Home কলাম সের্গেই আইজেনস্টাইন চলচ্চিত্রের শেরপা

সের্গেই আইজেনস্টাইন চলচ্চিত্রের শেরপা

মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।

এগার.
‘স্ট্রাইক’ চলচ্চিত্রের কাজ করতে গিয়েই আইজেনস্টাইনের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে এমন দুজন প্রতিভাবান মানুষের যোগাযোগ হয়েছিল, যাঁদের সহযোগিতা অক্ষুন্ন ছিল তাঁদের সারা জীবন ধরেই। এই দুইজন মানুষ হলেন সহকারী পরিচালক গ্রেগরি আলেকজান্দ্রভ এবং আলোকচিত্রশিল্পী এডওয়ার্ড টিসে। টিসের আলোকচিত্র গ্রহণের কাজ কখনো কখনো চিত্রকলার পর্যায়ে উন্নীত হয়ে যেত। বিভিন্ন দৃশ্য এবং ফ্রেমের গঠনশৈলীর অনন্যতা এবং সস্পাদনার নৈপুণ্য ছবিটিকে স্মরণীয় করে তুলল। এই চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় যথার্থই লিখেছেন, ‘স্ট্রাইক’ ছবিতে আইজেনস্টাইন সোভিয়েত চলচ্চিত্রে বিপ্লব আনলেন। তথাকথিত পট বা কাহিনীর অনুপস্থিতি, কেন্দ্রস্থ’ কোন নায়ক চরিত্রের অনুপস্থিতি- এসব ছিল তখনকার যুগে অভাবনীয়। ‘স্ট্রাইক’-এর বিষয়বস্তু হল একটি প্রাক্-বিপ্লব ধর্মঘট, কিভাবে সে ধর্মঘটের সূত্রপাত হল এবং কিভাবে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের উপর বলপ্রয়োগ করে ধর্মঘট ভেঙে দিলেন। এই সরল কাঠামো অবলম্বন করে সুনির্বাচিত টাইপ চরিত্র, দৃশ্যপট ও ডিটেলের সাহায্যে এবং সম্পাদনা ও দৃশ্য পরিকল্পনার কৃতিত্বে আইজেনস্টাইন ‘স্ট্রাইক’ ছবিতে আশ্চর্য নাটকীয় আবেগের সঞ্চার করলেন। আইজেনস্টাইন যে সম্পাদনা রীতির উদ্ভব করেছিলেন তাকে তিনি ‘মন্তাজ অফ অ্যাট্টাকশনস্’ আখ্যা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তাঁর মতে ছবির প্রতিটি শট্-এ এমন উপাদান থাকবে যার একক অর্থ হবে, আবার অর্থ হবে শট্-এর সংযুক্ততে, এমন সব শট দর্শকদের মনকে ক্রমাগত আকৃষ্ট আর উদ্বেলিত করবে। এই ছবিতে তিনি সফলভাবে মন্তাজের ব্যবহার করেন, তখনো আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের কোন পরিচালক এত সফলভাবে তাদের ছবিতে মন্তাজের ব্যবহার করেননি। আইজেনস্টাইনের মন্তাজের ব্যবহার তাঁর ছবির মূল বক্তব্য শুধু ফুটিয়ে তুলতে সহায়তা করে না বরং দর্শকের মনে পর্দায় প্রদর্শিত দৃশ্য সম্পর্কে নিজের মত করে চিন্তা করার একটা ক্ষেত্র তৈরি করে। ‘স্ট্রাইক’ ছবির একটি দৃশ্যের কথা একটু ভাবলেই আমাদের বিস্মিত হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। চলচ্চিত্র শিল্প বিকাশের শুরুর দিকে কত বেশি সুক্ষ্ম ও শক্তিশালীভাবে আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।

স্ট্রাইক চলচ্চিত্রের পোস্টার

‘স্ট্রাইক’ ছবির একটি দৃশ্যে আছে-
কসাইয়ের ছুরিকে এড়ানোর জন্যে একটা ষাঁড় ভীষণভাবে মাথাটা ঝাকাচ্ছে ছবির ফ্রেমের ওপরের অংশ ছাড়িয়ে।
(ক্লোজ আপ্) ছুরিধরা হাত নিচের ফ্রেমলাইন ছাড়িয়ে জোরে আঘাত করে।
(লং শট্) ১৫০০ জন একটা ঢালু জমি দিয়ে নেমে আসছে।
৫০ জন জমি থেকে উ’চু হয়ে উঠছে হাতগুলো ছড়িয়ে।
একজন সৈনিক গুলি চালানোর জন্যে লক্ষ্য ঠিক করছে।
(মিডিয়াম্ শট্) বারুদের আগুন নিয়ে গুলি বেরিয়ে এলো।
ষাঁড়ের কম্পিত দেহটা গড়িয়ে পড়ে। ফ্রেমের বাইরে তার মাথা।
(ক্লোজ-আপ্) ষাঁড়ের পাগুলো ভীষণ ঝাঁকুনি দিচ্ছে। তার ক্ষুর রক্তাক্ত।
(ক্লোজ-আপ্) রাইফেলের পেছনের অংশ।
ষাঁড়ের মাথাটা একটা বেঞ্চের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে।
১০০০ জন ক্যামেরাকে দ্রæত অতিক্রম করে চলে যায়।
ঝোপের আড়াল থেকে একদল সৈন্য বেরিয়ে আসে।
(ক্লোজ-আপ্) অদেখা আঘাতে ষাঁড়ের মাথাটা মৃত্যুতে ঢলে পড়ে, তার চোখগুলো জলন্ত।
(লং শট্) সৈন্যদের পেছন থেকে গুলিবর্ষণ দেখা যায়।
(মিডিয়াম শট্) ষাঁড়টির পাগুলো এক সাথে বাঁধা হয়, মাংস কাটার প্রস্তুতি হিসেবে।
(ক্লোজ-আপ্) একটা পাড়ে মানুষেরা গড়িয়ে আসছে।
ষাঁড়টির গলাকাটা, রক্ত বয়ে যাচ্ছে।
(মিডিয়াম ক্লোজ-আপ্) ছবির ফ্রেমে মানুষেরা উঠে আসে, তাদের হাত ছড়ানো।
কসাই ক্যামেরা অতিক্রম করে যায় (প্যানিং) তার রক্তাক্ত দড়ি দুলিয়ে।
এক দল লোক একটা বেড়ার দিকে ছুটে যায়, আর সেটা ভেঙে ঢোকার পরে তার পেছনে লুকোয়।
ফ্রেম থেকে হাত ঝুলে পড়ে।
ষাঁড়ের মাথাটা দেহ থেকে কাটা।
গুলিবর্ষণ।
এক দঙ্গল মানুষ ঢালু জমি বেয়ে জলে গড়িয়ে পড়ে।
গুলিবর্ষণ।
(ক্লোজ-আপ্) বন্দুকের নল থেকে বুলেট ছোঁড়া হচ্ছে।
সৈনিকদের পা এগিয়ে চলেছে ক্যামেরা থেকে দূরে।
জলে রক্ত ভাসছে, জলের রং বদলাচ্ছে।
(ক্লোজ-আপ) ষাঁড়টির কাটা গলা থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছে।
একটা হাতে ধরা পাত্র থেকে বালতিতে রক্ত ঢাকা হচ্ছে।
রক্তের বালতি ভরা ট্রাক, (ডিজলভ্) লোহা-লক্কর ভরা ট্রাক। কাটা গলার মধ্য দিয়ে ষাঁড়টির জিভ টানা হচ্ছে।
সৈনিকদের পা দেখা যায় ক্যামেরা ছেড়ে আরো এগিয়ে চলেছে।
ষাঁড়টির ছাল ছাড়ানো হয়েছে।
১৫০০টি দেহ খাড়া ঢিবির পাদদেশে পড়ে আছে।
২টি ছাল-ছাড়ানো ষাঁড়ের মাথা।
একটা হাত রক্তের মধ্যে পড়ে আছে।
(ক্লোজ-আপ্) সমস্ত পর্দা জুড়ে, মৃত ষাঁড়টির চোখ।
(টাইট্ল্) শেষ।

১৯৩০ সালের জুন মাসে হলিউডে অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ওয়াল্ট ডিজনি’র (ডান থেকে দ্বিতীয়) সাথে সের্গেই আইজেনস্টাইন (বাম থেকে দ্বিতীয়), আইজেনস্টাইনের সহকারী পরিচালক গ্রেগরি আলেকজান্দ্রভ (সব বামে) এবং আলোকচিত্রশিল্পী এডওয়ার্ড টিসে (সব ডানে)

সের্গেই আইজেনস্টাইন যে চলচ্চিত্রের জন্য বিশ্বের চলচ্চিত্র পিপাসু মানুষের কাছে আজীবন শ্রদ্ধার আসনে থাকবেন, সেটা হচ্ছে ১৯২৫ সালে তাঁর নির্মিত দ্বিতীয় ছবি ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’। ১৯২৫ সাল ছিল ১৯০৫-এর পোটেমকিন যুদ্ধ জাহাজের বিপ্লবের কুড়ি বছর পূর্তি। সোভিয়েত রাশিয়ার সরকার ১৯০৫-এর বিপ্লবের ইতিহাস চিত্রায়িত করার জন্য আইজেনস্টাইনকে দায়িত্ব দিলেন। প্রাথমিকভাবে ছবির নাম ঠিক হয়েছিল ‘১৯০৫’। ছবির চিত্রগ্রহণের জন্য আইজেনস্টাইন মস্কো থেকে গেলেন ওডেসা শহরে। ওডেসা শহরের পটভূমিতে ডক শ্রমিকদের ধর্মঘট এবং পোটেমকিন যুদ্ধ জাহাজের নাবিকদের বিদ্রোহ সেখানেই চিত্রিত করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ওডেসা বন্দরে এসে সমুদ্রের ধারের পাথর বসানো দীর্ঘ এবং প্রশস্ত সিঁড়ির ধাপগুলি দেখে আইজেনস্টাইন তাঁর পূর্ব পরিকল্পনা পরিবর্তন করলেন। মূল চিত্রনাট্যে পোটেমকিনের ঘটনাবলী এবং ওডেসা বন্দরে গণহত্যার প্রসঙ্গটি মাত্র বিয়াল্লিশটি শটে তোলা হবে বলে ঠিক করা ছিল। নতুন চিত্রনাট্যে তিনি অন্য সমস্ত ঘটনা বাদ দিয়ে কেবলমাত্র পোটেমকিন জাহাজের ঘটনাবলী নিয়েই এই পুরো ছবি করার সিদ্ধান্ত নেন। এক ঘন্টা পনের মিনিটের নির্বাক এই ছবিটি পাঁচটি অংশে বিভক্ত। ছবির শুরুতেই পর্দায় ভেসে আসে সমুদ্রের ঢেউ আচড়ে পড়ার দৃশ্য। সমুদ্র তীরের পাথরের উপর উত্তাল ঢেউয়ের আচড়ে পড়া দৃশ্য উপস্থাপিত করে পরিচালক প্রথমইে দর্শকদের স্মরণ করিয়ে দেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে উঠা মানুষের প্রতিবাদের ছবি এটি। পর্দায় ভেসে আসে ১৯০৫ সালে মহামতি লেনিনের এক মহান উক্তি, ‘বিপ্লবও যুদ্ধ’। তবে ইতিহাসে আমরা যত ধরনের যুদ্ধের কথা জানি, তার মধ্যে বিপ্লব নামের এই যুদ্ধ সবচেয়ে ন্যায় সঙ্গত, যথার্থ, ঠিক ও মহান যুদ্ধ… রাশিয়ায় এই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এ ছবির প্রথম অংশের নাম ‘মানুষ ও মাংসকীট’ The men and the Maggots. সমুদ্রে পোটেমকিন জাহাজের দুই নাবিক মাতুসেনকা ও ভাকুলিনচুক-এর ডেক-এ বিপ্লব সম্পর্কিত আলোচনার মাধ্যমেই মূলত শুরু হয়ে যায় ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ ছবির যাত্রা। তারা দু’জনেই রাশিয়ার আসন্ন বিপ্লব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ এবং এমন সময়ে বিপ্লবে অন্যান্য পেশাজীবি এবং সাধারণ মানুষদের পাশে দাঁড়ানো তাদের নৈতিক দায়িত্ব বলে তারা মনে করেন। কিন্তু জাহাজের সাধারণ নাবিকদের বিপ্লবের মন্ত্রে তারা উদ্দীপ্ত করতে ব্যর্থ হন। তবে ঘটনার কিছুটা মোড় ঘুরে যায় পরের দিন সকালে। তারা আবিস্কার করেন তাদের যে মাংসের স্যুপ খাওয়ানো হচ্ছে তা পচা এবং পোকাযুক্ত। তাদের হৈচৈ-এ সিনিয়র অফিসার গিলিয়ার ভোস্কি এবং ডাক্তার শ্রিমিমোভ ছুটে এসে মাংস পরীক্ষা করে পোকা দেখতে পেলেও তারা সমুদ্রের নোনা জলে পোকাগুলো ধুয়ে স্যুপ করে খেয়ে নিতে বলে। সৈনিকদের প্রতি ডাক্তার ও অফিসারের তাচ্ছিল্যকর ব্যবহার দর্শকদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেই সময়কার রাশিয়ার নীচু সমাজের প্রতি উচ্চ সমাজের মনোভাব এবং রাশিয়ার বিপ্লব কেনো অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। স্যুপ রান্না হলো, কিন্তু নাবিকরা তা খেলো না। এমনকি যে খাবার ঘরের ওয়েটার প্রতিবাদের ঝামেলায় যেতে ইচ্ছুক ছিলেন না, তিনিও পেট ধোঁয়ার সময় পেটে খোদিত করা ‘সুদিনের আহŸান ও সুন্দর ক্ষুধাহীন দিন’ লেখা দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। যে পেটটি ধুচ্ছিলেন সেটিকে ক্রোধের সাথে ছুঁড়ে ফেলেন তিনি। তারপরই শুরু হয়ে যায় ছবির পরবর্তী অংশ ‘কোয়াটার ডেকের নাটক’ (Drama on the Quarterdeck).

“ব্যাটলশীপ পটেমকিন” চলচ্চিত্রের ‘ওডেসার সিঁড়ি’র হত্যাকান্ডের দৃশ্য

পোকাযুক্ত মাংসের স্যুপ খেতে না চাওয়ায় পোটেমকিন জাহাজের ডেক-এ শুরু হয়ে যায় নাটক। নাটকটি শুরু করেন জাহাজের ক্যাপ্টেন গলিকভ। রাশভারি গলিকভ কল্পনা করতে পারেননি তার জাহাজের কোন নাবিক কখনো অবাধ্য হতে পারে। পচা-আবর্জনা যায় দেওয়া হোক না কেন খেতে বাধ্য থাকবে সবাই। নাটকটি ক্লাইমেক্সের দিকে এগুতে থাকে যখন তিনি চিৎকার করে জানিয়ে দেন, সকল নাবিক স্যুপ না খেয়ে জাহাজের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে ফলে তাদেরকে জাহাজের মাস্তুলে ঝুলিয়ে মারা হবে। ভয়ার্ত অধিকাংশ নাবিকই মৃত্যুর জন্য অসহায়ভাবে প্রস্তুত হতে থাকে। তবে ডাক দিয়ে ওঠেন মাতুসেন্কো। মাতুসেন্কোর ডাকে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে উঠেন। অন্যদিকে যে সকল প্রতিবাদ শক্তিহীন নাবিক প্রতিবাদ না করে ডেক-এর এক কোণায় দাঁড়িয়েছিলেন, ক্যাপ্টেন বন্দুকধারীদের আদেশ দেন তাদের গুলি করার। জাহাজের বন্দুকধারীরা বন্দুক উঁচিয়ে তাদের দিকে গুলি ছুঁড়ার সময়ই পোটেমকিন জাহাজের বিপ্লবের প্রধান নায়ক ভাকুলিনচুক-এর কথা বন্দুকধারীদের জাগিয়ে দেয়, তারা গুলি ছুঁড়তে অস্বীকৃতি জানায়। এমন সময় চূড়ান্ত মুহূর্ত উপস্থিত হয়। অফিসার এবং সাধারণ নাবিকদের মধ্যে শুরু হয় সশস্ত্র ও সহিংস দ্ব›দ্ব। সাধারণ নাবিকদের বিজয় হলেও, যে জন অসহায় নুয়ে পড়া নাবিকদের জাগানোর জন্য প্রথম ডাক দিয়েছিলেন সেই ভাকুলিনচুক গুলিবিদ্ধ হন এবং মারা যান। অত:পর অতি সম্মানের সাথে ভাকুলিনচুক এর অন্তোষ্টিক্রিয়ার জন্য মৃতদেহ নিয়ে রওনা হন ওডেসা বন্দরে। শুরু হয় তৃতীয় পর্ব : ন্যায়বিচারের জন্য মৃতের আহ্বান’ (Drama on the Quarterdeck).

বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা ছবি সের্গেই আইজেনস্টাইন পরিচালিত “ব্যাটলশীপ পটেমকিন” চলচ্চিত্রের পোস্টার (১৯২৫)

কুয়াশা মাখা সকালে ওডেসা বন্দরে ভাকুলিনচুক-এর মৃতদেহ রেখে পোটেমকিন জাহাজের সবাই একটু দূরে থেকে সবকিছু দেখতে লাগলো। কাগজে ‘এক বাটি স্যুপের জন্য মৃত্যু’ কথাটি লিখে রাখা হলো। সেই সাথে জানিয়ে দেওয়া হলো পোটেমকিন জাহাজে কি ঘটেছে। কুয়াশা সরিয়ে সূর্যের আলো ওঠার সাথে সাথে খবরটি ছড়িয়ে পড়লো ওডেসা শহরে। হাজারো মানুষ দলে দলে নৌবিদ্রোহের নেতার মৃতদেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসলো। অর্থ দিয়ে, ফুল দিয়ে, মাথার টুপি খুলে, চোখের অশ্রু ফেলে হাজারো মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করলো বিদ্রোহীদের সাথে। দরিদ্র সব মানুষগুলো তাদের সামান্য খাবারও আনন্দে পৌঁছে দিল পোটেমকিন জাহাজে। তারপর বঞ্চিত মানুষের রক্তাক্ত পতাকা তোলা হল পোটেমকিন জাহাজে। জনতার এই উচ্ছ্বামের মধ্যেই শুরু হলো ব্যাটলশিপ পোটেমকিন চলচ্চিত্রের সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য পর্ব ‘ওডেসার সিঁড়ি’ (ঞযব ঙফবংংধ ঝঃধরৎপধংব).

চলচ্চিত্রের শিল্পের ইতিহাসে এই রীলটি অসাধারণ মূল্যবান তার শিল্পগুণ ও চিত্র সম্পাদনা পদ্ধতির জন্য। পোটেমকিন জাহাজের বিদ্রোহী নাবিকদের প্রতি সম্মান জানাতে যখন তীরে ভীড় জমিয়েছে অগণিত মানুষ, তখনই হঠাৎ এইসব নিরস্ত্র শিশু, বৃদ্ধ, যুবক-যুবতী, পুরুষ-নারী, পঙ্গু মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জার সম্রাটের রক্ত লোলুপ কসাক বাহিনী। পর্দায় বন্দুকধারী পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীর তান্ডব চলতে থাকে প্রায় সাড়ে ছয় মিনিট। শত শত অসহায় শান্তিপ্রিয় মানুষের দেহ নিমিষেই নি®প্রাণ হয়ে পড়ে থাকে ওডেসা বন্দরের সিঁড়িতে। শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, পঙ্গু, যুবতী, কেহই রক্ষা পায়নি এই তান্ডবলীলা থেকে। সমুদ্রতীর থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পোটেমকিন জাহাজের নাবিকরা এই গণহত্যার প্রতিশোধ স্বরূপ ওডেসার জৌলুসপূর্ণ স্থাপনাগুলো জাহাজের কামানের গোলায় উড়িয়ে দিলো। এখানেই চতুর্থ পর্ব শেষ হয়ে শুরু হয় পঞ্চম পর্ব : নৌবাহিনীর মুখোমুখি’ (A Dead Man Calls for Justice).

সমস্ত রাত্রি চূড়ান্ত উদ্বেগের মধ্যে কাটাবার পর ভোরবেলার কুয়াশার মধ্যে দেখা গেল বেশ কয়েকটি যুদ্ধ জাহাজ পোটেমকিনের দিকে এগিয়ে আসছে। গভীর উত্তেজনা, আতংক পোটেমকিনের নাবিকদের। তারা প্রস্তুত হয়ে যায় যে কোন ধবংসাত্মক পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য। আরেকটি যুদ্ধজাহাজ যখন প্রায় মুখোমুখি এবং পোটেমকিনের নাবিকরা যখন সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত, তখনই তাদের মনে জাগে, তাদের ধবংস করার জন্য যে যুদ্ধজাহাজ এগিয়ে আসছে, তাদের প্রতি ভ্রাতৃত্বের আহ্বান জানানো। অপর জাহাজের সাধারণ নাবিকরাতো তাদেরই মত বঞ্চিত। পোটেমকিন জাহাজের নাবিকদের ভ্রাতৃত্বের আহ্বানে আগত যুদ্ধ জাহাজটি পোটেমকিনের বিদ্রোহী নাকিকদের উপর গুলি চালাতে অস্বীকার করলো। অত:পর ব্যাটলশিপ পোটেমকিন বিজয়ীর বেশে বাধাহীনভাবে দূর সমুদ্রে ভেসে গেল।

দূর সমুদ্রে জাহাজটি ভেসে যাওয়াতে স্বাভাবিকভাবে দর্শকদের মনে হয় বিদ্রোহী নাবিকরা ১৯০৫ সালের এই বিদ্রোহে সফল হয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তব ইতিহাসে ‘পোটেমকিন’ জাহাজের বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল। বিদ্রোহের পর প্রথমে জাহাজটাকে আটকানো হয় কনস্তান্জাতে, তারপর জারের সরকারের হাতে জাহাজটিকে তুলে দেওয়া হয়। কিছু নাবিক পালিয়ে যায়, কিন্তু মাতাইয়ুসেনকোসহ বেশ কিছু নাবিককে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।
পোটেমকিন জাহাজের বিদ্রোহ আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও আইজেনস্টাইন মনে করতেন ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের সাফল্যের পেছন ১৯০৫ সালে পোটেমকিন জাহাজের বিদ্রোহের বিশেষ অবদান রয়েছে। বিপ্লবের স্রোতকে আরো প্রবলতর করার জন্য রাশিয়ার জনগণকে বিপ্লবমুখী করার জন্য এর অবদান রাশিয়ার বিপ্লবী জনগণ সব সময় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’ ছবির সফলতার জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতেন ছবির অনামী অজ্ঞাত স্রষ্টাকে, আর এই স্রষ্টা হচ্ছেন রাশিয়ার অগণিত স্বাধীনতাকামী জনগণ। ১৯২৫ সালের ২১শে ডিসেম্বর-এ মস্কোর বলশই থিয়েটারে প্রথম ছবিটি দেখানো হয়। আর জনসাধারণের জন্য ছবিটি বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ১৯২৬ সালের ১৮ই জানুয়ারি। (চলবে)

Exit mobile version