ফরিদ আহমেদ : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশে আগমণের বিরোধিতা করতে গিয়ে রাস্তায় প্রতিবাদে নেমেছিলো বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো এবং চরম মৌলবাদী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ শেষ হয়েছে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের হাতে প্রহৃত হবার মাধ্যমে। কিন্তু, হেফাজত ইসলামের প্রতিবাদ সেভাবে থামেনি। বরং এটা গড়িয়েছিলো চরম সহিংসতার দিকে। পুলিশ, বিজিবি এবং তাদের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সরকারি রাজনৈতিক দলের সাথে সশস্ত্র লড়াইয়ে নেমেছিলো হেফাজতে ইসলাম। সেটা করতে গিয়ে সারা দেশব্যাপী তাণ্ডবলীলা চালায় তারা। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটানো হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে। সেখানে ভূমি অফিস পুড়িয়ে দেয় হেফাজত কর্মীরা। সেই সাথে ওই শহরের ঐতিহ্যবাহী সংগীত প্রতিষ্ঠান ‘সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন’-কে অগ্নিদগ্ধ করে তারা, সেখানে তাণ্ডবময় ভাঙচুর চালায়। হেফাজতের আক্রমণে প্রতিষ্ঠানে থাকা অতি দুর্লভ আড়াইশ বই, আড়াই হাজার ছবি, দলিলপত্র, আলাউদ্দিন খাঁর লেখা সংগীতের পাণ্ডুলিপি, দুর্লভ ছবি, সংগীতের যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়।
এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছিলো ১৯৫৬ সালে। আলাউদ্দিন খাঁর নির্দেশে তাঁর ছোট দুই ভাই নায়েব আলী খাঁ এবং আয়াত আলী খাঁ এই সংগীত বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আলাউদ্দিন খাঁ উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি ভারতীয় নাগরিক হিসাবে ভারতে বসবাস এবং মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর জন্ম হয়েছিলো আমাদের দেশে, এই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই। তাঁর পিতা সাধু খাঁ নিজেও সংগীতানুরাগী ছিলেন। সংগীত শেখার জন্য তিনি বিশ-বাইশ মেইল পথ পায়ে হেঁটে আগরতলাতে যেতেন। ত্রিপুরার রাজদরবারে সঙ্গীতবিদ ওস্তাদ কাশেম আলী খাঁ ছিলেন। তাঁকে তুষ্ট করে তাঁর কাছে থেকে গান শেখার জন্য নানা ধরনের ফলমূল উপহার হিসাবে নিয়ে যেতেন। এতে কাজ হয়েছিলো। ওস্তাদ কাশেম আলী খাঁ সাধু খাঁকে শিষ্য হিসাবে বরণ করে নিয়ে তাঁকে সংগীত শিক্ষা দিয়েছিলেন।
বাবার এই সংগীতানুরাগ জন্মগতভাবে পেয়েছিলেন আলাউদ্দিন খাঁ। কিন্তু, বাবার ইচ্ছা ছিলো না তিনি সংগীতে আসেন। তার বদলে পড়ালেখা করার দিকে ঠেলে দেওয়া হয় তাঁকে। সংগীত যার রক্তের মধ্যে তাঁর পক্ষে স্কুলের বদ্ধ গণ্ডির মধ্যে মন বসানো সম্ভব নয়। আলাউদ্দিন খাঁ নিয়মিত পাঠশালা ফাঁকি দিয়ে চলে যেতেন শিবমন্দিরে। সেখানে একজন সাধক সেতার বাজাতো। তিনি নিবিষ্ট মনে সেই সেতার বাজানো শুনতেন। তাঁর এই ফাঁকিবাজি ধরা পড়ে গেলো একদিন। অপরাধের শাস্তি দেওয়া হলো, সারাদিন খুঁটির সাথে বেঁধেও রাখা হলো। এই সব শাস্তির ফল হলো বিপরীত। পাঠশালার প্রতি তাঁর মন গেলো বিষিয়ে।
একদিন মায়ের সঞ্চয় থেকে বারো টাকা চুরি করে নয় বছরের বালক বের হয়ে গেলো ঘর ছেড়ে। জাহাজে চড়ে চলে গেলো সেই সুদূরের কোলকাতায়। সেখানে কোনো আত্মীয়স্বজন নেই, পরিচিত কেউ নেই। রাস্তায় ঘুমোতেন, কাঙালিখানায় একবেলা খাবার খেয়ে দিন গুজরান করতেন। ঘটনাবহুল দিন পেরিয়ে একদিন সুযোগ আসে গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী ওরফে নুলোবাবুর কাছে গান শেখার। সমস্যা দাঁড়ায় ভিন্ন জায়গায়। নুলোবাবু গোঁড়া হিন্দু ছিলেন। তাঁর মুসলমান পরিচয় পেলে তাঁকে শেখাতে রাজি হবেন না বলে, যে ব্যক্তি তাঁকে নুলোবাবুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি আলাউদ্দিন খাঁকে হিন্দু বলে পরিচয় করিয়ে দেন। হিন্দু হিসাবেই নুলোবাবুর কাছে সংগীতের তালিম নেওয়া শুরু করেন তিনি। নুলোবাবু অবশ্য একটা শর্ত দিয়েছিলেন। বারো বছরের আগে কণ্ঠসংগীত শিখতে পারবে না তাঁর শিষ্য।
নুলোবাবুর কাছে গান শেখার পর্ব শুরু হয় তাঁর। এক পর্যায়ে গিয়ে তাঁর প্রতিভা দেখে নুলোবাবু তাঁকে নিজের সন্তানের মতো বিবেচনা করে নিজের ঘরে আশ্রয় দেন। নিজের সমস্ত সংগীত জ্ঞান উজাড় করে দেন ছাত্রের মাঝে। সেটা শেষ হলেও অন্য ওস্তাদের কাছেও শেখানোর ব্যবস্থা করেন। সাড়ে সাত বছর পরে বিপত্তি ঘটে। আলাউদ্দিন খাঁর মেজো ভাই তাঁকে নানা জায়গায় খুঁজতে খুঁজতে কোলকাতায় চলে আসেন। ঘটনাচক্রে তাঁর সন্ধানও পেয়ে যান তিনি। নুলোবাবু তখনই জানতে পারেন যে তাঁর ছাত্র আসলে হিন্দু নয়, মুসলমান। এর সাথেই একই ঘরে থেকেছেন তিনি, এক সাথে খাওয়া দাওয়া করেছেন। তাঁর পৃথিবী টলে ওঠে। কিন্তু এক সময় বোধোদয় ঘটে তাঁর, “স্নেহ-মায়া-মমতা কোন ধর্মের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে না। সকল সংকীর্ণতার গণ্ডী পার হতে পারলেই এগিয়ে যাওয়া যায় মানবতার মিলনতীর্থে। হীনতা, ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতার স্থান নেই মানবতার কাছে।”
সংগীত শিক্ষাকে অসমাপ্ত রেখেই বাড়ি চলে যেতে হয় তাঁকে। তাঁর অজান্তে বিয়ের আয়োজন করা হয় এবং অনিচ্ছুক তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় মদনী বিবির সাথে। মদনী বিবিকে পরে তিনি মদিনা বিবি বলে ডাকতেন। তাঁর নামে একটাও রাগও সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। বিয়ের রাতে বাসর ঘর ঘুমন্ত স্ত্রীর অলংকার চুরি ঘরে ঘর থেকে বাইরে চলে আসেন তিনি। চলে যান কোলকাতাতে। গিয়ে দেখেন তাঁর ওস্তাদ নুলোবাবু আর জীবিত নেই। ফলে, ভিন্ন ওস্তাদ খোঁজার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
আমি এখানে তাঁর পুরো জীবনী উল্লেখ করছি না। আহাম্মদ আলীর লেখা ‘সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ জীবন ও সাধনা’ বইটা পড়লেই তার সবটুকু জানতে পারবেন। শুধু এইটুকু বলছি ভারত শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ হবার জন্য তাঁর রাস্তাটা মসৃণ কোনো রাস্তা ছিলো না। সুরের প্রতি তীব্র ক্ষুধা এবং একগুঁয়ে জেদ তাঁকে ওই পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। একটা সময়ে হতাশ হয়ে আত্মহত্যাও করতে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর পরিত্যক্ত স্ত্রীরও একই দশা হয়েছিলো। মদনী বিবিকে তাঁর আত্মীয় স্বজনের বিয়ে দিতে চাইলেও তিনি রাজি হননি। যখন প্রচণ্ড চাপ দেওয়া হয়েছে তখন তিনি পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে শ্বশুরবাড়িতে। সেখানেও যে খুব সুখকর জীবন তাঁর ছিলো তা নয়। বাসর রাতেই স্বামী যাঁকে ফেলে পালিয়ে যায় তাঁর নানা ধরনের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হয়। এগুলোর কারণে তিনিও আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। দু’জনের সেই আত্মহত্যার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিলো। ব্যর্থ হয়েছিলো বলেই একদিন তাঁরা আবার সংসার করতে পেরেছিলেন, সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বইটা যিনি লিখেছেন, সেই আহাম্মদ আলী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর গ্রামের লোক। কিন্তু দুজনের মধ্যে কোনো পূর্ব-পরিচয় ছিলো না। এমনকি বয়সেরও বিশাল ব্যবধান রয়েছে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মাত্র নয় বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। ফলে, গ্রামেও তিনি বেশি সময় ছিলেন না। আহাম্মদ আলীর তাই তাঁর জীবনী জানার কথা নয়। অথচ ভাগ্যচক্রে তিনিই লিখে ফেলেছেন তাঁর জীবনী।
১৯৫৪ সালে বৃদ্ধ বয়সে ভারত থেকে গ্রামে এসেছিলেন তিনি। সেই সময় আহাম্মদ আলী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আহাম্মদ আলীর কাছে গল্পচ্ছলে তাঁর জীবনী তিনি শুনিয়েছিলেন। সেগুলোই তখন আহাম্মদ আলী সংক্ষিপ্ত আকারে নোট করে নেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-র জীবনী তিনি লিখবেন, সেই পরিকল্পনা তাঁর ছিলো না। ঘটনাচক্রে সেটাই ঘটে যায়। তাঁর ভাষাতে,
“ওস্তাদজী তাঁর জন্মভূমি শিবপুর গ্রামে নিজের ঘরে বসে যখন তাঁর জীবনের ঘটনাবলী আমার কাছে বর্ণনা করেন তখন বলতে গেলে কৌতূহল বশেই এগুলো অতি সংক্ষিপ্তভাবে নোট করে রেখেছিলাম মাত্র। সে সময় কিন্তু জীবনী লেখার ইচ্ছায় বা উদ্দেশ্যে তা করিনি। তখন উদ্দেশ্য ছিলো ওস্তাদজীর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের চমত্কার ও চমকপ্রদ কাহিনী নিয়ে বন্ধু বান্ধবদের সাথে গল্প করা। কিন্তু, একটা ঘটনার কারণে ব্যাপারটির মোড় ঘুরে গেল। তা হলো, ঢাকার সাপ্তাহিক সওগাত পত্রিকা অফিসের সামনের খোলামাঠে তদানীন্তন পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের পক্ষ থেকে ওস্তাদজীকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। সে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে সংসদের পক্ষ হতে ওস্তাদজীর কাছে তাঁর জীবনী লেখার অনুমতি চাওয়া হলে তিনি হঠাত বলে ওঠেন, ‘আমার জীবনের সমস্ত ঘটনা আমি আমার স্বগ্রাম নিবাসী জনাব আহাম্মদ আলীর কাছে বলার সুযোগ পেয়েছি। সুতরাং আমার জীবনী তিনিই লিখবেন।’ ঘোষণা শুনে আমি ফ্যাসাদে পড়ে গেলাম এবং কিছুটা বিব্রতবোধও করলাম।”
আহাম্মদ আলী সাহেব বিব্রত বোধ করলেও আমাদের তাতে লাভই হয়েছে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-র নিজের বয়ান করা জীবনীই আমরা পেয়ে গিয়েছি তাঁর মাধ্যমে। এই বিশ্বখ্যাত ভারত শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত ব্যক্তিত্বটির জীবনী অত্যন্ত ঘটনাবহুল, নানা নাটকীয় ঘটনায় সমৃদ্ধ। একই সাথে এটা পাঠককে অনুপ্রেরণা যোগাতেও সক্ষম। নিজের ভালো লাগার বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য একজন ব্যক্তি কীভাবে বিরুদ্ধ পরিবেশেও লেগে থাকতে পারে, লক্ষ্যকে কোনোভাবেই বিচ্যুত না হতে দিতে পারে, এবং এর মাধ্যমে সাফল্যের শীর্ষে উঠতে পারে, সেটা এই জীবনী গ্রন্থের প্রতিটা লাইনের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে।