ডঃ বাহারুল হক : ভ্যানকুভার থেকে আমার বেয়াই বেয়াইন এসেছেন টরন্টো। আমার অতিথি হয়ে আমার বাসায় আছেন। গত কাল দুই জনকে নিয়ে দুপুর বেলা গেলাম বøাফারস পার্কে। প্রচন্ড রোদ; তবুও হাঁটছি লেকের পার ধরে। সারা পার বিরাট বিরাট পাথরের খন্ড রেখে ভারি সুন্দরভাবে বাধানো। শুধু বাধানো নয় পাথর খন্ডগুলোকে একটা আরেকটার উপর বসিয়ে রীতিমত দেয়াল বানানো হয়েছে যাতে দর্শনার্থীরা দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে ঝুপ করে লেকে পড়ে না যায়। এক জায়গায় নিচু এই দেয়ালের কিছু অংশকে রাজবাড়ির ঘাটের মত করা হয়েছে। সেখান দিয়ে দর্শনার্থীরা নিচে নেমে লেকের পানি ছুঁয়ে আসতে পারে। আমরাও নামলাম। নেমে লেকের পানিতে হাত পা ভিজালাম। খারাপ না ভালোই লাগলো লেকের ঠান্ডা পানিতে হাত পা ভিজিয়ে। পাথরের ঘাট বেয়ে আবারো উপরে। উপরে উঠে লেকের পার ধরে রোদ মাথায় নিয়ে আবারো হাঁটা। জলজ মাইক্রোস্কোপিক এক প্রানি এমিবার সিউডোপোডিয়ার মত লেকের পারের পানির দিকের একটি বর্ধিতাংশ চোখে পড়লো। চোখে পড়লো সেখানকার বড় বড় গাছগুলোও। আমরা চারজন এবার সেদিকে হাঁটা শুরু করলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেলাম। ঝাঁ ঝাঁ রোদ। কিন্তু গাছগুলোর নিচে ছায়া। তাকিয়ে দেখি দল বেঁধে সে ছায়ায় ঘুমাচ্ছে হাসের দল। বুঝেছি তারা আমাদের চেয়েও বেশি ক্লান্ত। কিন্তু আমরাও যে ক্লান্ত। গাছের নিচে ছায়ার মধ্যে পাতানো আছে দুইটি লম্বা বেঞ্চ আর সে বেঞ্চ দুইটির মাঝখানে একটি লম্বা টেবিল। ঘুমন্ত ক্লান্ত হাস গুলোকে বিরক্ত না করে সাবধানে হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম বেঞ্চ-টেবিলের কাছে। বেঞ্চির উপর বসে গেলাম আমরা চারজন। এবার আমার স্ত্রী সাথে থাকা পোটলাটা খুলে তরমুঝের খন্ড গুলো টেবিলের উপর রাখলেন। সবাই ক্লান্ত নয় শুধু দারুন তৃষ্ণার্তও বটে। ফলে তরমুজ শেষ হতে বেশি দেরি লাগলো না। আবার হাঁটতে থাকলাম। এবার গিয়ে বসলাম লেক পারের দেয়াল রুপ পাথর খন্ডের উপর।
চমৎকার বসার জায়গা। গাছের নিচে বলে বেশ ছায়া। যদিও আমি বসে পড়েছি আমার সাথি অপর তিনজন এদিক ওদিক হাঁটছে। হঠাৎ দেখি এক লোক আমার সামনে । লোকটার গলায় ঝুলছে দামি ক্যামেরা। লোকটা এদিক ওদিক করে বিক্ষিপ্তভাবে হাঁটছে। আর ছবি তুলছে। বিশেষ করে তুলছে পার থেকে দুরে দুরে লেকের পানিতে কিসের যেন ছবি। লোকটাকে এড়িয়ে চলার কোন উপায় নাই। তিনি আপনার দৃস্টি আকর্ষণ করবেনই। উচ্চতা কত আর! পাঁচ ফুট হয়ে এক দুই ইঞ্চি হতে পারে। তবে মুখাবয়বের দিকে তাকালে বুঝা যায় শরীরের উচ্চতা যাই হোক ব্যাক্তিত্বের উচ্চতা তার অনেক বেশি। গায়ের রঙ সাদা। মাথায় ক্রাউন সর্বস্ব একটা লো প্রোফাইল ক্যাপ যে ক্যাপের কোন ব্রিম নাই তবে সামনের দিকে আছে একটা বিল যা বলা যায় কপালের উপর ক্যাপের শক্ত বর্ধিতাংশ। বিল চোখ মুখকে রোদের ধমক থেকে রক্ষা করে।
রোদের তাপ চাপ থেকে রেহাই পেতে তিনি পরেছেন একটা কালো রঙের রোদ চশমা। গায়ে চড়িয়েছেন হাফ হাতার একটা আকাশি রঙের গেঞ্জি। আর ফুল বা হাফ পেন্টের পরিবর্তে একটা থ্রি কোয়াটার পেন্ট। সব মিলিয়ে তাকে সুদর্শন বলে প্রতিয়মান হচ্ছিল। আমাকে পেছনে রেখে চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন। তারপর আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন- তোমরা সবাই একত্রে দাঁড়াও, আমি ছবি তুলে দেব। ধেই ধেই করে বাকি তিনজন আমার কাছে চলে এলেন। লোকটা মুহুর্তের মধ্যে একেবারে ডিরেক্টর বনে গেলেন। কিভাবে কোথায় দাঁড়াতে হবে আমাদের তা বলে দিচ্ছেন। আমরা দাঁড়াচ্ছি আর তিনি ছবি তুলছেন। বুঝলাম জাত ফটোগ্রাফার। ফটো তোলা শেষ। তিনি চলে যাচ্ছেন। আমি যেতে দিলাম না। দাঁড় করিয়ে রাখলাম। লোকটাকে আরো ভালো করে দেখলাম। বয়স সত্তর হবে বা তার চেয়ে কম ও হতে পারে। সাজ পোশাকে বেশ স্মার্ট। গলায় সোনার চেন একটা আছে। সবচেয়ে বড় কথা- তিনি হাসছেন না কিন্তু তার বন্দি হাসিটা তার মুখের ভাজে ভাজে দুচোখে একেবারে প্রকট হয়ে ঝরে পড়ছে। আমি বললাম- “তুমি কি পর্যটক না এখানকার বাসিন্দা”? উত্তরে সে খুব দৃড়তার সাথে বেশ গর্ব করে বললো- “আমি পর্যটক নই। টরন্টো আমার,আমি টরন্টোর”। বুঝলাম, টরন্টো তার প্রানের শহর। তারপর বললাম- “তা কত বছর ধরে আছ এই শহরে”? তিনি বললেন- “আমি বিশ বছর বয়সে এসেছি টরন্টো, এখন আমার বয়স সাতাত্তর বছর । এবার তুমি হিসেব করে দেখ কত বছর আছি এই শহরে”। এবার আমি আর তাকে জানার কৌতুহল চাপা দিতে পারলাম না। আমি বললাম- “তুমি প্লিজ তোমার সম্মন্ধে বল। আমি জানতে খুব আগ্রহি”। লোকটি বলতে লাগলো- “আমার নাম এডাম ইনামুয়েল। আমি জাতিতে একজন পর্তুগিজ।
পর্তুগালে আমার জন্ম। পাঁচ বছর বয়সী আমাকে নিয়ে আমার মা বাবা চলে যান আটনান্টিক মহাসাগরের কুলে অবস্থিত উত্তর আফ্রিকার তেল সমৃদ্ধ দেশ এঙ্গোলা। দশ বছর পর সেখানে হঠাৎ একদিন আমার বাবা মারা যান। আমার বয়স তখন পনের বছর। বাবা মারা গেলে মাকে নিয়ে আমি পর্তুগাল ফিরে গেলাম। পর্তুগালে আমি এক মেয়ের প্রেমে পড়লাম। তাকে বিয়ে করলাম। তখন আমার বয়স সতের বছর। আমার বিয়ের এক বছর পর আমার একটা ছেলে হল। আমার ছেলেকে পেয়ে আমার মা কি যে খুশি! সারাদিন নাতি নিয়েই থাকতেন মা আমার। কিন্তু আমার মায়ের আনন্দ বেশি দিন দেখতে পেলাম না। আমার মা আমার বাবার মত হঠাৎ মারা গেলেন। বাবাকেতো আগেই হারিয়েছি। মাকে হারিয়ে অন্য রকম হয়ে গেলাম আমি । স্ত্রী পুত্রকে আরো বেশি করে বুকের মধ্যে চেপে ধরলাম। তারপর হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম- কানাডা চলে যাব স্ত্রী পুত্র নিয়ে। চলে এলাম। তখন আমি বিশ বছর বয়সী এক যুবক”। আমি হেসে বললাম- “তুমি এখনও যুবক”। আমার কথা শুনে এডাম একটা অট্টহাসি দিল। আমি ছাড়ছিনা এডামকে। বললাম- “স্ত্রী সন্তান নিয়ে এখন তোমার কি জীবন”? এডাম বললো- “আমার চার সন্তান- দুই ছেলে দুই মেয়ে। এই চারজন থেকে পেয়েছি আট জন নাতি নাতনী। এক নাতির একটা ছেলে হয়েছে দুই বছর আগে। আরেক নাতনীর বাচ্চা হবে আগামী মাসে।
ছিলাম একা, হলাম ফাদার,তারপর হলাম গ্র্যান্ড ফাদার, তারপর হলাম গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদার। আর কি চাই”? তাইতো, আর কি চাওয়ার আছে? বিদায় নিতে যাচ্ছে ঠিক সে মুহুর্তে আমি এডামকে বললাম- “তুমি কি ভাস্কো-ডা- গামার নাম শুনেছ? সে কে”? সহাস্যে এডাম উত্তর দিল- “হাঁ, আমি জানি। সে জগৎ বিখ্যাত এক পর্তুগিজ নাবিক এবং এক্সপ্লোরার”। তারপর জানতে চাইলাম গোয়া কোথায় এবং পর্তুগালের সাথে গোয়ার কি সম্পর্ক। এডাম উত্তর দিতে দেরী করেনি। তার উত্তর- “গোয়া ভারতে এবং চার শত বছর গোয়া ছিল পর্তুগালের একটা কলোনি”। আমি অবাক হলাম এডামের উত্তর শুনে। একজন সাধারন পর্তুগিজ এসব জানে! আর আমাদের কি অবস্থা? ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রী নেয়া কয়জন জানে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে অপরাজেয় বাংলা নামে যে ভাস্কর্য আছে তার নির্মাতা কে? অবশ্য এটা নিয়ে আমার সহকর্মী একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাস্কর অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল্লাহ খালেদের কোন আফসোস ছিলনা। এডাম বিদায় নিল। আমি এডামের চলে যাওয়া দেখছিলাম। কি সুখি একজন মানুষ! জীবনকে কত সুন্দরভাবে উপভোগ করলো! টরন্টোতে এমন মানুষ কয়জন আছে?