খুরশীদ শাম্মী
বদ্ধ ঘরের সিলিং তুমি। আমার বর্তমান পৃথিবীতে তুমি-ই আকাশ। বিদ্যুৎ আলোয় স্থির করে রেখেছ তোমার বৈচিত্র। রাত ও দিনের পরিবর্তনেও তোমার রূপের হয় না কোনো বদল। দেখতে দেখতে তোমাকে খুব আপন লাগে আজকাল। মনে হয়, মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা কথাগুলো বলবার একমাত্র নির্ভরযোগ্য পাত্র তুমি। গত সাত বছর তোমার আমার সম্পর্ক আমার কাছে কখনো মনে হয়েছে বন্ধুত্ব, কখনো প্রেম। তবে আমাদের শত্রুতা হয়নি কোনোদিন। হবে-ই-বা কী করে? সম্পর্কটা যে শুধু একতরফা। তুমি তো আমাকে জানতে চেষ্টা করোনি আজও। আবার উপেক্ষাও করোনি কখনো, নীরব থেকেছো প্রতিটি মুহূর্ত। এভাবে বেঁচে থাকা আমার আর ভালো লাগে না। আমি খুব ক্লান্ত। তোমার সাথে আমার শত্রুতা হলে, বিচ্ছেদ নিশ্চিত। যেভাবেই হোক, তোমার সাথে আমার বৈরি ভাব করা জরুরি। তবে তার আগে তোমাকে আমার জীবনের খুব গোপন ও বেদনাদায়ক গল্পটি বলবো। যে গল্পের কারণে তুমি আর আমি এতো কাছাকাছি। গল্পটি শুনতে না চাইলেও তোমাকে আমি বলবোই। অনেক রাত হয়েছে জানি, তবুও বলবো। আজই বলবো।
সিঁদুর আমি পরি না। সে’জন্য প্রতিদিন সকাল বিকাল নাস্তার মতো শাশুড়ির গালমন্দ খাই। গালমন্দগুলো কখনো চিংড়ির সাথে করল্লা ভাঁজির মতো মিতিতা লাগে, যাকে মিষ্টি তিতা বলে। আবার কখনো নিমপাতার মতো খাতিতা লাগে, যাকে খাট্টা তিতা বলে। তবুও আমি সিঁদুর পরি না। আমার স্বামী শৈলেন আমাদের বৈবাহিক জীবনে কখনো আমার সিঁদুর না পরা নিয়ে কোনো কথা বলেনি। তবে, শাশুড়ির অতি চেঁচা-চেঁচিতে তাঁকে দু’-একবার বলতে শুনেছি, “মা, তোমার ওই ধর্ম-ধর্ম করে কারো ব্যক্তিগত ভালোলাগাকে উপেক্ষা করার কোনো যুক্তি আমি খুঁজে পাই না। তুমি এগুলো নিয়ে ঝামেলা না করে বরং তোমার পুত্রবধূর ভালোদিকগুলো দেখার চেষ্টা করো। দেখবে, ওর সিঁদুর না পরা তোমার কাছে তুচ্ছ মনে হবে।”
পুত্রের অমন মন্তব্যে আমার শাশুড়ি প্রতিবারই তেলে বেগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই করে তুলেছেন পরিবেশ। এক নিঃশ্বাসে বলে গেছেন এক নদীসম অভিযোগ, “হইছো তো তোমার বাবার মইতো! বাড়িতে ঠাকুর আসার কথা শুইনলে তোমার কাইজের পাহাড় জইমে, পূজার কথা শুইনলে গায়ে জ্বর আইসে। আর ঘরে আইনছো এক বিদ্যাদেবী সরস্বতী, যার কিছুতেই খুঁইজে পাই না দেবীর ছোঁয়া। ক্যাইন যে তার বাবা-মা নাম রাইখছিলে সরস্বতী? বুইঝে উঠতে পারি না। দুই ক্লাস লেখাপড়া কইরে ধম্মের মাথা খাইয়ে বইছে। বলি, এমন হইলে, জাতপাত বাঁচাবি কী কইরে? সন্তান মানুষ কইরবি কী কইরে?”
শাশুড়ির অমন প্রশ্নের উত্তর কখনোই দেয়ার চেষ্টা করেনি শৈলেন। বরং রসিকতা করে বলেছে, “মা, আগে তো তোমার দেব-দেবীর আশীর্বাদে আমাদের ঘরে সন্তান আসুক! তারপর না হয় দেখা যাবে। তখন না হয় তুমিই ধর্ম-কর্ম শিখিয়ে মানুষ করে নিও। জাত বাঁচাবার দায়িত্ব তো ঠাকুরমা তোমাকেই দিয়ে গেছেন। মনে নেই? বাবা পূজোর ছুটিতে বন্ধুদের সাথে অন্য শহরে ঘুরতে যেতেন বলে ঠাকুরমা রাগ করে বাবাকে গালাগাল করতেন আর তোমাকে পূজোর সকল ভার দিয়ে দিতেন। এতদিন ধরে যখন জাত বেঁচে আছে, খুব শীঘ্র এই জাতের মৃত্যু হবে বলে মনে হয় না আমার।”
এগুলো তো গেলো শুধু আমার শাশুড়ি মায়ের কথা। পুত্র হারাবার ভয়ে কষ্ট হলেও তিনি মেনে নিয়েছেন আমাকে। একই বাড়িতে থাকার অধিকার দিয়েছেন। আর, আমার মা? যিনি আমাকে গর্ভে ধরেছেন, তিনি তো তাঁর পতিদেবকে খুশী করতে দুর্গা দুর্গা করে মুখের উপর কপাট আটকে দিয়েছিলেন সেদিন, যেদিন আমি রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে বিবাহ করে তাঁর আশীর্বাদের জন্য বাড়ি গিয়েছিলাম। যদিও শৈলেনকে আমার মা খুব পছন্দ করতেন। তবুও তাঁকে বিবাহ করার অপরাধে আমার মুখের উপর কপাট আটকে দিতে কার্পণ্য করেননি। আমার প্রথম অপরাধ ছিল, ঠাকুর ডেকে কুণ্ডলী না দেখিয়ে, লগ্ন ও শাস্ত্র না মেনে বিবাহ করা। আমার দ্বিতীয় অপরাধ ছিল, সিঁথিতে সিঁদুর না লাগিয়ে, মঙ্গলসূত্র বিহীন হেঁটে চলা। আর তৃতীয় অপরাধ ছিল, আমার বাবার মনে কষ্ট দেয়া ও পরিবারের সুনাম ক্ষুণ্ণ করা। আমি নাকি তাঁর হতচ্ছাড়া –মুখপোড়া সন্তান। আমার মতো নাস্তিকের নাকি নরকেও যায়গা হবে না। এ কথা বলে তিনি আমাকে চটিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তাঁকে তাঁর দেবতাদের অশেষ কৃপায় তাঁর প্রতিদিনের খাবার তালিকায় তাঁর স্বামীর প্রহার থাকাকে বাহবা জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম। সেদিনের পর আমার আর বাবার বাড়ি ফিরে যাওয়া হয়নি।
দেখলে তো? কেমন ভুলো মনা হয়েছি! গল্প করেই যাচ্ছি, অথচ তোমাকে আমি আমার নিজের পরিচয় দেইনি এখনও। হয়তো ইতোমধ্যে অনুমান করেছ, কিন্তু কখনো জানতে চাওনি। আজ যখন বলতে শুরু করেছি, সংক্ষেপে সবই বলিঃ
আমি সরস্বতী গুহ। সমাজবিজ্ঞানে এম এ পাশ করেছি এক প্রকার বিদ্রোহ করে। একটা কলেজে লেকচারার হিসাবে চাকরি করি তখন। শিক্ষার্থীদের সিলেবাস কিংবা বইয়ের বাঁধাগত লেখাপড়ার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনে বাস্তবতার মুখোমুখি বিষয়গুলো শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করি। ছাত্র-ছাত্রীরা সেগুলো পছন্দ করে। তারা আগ্রহ নিয়ে শুনে এবং প্রশ্ন করে নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেরাই করার চেষ্টা করে, যা’ আমাকে নতুন ও সময়পযোগী শিক্ষা দিতে অনুপ্রাণিত করে। সেজন্য আমাকে নিয়মিত পড়তে হয়, সিনেমা, নাটক, ডকুমেন্টরি দেখতে হয়। বৈকালের অধিকাংশ সময় আমি বাড়ির ছোট লাইব্রেরীতে থাকি। দেশ-বিদেশের নানান বই ও ম্যাগাজিন পড়ি। ছুটির দিনগুলোতে সিনেমা দেখি। এর মাঝেও সংসারের অধিকাংশ কাজ নিজেই করি। পাশাপাশি দায়িত্ব নিয়ে শাশুড়িকে ডাক্তার দেখানো, আত্মীয়স্বজন বাড়িতে আসলে তাদের আপ্যায়নও করি। কিন্তু বাদ পড়ে যায় শুধু পূজোর ঘর পরিচর্যা ও দেব-দেবীদের আপ্যায়ন। এ দু’টো কাজ অবশ্য আমার শাশুড়ির থেকে ভালো কেউ করতে পারবে না বলেই আমার ধারণা।
শৈলেন দত্ত একই কলেজে চাকরি করে। তবে তার পেশা লাইব্রেরীয়ান। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পাশ করে সে ওই পেশা বেছে নিয়েছে বইয়ের খুব কাছাকাছি থাকার জন্য। পাশাপাশি সে নাট্যচর্চা করে। বন্ধুদের নিয়ে এই মফস্বল শহরে একটা নাটকের সংগঠন পরিচালনা করে। দেশ-বিদেশের নানান বই ও ম্যাগাজিন শৈলেন-ই বাড়িতে আনে। রাত জেগে সে বই পড়ে। গুণিশিল্পীদের অভিনয় দেখে। কখনো কখনো বন্ধুদের নিয়ে নাটকের মহড়া করে। তার জীবন অনেকটা ষড়ঋতুর মতো। গ্রীস্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত, সবগুলো ঋতুর আমেজ আছে। ঘুরে ঘুরে ঋতুগুলো যে আসা যাওয়া করে তা’ প্রস্ফুটিত হয় শৈলেনের আচরণে। সুযোগ পেলেই সে তার দল নিয়ে হারিয়ে যায়। কিছুদিন পর সে ফিরে আসে রংধনুকে বুকে ধরে। ওই রঙে সে তার ভালোবাসা আঁকে। শীতল হয়ে কাজে মনোযোগ দেয়। টাপুর-টুপুর ভাবনাগুলোতে কলম ভিজিয়ে সে তার গল্প-কবিতা লেখে। মায়ের জন্য তার প্রেম শরতের কাঁশফুলের মতো শুভ্র। বাড়ির আঙিনায় কবিগানের আসর ডেকে হেমন্তের নবান্ন উৎসব বিলিয়ে দেয় ছোট্ট এই শহরে। আবার প্রয়োজনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে বৈশাখী ঝড়ের রূপ ধারণ করে। তখন হয়ে যায় সে ভিন্ন এক শৈলেন।
প্রকৃতির মতো বিশাল মনের শৈলেনের পাশে আমাকে এক টুকরো পাথর ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। নীতির বাইরে অনেকটা আবেগ নিথর একজন মানুষ আমি। শৈলেনের জন্য এক সমুদ্র ভালোবাসা থাকলেও নীতির ভাঁজে তাকেও সোনামুখী সুইয়ের গুঁতো খেতে হয় সময় সময়। কখনো কোর্ট-মার্শাল জারি হয় তার বিরুদ্ধে। অথচ সে বাড়িতে না থাকলে বিষণ্ণতা আমাকে আগলে ধরে। কাজে মন বসে না। নিয়ম ভেঙে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে আসবার আবদার করি।
সেবার, শৈলেন নাটকের দল নিয়ে অন্য শহরে গিয়েছে প্রায় পাঁচ দিন। শীত ঝেঁপে বসেছে। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলান দিতেই আলসেমিটা আঁটসাঁট করে বসে পড়ে আমার মধ্যে। কাজের মেয়ে ঊষাকে ডেকে বেডরুমে চা দিতে বলি। চায়ের কাপে ঠোঁট মিলাতেই সংবাদপত্রের পাতায় আটকে যায় আমার চোখ। গরম চা, পুড়ে যায় জিভ। বিরক্ত লাগে বেশ। কিন্তু, ছবিটা আঠার মতো কিছু। চোখ সরাতে পারি না। চায়ের কাপ টেবিলে রেখে মনোযোগ দেই ছবির দিকে ও ছবির সাথে সম্পৃক্ত লেখাতে। ছবিটা নিশ্চিত এক হিন্দু দম্পতির। কেননা নারীর সিঁথিতে লাল সিঁদুর। শিরোনামটা ঝাপটা দিয়ে জাগিয়ে তোলে আমাকে, “সিঁথির সিঁদুর বাঁচাতে মৃণালিনীর আকুতি”। এক নিঃশ্বাসে সংবাদটা পড়ে ফেলি। সংবাদের সারমর্ম, মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে মৃণালিনীর স্বামীর ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়েছে। ক্যানসারের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল। তবুও স্বামীর চিকিৎসা করাতে চায় সে। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন নগদ অর্থ, যা’ তার পরিবারের নেই। সেজন্য সে দেশবাসীর কাছে আকুতি জানিয়েছে। তার সাথে যোগাযোগের জন্য টেলিফোন নাম্বার ও অনুদানের জন্য ব্যাংক একাউণ্টের তথ্য দেয়া আছে। মৃণালিনীর আবেদনে সাড়া দেয়ার জন্য আমার মন এক প্রকার দাবী তোলে, “ধর্ম-কর্ম তো কিছুই করো না, মেয়ে! অন্তত একজন অসহায় নারীকে তার ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করো। মানবতা বলেও তো কিছু আছে।” মৃণালিনীকে নিয়ে এলোমেলো ভাবতে ভাবতে সংবাদপত্রের পাতা উল্টাতেই আরেকটা ছবি দৃষ্টিতে খোঁচা দেয়, রক্তলাল ব্যকগ্রাউণ্ডে কালো ছায়ায় একজন পুরুষ একজন নারীকে গলা টিপে ধরেছে। ছবিটার সংবাদের শিরোনামঃ “হাত কেটে সিঁদুর দান, তারপরই গলা টিপে হত্যা”। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি ওই সংবাদটিও। পড়া শেষে প্রচণ্ড রাগ হয় আমার ভেতরে। মনের ঠিক কেন্দ্র বিন্দুতে এক ফোঁটা লাল রক্ত যেন কেরোসিনের ছোঁয়ায় দাউ দাউ করে জ্বলে। আর ছাইগুলো লাল সিঁদুরে পরিণত হয়। তখন স্মৃতিতে জেগে ওঠে আমার শৈশব, ভয়ে কোঁকড়ানো আমার মায়ের মুখমণ্ডল! সারারাত স্বামীর হাতে মার খেয়ে পাখিডাকা ভোরে চাপ-কলের ঠাণ্ডা জলে স্নান করে সিঁথিতে গাঢ় করে সিঁদুর লাগিয়ে উনুনে জল গরম করায় ব্যস্ত থাকত আমার মা তার ওই পতির জন্য। ভোরের আলোও উজ্জ্বল করতে ব্যর্থ হতো আমার মায়ের মলিন মুখখানা। আমি তখন স্কুলে পড়ি, একদিন ভোরে মায়ের হাত, গলা ও চিবুকে ছোপ ছোপ রক্ত দেখে ভয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করি, “তোমার গায়ে এত রক্ত কেন, মা? তোমাকে বাবা কেন মারে? মা, তোমার…।” আমার মা আমাকে এক হাতে তার বুকে জড়িয়ে ধরে, অন্যহাতে আমার মুখ চেপে ধরে, আমার কণ্ঠ রোধ করে। তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে, “এগুলো রক্ত না, সিঁদুর! সিঁদুর ঢালতে গিয়ে একটু বেশিই পড়ে গেলো। সিঁদুর নারীর অলংকার, সিঁদুর নারীর ভালোবাসা। তা মুছতে নেই।” আমি আমার মুখ থেকে মায়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বলি, “মিথ্যা বলছো তুমি, মা। এগুলো সিঁদুর না। রক্ত!” মা আমাকে চুমু খেয়ে বলে, “চুপ কর, মা। রক্তলাল সিঁদুর, এমনই হয়!”
নেপথ্যে আমার শাশুড়ি-মায়ের অভিযোগের সুর বেজে চলে, “সংসারে কেউ থাইকলে না তুলসী তলায় সন্ধ্যা দেওয়ার জইন্যে।” এ অভিযোগ নিত্যদিনের। এতদিনে গা সয়ে গেছে আমার। শাশুড়ির উপর একটুও বিরক্ত হয় না মন। বরং নিজেকে শান্ত করতে ঠাণ্ডা চায়ে আবার চুমুক দিতেই শৈলেনের কণ্ঠ, “কই গো, সখী, কই?”
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালে আমার হাতে ধরিয়ে দেয় সে একটা বই। প্রথা বিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ রচিত বই “নারী”। বইটি নিয়ে আমার আগ্রহ সেই কবে থেকে। শুনেছি, ১৯৯৫ সালের ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। আবার ২০০০ সালের ৭ মার্চ উচ্চ-আদালত বইয়ের নিষিদ্ধকরণ আদেশ বাতিল করে নেয়। তখন শৈলেন বইটি কিনে এনেছিল, কিন্তু বাড়ির লাইব্রেরী থেকে কে যে পড়তে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি, তা’ আর মনে করতে পারিনি। এতদিন পর আবার বইটি হাতে পেয়ে খুশিতে আমি আতœহারা। বইটি সম্পর্কে ইতোমধ্যে বেশ শুনেছি। সবাই বলে, স্বাধীন বাংলাদেশে নারীবাদ বিষয়ক প্রথম বই। কিন্তু, কোনো কারণে পড়া হয়নি। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে নতুন বইয়ের কাগজ-কালীর গন্ধ নেই। দু’-একটা পাতা উলটাই। পাশে এসে সে ছোট্ট করে আমার গালে চুমু খায়। তাকে জড়িয়ে ধরে আমি এক চিমটি খুশি ছুঁয়ে দেই মাত্র। পরক্ষণেই আলতো করে তার মুখ ফিরিয়ে দিয়ে বলি, “ও মা, সিগারেটের গন্ধ! পাঁচ দিনে শরীরে পচন ধরেছে যেন। দ্রুত স্নান করে এসো। আমি চা বানিয়ে আনি। চায়ের সাথে নাড়ু, মুড়ি চলবে তো? না কি সচীনের দোকানের লুচি, মিষ্টি ছাড়া বিকেলের নাস্তা হবে না।”
- রাত হয়ে গেলো। আর তুমি বলছো, বিকেলের নাড়ু-মুড়ি? তোমার ওই পথ্যের মতো গরম জল আর মুড়িতে আমার চলবে না, ভাত খাবো। পুরোদিন কিছু খাওয়া হয়নি। আসতে বেশ ধকল গেলো। মাঝ পথে বাস নষ্ট হয়ে গেলে ঠেলা গাড়িতে চড়ে আসতে হয়েছে বেশ কিছুটা পথ। দোকানপাটও ছিল না যে কিছু খাবো। সওজল অবশ্য বলেছিল, ওর কোন পিসির বাড়ি আছে কাছাকাছি। কিন্তু ইচ্ছে হলো না যেতে। ঘরে যদি অপেক্ষায় থাকে রূপসী জায়া, পিসির কথা না শোনে কায়া।
- ও মা! তাই তো বলি, চেহারাটা এমন শুকনো কেন? শরীর ধুলোয় চটচট!
- তুমি শুধু শুকনো চেহারা দেখলে? মন যে শুকিয়ে চৌচির! ভেবেছি, এবার দু-চারটে সন্তানের বাবা না হয়ে আর বাড়ির বাইরে বের হবো না।
- গত পাঁচ বছর ধরে একই কথা শুনি।
- এবার সত্যি করে বলছি। মা’কেও না হয় বলবো তার দেবদেবীদের আশীর্বাদ এনে দিতে।
- আশীর্বাদ? তা দেখা যাবে। এবার না হয় রসিকতা রেখে স্নান করে এসো। ঊষাকে গরম জল দিতে বলি।
- গরম জলের দরকার নেই। ঠাণ্ডা জলে স্নান করলে ঘুম ভালো হবে। তুমি বরং ঊষাকে খাবার দিতে বলো। খিদে ও ঘুম আমাকে আঁকড়ে ধরেছে। গত পাঁচ রাত ঘুম হয়নি একটুও।
- ইস্! অনেক তো হলো। বয়সও তো কম হয়নি আমাদের। এভাবে নিদ্রাবিহীন ঘুরাঘুরি করে শরীরটাকে শাস্তি দেয়া একটু না হয় কমিয়ে আনার চেষ্টা করো।
তারপর? তোমার গলা আটকে আসছে কেন? তুমি থেমো না, সরস্বতী। গত সাত বছর তোমার নিথরতা আমাকে বোকা বানিয়ে রেখেছে। তোমাকে আমি আমার মতো জড় পদার্থ মনে করে এসেছি। অথচ, তুমি অদৃশ্য স্ফুলিঙ্গ! তুমি খরগ্রোতা নদী। তুমি দোদুল্যমান তরঙ্গ। তুমি সংগ্রামী সৈনিক। তোমার আত্ম-কাহিনী আজ সম্পূর্ণ শুনতে চাই। বলো সরস্বতী, বলো।
গাঢ় নিঝুম রাত। স্বপ্নরা দখল করেছে মানব রাজ্য। শৈলেন তখনও দেখা পায়নি স্বপ্নের। পাশ ফিরে শুয়েছে মাত্র। ভীষণ তেষ্টা পায় আমার। উঠে বসি। পাশের টেবিল থেকে ভরা গ্লাস তুলে হাতে নেই। মৃদু আলোয় হঠাৎ চোখ পড়ে আয়নায়। চমকে উঠি! চোখ দু’টো মাটির দিকে সরিয়ে নেই। মনে হলো ভুল দেখেছি। জল পান করার চেষ্টা করি। জল বুকে আটকে যায়। গ্লাসটা টেবিলে রেখে বুকে হাত দিয়ে সাহস যোগাই। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করি। পা দু’টো থরথর করে কাঁপে। ভয়ে বিছানায় বসে পড়ি আবার। বাঁকা করে আয়নার দিকে তাকাই। ঘোলা। তবে দৃশ্য বদলায়নি। এবার শক্ত হয়ে চপ্পল পায়ে দাঁড়াই। আয়নার সামনে যাই। চোখ তুলে নিজেকে দেখি। খুব কাছ থেকে দেখি। দেখি, আমার মায়ের প্রতিকৃতি! সিঁথিতে রক্তলাল সিঁদুর। আমি আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হই। ক্রোধের লাভা টগবগিয়ে ফুটে ওঠে। ড্রেসিং টেবিলে রাখা প্রসাধনীগুলো ছুঁড়ে ফেলি। শৈলেন হতভম্ব হয়ে বিছানা ছেড়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। “কী হয়েছে? তোমার, কী হয়েছে?” বলে আমার কাঁধে হাত রাখে।
আমি চিৎকার করে বলি, “এক হাতে তুলে দাও হুমায়ুন আজাদের “নারী” আর অন্য হাতে সিঁথিতে লেপ্টে দাও নিজের শরীরের রক্ত সিঁদুর। এ কোন হিপোক্রেসি?”
শৈলেন নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলে, কী বলছো, সরস্বতী? এ অভিযোগ ভারী অন্যায়। হয়তো কিছু ভুল দেখছো। আমি জানি তুমি সিঁদুর ভয় পাও। সিঁদুর তোমার কাছে রক্ত মনে হয়। তোমাকে কেন আমি সিঁদুর পরাবো?
আয়নার দিকে আঙ্গুল তুলে আমি নিথর দাঁড়িয়ে থাকি।
শৈলেন আমার সিঁথির দিকে তাকায়। অতঃপর শব্দগুলো এলোমেলো করে বলতে থাকে, “বিশ্বাস করো, সতী, এ আমি ইচ্ছে করে করিনি। নাটক শেষে গলার পৈতা খোলা হয়নি ভুলে। হয়তো পৈতায় খোঁচা লেগে কেটেছে কোথাও। নয়তো আমার হাতের নখ, না, কিংবা কব্জীর ব্যাণ্ডে লেগে কেটেছে। বিশ্বাস করো, সতী, আমি …”
শৈলেনের কথাগুলো মিহি হতে লাগে আমার কানে। আমি ঢলে পড়ি মাটিতে। সে রাত্তিরেই আমাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। শৈলেন নির্দোষ প্রমাণিত হয় প্রতিটি পদে পদে। ক্ষমা চাইবার ক্ষমতা নেই আমার। সব ভুলে আমার মা আসেন হাসপাতালে আমাকে দেখতে। তাঁর সিঁথিতে রঙ নেই। বদনখানা মলিন। বিবর্ণ তাঁর দৃষ্টি। স্পষ্ট দেখা যায় তিনি সিঁদুর মুছে এসেছেন আমাকে দেখতে। মাতৃত্বের মমতা বিলিয়ে দেন তিনি আমার কাঁধে, চোখে, সর্ব শরীরে। তার অশ্রু আমাকে ব্যকুল করে তোলে। আমি পারিনি হাত উঁচু করে আমার মায়ের বেদনা মুঁছে দিতে। নিথর দেহে মা’র অন্তরে জমে থাকা দাগগুলো গণনা করার ব্যর্থ চেষ্টা করি। তারপর একদিন এ্যাম্বুলেন্সে করে আমাকে বাড়িতে আনা হয়। এ রুমটা হাসপাতালের সব যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজায় আমার জন্য। শাশুড়ি বাড়িতে আইন করেন, সিঁদুর পরে কেউ আমাকে দেখতে আসতে পারবে না। শৈলেন নাটক, লেখালেখি সব ছেড়ে দিয়েছে প্রায়। কাজ শেষে শুধু বসে থাকে আমার বিছানার পাশে একটা চেয়ার পেতে। ওর কিংকর্তব্য-বিমূঢ় দৃষ্টি আমাকে কাঁদায়, আমার অন্তরে ঝর্ণা ধারা বয়ে যায়, যে ঝর্ণার জলে স্নান করে প্রতিদিন শৈলেন-ই। ইচ্ছে হয় ওকে বুকে জড়িয়ে ধরি। পরক্ষণেই আমার অক্ষমতা ঝড়ের মতো তোলপাড় করে তোলে আমাকে। আমি যেমন নিথর, তেমনই পড়ে থাকি।
খুরশীদ শাম্মী, টরন্টো, অন্টারিও