ভজন সরকার : গৌর একের পর এক চশমার লেন্স বদলে দিচ্ছে। আমি বা চোখ বন্ধ করে ডান চোখে পড়ে যাচ্ছি D F N…। কিছুক্ষণ পড়ে আর পড়তে পারছি না। গৌর আবার লেন্স বদলে দিচ্ছে পরম যত্নে। আমি নিজেই অধৈর্য হয়ে বলি, “তোর বাংলা চার্ট নেই। এখানে কি সবাই ইংরেজি পড়তে পারে?”
গৌর হা হা করে হাসে, “আরে না। তুই আমেরিকা থেকে এসেছিস। তাই এই পুরানো চার্টটা অনেক কষ্টে খুঁজে বের করে টাঙালাম। এই অজপাড়া গাঁয়ে ওই ইংরেজি -ফিংরেজি জানা মানুষ কি গৌর সেনের সেন নেত্রালয়ে চোখ দেখাতে আসে?”
আমি চুপ করে থাকি। গৌর আবার ডান চোখ ঢেকে দেয়। আমি বা চোখ দিয়ে পড়তে থাকি D F N…। একেবারে নিচু পর্যন্ত এসে থেমে যাই।
গৌর বিশেষজ্ঞ চক্ষুবিশেষজ্ঞের মতো বলে দেয়। ডান চোখটায় অনেকটাই পাওয়ার লাগবে। বাম চোখে অনেকটাই কম লাগবে।
আমি মুচকি মুচকি হাসি। উন্নত বিশ্বে বাস করি। অনেক বড় চাকুরী। পৃথিবী বিখ্যাত হাসপাতালের নামকরা চক্ষুবিশেষজ্ঞ দিয়ে নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করাই। বয়স হলে এমনিতেই চোখের পাওয়ার কমে যায়। কাছের জিনিস দেখতে অসুবিধে হয়। চল্লিশের পরেই প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষের এমনটা হয়।
আমারও সেটাই হয়েছে। পড়তে গেলেই অস্পষ্ট হয়ে যায় অক্ষরগুলো। তাই সাথে এক জোড়া চশমা রাখি। গৌর এবার সে চশমা জোড়া দেখেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সব কাজ ফেলে বন্ধুর চোখ-পরীক্ষায় লেগে যায়।
আমি বলি, “তুই কি কোনো ট্রেনিং নিয়েছিলি? আই মিন কোনো আই স্পেশালিষ্টের অধীনে কাজ? কোনো ডিপ্লোমা বা ডিগ্রী?”
গৌর হাসে। আমি অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকি।
“শোন, এদেশে যখন এলাম তখন বিয়েটিয়ে করিনি। ওদেশে থাকতে তোরা সব পাসটাস করে চলে গেলি কলেজে। আমি আর কলেজে ভর্তি না হয়ে ঢাকার তাঁতি বাজারে চলে এলাম। এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের চশমা এবং শাঁখার দোকান এক সাথে। ওখানেই কাজ শুরু করলাম। ট্রেনিং কিংবা অভিজ্ঞতা যা বলিস সে ওই ক’বছরের।”
আমি জানতাম গৌর এদেশে চলে এসেছে। কবে, কিভাবে, কেন এলো? সে গল্প শোনা হয়নি।
আগেও একবার এসেছিলাম গৌরের সেন নেত্রালয়ে। তখন তাড়া ছিল রাতের ট্রেনে কলকাতা ফিরে আবার পরের দিনই উড়ান দেবো নর্থ-আমেরিকার পথে। দীর্ঘ বিশ বছর পরে স্কুলের সেই গৌর সেনকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম। সেবার গৌরের সেন নেত্রালয়ে বসেছিলাম মাত্র ঘন্টাখানিক। সেই এক ঘন্টা সময়ে পেছনে পরে থাকা রাজ্যের কথা বলেছিলাম দুজনে। মাত্র একটি ঘন্টায় দীর্ঘ এক যুগের গল্প। ছেলেবেলা। স্কুলের দুষ্টুমি। প্রথম প্রেমপত্রের হাতেখড়ি। কী বলা হয়নি ওইটুকু সময়ে। পেছনে ফেলে আসা ঘটনার সারবেত্তা নিংড়ে নিয়েছিলাম সেদিন দুজনে। গৌরকে কথা দিয়েছিলাম আবার যখন আসবো সারাদিন সেন নেত্রালয়ের ঝাঁপি বন্ধ করে আমাদের কথাই বলবো।
আবার দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে পশ্চিম বাংলায় আসা। আত্মীয়স্বজন অনেকেই দেশ ছেড়ে প্রতিবেশীকেই বাসভূমি বানিয়েছে। আগে আক্ষেপ হতো। অভিযোগ করতাম। এখন আর করি না। আমি যদি দেশ ছেড়ে নর্থ আমেরিকায় আসতে পারি তবে এই মানুষগুলোর এই প্রতিবেশী দেশে এলে দোষ কোথায়?
অনেকবার যুক্তি দিয়েছি। আবেগকে এক কোণায় ফেলে রেখে বাস্তবতাকে যুক্তির নিক্তিতে মেপে দেখেছি। দোষ যদি কিছু করে থাকি সে তো আমারও? আমি যদি ভিন্ন মহাদেশে ভিন্ন পরিবেশে একটু উন্নত জীবনের খোঁজে আসতে পারি, তবে এই মানুষগুলো তো আমার চেয়েও অধিক অনিশ্চয়তা আর ভয়বহতাকে প্রত্যক্ষ করেই দেশ ত্যাগ করছে। ওদের দোষী করছি কোন্ ঠুনকো অজুহাতে? অপরাধ যদি কিছু হয়, তার পাল্লা তো আমার দিকেই ভারী।
স্বাধীন দেশটা আবার যেন বদলে গেলো। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশ পেয়েছিলাম, মাত্র বছর কয়েক পরেই তা আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেলো। ধর্মের বিভাজন রেখা আবার জেগে উঠলো। দেশভাগের ক্ষত আবার স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষগুলো আবার কমে যেতে লাগলো।
দিন যায় বন্ধুর সংখ্যা কমতে থাকে। একদিন শুনি গৌরও নাই হয়ে গেছে। যেমন অবিনাশ, বিমল, প্রণিতা, অঞ্জলিরা গেছে সবার অগোচরে।
সেই গৌর সেনকে খুঁজে পেয়েছিলাম ভারতের পশ্চিমবংগের এক জেলা শহরতলীর বাজারে। গৌর সেখানে চশমার দোকানদার। দশ ফুট বাই ছয় ফুটের এক ছোট দোকান। সামনে কাঁচের শো-কেসে সাজানো হরেক রকমের চশমার ফ্রেম। দেয়ালে টানানো বাহারি-নারী পুরুষ মডেলদের ছবি, চোখে নানা ঢংয়ের চশমা। মাঝখানে একখানা উঁচু কাঠের টুল, বাইরে বাঁশ হেলান দিয়ে উপরে উঠানো টিনের ঝাঁপি। সেখানে তিনজন বসতে পারে এমন সাইজের কাঠের বেঞ্চি পাতা। একটা কাপড়ের পর্দা টানানো ছোট আরেকটা প্রকোষ্ঠ দোকানের ভিতরে। ওখানেই চোখের লেন্স পরীক্ষা করা হয়। এতোক্ষণ গৌর আমার চক্ষু পরীক্ষা করছিল ওখানে বসেই।
গৌরের উৎসাহে আমি বাধা দেই না। একের পর এক লেন্স পাল্টিয়ে গৌর আমার দুই চোখের জন্য চশমার পাওয়ার নির্দিষ্ট করে দেয়। আমি অবাক বিষ্ময়ে দেখি নর্থ আমেরিকার বিশেষজ্ঞ চক্ষুবিদও আমাকে ঠিক সেই চশমার পাওয়ারই প্রেসক্রাইব করে দিয়েছিল। আমি গৌরকে সে কথা বলতেই গৌরের মুখ গৌড় বর্ণ হয়ে যায়। চোখে-মুখে এক ধরণের সাফল্যের হাসি ফুটে ওঠে।
আমি গৌরকে নিশ্চিত করি, আমার বেশ ক’জোড়া চশমা আছে। তবুও পাওয়ারটা ডাবল-চেক করে নিলাম মাত্র। আমার চশমার দরকার নেই। আমি জানি, গৌর কিছুতেই আমার কাছ থেকে চশমার দাম নেবে না। তাই গৌরকে আর আর্থিক ক্ষতির মধ্যে ফেলতে চাই না।
এপ্রিল মাসে উত্তরবংগের মাটি চৌচির করা রোদ আর গা-জ্বালা করা গরম। মাথার উপর ভনভন করে প্রচন্ড শব্দে ইলেক্ট্রিক পাখা ঘুরছে। পাখার বাতাস সঞ্চালনে ঘর আর বাইরের লু-হাওয়া যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমি প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ-ঘাড় মুছে নিচ্ছি। গৌর আমার এ দুরাবস্থা দেখে একটু পর পর জলের বোতল এগিয়ে দিচ্ছে। আমি বোতল থেকে ঢকঢক করে জল ঢালছি মুখের ভিতর। শরীরের কষ্ট যেন কষ্টই বোধ হচ্ছে না দীর্ঘ ত্রিশ বছর পরে বন্ধুকে পেয়ে।
গৌর বাইরে গিয়ে চা অর্ডার দেয়। কাচের গøাসে দু’কাপ চা দিয়ে যায় পাশের দোকান থেকে। আমি আর গৌর ‘সেন নেত্রালয়’-য়ে বসে গরম লেবু চায়ে চুমুক দেই আর সেলুলয়েড পর্দার মতো নিমিষেই ফিরে যাই বাল্যকালে।
হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণীর বাংলা ক্লাস। শিক্ষক যোগেশ ভৌমিক স্যার। বাংলার শব্দ রূপ পড়াচ্ছেন। গৌর যখন দাঁড়াল যোগেশ স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “বল নেত্র মানে কী?”
ক্লাশে অমনোযোগী ছাত্র গৌরের পক্ষে নেত্র অর্থ জানা নেই। এক হাত দিয়ে মাথা চুলকাচ্ছে আর এ দিক-ওদিক তাকাচ্ছে গৌর। যোগেশ স্যার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ব্রিটিশ আমলে বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যে স্নাতক। চর্যাপদ থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলা সাহিত্য স্যারের নখদর্পনে।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে যোগেশ স্যার বলে যাচ্ছেন,
“দেখে শূন্য নেত্র তুলি খণ্ড খণ্ড মেঘগুলি
জোছনা মাখিয়া গায়ে উড়ে উড়ে যায়।”
যোগেশ স্যার হাতের বেত উঠিয়ে আবার গৌরকে বলে, “এবার বুঝেছিস। আকাশের খন্ড খন্ড মেঘগুলি যা দিয়ে দেখা যায়। কী দিয়ে দেখা যায়?”
পুরা ক্লাসের অনেকেই ফিসফিস করে বলছে কিন্তু গৌর সেন এক হাতে মাথা চুলকাচ্ছে আর জানালার দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়েই আছে। কিন্তু নেত্র শব্দের অর্থ বুঝতে পারছে না। যোগেশ স্যার হাতের বেত দেখিয়ে বলছেন, “তুই দাঁড়িয়ে থাক। ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকবি।”
আমি দীর্ঘ তিন যুগ পরে গৌরকে জিজ্ঞেস করি, “যোগেশ স্যারের কথা মনে আছে তোর? একবার নেত্র অর্থ বলতে পারিসনি বলে দাঁড়িয়েছিলি ক্লাসে?”
গৌর হো হো করে হাসে, ‘আরে তুই ছিলি ক্লাসে ফার্ষ্ট বয়। তুই একদিন দাঁড়িয়ে থাকলে সেটা মনে থাকে। আমি তো প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকতাম। শুধু যোগেশ স্যার কেন, সব স্যারের ক্লাসেই দাঁড়িয়ে থেকেছি।’
আমি জিজ্ঞেস করি, “যোগেশ স্যারও নাকি দেশ ছেড়ে পশ্চিমবংগে এসেছিলেন? তুই খোঁজ পেয়েছিলি স্যারের?”
গৌর বলে, “হ্যাঁ, স্যারের এক ছেলে রাণাঘাট ছিল। ওখানেই নাকি স্যার মারা গেছেন। তবে স্যার কিন্তু ভীষণ ভালো বাংলা জানতেন, সেটা বলতেই হবে।”
আমি মাথা নাড়ি গৌরের কথায়। কৌতুহল নিয় জিজ্ঞেস করি, “সেন নেত্রালয় কি ক্লাস এইটের নেত্র শব্দের অর্থ না জানার অনুশোচনা থেকেই দিয়েছিস?”
গৌর আমার প্রশ্নের অর্থ না বুঝেই বলে, “ধুর আমি কি এখনো এতো কঠিন শব্দের অর্থ জানি নাকি?”
হয়ত গৌর সেন নেত্র শব্দের অর্থ না জেনেই ওর চশমার দোকানের নাম দিয়েছে “সেন নেত্রালয়”।
আমি এ নিয়ে আর কথা বাড়াই না। তিন দশক পরে বন্ধুকে পেয়ে হারিয়ে যাই অতীতের স্মৃতি চারণে।
গল্পে গল্পে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। উত্তরের হিমালয় থেকে কালো করে মেঘ ধেয়ে আসে উত্তর আকাশে। আমি গৌরের সেন নেত্রালয় থেকে বাইরে আসি।
“আবার দেখা হবে, বন্ধু। ভালো থাকিস।” বলেই সামনে দাঁড়ানো রিক্সায় উঠি।
হঠাৎ জামার পকেটে হাত লাগতেই কলমের মতো একটা বস্তু হাতে লাগে। খুলতেই দেখি ছোট্ট একজোড়া রিডিং-চশমা। বুঝতে বাকী থাকে না, গরমে অতিষ্ঠ হয়ে একবার জামা খুলে ফেলেছিলাম। আর তখনি গৌর আমার চোখের পাওয়ারের এক জোড়া চশমা জামার পকেটে গুঁজে দিয়েছে। আমি কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না।
মৃদু আলো-মৃদু অন্ধকারে রিক্সা চলতে থাকে পিচ ঢালা পথ গড়িয়ে। আমার মন তখনও ক্লাশ এইটে। গৌরকে শব্দ রূপ জিজ্ঞেস করছেন যোগেশ স্যার।
গৌর নেত্র শব্দের অর্থ বলতে না-পেরে দাঁড়িয়ে আছে। যোগেশ স্যার রবীন্দ্রনাথের বন-ফুল কাব্যনাটক থেকে বলে যাচ্ছেন,
“দেখে শূন্য নেত্র তুলি- খণ্ড খণ্ড মেঘগুলি
জোছনা মাখিয়া গায়ে উড়ে উড়ে যায়।
একখণ্ড উড়ে যায় আর খণ্ড আসে
ঢাকিয়া চাঁদের ভাতি মলিন করিয়া রাতি
মলিন করিয়া দিয়া সুনীল আকাশে।”
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা।)