো তাতে খুশি না। শাওনকে ইঙ্গিত করে বললাম, ও তো জোরাজুরি করে তোমাকে দিয়ে দাম কমিয়েছে। তোমাকে আমি ১৬০ টাকাই দিচ্ছি।
না স্যার, তা হয় না। আমি দ্যাড়শো টাকায় রাজি হইয়াই আপনারে ফল দিছি। ওই ১০ টাকা নিতি পারবো না।

আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার কথাই মানলাম। আমি না হয় খুশি হয়ে তোমাকে ১০টা টাকা দিলাম। তুমি এটা রাখো প্লিজ, বলে ১০ টাকার নোটটি ওর দিকে আবার বাড়িয়ে ধরলাম।
খুব খুশি হলো ছেলেটি। একেবারে গাল ভরে হেসে ফেললো। তারপর ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললো, স্যার আপনে মানুষডা ভালা। তয় স্যার, আমি ফল বেইচা খাই। সাহায্য নেবো না ! এটুকু বলে আবার হাঁটা ধরলো সে।

ওর কথা শুনে আমার বিষন্ন মনটা বেশ প্রসন্ন হলো। হঠাৎ যেন আবিস্কার করলাম, আরে তাই তো, সোনার বাংলায় তো শুধু ঘুষখোরদেরই না ? এ দেশটি তো ফলওয়ালারাদেরও !
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)