অনলাইন ডেস্ক : দূর–দূরান্ত থেকে একের পর এক উড়োজাহাজ পাখির মতো পা গুটিয়ে নামত। শত শত যাত্রী নামা-ওঠা করিয়ে পাখা মেলে আবার উড়াল দিত দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রতিদিনের দৃশ্য ছিল এটি। কিন্তু দেশের প্রধান বিমানবন্দরের চিরচেনা দৃশ্যপট অনেকটাই ফিকে। করোনার ছোবলে এখন আর নিত্যদিনের মতো উড়োজাহাজের আসা-যাওয়া নেই। তবে জুন মাস থেকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কয়েকটি রুটের ওপর যাত্রীবাহী ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় কিছু প্রাণ ফিরে পেয়েছে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। প্রতিদিন সব মিলিয়ে হাজার দুয়েক যাত্রী চলাচল করলেও পরিস্থিতিকে অস্বাভাবিকই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

করোনাভাইরাস মহামারি রূপ ধারণ করায় গত ২১ মার্চ থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ ও চীন ছাড়া বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে যাত্রীবাহী ফ্লাইট বন্ধ করে দেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। কয়েক দফা সময় বাড়ানোর পর ১ জুন থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে ঢাকা থেকে সৈয়দপুর, সিলেট ও চট্টগ্রামে সীমিত আকারে ফ্লাইট চালুর অনুমতি দেয় বেবিচক। ১১ জুন এর সঙ্গে যুক্ত হয় যশোর। এরপর ১৬ জুন থেকে কাতার ও যুক্তরাজ্যে এবং ২১ জুন থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ফ্লাইট চলাচলের অনুমতি দেয় বেবিচক। আগামী ১ জুলাই থেকে তুরস্কেও ফ্লাইট চলাচল শুরু হতে পারে।

কিন্তু দেশে করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় যাত্রীদের আস্থা এখনো ফেরেনি। অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী–সংকটে ধুঁকছে বিমান সংস্থাগুলো। প্রতিদিন গড়ে হাজারখানেক যাত্রীও মিলছে না। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ১ জুন ঢাকা-সৈয়দপুর-ঢাকা রুটে মাত্র দুটি ফ্লাইট চালিয়েছে। এরপর থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে লাগাতার ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে তাদের। অন্য দুটি বিমান সংস্থা ইউএস–বাংলা ও নভোএয়ারের প্রতিদিনই বেশ কয়েকটি ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে। ১ জুন থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত ঢাকার সঙ্গে চারটি রুটে ১৬ হাজার ৩৫৮ জন যাত্রী আসা-যাওয়া করেছেন।

এই পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি বলে জানান বিমান সংস্থাগুলোর কর্তাব্যক্তিরা। অ্যাভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) মহাসচিব ও নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মফিজুর রহমান বলেন, করোনা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। রেড জোন কোথায় হবে, কোথাও গেলে আটকে পড়তে হবে কি না, এসব চিন্তা যাত্রীরা করছে। কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি না হলে যাত্রীরা সহজে ফিরবে না। এখন ২০১৯ সালের মতো অবস্থা নেই যে সৈয়দপুরে এক দিনে ১৫টি ফ্লাইট চলবে। তাই পরিস্থিতির কারণে একেবারে স্বল্প পরিসরে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চলবে। তবে আপাতত বন্ধ হবে না।

১৬ জুন থেকে বর্তমানে কাতার, যুক্তরাজ্য ও আরব আমিরাতের সঙ্গে সরাসরি ফ্লাইট চলছে। আর আগে থেকে চীনের গুয়াংজুতে ইউএস–বাংলার ফ্লাইট চলাচল করছিল। সব মিলিয়ে চারটি দেশের সঙ্গে ঢাকায় ফ্লাইট চালু রয়েছে। তবে কাতার ও আমিরাতে কেবল ট্রানজিট যাত্রীরা ঢাকায় আসা-যাওয়া করছে। ঢাকা থেকে কাতারের দোহায় সপ্তাহে তিন দিন কাতার এয়ারওয়েজ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে তিনটি করে ফ্লাইট পরিচালনা করছে এমিরেটস এয়ারওয়েজ। বিমান যুক্তরাজ্যের লন্ডনে প্রতি রোববার একটি করে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। তাই বর্তমানে শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রতি সপ্তাহে আটটি আন্তর্জাতিক যাত্রীবাহী ফ্লাইট চলছে। এর সঙ্গে কিছু বিশেষ ও চার্টার্ড ফ্লাইটও চলাচল করছে। কিন্তু এই বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রী চলাচলের সংখ্যা প্রতিদিন শ পাঁচেকও হচ্ছে না। অথচ করোনা পরিস্থিতির আগে শাহজালাল বিমানবন্দরে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে প্রতিদিন দেড় শর মতো ফ্লাইট ওঠা–নামা করত। চলাচল ছিল ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার যাত্রীর।

চারটি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চললেও বর্তমানে দেশে ফিরছেন কম যাত্রী। বিপরীতে দেশ ছাড়ার মাত্রা বেশি। করোনা পরিস্থিতি বিশ্বের অধিকাংশ দেশে উন্নতির দিকে রইলেও বাংলাদেশে অবনতি হওয়াই এর প্রধান কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁদের মতে, করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে শাহজালাল বিমানবন্দর আগের রূপে ফিরতে আরও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে।

অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম বলেন, দেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না, অবনতিই হচ্ছে। অনেক দেশই বাংলাদেশিদের ভিসা দিচ্ছে না। করোনা মোকাবিলায় দেশে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার নিম্নমুখী হয়। তাতে দেশি–বিদেশি ব্যবসায়ীদের আস্থা আসবে। তাঁরা আবারও আসা-যাওয়া করতে পারবেন। তা না হলে শাহজালাল বিমানবন্দর শিগগিরই প্রাণ পাবে না।

দেশে আসার চেয়ে, বিদেশ পাড়ি জমানো যাত্রী বেশি বলে জানান বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান। তিনি বলেন, শিডিউল ফ্লাইটগুলোতে বিদেশ থেকে এখন দেশে ফিরছেন কমসংখ্যক যাত্রী। তবে ঢাকা থেকে ফিরতি ফ্লাইটে বেশ ভালোই যাত্রী থাকছেন। জুলাই থেকে টার্কিশ এয়ারলাইনস ঢাকায় ফ্লাইট আবারও চালু করতে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসও অনুমতি চেয়েছে। পরিস্থিতি কী হয়, তা ভবিষ্যতের ওপর নির্ভর করবে।