শারমীন শরীফ : আজ ইচ্ছে হল অন্য কিছু নিয়ে গল্প করি। গত কয়েক দিন ধরে আমি খুব স্মৃতিতাড়িত হয়ে আছি, মনে হল স্মৃতি নিয়ে কিছু লিখি। স্মৃতি হল তথ্য সংরক্ষণ করার একটা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আমরা আমাদের ব্রেইনে নতুন নতুন তথ্য জমা করে রাখি। স্মৃতি শব্দটার মাঝে লুকিয়ে আছে হাজারো ফেলে আসা মুহূর্ত যেটা হতে পারে আনন্দের বা কষ্টের অথবা একেবারেই অপাংক্তেয়। স্মৃতির ধুলো বলে একটি শব্দ আছে, আমি এই শব্দটা নিয়ে অনেক ভেবেছি, আসলে স্মৃতিতে ধুলো বলে কিছু নেই আছে একটা মায়ার আবরণ যাতে মুড়ে থাকে আমাদের অতীত।

আমার খুব এমন হয় যে কোন একটা গান শুনলে মনে হয় স্মৃতির কোন একটা মুহূর্তে এসে আটকে আছি। আবার মাঝে মাঝে নাকে এসে লাগা কোন একটা গন্ধে স্মৃতির তুমুল ঢেউ এসে যেন আছড়ে পড়ে, মুহুর্তের সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়; স্তব্ধ হয়ে যায় সময়। ফেলে আসা সময়, ঘটনা বা জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো যেন ক্ষণিকের জন্য জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমি খুব স্মৃতিতাড়িত হই গোলাপ জলের গন্ধে আর আগরবাতির গন্ধে। এই গন্ধগুলো আমার নাকে এসে লাগলেই বুকের মধ্যে কেমন ফাঁকা হয়ে যায়, চিন চিনে ব্যাথার একটা অনুভূত ছড়িয়ে পরে কোষে কোষে। ছোটবেলায় এগুলোর সংস্পর্শে যতটা আসা হয়েছে বড় হয়ে ততটা আর হয়নি আর তাই এর সাথে মিশে রয়েছে আমার বাল্যকাল। ছেলেবেলায় ঈদের সময়ে পায়েসে, ফিরনিতে গোলাপজলের গন্ধ, মিলাদ মাহফিলে গোলাপ জলের গন্ধ, আগরবাতির গন্ধ। স্পেশাল সবকিছুতেই যেন গোলাপজলের ছোয়া থাকত আর তাই গোলাপ জলের বোতল খুললেই আমি কিছুক্ষণের জন্য অসাড় হয়ে যাই। আর সেই সাথে আগরবাতির গন্ধ আমায় মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়। একরাশ বেদনায় যেন ছেয়ে যায় মন। হামদ ও নাত শুনলে ঈদের সকালের কথা মনে পড়ে যায়, নামাজ শেষে মসজিদের মাইকে বাজত। গান শুরু হলেই বুঝতাম আব্বা এক্ষুণি আসবে আর আমি ঈদি বা সালামি পাব। ততক্ষণে আমার নতুন জামা পড়া, সাজগোজ শেষ, দৌড়ে গিয়ে দরজায় দাঁড়াতাম আব্বাকে সালাম করব আর প্রথম ঈদি নেব বলে।

গন্ধ বা গানের সুরে স্মৃতিতে চলে যাওয়ার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, “গন্ধ এবং স্মৃতি খুব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত কারণ মস্তিষ্কের শারীরবৃত্তি ঘ্রাণসংকেতগুলিকে খুব দ্রুত লিম্বিক সিস্টেমে (ব্রেইনের যে অংশ ইমোশনকে চালিত করে) পৌঁছানোর অনুমতি দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে গন্ধের সাথে যুক্ত স্মৃতিগুলি পুরনো হতে হতে মগজে ঘাপটি মেরে থাকে, যার অর্থ হল যখন কোন একটা গন্ধের কারণে এমনটা ঘটে তখন ঘাপটি মেরে থাকা স্মৃতিগুলো খুব প্রাণবন্তু হয়ে ওঠে মূহূর্তের মধ্যে। স্মৃতির এই উচ্ছলতা মানুষকে প্যারালাইজড করে দেয় ক্ষণিকের জন্য, সেই মুহূর্তটি চুম্বকের মত আটকে যায় অতীতে। আমার ক্ষেত্রে এমনটা অনেক হয়। আমি এমনভাবে স্মৃতিতে ডুবে যাই যে কয়েক সেকেন্ড আমার পারিপার্শ্বিক জ্ঞান থাকে না। ক্ষণিকের জন্য বুকটা খালি হয়ে যায়। কি নিঃসীম এক হাহাকারে ভরে ওঠে মন। আমাদের বাড়িতে দৈনিক ইত্তেফাক আসতো নিয়মিত। আমার মনে হয় অন্য পত্রিকার থেকে দৈনিক ইত্তেফাকের একটা আলাদা গন্ধ আছে। কাজের পরে আমার বাবা সারাক্ষণ খবরের কাগজ নিয়ে পড়ে থাকতেন আর এই নিয়ে আমার মায়ের অনেক আপত্তি ছিল, মা তখন আব্বার চারপাশে ঘুরঘুর ঘুরত আর তাঁর অভিযোগ জানাত। এখন খবরের কাগজের গন্ধ পেলেই আমার কাছে মনে হয় আমার বাবা-মা আশেপাশে কোথাও আছেন। আমার বাবা আতর ব্যবহার করতেন ঈদে বা যে কোন বিশেষ আয়োজনে, আবার নামাজ পড়ার সময়ও আব্বা আতর লাগাতেন। আমার মাথায় আছে আতরের গন্ধ মানে ‘আব্বা’। আব্বার শেষ আতরের কৌটোটা এখনো আমার কাছে রয়েছে। যখন আব্বার জন্য বুকে হাহাকার ওঠে তখন আমি চোখ বন্ধ করে কৌটোটা খুলে জোরে একবার নিঃশ্বাস টেনে নেই সাথে সাথে আমি তাঁর কাছে পৌঁছে যাই।

অতীত নিয়ে অধীক চিন্তা করা কি খারাপ? এ বিষয় নিয়েও অনেক মতবাদ রয়েছে। আমার মতে অতীত নিয়ে চিন্তা করা এবং তাতে বেঁচে থাকার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কখনও কখনও আমরা অতীতে বাস করি কারণ এটি আমাদের কাছে পরিচিত; আমরা জানি কখন কি ঘটেছে; কোথায় কোন চমক আছে, অতীতে কোনটা ভাল বা খারাপ। অতীতকে ধরে রেখে নতুনের সাথে বদলাতে না চাওয়ার মানে হয়ত অতীতে বাস করা। আর মাঝে মাঝে আমাদের প্রিয় পুরানো ঘটনাগুলি খুব যত্নে নেড়েচেড়ে দেখে, স্মৃতি রোমন্থন করে বর্তমানে ফিরে আসাই হল স্মৃতিচারণ। কিন্তু কেন আমরা স্মৃতিতে ফিরে ফিরে যাই যাই তা নিয়ে ভাবুন তো। আবার এও ভেবে দেখুন আমরা কিন্তু সুখ স্মৃতিগুলোকে রোমন্থন করতে বেশি ভালোবাসি এবং অপ্রিয় স্মৃতিগুলোকে খুব সন্তর্পনে পাশ কাটিয়ে যাই। যখন একটি অবাঞ্চিত স্মৃতি মনের মধ্যে প্রবেশ করে, তখন এটিকে আটকাতে চাওয়া একটি স্বাভাবিক মানবিক প্রতিক্রিয়া।

একশো বছর আগে, ফ্রয়েড পরামর্শ দিয়েছিলেন যে মানুষের একটি পদ্ধতি রয়েছে যা তারা চেতনার বাইরে অবাঞ্চিত স্মৃতিগুলিকে বøক করতে ব্যবহার করতে পারে। অতি স¤প্রতি, বিজ্ঞানীরা বুঝতে শুরু করেছেন যে এটি কীভাবে কাজ করে। নিউরো ইমেজিংএর মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে বের করা হয়েছে যে, মস্তিষ্কের কোন একটা সিস্টেম ইচ্ছাকৃত ভুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং গবেষণায় দেখা গেছে যে মানুষের পক্ষে ইচ্ছাকৃতভাবে চেতনা থেকে স্মৃতিগুলিকে অবরুদ্ধ করা সম্ভব (যেটা হয়ত কোন কোন ক্ষেত্রে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে), এর মানে এই দাঁড়ায় যে, আমরা চাইলেই অপ্রিয় সব স্মৃতিগুলোকে তালাচাবি মেরে রেখে দিতে পারি।

প্রন্তু তাহলে দুঃখ বিলাসের কি হবে? আকাশ ভেঙে কোন এক বৃষ্টির বিকেলে যখন পাখিগুলিও বিদ্যুতের তারে বসে পাখা গুটিয়ে ভাবছে ঘরে ফিরবো কি করে তখন ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে হাত ভিজিয়ে রবীন্দ্র সংগীত শুনতে শুনতে দুঃখের স্মৃতি রোমন্থন করাতেই মনে হয় সব থেকে বেশি আনন্দ! চারিদিকে যখন দুঃখ বিলাসের আবহাওয়া, তখন দুঃখের স্মৃতিতে তালা চাবি মারা থাকলে চলবে কি করে?

খারাপ বা কষ্টের স্মৃতিকে অবজ্ঞা করার কিছু নেই, এখান থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার রয়েছে, বোঝার রয়েছে। বেদনাদায়ক স্মৃতিতে রয়ে যায় ইতিবাচক অনেক কিছু, তবে সেটা অনুধাবণ করতে হবে। আবার এভাবেও ভাবতে হবে যে, খারাপ বা নেতিবাচক স্মৃতিগুলো যদি হতাশার কারণ হয় তবে এটি আমদের আত্মবিশ্বাসকে ভঙ্গুর করে দিতে পারে। অন্যদিকে আত্মবিশ্বাসের অভাব বোধ থেকেও নেতিবাচক স্মৃতিগুলো আমাদের মগজে হানা দিতে পারে এবং যেটা কিনা আমাদের ভবিষ্যত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অন্তরায় হয়ে পারে। কিন্তু আমরা যদি সাহস করে এই নেতিবাচক স্মৃতিগুলির মুখোমুখি হতে পারি এবং সেই অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্য দিয়ে আগামীর জন্য কিছু শিখতে পারি তাহলে অনায়াসেই অতীতেকে ঢেকে না বরং যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে সমনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
তবে আমাদের মনের ঘরের স্মৃতির দরজা কখনো কখনো একেবারেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে যার নাম ডেমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ। মস্তিস্কের স্মৃতি সংরক্ষণের জায়গা আক্রান্ত হলে ডেমেনশিয়া বা এ্যলঝেইমার রোগের উৎপত্তি হয়ে থাকে। আবার মানুষ যদি কোন স্মৃতিকে ভুলে যাবার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ক্রমাগত দমন করতে থাকে সেখান থেকেও উৎপত্তি হতে পারে এই রোগের। এই বিষয়ে আমরা আরেকদিন বিস্তারিত আলোচনা করতে পারি।

একদিন আমরা বিলীন হয়ে যাব এই পৃথিবী থেকে কিন্তু এই ধরার বুকে রয়ে যাবে আমাদের হাসি, কান্না, কথা এবং স্মৃতি! রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি কবিতা দিয়ে আজ শেষ হোক-
ডেকে ওঠো যদি স্মৃতিভেজা ¤øান স্বরে,
উড়াও নীরবে নিভৃত রুমালখানা
পাখিরা ফিরবে পথ চিনে চিনে ঘরে
আমারি কেবল থাকবে না পথ জানা-

হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে যায় প্রেমে
অথচ আমার ব্যাপক বিরহভূমি
ছুটে যেতে চাই- পথ যায় পায়ে থেমে
ঢেকে দাও চোখ আঙুলের নখে তুমি।
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা