স্বপন কুমার সিকদার : এই লিখাটির একটি পঠভূমি দিতে চাই। বিগত ২০১৮ ইংরেজি সনের ৮ই নভেম্বর বৃহস্পতিবার বিকাল ২-৩০ ঘঃ শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ তিথিতে শুভ দিনে ও শুভ ক্ষনে আমাদের মমতাময়ী মা সুখ প্রভা সিকদার ৯৫ বত্সর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে যান। উনার গত মহাপ্রয়ানের স্মৃতি চারনের দিনে মনে ভেসে উঠলো কিংবদন্তি অভিনেতা ও গীতিকার খান আতাউর রহমানের কালজয়ী গানের কথাগুলো – “তুমি যেদিন থাকবে না মা, সেদিন আমার হবে কি; সুখে থাকি দুঃখে থাকি, কাহার আসবে যাবে কি”।

মনে এলো, মার স্মৃতি রক্ষার্থে সাধ ও সাধ্যের মধ্যে আর কি করতে পারি। আমাদের এলাকায় বাবার নামে একটি সরকারি প্রাথমিক স্কুলের নামকরণ হয়েছে, মা ও বাবার নামে একটি সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিকের নামকরণ হয়েছে। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটি ‘পশ্চিম হারলা শচীন্দ্র সিকদার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সড়ক’ নামে নামকৃত হয়েছে যা বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মোঃ নজরুল ইসলাম চোধূরী, সম্মানিত সংসদ সদস্য, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সহৃদয় হয়ে শুভ উদ্বোধন করেন, সর্বসাধারনের ব্যবহারের জন্য একটি আধুনিক পাকা ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে যা বাবার নামে উত্সর্গীকৃত। ‘বিশ্ব মা দিবস’- এ ‘মমতাময়ী মা সুখ প্রভা সিকদার’ ও ‘বিশ্ব বাবা দিবস’-এ ‘অসীম মমত্ববোধ ও ভালোবাসার প্রতীক বাবা শচীন্দ্র সিকদার’ নামে দু’টি আর্টিকেল লিখেছি যা ঢাকা, বাংলাদেশের বিশিষ্ট দৈনিক বাংলা পত্রিকা ‘আমাদের সময়.কম’; টরন্টো, কানাডার বিশিষ্ট বাংলা পত্রিকা ‘বাংলা কাগজ’ ও ফেইসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। মাকে মার মা-বাবা ‘সুখ’ বলেই ডাকতেন। সরকারি কর্মচারী বাবার নির্দিষ্ট আয়ের সংসারে প্রাচূর্য্য ছিল না। কিন্তু মা তো অসুখী ছিলেন না। মা তো কোনদিন দামী শাড়ী, গয়না, খাবার. ধন-দৌলত ইত্যাদি চান নাই বা দেখি নাই। এক কথায় মা ছিলেন সর্বোতোভাবে সুখী – আমাদের এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয়া। তাই ভাবলাম, একটি আর্টিকেল মার নাম ‘সুখ’ শিরোনামেই লিখি। লিখিত আর্টিকেলটি সন্মানিত পাঠকবৃন্দের কাছে নিবেদন করা হলো।

সুখ (Happiness): আর্টিকেল
“এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না,
শুধু সুখ চলে যায়।
এমনি মায়ার ছলনা।
এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়”। – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
“আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে-
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে”। – কাজী নজরুল ইসলাম

এক একজন মানুষের কাছে সুখের অনুভূতি এক এক রকম। যুগ যুগ ধরে মনীষীগণ-মহামানবগণ সুখ কি ও কেন, সুখ কি ভাবে লাভ করা যায় তা জানতে ও জানাতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছেন। উনাদের কেউ সুন্দরী স্ত্রী ও রাজসিংহাসনের মায়া ত্যাগ করে মানবের জন্য সুখ অন্বেষনে গৃহত্যাগ করে সন্যাস জীবন বেঁচে নিয়েছেন। কেউ বিপথগামী দ্বারা ক্রুশ বিদ্ধ হয়ে জীবন আহুতি দিয়েছেন। ইত্যাদি, ইত্যাদি। তবে মোটামুটিভাবে বলা যায়, সুখ হল মানুষের জীবনের সব থেকে বড় চাওয়া। মহামানব গৌতম বুদ্ধের মতে – “Hapiness doesn’t depend on what you have or who you are, it solely relies on what you think”. তিনি আরও বলেছেন – “চিন্তার প্রতিফলন ঘটে স্বভাব বা প্রকৃতিতে। যদি কেউ মন্দ অভিপ্রায় নিয়ে কথা বলে বা কাজ করে দুঃখ তাকে অনুগমন করে। আর কেউ যদি সুচিন্তা নিয়ে কথা বলে বা কাজ করে সুখ তাকে ছায়ার মত অনুসরন করে”। তিনি বলেন, “ভালো কাজ সবসময় কর। বারবার কর। মনকে সবসময় ভালো কাজে নিমগ্ন রাখো। সদাচরণই স্বর্গসুখের পথ”। উনার মতে – “সুখের জন্ম হয় মনের গভীরে। এটা কখনও বাহিরের কোন উত্স থেকে আসে না”। উনার পরামর্শ “কোনো পরিবারকে সুখী ও স্বাস্থ্যবান হতে হলে সবার প্রথমে দরকার অনুশাসন এবং মনের উপর নিয়ন্ত্রণ । যদি কোনো ব্যক্তি নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যায়, তাহলে সে আত্মজ্ঞানের রাস্তা অবশ্যই খুঁজে পাবে”। দুঃখপাশ হইতে জীবলোকের মুক্তি প্রদানের চেষ্টাই ভগবান্ বুদ্ধদেবের জীবন দর্শন।
পবিত্র হিন্দু শাস্ত্রে আছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন “পরিবর্তন সংসারের নিয়ম। প্রকৃতিতে যে ভাবে দিন রাত্র হয় ,সে ভাবে মানুষের জীবনেও সুখ ও দুঃখ আসে”।তিনি আরও বলেছেন “সুখের একমাত্র চাবিকাটি হলো নিজের কামনার উপর নিয়ন্ত্রণ”। তিনি সুখ লাভের জন্য নিষ্কাম কর্ম যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন। উনার উপদেশ – ভগবান যা দিয়েছেন সেটা নিয়ে আমাদের তৃপ্ত থাকার সবসময় চেষ্টা করতে হবে। শ্রী গীতায় পরম পুরুষ শ্রীকৃঞ্চ সুহৃদ অর্জুনকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, “যে সুখ ও দুঃখে সমদর্শী সেই যথার্থ যোগী (ভগবানের প্রকৃত উপাসক)।অতএব, তুমি যোগী হও”।

According to holy Christianity, ÒHappiness is the spiritual experience of living every minute with love, grace and gratitude”.
পবিত্র ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী – “প্রচুর ধন সম্পত্তির মধ্যে সুখ নাই, মনের সুখই প্রকৃত সুখ”(আল হাদিস)।হযরত আলী (রাঃ) বলেন – “স্বাস্থ্যের চাইতে বড় সম্পদ এবং অল্পে তুষ্টির চাইতে বড় সুখ আর কিছু নেই”। তিনি আরও বলেন – “সব দুঃখের মূল এই দুনিয়ার প্রতি অত্যধিক আকর্ষণ”। সুখ লাভার্থে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ স্বরুপ বলা হয় ‘হে প্রতিপালক, তুমি আমাকে সামর্থ দাও, যাতে আমি তোমার সেই নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি’ (সুরা নামাল আয়াত ১৯)। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি ভাব আসে। মহানবী (সা:) বলেছেন, প্রকৃত সুখ ও ঐশ্বর্য হচ্ছে অন্তরের সুখ ও ঐশ্বর্য। সকল পুণ্যকর্ম শান্তি এনে দেয়। ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ।

মনীষী Ralph Marston বলেছেন – “Happiness is a choice, not a result. Nothing will make you happy until you choose to be happy”. সুখ সবসময় যা চাই তা লাভ নয়, বরঞ্চ যা আছে তার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাওয়া। দালাই লামার মতে, সুখ প্রস্তুতকৃত কোন বস্তু নয়। ইহা আমাদের কর্ম থেকে আসে। Bertrand Russel একধাপ এগিয়ে বলেন – “I believe four ingradients are necessary for happiness: health, warm personal relations, sufficient means to keep you from want, and successful work”.

সুখ হলো মনের একটি অবস্থা। ইহা হলো ঠিক একটি বিষয়ের প্রতি আমদের দৃষ্টিভংগি। আমরা সুখী বলেই হাসি না বরং হাসি বলেই সুখী। সাফল্য সুখের মূল বিষয় নয়। সুখ সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। আমাদের ভাল কাজ করার সন্ধান করতে হবে এবং তখনই আমরা দেখতে পাবো যে সুখ আমাদের পিছনে চলছে। তারাই সুখী যারা নিজেদের সংশোধন করতে পারে। সুশৃঙ্খল মন আমাদের সুখের দিকে পরিচালিত করে। সুখ জীবনকে দীর্ঘায়িত করে, কর্মস্পৃহা বাড়ায়। সংসারে যে সবাইকে আপন ভাবতে পারে, তার মত সুখী আর কেউ নেই। সুখ চাই, সুখ চাই বললে সুখ আসে না। সুখ অর্জনের জন্য চেষ্টার প্রয়োজন। সুখের ভিত্তি হলো বিশ্বাস, কৃতজ্ঞতা, তৃপ্তি ও আশাবাদিতা ইত্যাদি। আগের দিনে রাজা-মহারাজারাও অনেক সুখভোগের সুযোগ যা স্বপ্নেও কল্পনা করেন নি, তা আমরা এখন উপভোগ করি। এরপরও আমরা অনেকে নিজেদেরকে অসুখী ভাবি। সুখী হওয়া মানে প্রাচুর্য্য নয়, বরং যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। অন্যের সুখের কারণ হয়ে আমরা সুখানুভূতি পেলে তা হয় বড় সুখ। তাই কবির আহ্বান –

“পরের কারণে স্বার্থে দিয়া বলি, এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মত সুখ কোথাও কি আছে? আপনার কথা ভুলিয়া যাও” – কবি কামিনী রায়
সুখ নিতান্তই ইন্দ্রিয়ানুভূতির বিষয়। এই ইন্দিয়ানুভূতিতে যা ইতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হয় তাহাই সুখ। একজন পরিপূর্ণ সুখী মানুষ দুর্লভ। শেক্সপিয়র বলেন – “আমি সবসময় নিজেক সুখী ভাবি, কারো কাছে কিছু প্রত্যাশা করাটা সবসময়ই দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়”। বিশিষ্ট প্রবন্ধকার ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী উনার ‘সুখ না দুঃখ?’ প্রবন্ধে সুখ ও দুঃখ নিয়ে একটি সুন্দর বিশ্লেষণ দেন। তিনি বলেন, “জীবনে সুখ না থাকিলে, অর্থাত সুখের মাত্রা অধিক না হইলে, মানুষ বাঁচিতে চাহিবে কেন?” তিনি আরও বলেন, “আবার দুঃখের অস্তিত্ব উড়াইতে গেলে সুখের অস্তিত্বও উড়িয়া যাঁয়”। তিনি যুক্ত করেন, “খুঁজিয়া দেখিলে সুখত সংসারে মহার্ঘ ও দুশ্প্রাপ্য.. বাঁচিবার ইচ্ছা, সুখের ইচ্ছা নহে, উহা দুঃখ হইতে নিষ্কৃতির ইচ্ছা ”। তিনি বলেন, সুখ বলিতে যে যা বুঝে, তাহার জন্য অন্বেষন ও তাহা লাভের চেষ্টাই জীবন। জীবনের প্রবাহ সেই উদ্দেশ্যে চলিতেছে বলিয়া সামাজিক উন্নতি। তাঁর মতে, জীবনে সুখ বেশী না দুঃখ বেশী তা বিতর্কিত।

এরিস্টটলের মতে, “জ্ঞানী লোক কখনও সুখের সন্ধান করে না”। আব্রাহাম লিংকন বলেন – “মানুষ যতটা সুখী হতে চায়, সে ততটাই হতে পারে। সুখের কোনো পরিসীমা নেই। ইচ্ছে করলেই সুখকে আমরা আকাশ অভিসারী করে তুলতে পারি”। সুখকে সবাই খুঁজে পেতে জানে না। তারা এই দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি সুখী, যারা অল্পতেই নিজের সুখ খুঁজে নেয়।দুনিয়ায় এমন কেউ নেই, যে সুখ চায়না। কিন্তু সারা দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত কেউ সর্বোচ্চ সুখী হতে পারেনি। আমাদের মনে করতে হবে সুখ হল একটি উপহার।আর কৌশলটি হল এটি প্রত্যাশা করা নয় – আমরা যা করি তা পছন্দ করা। আমাদের জীবনের প্রতিটি মিনিট উপভোগ করতে শিখতে হবে। ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের মতে -“সুখ অর্জনের আনন্দ এবং সৃজনশীল প্রচেষ্টার রোমাঞ্চে নিহিত”।সুখ একটি সচেতন পছন্দ – নিজেকে মূল্য দিতে শিখতে হবে। সুখ লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষাই হলো তারুণ্য ধরে রাখার রহস্য।

সুখী হতে হলে বেশী কিছু লাগে না – শুধু একটা সুখী মন হলেই চলে। সুখ কিনতে পাওয়া যায় না বা কারো থেকে ধার নেয়া যায় না। তবে আমরা বস্তুবাদী জিনিস থেকে সাময়িক সুখ লাভ করি। সুখের আকাঙ্খা বা অনুভূতি পাত্র ভেদে পাল্টায়। যেমন –
“একটা শুকনো রুটি, একটুখানি বাসি তরকারি,
অনাহারী ক্ষুধার্তে দিলে. দেখবে সুখের রকমারি।
… …. … …
সুখ জলেরই মতো, পাত্র ভিন্নে রং বদলায়,
সুখের নীল প্রজাপতি, সাধন করলে ধরা যায়”। – সজল মালাকার
বেঁচে থাকতে হলে আমাদের সুখী হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সুখ শুধু ধন সম্পদে থাকে না।আত্ম-তুষ্টি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মধ্যে হলো পরম সুখ। যেমন –
“আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু, কম করে মোরে দাওনি;
যা দিয়েছ, তারি অযোগ্য ভাবিয়া, কেড়েও তা কিছু নাওনি ”। – প্রখ্যাত গীতিকার রজনী কান্ত সেন

এন্ড্রু কার্নেগির মতে- “সুখের সবচেয়ে গোপন গূঢ় কথাই হল ত্যাগ”। তাই অনেক সময় ভোগে নয়, কর্মসম্পাদন করাতেই প্রকৃত সুখ দেখি। এ’কারনে আমরা ফেলে আসা দিনগুলির মধ্যে সুখ খুঁজে পাই। মনীষীগনের পরামর্শ – বিশেষ করে ধর্ম, জ্ঞান চর্চা ও অনুষ্ঠানের মধ্যেই প্রকৃত সুখ অন্তরে খুঁজে নিতে হবে। এই পৃথিবীতে যে সহজ-সরল ভাবে জীবন যাপন করে তার জীবনে সুখের কোন অভাব নেই। সুখ এবং দুঃখ মানুষের জীবনে আছে ও থাকবে। মানুষ নিজেই নিজ কর্ম দ্বারা সুখ বহে আনতে পারে। মহাত্মা গান্ধী বলেন- “যা ভাবো, যা বলো এবং যা করো তারই মেলবন্ধনি হলো সুখ”।

সুখী হতে দরকার এমন কিছু মানুষের যারা সত্যি আমাদেরকে বোঝে। সুখে থাকাই জীবনের বড় সার্থকতা নয়, কাউকে সুখে রাখতে পারলেও নিজেকে সুখী মনে হয়। তিনি প্রকৃত সুখী যিনি প্রয়োজনের তুলনায় সব সময় বেশি আশা করেন না বা চান না। এক একজন মানুষের কাছে সুখ একেক ভাবে ধরা দেয়। যেমন – কারো কাছে টাকার সুখ, আবার কারো কাছে ভালবাসার সুখ ইত্যাদি। আমরা নিজের জীবনে যত ভালো কাজ করবো, আমরা সেরকমই ফল পাবো। তাই সব সময় সবাইকে সুখী রাখার চেষ্টা করতে হবে। সন্তুষ্টির ব্যাপারটা আমাদের নিজেদের উপরই নির্ভর করে। অত্যধিক সুখ আশা করা সুখ লাভের পথে একটি বড় বাধা। ডেনিস ওয়েটলি বলেন – “সুখ হল প্রতি মিনিটে প্রেম, অনুগ্রহ এবং কৃতজ্ঞতার সাথে বেঁচে থাকার আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা”।জীবনের প্রতিটি মিনিট উপভোগ করতে শিখতে হবে। সুখ পেতে চাইলে ইহকালে সব সময় সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে হবে ।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসে সুখ দেখেছেন। আবার সুখ অর্জনের জন্য কর্মকেও তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন – “কপালে সুখ লেখা না থাকলে সে কপাল পাথরে ঠুকেও লাভ নেই। এতে কপাল যথেষ্টই ফোলে, কিন্তু ভাগ্য একটুও ফোলে না”। কবি স্রষ্টা প্রদত্ত মেধা বা প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে তথা নিজ কর্মের মাধ্যমে উনার দারিদ্রতাপূর্ণ অবস্থা সত্তে¡ও সন্মান লাভের শীর্ষে পৌঁছেছেন ও সুখ লাভ করেছেন।তাই আমরা দেখি তিনি দারিদ্রতা প্রসঙ্গে বলেছেন, “হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছো মহান। তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান”।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘পৃথিবীতে এসে যে ব্যক্তি দুঃখ পেলনা, সে লোক ঈশ্বরের কাছ থেকে সব পাওয়া পেলনা’। বারেবারে মৃত্যু-দুঃখ-অপমান রবীন্দ্রনাথকে সহ্য করতে হয়েছে উনার সৃষ্টিপথে যা তিনি প্রকাশ করেছেন বহুভাবে, “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবুও আনন্দ, তবুও অনন্ত জাগে”। উনি আমাদের বিরহ ক্লান্ত প্রাণে সুধা ঢেলেছেন – আশার বাণী শুনায়েছেন। তিনি সুখ ও দুঃখকে সমান ভাবে নিয়েছেন। যেমন –
“সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়।
সে কি কেবলই চোখের জল?সে কি কেবলই দুখের শ্বাস?
… … ….
আমার চোখে তো সকলই শোভন,
সকলই নবীন, সকলই বিমল,সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন,
বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল—সকলই আমার মতো।
… … ….
ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে,জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,
হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে আকাশের তারা তেয়াগে কায়।
আমার মতন সুখী কে আছে।আয় সখী, আয় আমার কাছে –
সুখী হৃদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ”।- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সুখ লাভে আমাদের নিরলস ভাবে কাজ করে যেতে হবে। আবারও বিশ্বকবির ভাষায় বলি – “আসবে পথে আঁধার নেমে , তাই ব’লেই কি রইবি থেমে”।বিশ্বকবির “নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস” কথাগুলিকে আস্থায় এনে দোদুল্যমান চিন্তা বা মোহ থেকে সরে আসতে হবে। আমাদের উচিত জীবনে যা পাওয়া গেছে তা নিয়ে সন্ত্তুষ্ট থাকা এবং নিজের চেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীকে দেখা। যেসব দেশে বৈষম্য ও ভেদাভেদ কম এবং রাষ্ট্রীয় সহায়তা বেশী ঐ সব দেশের মানুষ তুলনামূলকভাবে বেশী সুখী। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দেশ গড়ার লক্ষ্যে ব্যক্তি ও দেশ হিসাবে আমাদেরকে এই দিকেও বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে মনে করি। নিজেকে সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি বলে মনে করলে তাতে লাভ ছাড়া ক্ষতি নাই। “পুষ্প আপনার জন্য ফুটে না। পরের জন্য তোমার হৃদয়-কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও” -সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। মানুষ যেদিন ফুলের মত পরের কল্যাণে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে পারবে সেদিনই সমাজ জীবনে দুঃখ যন্ত্রণা ও বৈষম্যের অবসান হবে – মানবের জীবন হয়ে উঠবে আনন্দময়, কল্যাণময় ও সার্থকতায় উজ্জ্বল।

এই লিখায় কিছু উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। কোন ভুল-ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি কামনা করচ্ছি। এই লিখাটিতে যাদের বাণী ও কথার উদ্ধৃতি দিয়েছি – সহযোগীতা নিয়েছি, উনাদের সবার প্রতি রইল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। সবাই সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন। ধন্যবাদ।