বনানী বাবলী : সত্তর কিংবা আশির দশকের কথাই ধরা যাক। বেশি দূরে নয়। তখন প্রতিটা এলাকাতে একটা করে হয় মাঠ নয় তো খোলা জায়গা ছিল শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার জন্য। পাড়ায় পাড়ায় ছিল ক্লাব এবং যেখানে তৈরী হতো হাতে লিখা দেয়াল পত্রিকা, তৈরী হতো আগামী দিনের লেখক। সেখানে হতো সৃজণশীলতার প্রকাশ, খেলাধুলা, হতো ক্যারাম প্রতিযোগিতা। আর বৃষ্টির দিনে পাশের বাড়ির সুদিপা কাকীর বাড়ি যাওয়া ছিল আমাদের ছোটদের পৃথিবীর অজানা রহস্যের প্রবেশাধিকার। সেই কাকী মসজিদ, মন্দির, মাজার, গির্জার ছবি বা এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি দেখলেই করজোড়ে প্রণাম করতেন। আমরা ছোটরা তাঁকে প্রশ্ন করতাম এবং বলতাম, “ওটাতো মুসলমানদের কিংবা ওটাতো খ্রিস্টানদের, তুমি কেন প্রণাম করো?” তিনি হেসে বলতেন, “যে নামেই ডাকো না কেন – সে যে ঈশ্বরের বাস।”

স্কুল ছুটির দিনে দুপুরের খাওয়ার পরই মাথায় একটা চিন্তাই কাজ করতো এবং সেটা হলো কখন ঘরের পাশের মাঠে খেলতে যাবো। সেই সব দিনের কোনও এক বিকালে আমি আর আমার পাশের বাড়ির বন্ধু রুবিনা দুইজনে মাঠের পাশের মোটা আম গাছের পেছনে লুকিয়ে আছি। লুকোচুরি খেলছিলাম আরও কয়জন বন্ধুদের সাথে। আমরা দুই বোকা লুকিয়ে আছি তো আছি। কোথাও কোনও সারা শব্দ নেই। আমরা দুইজনে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ওরা আমাদের খুঁজছে কি অথবা খেলা শেষ হলো কি কিংবা অন্যরা গেলো কোথায়? বিকাল প্রায় শেষ হওয়ার পথে। তারপর আমরা হাঁটছি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরার জন্য। পুকুরের রাস্তা পেরিয়ে তবেই আমাদের বাড়ি পৌঁছতে হবে। কিন্তু “পরবি পর মালির ঘাড়ে”। পাড়ার গনি চাচা দাঁড়িয়ে আছেন পুকুর পাড়ে কোমড়ে হাত রেখে। আমরা কাছে আসতেই বললেন, “পূজার আরতি শুরু হইয়া গেল, মসজিদে আজানও হইয়া গেল কিন্তু তোমাগো খেলা শেষ হইল না। যাও, ঘরে যাও-ও।” এই ছিল আমাদের শৈশবের সমাজচিত্র। একটি কিশোর বা কিশোরীকে শাসন করার অধিকার ছিল শুধু পরিবারের নয়, পাড়া প্রতিবেশীরও সেই অধিকার ছিল। ইংরেজিতে একটা কথা আছে ….. A village raise a child.

আমাদের পাড়ায় দল বেঁধে মিলাদের চাঁদা চাইতে যেমন আসতো, ঠিক তেমনি আসতো পূজার চাঁদা তুলতে ছেলেরা। কোথায় গেল আমাদের সেই মায়ার বন্ধন, সৌহার্দ্য, স¤প্রীতি? এ কোন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ দেখতে পাচ্ছি। এ কেমন মাতৃভূমির চিত্র দেখছি। “মনে পরে শৈশবে বাংলাদেশের প্রতিটা ধর্মীয় উৎসবগুলি আমাদের ছোটদের জীবনে কত খুশির বার্তা নিয়ে আসতো। ঈদ মানেই যত রকম মজার সেমাই। আর শারদীয় দুর্গাপূজার মূল আকর্ষণই ছিল পূজামণ্ডপের মায়ের প্রসাদ। বুদ্ধ পূর্ণিমার সন্ধ্যার ফানুস উড়ানোর উৎসব কিংবা বড়দিনের কেক, ভোলাই যায় না। নুতন জামায় আর রঙিন চুলের ফিতেয় নিজেদের সাজিয়ে আমরা সব বন্ধুরা বেড়াতাম অন্য বন্ধুদের ঘরে ঘরে, প্রতিটা ধর্মীয় উৎসবে (বাংলাদেশ তোমারই জন্য – পুস্তকের অংশবিশেষ )।”

গত সপ্তাহের অনলাইন Bangla Hunt News এর একটা হেডিং এ নজর আটকে গেলো ….. “ভারতে যেন এমন কিছু না হয়, যার জন্য বাংলাদেশের হিন্দুদের ভুগতে না হয়! কুমিল্লা নিয়ে হুঁশিয়ারি হাসিনা … “আর চীনের উইঘরে যে সংখ্যালঘু মুসলমানদেরকে নির্যাতন করছে সেটা? না, চীনের নাম উল্লেখ করা যাবে না।

চীনের বিরুদ্ধে রাস্তা জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ দিয়ে স্লোগানও দেয়া যাবে না। কারণ কিছু বললে যদি বাংলাদেশে বিশাল বিনিয়োগ বন্ধ করে দেয় চীন?

ভারতে কিংবা চীনে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হলে যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নির্যাতিত হতে হবে সেটা কেন? কিন্তু অন্য দেশের খারাপ উদাহরণ গুলি না টেনে আমাদের দেশ অন্যান্য দেশের ভালো উদাহরণগুলি নেয়াই তো উচিত। উদাহরণ নিন কিংবা শিখুন উন্নত দেশগুলি থেকে যেখানে সংখ্যালঘুদের স্বপক্ষে যে পদক্ষেপ নিয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এইতো কিছুদিন আগে কানাডার অন্টারিও প্রভিন্সের লন্ডন শহরের Hyde Park রোডে (২০২১ জুন মাসের ৬ তারিখে) এক বিশ বছরের তরুনের ইসলামোফোবিয়ার কারণে এক মুসলমান পরিবারের চার জনকে ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ির ধাক্কা দেয় এবং ফলস্বরূপ চারজনই নিহত হন। রাষ্ট্র কী করেছে? রাষ্ট্র অপরাধীকে আদালতের বিচার করেছে এবং সেই চারজন নিরপরাধ নাগরিককে কানাডার পতাকা কফিন দিয়ে ঢেকে সম্মান জানিয়েছে শেষ বিদায়ের দিন। এই অপরাধের যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয় সেই জন্য সাধারণ মানুষ এবং মিডিয়া সোচ্চার হয়েছিল একই সাথে। একটি দেশের নাগরিকের জীবন, তার ধর্মীয় অধিকার ক্ষুন্ন হলে দায় কার? চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে দুর্গাপূজার মণ্ডপে নিহত মানিক সাহার পরিবারের স্বজন হারানোর আহাজারি কি আমাদের মনে এতোটুকু দোলা দিচ্ছে? চলুন নিজেদের প্রশ্ন করি। আমাদের একাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতেই হবে। যেখানে বঙ্গবন্ধুর চার মূলনীতির (গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ) সংবিধান প্রশংসিত ছিল পৃথিবী জুড়ে।
আসুন ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধে উঠে আমরা মানুষকে ভালোবাসি।

নেলসন মেন্ডেলা বলেন, “Education is the most powerful weapon which you can use to change the world.”
দালাই লামা বলেন, “Our own brain, our own heart is our temple; the philosophy is kindness.”

আজ ভাবছি কোথায় গেলেন সেই পাড়ার চাচা চাচীরা যাঁরা তৈরী করেছিলেন স¤প্রীতির সমাজ? স¤প্রতি খুলনা, চাঁদপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ এবং আরও অন্যান্য জায়গার শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে মন্দিরে হামলার দুঃখজনক ঘটনাগুলি বিবেককে দংশন করে। জানি না এর আদৌ কোনও প্রতিকার বা সমাধান আছে কী না। আমরা সাধারণ নাগরিক শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবো। কারণ মন্দির ভেঙ্গেছে তো আমার কী, মা দুর্গার প্রতিমা ভেঙেছে তো আমার কী? আর পূজামণ্ডপে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তাতে আমার কী? আর রাষ্ট্র? সেতো ঠুঁটো জগন্নাথ।