সাজ্জাদ আলী
এক:
“সুপ্রিম রেস্পন্সিবিলিটি” শব্দযুগলের যুৎসই বাংলা প্রতিশব্দ “বৃহত্তর দায়”। তো এই বৃহত্তর দায়ের স্বরূপ কি এবং ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা কিভাবে প্রযুক্ত হবে? এ সম্পর্কে পাঠক বন্ধুদের আমার নিজস্ব চিন্তাটা জ্ঞাত করি তবে। প্রথমেই বলি “বৃহত্তর দায়” বিষয়টি বস্তুত সমাজের বড় মানুষদের জন্যই প্রযোজ্য। আমজনতার ওসব দায়িত্বের বালাই নাই। ‘সুপ্রিম রেস্পন্সিবিলিটি’র দুটো একটি উদহরণ তবে বলি। ধরুন একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের হুকুমদানকারী ব্যক্তি নিজের হাতে হত্যা করেন নাই বটে, কিন্তু হুকুমদারী আসামীর গুরুদন্ড থেকে তার নিস্তার নেই। আবার একটি পরিবারের ক্ষেত্রে, সন্তানের সুকীর্তির সুনাম যেমন পিতা পাবেন, তেমনি কুকীর্তির দায়ভারও তিনি এড়াতে পারেন না। যদিও পিতা ব্যক্তিগতভাবে অপকর্মটি করেননি, তবুও লোকে তাকে দোষারোপ করবেই। বলবে, ওই দেখ ছলিমদ্দির ছেলে কলিমদ্দিটা এক নম্বরের লুচ্চা!
দেশে যদি যাত্রীবাহী লঞ্চডুবি হয় বা রেল দুর্ঘটনা ঘটে, তবে তার সুপ্রিম রেসপন্সিবিলিটি ওই বিভাগীয় মন্ত্রীরই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপক হিসেবে মাননীয় মন্ত্রী একথা বলে দায় এড়াতে পারেন না যে, আমি তো ট্রেনখানি চালাচ্ছিলাম না। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশে এমনতর দুর্ঘটনায় “বৃহত্তর দায়” স্বীকার করে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেবার নজীর আছে। আরো একটা উপযুক্ত উদহরণ বলি তবে। গণতান্ত্রিক রাষ্টসমূহের কোন সাধারণ নির্বাচনে দল পরাজিত হলে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন দলনেতারা মনে করেন যে, তার নেতৃত্বের অদক্ষতার কারণেই দল পরাজিত হয়েছে। সেই পরাজয়ের “বৃহত্তর দায়” স্বীকার করে দলপতির পদ থেকে তিনি স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ান। পাশ্চাত্যে এমন নজীর অনেকটা প্রথা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এমন কি আমাদের প্রতিবেশী ভারতের গত সাধারণ নির্বাচনে দলের ভরাডুবির দায় নিজ কাধে নিয়ে রাহুল গান্ধি কংগ্রেস দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
এমনতর দায়স্বীকার করতে পারাটা চাট্টিখানি কথা নয়। এজন্য ব্যক্তিকে হতে হবে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, নির্লোভ, দেশপ্রেমিক এবং নীতিবোধে সমৃদ্ধ। থাকতে হবে তাঁর অতি উন্নত চারিত্রিক গুণাবলি। যে কোন প্রকারে পদ আঁকড়ে থাকার মানষিকতা সম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে “সুপ্রিম রেসপন্সিবিলিটি” বোঝা সম্ভব নয়।
![](https://i0.wp.com/www.banglakagoj.com/wp-content/uploads/2019/10/B-K-2-3.jpg?resize=516%2C301)
দুই:
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যই ওই বিদ্যাঙ্গনের সর্বোচ্চ অভিভাবক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোর কার্যক্রমের শতভাগ ব্যায়ভার জনগণের টাকায় নির্বাহ হয়। সংগত কারণেই একটি ব্যবসামুখি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জনগণের কাছে জবাবদিহিতার মাত্রাও শতগুণ বেশি। একজন অভিভাবক তার সন্তানকে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্র হিসেবে পাঠানোর পর থেকে ওই ছাত্রের দেখভালের দায়িত্ব বিদ্যায়তন কর্তৃপক্ষেরই। শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি ছাত্রদের নৈতিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, শৃঙ্খলা, থাকা, খাওয়া থেকে শুরু করে নির্বিঘেœ ঘুমুতে পারা পর্যন্ত দেখভালের দায়িত্ব বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরই। এসব কাজের জন্য ইউনিভার্সিটির হলগুলোর আবাসিক শিক্ষকদের জনগণের টাকায় পোষা হয়।
তিন:
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে একটি আবাসিক হলের কক্ষে তার সহপাঠিরা ডেকে নিয়ে ৪/৫ ঘন্টাব্যাপী দফায় দফায় পিটিয়ে মেরেই ফেললো! গুলি করে একজন মানুষকে মারা অথবা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারার প্রক্রিয়াটা বেশ সংক্ষিপ্ত! একটা গুলি, একটা কোপ, একটাই চিৎকার! সব শেষ! এ ক্ষেত্রে হত্যাকারীরা ছাত্রটির মাথায় তেমন একটা পেটায়নি, শরীরের তুলনামূলক অসংবেদনশীল অংশে লম্বা সময় নিয়ে বিরতী দিয়ে দিয়ে পিটিয়ে মেরেছে। শতশত লাঠির আঘাত পড়েছে মৃতের শরীরে। প্রতিটি আঘাতে সে মরণ চিৎকার করেছে। ৪ ঘন্টাব্যাপি তার সেই আর্তনাদ পাশের কক্ষের কেউ শুনতে পেল না! ভবনের করিডোর দিয়ে তার বাঁচার আকূতি অনুরণিত হলো না! ছাত্রটির রক্ষক আবাসিক শিক্ষকরা কেউ এগিয়ে এলো না তাকে বাঁচাতে? কর্তৃপক্ষ “না দেখার ভান করে” একটি জীবন ঝরতে দিলো! হায় ধরণী দ্বিধা হও!
সেই শৈশবে দাদী কোলে বসিয়ে শিখিয়েছিলেন, অন্যায় যে করে, আর তা যে সহে; উভয়েই সমান দোষে দোষী। ঘটনার পরম্পরায় এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, হত্যাকারী ছাত্ররা, ওই আবাসিক হলের প্রশাসকরা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ অভিভাবক উপাচার্য, এরা সকলেই এক গোয়ালের বাসিন্দা। ভিন্নমতাবলম্বীকে নির্মূলের প্রয়োজনে তাকে হত্যা করার ব্যাপারে ওরা সবাই নীতিগতভাবে একমত! তফাৎ শুধু এই যে কেউ নিজ হাতে মেরেছে, কেউ মারতে দেখে চুপ করে থেকেছে, আর কেউ বা ঘটনা শুনে নির্লিপ্ত থেকেছে। কিন্তু এ কেমন কথা যে শুধু হত্যাসংশ্লিষ্ট ছাত্রদের বিচারের আওতায় আনা হবে? আর হত্যার প্রশ্রয়দানকারীরা আরো একটি হত্যাকান্ড সংগঠনে সহয়তা দেবার জন্য বহাল তবিয়তে থাকবে?
চার:
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীরা দুবৃত্ত হয়ে উঠে। আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলে ছাত্রলীগের দুর্বিনীত আচরণ নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। কিন্তু সে সমালোচনা পাঠ করে অন্য দলের সমর্থকেরা পুলকিত হবেন না প্লিজ। ক্ষমতায় থাকতে আপনাদের দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর “অনাচার” বেশি বই কোন অংশেই কম ছিলো না। আর দেশের মানুষ তা ভোলেনি। যাই হোক, আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ছাত্রলীগের ছেলেরা বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোকে পিটিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়া করে আবাসিক হলগুলোর দখল নিয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে লীগের ছেলেরা তাদের ক্রিড়ানকে পরিনত করেছে। উপরোন্তু ওরা দেশব্যাপী গুন্ডামী, মাস্তানী, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী ইত্যাদি সকল অপকর্মের হোতা।
তো এই সোনালী ছেলেরা এত যে সব রূপালী দাপট দেখাচ্ছে, এদের শক্তির উৎস কোথায়? কার বলে ওরা এতটা বলিয়ান? ক্ষমতাকেন্দ্রের সেই প্রাণভ্রমরাকে জিজ্ঞাসা করি, এরা তো আপনারই পোষ্য, তাই না? আপনিই তো এদের ত্রাতা। বলি, কি কারণে এদের পোষেন? দুর্মুখরা তো কানাঘুষা করে যে, ওরা নাকি আপনার পেটোয়া বাহিনী। বিরুদ্ধবাদীরা যখন রাস্তায় মিছিল করতে নামে, ওরা তখন পিটিয়ে রাস্তা ফাঁকা করে। বিরোধীদের জনসভা ভন্ডুলেও ওরা সিদ্ধহস্ত। ভোটের সময় ভোটকেন্দ্রগুলো ওরা দখলে রাখে। এতসব অপকর্ম আপনার জন্য ওরা করে বলেই হয়তো ওদের মনে একটা ভরসা তৈরী হয়েছে যে, ওদের দুষ্কর্মগুলোও আপনার সুরক্ষা পাবে। আপনি কেমনে ভুলে গেলেন যে ওরা আসলে ছাত্র। সবাই পড়তে এসেছিলো।
মাস খানেক আগে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদককে অপকর্মের দায়ে বহিস্কার করা হলো। আবার ক’দিন আগেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগারদের হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার করা হলো। এই উভয় ক্ষেত্রেই শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকার প্রধানের সরাসরি আদেশ প্রয়োজন হয়েছে। সংগঠিত যে কোন অপরাধেই পুলিশ স্ব-উদ্যোগে নাগরিকদের নিরাপত্তা দেবে, এমনই তো বিধান। তবে সে বিধান ভেঙ্গে পড়লো কি প্রকারে? আইনের প্রয়োগে প্রধানমন্ত্রীর আদেশ/অনুমোদন লাগবে কেন? এটা কি সরকার প্রধানের দৈনন্দিন কাজ? বোধকরি সবুজ সংকেত লাগছে এ জন্য যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কর্তারা জনেন যে, ছাত্রলীগাররা তাঁদের থেকেও ক্ষমতাশালী! কি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি? ছাত্রলীগ এতটাই ক্ষমতাবান?
প্রকৌশল বিদ্যালয়ে পড়–য়া ছেলেটির হত্যাকান্ডের পরপরই সরকার প্রধানের অনুমোদনে হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করা হলো। এই ঘটনাকেই কেস স্টাডি হিসেবে বেছে নি তবে। দেখা যাচ্ছে দলগতভাবে আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ এবং তাদের আভিভাবক স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এই “দ্রুত গ্রেফতার” বিষয়ে এক ধরণের তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। ভাবখানা এই যে, দেখ দেশবাসী হত্যা পরবর্তী কত দ্রুত অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হলো। এমনটা কি তোমরা অন্য সরকারদের আমলে দেখেছো কখনও? আহারে, আপনাদের আক্কেলজ্ঞানের তোড়ে দেশবাসি আজ বেক্কেল বনে গেছে! বুঝলাম যে হত্যাকান্ড ঘটার পরে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছেন। কিন্তু দেশব্যাপী ছাত্রলীগ নামধারী একটা লাঠিয়াল গোষ্ঠি আপনারা পালন করছেন, সে কথা তো সত্য। সব থেকে বড় সত্য এই যে, এরা এতটাই হিং¯্র ও মারমুখি যে, এদের দ্বারা আরেকটি হত্যাকান্ড সময়ের অপেক্ষা মাত্র। প্রতিপালক হিসেবে আওয়ামী নেতৃত্বের সেটা কি অজানা? তাহলে দেশবাসী এই দুষ্টের পালকদেরকে “শিষ্টের রক্ষক” ভাববে কি ভাবে?
এই সহিংস ছাত্রলীগকে যদি শক্ত সাংগঠনিক শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করা না যায়, তবে তো সমুখে ঘোর অমানিশা! ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকান্ডে চর্তুদিকে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের রব উঠেছে। সে ব্যবস্থাই বোধকরি আপাতঃ সর্বোত্তম। কিন্তু সেটা করবে কে? কর্তৃত্বতো জনতার হাতে না। বর্তমান সরকারী দল ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করবে না, কারণ ক্ষমতায় টিকে থাকতে ছাত্রলীগকে দরকার। আর বিরোধীদলগুলোর প্রত্যেকেরই ক্ষমতায় পৌঁছুতে নিজ ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করতে হবে। তো বিরোধী-সরকারী নির্বিশেষে ওদের শ্রেণী স্বার্থ ছাত্ররাজনীতির পক্ষেই। বিড়ালের গলায় তবে ঘন্টাটি বাঁধবে কে? আসলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধে সব দলের সম্মিলিত নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। বিকল্প প্রস্তাবনা হিসেবে সংসদে কঠিন আইন করে দেশের শিক্ষাঙ্গনে দলীয় রাজনীতি বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া যায় কিনা, রাষ্ট্র চিন্তকেরা সেটা ভেবে দেখতে পারেন।
পাদটিকা:
সূচনায় বলছিলাম যে “সুপ্রিম রেসপন্সিবিলিটি” স্বীকার করাটা চাট্টিখানি কথা না। ওটা বৃহৎদের ধর্ম, আর সে জন্য ব্যক্তিকে সর্বোৎকৃষ্ট হতে হয়। স্তাবকরা যত জোরেই স্তুতির ঢোল বাজাক না কেন আমজনতা ঠিকই বুঝতে পারে যে, আমাদের শীর্ষ রাজনীতিক, অধ্যাপক, বড়মন্ত্রী, দলপতি, এরা কেউই “বৃহৎ” নন!
(কৈফিয়তঃ এতক্ষণ ঠগ বাছতে গিয়ে যেন গা উজাড় করে ফেলেছি! দুর্বৃত্তায়িত ছাত্র নামধারী বিশাল গোষ্ঠির কথা বলতে যেয়ে সুশীল ছাত্রটিকেও (রাজনীতিককেও) প্রকারান্তরে একই কাতারে নামিয়ে এনেছি। এটা অন্যায় হয়েছে। রাজনীতিতে যুক্ত আদর্শবান সংখ্যালঘু ছাত্র বন্ধুরা/রাজনীতিকরা আমায় মার্জনা করবেন। এ সমালোচনা আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, গায়ে মাখাবেন না, প্লিজ। আপনার প্রতি আমরা সদা শ্রদ্ধাবনত।)
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)