স্বপন কুমার সিকদার : বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস মূলত পাকিস্তানের অপশাসন, নির্যাতন ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। এই স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে যুক্ত হয়ে আছে পাক-হানাদার ও তার দোসরদের অবর্ণনীয় অত্যাচার ও নির্যাতনের কাহিনী। যেমন-চোখের সামনে নিজের বাড়িঘরে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও বাস্তুহারা করা; চোখের সামনে যুবতী নারীদের চুল-মুঠি দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া, সুন্দরী নারীদের জোর করে বিয়ে করার চেষ্টা করা, নিজেকে বাঁচানোর জন্যে ধর্মান্তরিত হওয়ার বেশভূষা ধারণ, যুবতী নারীদের মা-বাবা বা স্বামীর সামনে বিবস্ত্রকরণ ও নির্যাতন, স্ত্রীকে সারা জীবনের জন্য স্বামীর সোহাগ থেকে কিংবা সন্তানকে চিরদিনের জন্য বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত করা, মা ও বাবার চিরদিনের জন্যে সন্তান হারানোর বেদনা, পরিধেয় বস্ত্র খুলে পুরুষদের বেলায় হিন্দু না মুসলিম পরীক্ষা করা, হিন্দু বা মুক্তিযোদ্ধা বলে সন্দেহ হলে গাড়ি থেকে নামিয়ে ঘরে আটকিয়ে রাখা ও অকথ্য নির্যাতনের পর রাতে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া বা গণকবর দেয়া, গ্রামে হত্যা ও অগ্নিসংযোগ তথা অপারেশনে গিয়ে তিন ছেলেকে পাক বাহিনীর গুলি করার জন্য দাঁড় করানোর পর ঝোপ-ঝাড়ে লুকিয়ে থাকা বৃদ্ধ বাবা বের হয়ে পাকবাহিনীকে নিজেকে গুলি করা ও ছেলেদের গুলি না করার জন্যে শত আকুতি মিনতি করা সত্বেও প্রথমে বাবাকে ও পরে পর পর তিন ছেলেকে পাকবাহিনীর নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করার মত ঘটনা, চিরদিনের জন্যে পঙ্গু হওয়া, মৃত্যুর মুখ থেকে ভাগ্যক্রমে অনেকের রাজাকার ও পাক-হানাদারদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া, শিশু ও বৃদ্ধসহ প্রায় এক কোটি লোকের শাপদসংকুল দুর্গম পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে বা সাধারণ পথে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে ডাকাতের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারানো বা আত্মীয় কেউর পথিমধ্যে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু বরণ করার পরও শরণার্থী হিসাবে বাদবাকীদের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ ও অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হওয়া, ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও কয়েক লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর অতীব বেদনাদায়ক ইতিহাসসহ আরো অনেক কিছুর বেদনাপূর্ণ ইতিহাস।
আমি নিজেও দুইবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসি এবং বহু আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব হারিয়েছি এই সময়ে। আবার স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে যুক্ত হয়ে আছে অনেক বীরত্বপূর্ণ ঘটনাও। যেমন-যুদ্ধকালীন সময়ে মানুষের উপর যারা অত্যাচার করেছে তাদের সবার চোখের সামনে ধরে নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ কর্তৃক রাতে হত্যা করা, পাকবাহিনী ও রাজাকারদের আস্তানায় বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের বীরত্বপূর্ণ আক্রমণ ও বিজয় লাভ, মোটামুটিভাবে যুদ্ধকালীন সময়ে গ্রামে-গঞ্জে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিভিন্ন রণাঙ্গনে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের বিজয়ের খবর পরিবেশন ও দেশাত্মবোধক গান পরিবেশনের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের আপামর জনগণকে উজ্জীবিত করা বা রাখা, বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের দেশের মাটি বা সবুজ প্রান্তর টগবগে রক্তে রঞ্জিত করা এবং আরো অনেক কিছুসহ শেষ পর্যন্ত মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর কাছে হানাদার পাকবাহিনীর আত্মসমর্পনের গৌরবোজ্বল ইতিহাস।
“পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল”। “এক সাগর রক্ত পেরিয়ে বাংলার স্বাধীনতা” যারা আনলো, আমরা তাদের স্বপ্নকে ভুলতে পারি না। সেই সূর্য সন্তান ও সকল শহীদসহ বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী জনতা তথা দেশের আপামর জনসাধারণ ষারা সেই দিনগুলিতে মানুষকে সাহায্য করেছেন, সমর্থন করেছেন, সাহস যুগিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তাদের সবাইকে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর এই দিনে হাজারো সালাম, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা। আর “ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা”। যতটুকু জেনেছি. দেখেছি ও বুঝেছি সেই ভাষা আন্দোলন (বা তৎপূর্ব) থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের এক চুল পরিমাণ ত্রæটিও পাইনি। আশ্চর্য হয়েছি (আশ্বস্তও হয়েছি) এই ভেবে যে, দেশকে বঙ্গবন্ধু কতটুকু ভালোবাসলে জেল থেকে বের হয়েই এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে বলতে পারেন “এই বাংলার মাটিতেই যেন আমার কবর হয়”। স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছরে আমাদের অনেক অর্জন আছে। আরো অনেক দূর যেতে হবে।
“বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন এক হউক”। এত দুঃখ-কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হলো তাকে অর্থবহ করা তথা সুখী ও সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়ার জন্যে মহান নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা যাতে বাস্তবায়িত হয় স্বাধীনতার এই সুবর্ণ জয়ন্তীতে সেই প্রার্থনাই করি পরম করুনাময়ের কাছে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : টরন্টো, কানাডা