ভজন সরকার : (২)
একটি শহরে প্রবেশ করার পর মোটামুটি সব কিছুই এই মিউনিসিপ্যাল গর্ভমেন্টের অধীন। পানি-বিদ্যুৎ-পয়ঃনিস্কাশন-বর্জ্য নিস্কাশন-রাস্তাঘাট-পুলিশের একাংশ এবং বছরের একটি উল্লেখযোগ্য সময়ে বরফ পরিষ্কারসহ নাগরিক জীবনের প্রায় ৯০ শতাংশ সেবা মিউনিসিপ্যালিটি দেয়। আবার এই মিউনিসিপ্যাল পরিসেবার প্রায় অধিকাংশই দেয় পাবলিক ওয়ার্কস বিভাগ। সেই সাথে আছে উন্নতবিশ্বের অতি কঠিন নিয়ম-নীতি-আইন-কানুন, যেগুলোর প্রায় অধিকাংশই পুঙ্খানপুঙ্খভাবে মেনে চলতে হয়।

পাবিøক ওয়ার্কস বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান ক’রে বুঝলাম এ কোনো সাধারণ চাকুরী না। প্রথম দিন বেশ ফিটফাট হয়ে টাই-স্যুট পরেই অফিসে গেলাম। উষ্ণ অভ্যর্থনায় কাটলো প্রথম ঘন্টা। দ্বিতীয় ঘন্টায় মেয়র ও কাউন্সিলাদের সাথে পরিচয়। মেয়র পদমর্যাদায় মিউনিসিপ্যাল গভর্মেন্টে রাণী এলিজাবেথের প্রতিনিধি। তাই সরকারি প্রটোকলে সেভাবেই সম্বোধন করতে হবে; “হিজ বা হার এক্সেলেন্সি বা ওরশিপ মেয়র”। এটা জেনেছি ইন্টারভিউয়ের দিনই। মেয়রের কক্ষে ঢুকে দেখলাম আসলে ব্যাপারটা অতোটা ফর্মাল নয়। মেয়র নিজেই বললেন, এটি শুধু কাউন্সিল অধিবেশনের বেলায় প্রযোজ্য। ঠিক সংসদ অধিবেশনের মতোই; স্পিকারকে যেমন সবার সম্মান জানাতে হয়।

আমারই সমবয়েসি এক ভদ্রলোক। বেশ বড় বড় চুল। পাকানো গোঁফ। প্রথম দেখাতেই মনে হবে এই মাত্র ঘোড়সওয়ারের চাবুক রেখে এসেছে। আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় স্বাগত জানালেন ‘হিজ ওরশিপ’ মেয়র। এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলেন। একটু বিব্রত হয়েও সামলে নিলাম।
ভদ্রলোক আরেকবার হাত বাড়িয়ে শক্ত করে ধরে বললেন, “তোমাকে দেখে মনে হলো কতোদিন স্যুট-টাই পরি না। বিয়ের দিন পরেছিলাম। আর কেউ মারা গেলে চার্চে শেষকৃত্যে পরতে হয়। অনেকদিন এ শহরে শেষকৃত্য হয় না”।
সেদিন নিজের অফিস রুমে এসেই টাই খুলে ফেললাম। দীর্ঘ তিন বছরে আর ওই বস্তুটি গলায় ঝুলাইনি।

বিশাল বড় অফিস রুম। প্রায় অর্ধশত স্টাফ। শহর ছোট হ’লেও পরিসেবার কাঠামো ও আইন-কানুন একই। তার উপরে প্রথম দিনেই বস যে বিরাট কর্মযজ্ঞের ফিরিস্তি দিলেন, শুনেই আমার গলা শুকিয়ে গেল। প্রথম দিন কাটালাম এই ভেবে যে, ভালো না লাগলে পরের সপ্তাহেই কেটে পড়বো।
যে মানুষটির জন্য আমার কেটে পড়া হয়নি, সে সুধীর যোশী। ওইদিন কালো ভালুকের খোয়ার থেকে উদ্ধার করার পর সুধীর যোশী হলো আমার একমাত্র আপনজন। পরিবার তখনও টরন্টো। টরন্টোর পাট চুকিয়ে এখানে নিয়ে আসব কিনা সাত-পাঁচ ভাবছি।

সে সময়েই একদিন সুধীর যোশী তার জীবন-গল্পের ঝাঁপি খুললেন। আমার সাথে তার অভিবাসী জীবনের গল্পটি প্রায় একই। সব অভিবাসনের দুঃখ গাঁথাগুলো কি একই হয়?
উত্তর ভারত থেকে সুধীরের অভিবাসী হয়ে চলে আসা আশির দশকে। সাথে শুধু বিহারের এক খনিতে চাকুরীর কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা আর কিছুদিন আগে বিয়ে করা বউ।

অধিকাংশ অভিবাসীদের মতোই টরন্টোই প্রথম গন্তব্য সুধীরের। তারপরে চলে আসা এই ছোট ম্যারাথন শহরের সোনার গনির শ্রমিক হিসেবে। তারপর দু’টো ছেলে জন্মেছে এখানেই। ছেলেরা একটু বড় হ’তেই বড় বিপর্যয়। সুধীরের ভারতীয় বউ ছেলে দু’টোকে রেখে সোনার খনির এক ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করে চলে গেল অস্ট্রেলিয়া।

সুধীরের কোনো আক্ষেপ নেই। মুখে স্মিত হাসি নিয়ে সুধীর বলে, “জানো মিঃ সরকার, ঘর থেকে বেরুলে সবাই যে ঘরে ফিরবে সে নিশ্চয়তা নেই। কেউ কেউ গলি থেকে রাজপথে উঠে গলিতে আর ফিরে আসতে চায় না। আমার বউয়ের ক্ষেত্রেও সেটিই হয়েছিল। বড় ছেলেটি তখন ক্লাস নাইনে। ছোট ছেলে ক্লাশ এইটে। বুঝতেই পারছো। বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে দু’টো নিয়ে এক মহাসমুদ্রে পড়লাম”।

সুধীরের সাথে যখন দেখা তাঁর ছোট ছেলেটি ভালো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। বড় ছেলেটিও বিশ্ববিদ্যালয়ে। সুধীর একাই থাকে। তাই আমার একাকী সময়ে সুধীরের সাথে গল্প ক’রেই কাটাই অফিসের পরের সন্ধ্যাটুকু।
সুধীর বলে তাঁর জীবনের কথা, “এই ছোট্ট শহরে ছিলাম ব’লেই ছেলে দু’টোকে মানুষ করতে পেরেছি। ভারতীয় চেহারার আমরা মাত্র কয়েক জন। ছেলে দু’টোর জন্ম ও বেড়ে ওঠা এখানেই। প্রত্যেক মানুষই একে অপরকে চেনে। সুবিধে হলো এই যে, কোথাও কিছু করলে সাথে সাথেই টেলিফোনে খবর পাই,
“তোমার ছেলেদের ওখানে দেখলাম”। ঠিক আমাদের ভারতীয় সমাজের মতো। পাড়া-মহল্লার যৌথ অভিভাবকত্বের মতো। ছেলেদেরও বন্ধু-বান্ধব অনেক। প্রায় সব বন্ধুদের বাবা-মা ওদের বাবা-মা হয়ে গেল। আমিও কাজে মন দিতে পারলাম”।

আমি নিজেও কাজে মন দিলাম। পাহাড় সমান দায?িত্ব। সম্বল নিজের সাধারণ জ্ঞান। সাথে টেকনিক্যাল শিক্ষা। এমনিতেই প্রবাসে ইংরেজি সমস্যা; বাংলিশ উচ্চারণ। বুঝতে ও বোঝাতে সমস্যা। তার উপরে এ শহরের অধিকাংশ খনি শ্রমিক কানাডার পূর্ব-উত্তরের প্রদেশ নিউ ফাউন্ডল্যাÐ থেকে আসা। কানাডা থেকে জলপথে বিচ্ছিন্ন আটলান্টিক পাড়ের এ রাজ্যের উচ্চারণ মূল কানাডা ভ‚-খন্ডের চেয়ে ভিন্ন। তাই ভাষা সমস্যাটাই সবকিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে দেখা দিল।

মে-জুন মাস থেকেই কানাডার উত্তরাংশে দিন বড় হ’তে থাকে। রাত ১০টা পর্যন্ত সূর্যের আলো থাকে। সাড়ে ৪টায় অফিস শেষ। তখনও ৪ -৫ ঘন্টা বাকি ঘুমানোর আগে। আমার গাড়িটাও টরন্টোতে রেখে এসেছি। ভরসা তাই সুধীর যোশী। যেদিন সুধীরের কাজ থাকে না, আমরা দু’জন বেড়িয়ে পড়ি।

কোনোদিন বিশাল জলরাশির হ্রদ লেক সুপিরিয়রের পাড়ের কোনো বিচে। কোনোদিন গা ছমছম কোনো পাহাড়ের উপত্যকায়। প্রতিদিনই সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে বাসার সামনের বেঞ্চে বসে জমানো আড্ডা। সাথে সুধীর যোশীর পরিচিত আরও কয়েকজন খনির শ্রমিক ও ইঞ্জিনিয়ার। প্রায় দিনই বারবি-কিউয়ের মাংশ, সাথে বেয়ার। আড্ডা গড়িয়ে যায় সপ্তাহান্তের মধ্যরাত অব্দি।
অফিসের কাজে ইতিমধ্যেই ধাতস্থ হয়েছি। মেয়রসহ অফিসের বস সবাই চাপ দিচ্ছে টরন্টো থেকে ফ্যামিলি নিয়ে আসতে। অথচ তখনও নিজের মধ্যেই আত্মবিশ্বাস জন্মেনি। কতোদিন চাকুরী করতে পারবো? পরিবারের সব্বাইকে এতোদূর টেনে এনে আবার দু’দিন পরেই পাত্তারি গোটাতে হবে নাতো?
সুধীর যোশী আশ্বস্ত করে। অভয় দেয়। নিজের জীবনের সেই টানাপোড়েনের কথার উদাহরণ দেয়। তার পরিচিত বন্ধু-বান্ধুব-আত্মীয়স্বজন অনেকেই তখন সুধীরকেও বারণ করেছিল এতো দূরে চলে আসতে।

সুধীর যোশীর এক উত্তর ছিল, “ভারত থেকে এই বিভ‚ঁই বিদেশে কেনো আসা? নিজের ও পরিবারের ভালোর জন্যেই তো? টরন্টোর “ঘেট্টো” জীবনকেই যদি বেছে নিই, তবে ভারত থেকে চলে আসা কেনো? দেশী সংস্কৃতি আর দেশী মানুষই যদি সিদ্ধান্ত গ্রহনের মূল কথা হয়, তবে ভারতই তো ছিল শেকড় গাড়ার জায়গা। কানাডায় পাড়ি দেওয়া কেনো?”

সুধীর যোশীর কথায় সাহস পাই। নিজের অতীতকে খুঁজে পাই। পায়ের নিচে সর্ষে দানা বেঁধেছি। ইয়ারপুর, তেরশ্রী, ঘিওর, ঢাকা, বরিশাল, মাদারীপুর, ঢাকা, টরন্টো। জীবনের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই প্রথাবিরোধী নিয়েছি। সব কিছুই শূন্য থেকে শুরু করেছি। যখন একটু থিতু হয়েছি। সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে আবার বিশাল অনিশ্চিয়তায় ঝাঁপ দিয়েছি কিছুদিন পরেই। এবারেও না হয় শুরু হোক জীবনের আরেকটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিই, সামনের মাসেই ফ্যামিলি নিয়ে আসবো।

টরন্টো থেকে ফ্যামিলির সবাই চলে এলো। নিজেও ব্যস্ত হয়ে গেলাম। সুধীর যোশীর সাথে দেখা হয় ছোট্ট শহরের অলিতে-গলিতে। ছেলেরা সবাই বাইরে। সুধীর যোশী একা মানুষ। বিশ-পঁচিশ বছর এই শহরেরই বাসিন্দা। সুধীর তখন পদোন্নতি পেয়ে পেয়ে গোল্ড মাইনে বেশ উচ্চপদে আসীন। গাড়ি-বাড়ি মেরামতসহ এমন কোনো কাজ নেই সুধীর জানে না। বিপদে আপদে সবার পাশেই সুধীর যোশী। চ্যারিটিসহ যে কোনো স্বেচ্ছাসেবী অনুষ্ঠানে সুধীরের নিয়মিত উপস্থিতি।

সুঠাম দেহের সুধীর অত্যন্ত সুদর্শন। বয়সের তুলনায় অনেক কম বয়েসী দেখায় সুধীরকে। ভালো চাকুরী করেছে দীর্ঘদিন। সংগী জুটানো কোনোই সমস্যা নয়। জিজ্ঞাসা করতেই সুধীর একগাল হেসে জবাব দেয়, “ দু’টো টিনেজ বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়েই আর কিছু ভাবার সময় হয়নি”।
ভারতীয় উপমহাদেশের অভিবাসী “ঘেট্টো” জীবনের প্রতি বিতশ্রদ্ধ সুধীরকে এতোদিন পশ্চিমা জীবনযাত্রার প্রতি আকৃষ্টই ভেবেছিলাম। ছেলেদের কথা ভেবে নতুন ক’রে জীবনসংগী খোঁজা থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত শুনে সুধীরের প্রতি দৃষ্টিভংগী পাল্টাই। এ যেনো প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের এক মিলিত স্রোতধারা। চ্যালেঞ্জ-আধুনিকতা-ক্যরিয়ারের সাথে পারিবারিক দায়বদ্ধতার যূথবদ্ধতা।
দেখা হ’লেই সুধীরকে জিজ্ঞাসা করি, “ সুধীর, ছেলেরা সবাই বাইরে। জীবনসংগী কিংবা কোনো গার্লফেন্ড? এখন তো আর ছেলেদের মানুষ করার দুশ্চিন্তা নেই”।

সুধীর হাসে। বুঝতে অসুবিধে হয় না, সুধীর অতিশীঘ্রই তার জীবনসংগী বেছে নেবে।
ছুটির দিনে হঠাৎ সুধীরের টেলিফোন। রাতে আমাদের সাথে ডিনার করবে সাথে আরেকজন অতিথি। সুধীর বিকেলেই চলে আসে। সংগে বয়স পঞ্চাশের এক ভদ্রমহিলা। পরিচয় করিয়ে দেয়, সান্দ্রা ব্রাউন। সান্দ্রার বাবা কানাডার আদিবাসী, মা ইংল্যান্ডের। জন্ম আমেরিকায়। আমেরিকার নাগরিক। কানাডা এসেছে পিছিয়ে পড়া আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করতে।সুধীরের সাথে পরিচয় পাশের আদিবাসী রিজার্ভের এক চ্যারিটিতে। তারপর যোগাযোগ, ভালো লাগা এবং এক সাথে থাকার সিদ্বান্ত।

সান্দ্রা-সুধীরের সাথে অনেক কথা হয় সেদিন। সান্দ্রা ছ’মাস পরেই আমেরিকার আরেক আদিবাসী রিজার্ভে যাবে প্রজেক্ট নিয়ে। সুধীরের দিকে তাকাই। সুধীর ব’লে, “ মিঃ সরকার, বলেছিলাম না, প্রবাসী যখন হয়েছি তখন আর “ঘেট্টো” জীবনে আটকে থাকা কেনো?”

ঠিক ছ’মাস পরে সান্দ্রা আমেরিকা গেল। সাথে সুধীর যোশীও।
করোনা-আক্রান্ত লকডাউনের দিনে ঠিক ১৪ বছর পরে সুধীরের টেলিফোন। সাথে সান্দ্রা ব্রাউন। দু’বছর পরে সুধীর আমেরিকা থেকে আবার চলে আসে কানাডাতে। ছেলেদের কাছাকাছি দক্ষিণ ওন্টারিওতে। সান্দ্রা থেকে যায় আমেরিকাতে। তারপর সেখান থেকে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা। সুধীরের সাথে যোগাযোগ ছিল। বছরের দু’একবার এসেছেও কানাডায় সুধীরের কাছে। এভাবেই ১২ বছর কেটে গেছে। সুধীরের ছেলেরাও সংসারী হয়েছে।

২ বছর আগে সান্দ্রা পাকাপাকি ভাবেই চলে আসে সুধীরের কাছে কানাডাতে। সুধীর আবার নতুন ক’রে থিতু হ’তে চায়। ততোদিন সুধীরের বয়স পচাত্তর পেরিয়ে গেছে।সান্দ্রা-সুধীর আবার সিদ্ধান্ত নেয় নতুন ক’রে এক সাথে থাকবে।
ঠিক গল্পের মতোই মনে হয় সান্দ্রা-সুধীরের জীবনের কাহিনি। মনে পড়ে সুধীর যোশীর সাথে ১৪ বছর আগে কাটানো সেই দিনগুলোর কথা। জীবন বড় অনিশ্চিত। প্রবাসের জীবন তো আরও চ্যালেঞ্জিং। ঘর থেকে বেরোলে সবাই যে ঘরে ফিরবে সে নিশ্চয়তা নেই। কেউ কেউ গলি থেকে রাজপথে উঠে গলিতে আর ফিরে আসতে চায় না। কেউ কেউ আবার রাজপথকেই বেছে নেয়। রাজপথেই জীবন গড়ে তোলে ভালোবাসার মানুষের সাথে, বয়সের সীমাবদ্ধতা কোনো বিষয়ই নয়।