মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

 

ঊনত্রিশ.
১৯৯৮ সালের নভেম্বরে আমি এক সপ্তাহের জন্য কোকুইটলামের পাইনট্রি সেকেন্ডারী স্কুলে বিকল্প শিক্ষক হিসেবে পড়াতে গেলাম, ভ্যাংকুভারের পূর্ব দিকে ঐ জায়গাটায় গাড়ি চালিয়ে যেতে প্রায় আধ ঘন্টা লাগতো। একদল ছোট ছোট সুন্দর সব ছেলেমেয়ের সাথে ঐ সপ্তাহটা দারুণ কাটলো, ফলে এক সপ্তাহ পর আমার চলে আসার সময় আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ১৩ তারিখ শুক্রবার তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি সরাসরি আমার এপার্টমেন্ট এ ফিরে এসেছিলাম। তারপর রাতের খাবার খেয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেদিন আমি খুব দ্রুতই বেহুসের মত ঘুমে আচ্ছন্ন হয়েছিলাম, আর সেদিনই আমি আমার সবচেয়ে ছোট ভাই মিশেলকে চিরদিনের মত হারিয়ে ফেললাম।

পরের দিন সকাল পাঁচটায় আমার ফোন বেজে উঠেছিল। মা ফোন করেছিলেন এবং জানালেন, কোনো একটা দূর্ঘটনা ঘটেছে। মায়ের কন্ঠস্বর শুনে মনে হয়েছিল, ঐ দূর্ঘটনাটা ঘটেছে আমার কোনো ভাইয়ের জীবনে। কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারলাম আমার ধারণাটা ঠিক। খবরটা শুনে আমি মুহূর্তেই নির্বাক হয়ে গেলাম, আমার হৃদয়টা দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে যেতে লাগলো, আমার শরীরের রক্ত হীম হতে শুরু করলো। অপর পার থেকে আবার মায়ের কন্ঠ ভেসে আসলো, ‘আমরা এখনো নিশ্চিত নই, কারণ তারা এখনো তার শরীরটা খুঁজে পাইনি।’ তিনি একটু থেমে আবার বললেন, ‘কিন্তু আরসিএমপি (রয়েল কানাডিয়ান মাউনন্টেড পুলিশ) বলেছে, মিশেল কোকানী থেকে আরেকটু উপর দিকে এক তুষার ধসের মধ্যে পড়েছে।’

মিশেল যা করতে ভালোবাসতো, সে তার মৃত্যুর সময় সেটায় করছিল। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার আরো দক্ষিণে গ্রামীণ এলাকায় সে বন্ধুদের নিয়ে স্কি’তে মেতেছিল। আমি যখন বøাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে ক্লাস নিচ্ছিলাম, তখনই একটা তুষার ধস মিশেলকে আর তার এক বন্ধুকে কোকানী লেকে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল। তারা তখন সেই লেকের পাশের খাঁড়া পাহাড় দিয়ে স্কি করে যাচ্ছিল। তাদের বন্ধু এনডি কোনো রকমে সাতরিয়ে লেকের পাড়ে এসে পৌঁছেছিল, কিন্তু মিশেল লেকের পাড় থেকে অনেক দূরে পড়েছিল। তার অন্যান্য বন্ধুদের সেই তুষারস্তুপ থেকে নিজেদের বের করতে কয়েকঘন্টা লেগেছিল, আর তারা সেখান থেকে নিজেদের উদ্ধার করেই খবরটা আরসিএমপি’কে দিয়েছিল। অন্যদিকে আমি খুবই সাধারণ একটা দিন কাটিয়েছিলাম সেদিন, যেমন পরিবারের সবার সাথে যেভাবে সুন্দর আনন্দের দিন কাটাই, কিন্তু আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি সেই মুহূর্তে কী ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটে গেছে।

কিন্তু আমার মনের একটা অংশ বলছিল মিশেল তখনো বেঁচে ছিল, আমি কখনো এমন কোনো জগতের কথা ভাবতে পারতাম না যেখানে মিশেল নেই।

আমার মধ্যে তখন খুব একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। মিশেল ঐ হিমবাহের আশেপাশে তখন কী করছিল? আমি তার বড় ভাই হিসেবে কেনো তাকে আমি রক্ষা করতে পারিনি? আমরা একই প্রদেশে বাস করতাম, আমারতো তার কাছে আরো ঘন ঘন যাওয়া উচিৎ ছিল, তার সাথে আরো বেশি বেশি কথা বলা উচিৎ ছিল, তার প্রতি আরো বেশি বেশি লক্ষ্য রাখা উচিৎ ছিল যাতে কোনো ধরনের বিপদ তাকে ছুঁতে না পারে।

মিশেলের জন্য সেই বছরটা ছিল প্রাণ ফিরে পাওয়া এক বছর। সেই বসন্তে ম্যানিটোবার মধ্য দিয়ে সে যখন বাড়ীতে ফিরছিল, একজন বেখেয়ালী ড্রাইভার তার রাস্তায় এসে তার গাড়ীতে মারাত্মকভাবে আঘাত করে। সেই দূর্ঘটনায় মিশেল মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল, কিন্তু তার সেই নিজের আহত অবস্থা তাকে সে সময় ততটা ভাবায়নি, যতটুকু ভাবিয়েছিল তার প্রিয় কুকুর মাকওয়া। মাকওয়া তার সাথে গাড়ীতেই ছিল, দূর্ঘটনার সময় কোনো রকমে সে গাড়ী থেকে বের হতে সক্ষম হয়ে সেই দূর্ঘটনার স্থান থেকেই পালিয়ে গিয়েছিল। পরে মাকওয়া’কে খুঁজে বের করতে এক সপ্তাহ লেগে গিয়েছিল। এই বিপদের পর যখন পুলিশ সেই দূর্ঘটনার জায়গায় এসেছিল তখন তাকে আরেকটা ঝুক্কির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মিশেলের গাড়ীতে সামান্য কিছু মারিজুয়ানা পাওয়া গিয়েছিল যার জন্য তার বিরুদ্ধে চার্জ আনা হয়। কিন্তু সম্ভবত সেই মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরে আসার ফলেই পরের গ্রীষ্মে মিশেল পরিবারের সবার সাথে আরো বেশী ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করছিল, অবস্থানগত কারণে বা ব্যস্ততার জন্য আমাদের সম্পর্কটা যে দূরে দূরে ছিটকে পড়ছিল, সেই ছিটকে পড়া থেকে সে আমাদের সেই ভালোবাসার সম্পর্কটা আবার সুন্দর করার চেষ্টা করছিল।
শরতে আবার আমরা তিন ভাই আমাদের তিন ভিন্ন পথে চলে গিয়েছিলাম, ঐ ছিল মিশেলকে আমার শেষ দেখা, যদিও সে আমার কাছ থেকে খুব একটা দূরে থাকতো না, রোজল্যান্ডের স্কি হিল এ সে কাজ করতো।

মাত্র ২৩ বছর বয়সে তুষার ধসে প্রাণ হারানো জাস্টিন ট্রুডোর সবচেয়ে ছোট ভাই মিশেল ট্রুডো

সে যে সপ্তাহে মারা গেল, সে সপ্তাহের সোমবারে তার সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল, আমিই একধরনের অপরাধবোধ থেকে তাকে ফোন করেছিলাম। অক্টোবরের শুরুতে তার জন্মদিনের সময় তাকে ফোন না করার বিষয়টা যখন তার একবন্ধু আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল তখন আমি নিজে নিজেকেই গালাগালি করেছিলাম, ঐ সময়টা যখন আসে, তখন আমাদের পরিবারের কেউ কখনো দেরী করি না। তার বন্ধুটা ঠিক কাজটায় করেছিল, সেই দিনের শেষেই আমি মিশেলকে ফোন করেছিলাম। সেদিন আমরা দু’জন অনেক কথাই বলেছিলাম, সাধারণত ভাইদের মধ্যে দীর্ঘ ক্ষণ ধরে যে সব কথাবার্তা হয়। ঐ কথার মধ্যে আমি যেটা স্পষ্টই মনে করতে পারি, তা হচ্ছে, তার পরিকল্পনায় ছিল পরের সপ্তাহের তিন দিন কোকানী হিমবাহে কাটানো।
সে নিজে থেকেই বলেছিল, ‘সময়টা খুব বেশি আগে হয়ে যাচ্ছে, সে কারণে আমাদেরকে খুব বেশী সতর্ক থাকতে হবে।’

আমি দায়িত্ববান বাবা-মা’রা যেভাবে বলে অথবা একজন বড় ভাই যেভাবে কথা বলে, সেই ভাবেই কিছুটা সতর্ক করার ভংগিতে বলেছিলাম, ‘ঠিক বলেছো, এই সময়ে তোমাকে চোখ কান খোলা রাখতে হবে যাতে কোনো ধরনের বিপদে না পড়ো।’ আমার ওমন কথা বলার ভংগিতে সে হা হা করে হেসে উঠেছিল। সে জানতো, তুষার ধসের বিপদ সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত এবং কিভাবে এমন বিপদ থেকে নিজেকে এড়িয়ে চলা যায় সেটাও আমি একেবারে জানতাম না। আমি শুধু জানতাম, ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ঐ এলাকার পাহাড়ে স্কি করতে গেলে, তুষার ধসের একটা ঝুঁকি থাকে। মিশেলের মৃত্যুর পর আমি এ ব্যাপারে অনেক বেশী জেনেছিলাম। পরবর্তীতে আমি কানাডিয়ান এভালানশ ফাউন্ডেশন এর পরিচালক হয়েছিলাম এবং তুষার ধস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলাম।

সেই দিনের শেষে যখন মিশেলের নিখোঁজ সংবাদটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন রোজল্যান্ডে জাতীয় সংবাদ মাধ্যম এসে ভীড় জমাতে শুরু করেছিল। যারাই মিশেলকে চিনতো সংবাদকর্মীরা তাদের কাছে গিয়েই মিশেল সম্পর্কে জানতে চাইছিল। সংবাদকর্মীদের সবাই একটিই কথা বলেছিল, সে ছিল খুবই হাসি খুশি আর আমুদে একজন ছেলে, আর তারা সবাই তাকে ‘মাইক’ নামেই চিনতো। সে এতই একজন প্রাণোচ্ছ¡ল যুবক ছিল যে যার সাথেই তার দেখা হতো, প্রথমেই তার দিকে সে একটি হাসি ছুঁড়ে দিতো আর তার এমন ব্যবহারের জন্য সে সবার কাছে খুবই প্রিয়ও ছিল। তারা পরে সবাই জেনে হতবাক হয়ে গিয়েছিল, এই সদা হাসি খুশী আর সবার পছন্দের ছেলেটি যার মধ্যে কখনও কোনো ভণিতার লেশ মাত্র ছিল না আর যার গভীর ভালোবাসা ছিল ফাকা বিরাণ জায়গায় স্কি করা, সে ছিল কানাডার এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে।

১৯৮৮ সালের ২০শে নভেম্বর আউট্রিমন্ট এর সেন্ট ভাইয়েতুর গীর্জায় মিশেলের পারলৌকিক কাজ শেষে ট্রুডো পরিবার। (বাম থেকে) বাবা কানাডার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো, মেজো ভাই শাসা, মা মার্গারেট এবং বড় ভাই কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।

মিশেল তার আশে পাশের বরফ, আকাশ বাতাস, পাহাড় আর মানুষের সাথে এমনই গভীর এক সম্পর্কের বন্ধন তৈরী করেছিল। সে ছিল সত্যিকারের একজন মুক্ত মানুষ যে কানাডার যে সব সুন্দর সুন্দর জায়গায় আদিবাসী সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছিল সেগুলো দেখতে খুবই উন্মুখ হয়ে থাকতো আর সেগুলোর প্রতি তার মুগ্ধতা ছিল অত্যন্ত গভীর। মিশেল সত্যিই ছিল এক শান্তির পাখি যে নিজেকে শাসা আর আমার থেকে অনেক দূরে নিয়ে চলে গেলো।
খুব সকালেই মন্ট্রিয়লে যাওয়ার টিকিটের ব্যবস্থা করে আমি বাবাকে ফোন করে জানালাম, আমি আসছি, সেই সাথে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, নতুন কোনো সংবাদ আছে কি না। বাবাকে কখনও মিথ্যা আশার কাছে নিজেকে সমর্পিত করতে দেখিনি, এখনো সেটা দেখলাম না, তিনি শুধু বেদনা কন্ঠে জানালেন, ‘না’। তারপর তিনি আবার বললেন, ‘মিশেল চলে গেছে, ফলে আর কোনো সংবাদ থাকতে পারে না। এখন শুধু একটায় প্রশ্ন তারা মিশেলের লাশ খুঁজে পাবে কি পাবে না।’

মিশেল কোকানী চষে বেড়াচ্ছিল কারণ ও ওভাবেই জীবনকে দেখতো, ঐ এলাকায় তার পছন্দের সব আকর্ষণই ছিল। জায়গাটা ছিল একেবারে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন, চোখ জুড়ানো সব প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী আর যেখানে স্কি করা ছিল এক ভয়ংকর দুঃসাহসিক ব্যাপার, সেই সাথে সেই প্রকৃতির মধ্যে যে বলিষ্ঠতা ছিল তা কখনও আমাদের চারপাশের এই হৈ চৈ করা জগতে পাওয়া যায় না। কোনো রৌদ্রালোকিত দিনে কোকানী লেকের তীরের উপরের সেই হিমবাহে স্কি করা ছিল মিশেলের কাছে স্বর্গের কাছাকাছি কোনো এক জায়গাই সময় কাটানো। কোকানী লেকের পাশের এক কিলোমিটার বিস্তৃত জায়গা ছিল এক পাহাড়ী স্বর্গ, জায়গাটা প্রস্থে ছিল প্রায় চার’শ মিটার আর খুবই গভীর যার চারপাশে ছিল খাঁড়া খাঁড়া পাথুরে পাহাড়। আমি এখন বুঝি, মিশেল কেনো সেই জায়গার এত বেশী প্রেমে পড়েছিল, যার ফলে ঐ সময় সেখানে স্কি করার ঝুঁকি থাকার পরও কেনো সে সেটা ওমনভাবে আমলে নেয় নি। আসলে তার কাছে বিপদের ঝুঁকি কখনো কোনো বাধায় ছিল না। সে যদি মনে করতো, তার যে ক্ষমতা ও দক্ষতা আছে তাতে যে কোনো ঝুঁকির মধ্য দিয়ে সামনে এগুনো সম্ভব, তাহলে কোনো কিছুই তাকে কখনো নিবৃত করতে পারতো না। সে এমন কাজটা করে দেখিয়েই আমাদের কাছ থেকে না ফেরার জগতে চলে গেলো। (চলবে)