কবি সাহিদুল আলম টুকুর কবিতায় অনুভূতির রোদ-ছায়া নান্দনিক হাহাকার তোলে। মানুষের হৃদয়ে কবিতার অধিবাস প্রাগৈতিহাসিক কালের। মানুষ তার জন্মযন্ত্রণা থেকে শুরু করে জীবনযাপনের যন্ত্রণার মধ্যে দিয়েও অপর মানুষ, লোকালয় ও প্রকৃতির সঙ্গে যে সম্পর্ক গড়ে তোলে, আমৃত্যু লালন করে, তাঁর কবিতায় রয়েছে সেই সম্পর্কের গভীর উদ্ভাসন। শিল্পমূল্য দিয়ে নয়, এ উদ্ভাসনকে স্পর্শ ও অনুভব করা যায় কেবল মানুষের রহস্যময় অন্তর্লীন হাহাকার দিয়ে। যাদের হৃদয়ে এমন হাহাকার নেই, সময়ের দায়ভাগী মানুষের মুখ, লোকারণ্য ও বন-নদী-ভূমি নেই, সাহিদুল আলম টুকুর অন্ধকারের এই মৌন অবগাহন তাদের হয়তো স্পর্শ করবে না। কিন্তু জীবনমৃত্যুর অন্তহীন রহস্যকে যিনি তার সময়ের সান্নিধ্যে ছুঁতে চাইবেন, দূরগামী সময়ের তরঙ্গের কাছে সে রহস্যকে সমর্পন করবেন, তিনি এসব কবিতায় খুঁজে পাবেন নির্জন স্তব্ধতার নতুন এক সংজ্ঞা। যে স্তব্ধতা নিয়ে নির্ভার হয়ে বসে থাকা যায় সন্ধ্যার সমুদ্রের বেলাভূমিতে। কিংবা ন্যাড়া পাহাড়ের চূড়াতে। গভীর অন্ধকার গ্রামের রাতের মাঠের ধারে বসে থাকা সে স্তব্ধতাকে ঝিঁ-ঝিঁর একটানা চিৎকারও পারে না চিড় ধরাতে।
– ইমতিয়ার শামীম

কবি সাহিদুল আলম টুকুর জন্ম ২৭ নভেম্বর ১৯৬৫ সালে ফরিদপুরে। লেখাপড়া করেছেন কাদিরদী প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাদিরদী উচ্চ বিদ্যালয় ও সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ ফরিদপুরে। ১৯৯১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএসএস করার পর পড়াশুনা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন যুক্তরাজ্যের রেডিং ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্রের সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের ব্রæকলিন কলেজ এবং কানাডার জর্জ ব্রাউন কলেজে। পেশাগত কাজ করেছেন বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সংবাদপত্রে। পৃথিবীর জনঅরণ্য ভ্রমণে তাঁর নিত্য সঙ্গী প্রকৃতি। ১৯৮১ সাল থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র, লিটল ম্যাগাজিন এবং সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থে নিয়মিতভাবে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হলেও তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ফণার মুখোশ’ প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মৌন অন্ধকার’। কবি সাহিদুল আলম দীর্ঘ এক যুগ টরন্টো থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’ এ অর্থনীতি বিষয়ে কলাম লিখেছেন। টরন্টো ফিল্ম ফোরাম এর অর্থ বিষয়ক সম্পাদক কবি সাহিদুল আলম টুকু ২০০৩ সাল থেকে তিনি কানাডার টরন্টোতে বসবাস করছেন।

টরন্টোতে বাংলাদেশ

‘আমি যত দূরে যাই
আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে’

টরন্টোতে আমাদের বাস
আমরা বাংলাদেশ
আমাদের আছে শহীদ মিনার
সাবাস বাংলাদেশ
পতাকা উড়ে সিটি হল এ- ২৬শে মার্চ
পতাকার রঙে সিএন টাওয়ার সাজে বাংলাদেশ

আমাদের আছে ডলি বেগম
বাংলায় কথা কয়
সভা-সমিতি, দুঃখ-শোকে তাঁকে পাওয়া যায়

আমাদের আছে ড্যানফোর্থ বাংলা টাউন
বাংলা কাগজ, জাহাঙ্গীর ভাই-
টরন্টো ফিল্ম ফোরাম, মনিস – বাবুল ভাই

জারুল বোনের মেয়েটি

জারুল গাছের ছায়ায় যে মেয়েটি
আকাশ ছোঁয়া মৌনতা নিয়ে
হেঁটে এসেছিল একদিন
নীল একটা কামিজ পরে
নিঃশব্দে ছন্দময় পা ফেলে ফেলে
মেয়েটির কোমলতা আর মাধুরীভরা মুখ
অবনত মাটির দিকে
পথের প্রান্ত খোঁজে না সে
মৌনতায় চৌচির বাতাস নিঃশ্চুপ
আকাশের সমস্ত নীল রঙ যেন তার শরীরে
আর ছোপ ছোপ মেঘের আভা তার মুখে
মেঘলা হয়ে ভেসে গেল সে শ্রাবণ আকাশে

হৃদয়পুর

তোকে নিয়ে খুব বিপদে আছি
সময় নেই অসময় নেই
তুই হৃদয় খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করিস
প্রান্তহীন হৃদয়
জলকাদা নরম পালক
যতনে হয়ে যায়
মূর্ত বাক-প্রতিমা, নানক
যেভাবে যেমন তুই চাস
অতীত যা সব স্মৃতি সম্পদ
বেদনা বিদূর ছায়াভাংগা পথ
আমি দেখি অন্তরাত্মার চোখে
সুখের পলেস্তারা খসে পড়ছে
বেরিয়ে গেছে দুঃখের দুধ দাঁত
ইট সুরকী বালুর নখ
কাণ্ডহীন গাছের শেকড়
তোকে নিয়ে আমি খুব বিপদে আছি
সময় নেই অসময় নেই
তুই চলে যাস হৃদয়পুর

কাকতালীয় স্পর্শ

মেয়েটির হাতে
কাকতালীয় আমার হাতের স্পর্শ
মেয়েটি বললো
সাপের মত ঠাণ্ডা হাত
প্রশ্ন করতে পারিনি
সে সাপের স্পর্শ পেয়েছিল কিনা
মেয়েটি দরজা খুলে চলে গেছে দূরে
যেতে যেতে বললো
বাহ! চারিদিকে কী আলোর ছড়াছড়ি
প্রশ্ন করতে পারিনি
সে অন্ধকার দেখেছে কিনা
মেয়েটি বললো
কি সবুজ! কি দারুণ!
প্রশ্ন করতে পারিনি
সবুজের আগে বা পরে
সে হলুদ দেখেছে কিনা
আর এরই মধ্যে মেয়েটি
সবুজ দিগন্তে আলোর পানে হারিয়ে গেল
আর আমি
হলুদ নদীর পাড়ে
হেঁটে চলেছি নিরন্তর।

নিঃসঙ্গতা

যখন তুমি একা
যখন তুমি জানালায়
দেখছ আকাশ, উড়ে যাওয়া মেঘমালা
অন্য বাড়ী ছাদ তখন
তোমার কাছে আসা
ছায়াময় মূর্তির প্রথম উচ্চারণ
দুপুর বেলায় চাঁদের আলো
জানালার সঙ্গী পর্দা
তখন ঢেকে ফেলে
মরচে ধরা লোহার শিকগুলো
আর তুমি ফিরে যাও
নির্জন নির্জীব বিছানায়

আমার কয়েকজন বন্ধু

আমার বন্ধু লেখক এবং কবি
প্রবন্ধ পড়েন
নিবদ্ধ হন সুধী

আমার বন্ধু প্রচ্ছদ শিল্পী
প্রচ্ছদ আঁকেন ভীষণ
তবু তিনি মৌন থাকেন
ধ্যানে আরাধ্য

আমার বন্ধু প্রকাশক
প্রকাশ করেন বই
মুনাফা নেই
আনন্দ তার প্রকাশে ভাল বই

আমার বন্ধু গায়ক
বাজান গীটার হাওয়াইন
দলছুট হয়ে দলে ঢোকেন
দর্শক মহীয়ান

আমার বন্ধু ভাস্কর
খোদাই করেন কাঠ
কালো মাটি দিয়ে গড়ে তোলেন
শিল্পের কারুকাজ

আমার বন্ধু চাষী
ফলান ধান পাট
তবুও অভুক্ত থাকেন
আসলে কার্তিক মাস।

কবিতার আলোর প্রক্ষেপণ
(কবি মোহাম্মদ কামাল শ্রদ্ধাভাজনেষু)

শুভ্র চুলের কারুকাজময় মুকুট তোমার মাথায়
কবিতার শুভ্রতার নরম পালক
তীর্থ যাত্রার মাঝে ক্ষণিক বিরতি
একরাশ নবীন আলো
তোমাকে দেখে
তোমাকে শুনে
নম্রতায় উচ্চারিত শব্দমালা
নক্ষত্রের আলোয় পেলব
তোমাকে ভালোবেসে ফিরে যায় সকলে
ফিরে যায় আলোর গহ্বরে।

বেদনার আকাশ

বন্ধুরা ঝরে যাচ্ছে
শীতের পাতা ঝরার মতো
একি মৃত্যুর মিছিল
একি মৃত্যুর স্রোত
এখন প্রতিটি দিন শোকের
প্রতিটি মুহূর্ত দুঃখের
আদ্র হয়ে থাকে দুটি চোখ
বেদনায় ভরে থাকে সারাটা মন
জেনেছি জীবন আবাহমান
মৃত্যু অনিবার্য
এ সত্য জেনেও
কাঁদে কেন মন?

কবি শহীদ কাদরী স্মরণে

কবিকে তোমরা আঘাত করো না
তাহলে সে পাথর হয়ে যাবে
সে তো আর হিটলার মুসোলিনি নয়
যে আঘাতে প্রতিঘাতে করবে
কবিকে তোমরা কষ্ট দিও না
তা হলে পৃথিবী প্রকম্পিত হবে
তোমাদের মনে নেই
বেনজামিন মলসসাকে
ফাঁসীর রজ্জুতে ঝুলানোর পর
পৃথিবী সাত মাত্রার ভূমিকম্পের
মতো প্রকম্পিত হয়েছিল
তোমাদের ভালোবাসা, আশ্রয় প্রশ্রয়ে
শুধু হৃদয়ে নয়
সারা পৃথিবীতে
শতশত চন্দ্রমল্লিকা ফুটে উঠবে
তখন সমুদ্রও ধরবে গান
প্রতিধ্বনিত হবে
এভারেস্ট, রকি আর আল্পসের বাঁকে বাঁকে

কমলা রঙের মেয়ে

কমলা রঙের রোদ মেখে
তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছো মেয়ে
তোমার সারা শরীরে রোদের ঝিলিক
তুমি কোথায় যেতে চাও!
সমুদ্রের গভীর নোনা জল তোমাকে ডাকে
সুপিরিয়র হ্রদের মিষ্টি জল তোমাকে পেতে চায়
হিমালয়ে এভারেস্ট
রকি, এন্ডুজ, আল্পস তোমার প্রত্যাশায়
তুমি কোথায় যেতে চাও
অশরীরী আত্মা হয়ে কোথায় লুকাতে চাও
গভীর বনাঞ্চল শেষ হয়ে গেছে
সুন্দরবন, আমাজানের গভীর জংগল
এখন আর অত ঘন নেই
আগুনে পুড়ে গেছে
ক্যালিফোর্নিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া
নিউ সাউথ ওয়েলসের গভীর বনভূমি
পালাতে পারবে না কোথাও
তার চেয়ে কমলা রোদের রঙ মেখে
জীবানান্দের দেশ থেকে ঘুরে আসো

কলকাতা

আমার কাছে কলকাতা মানে
মানিক সুশীল শ্যামল
বড়দি আর কমলদির স্নেহের আঁচল
আমার কাছে কলকাতা মানে
গড়ের মাঠে গড় জনতা
গিরীশ মঞ্চে নাটক দেখে
ট্রামে চড়ে শিয়ালদা
রেলগাড়িতে চ্যাপ্টা হয়ে
হৃদয়পুরে সুশীলদা
আমার কাছে কলকাতা মানে
শঙ্খ ঘোষের শঙ্খ ধ্বনির কবিতা শোনা
প্রতুলদার বাংলার গানে নিবিড় হওয়া
অমলকান্তি নীরেন্দ্রনাথ
চিলের কান্নায়
কেটেছিল তাঁর সারাটি রাত।
আমার কাছে কলকাতা মানে
কলেজ ষ্ট্রীটে বইয়ের দোকান
কফি হাউজের আড্ডা শেষে
কল্পতরু পানের দোকান
আমার কাছে কলকাতা মানে
রবীন্দ্রনাথের পুণ্যস্মৃতি
জোড়াসাকোর ঠাকুর বাড়ি রবীন্দ্রভারতী।

রূপান্তর

হাত বদল হয়ে যাচ্ছে
আমাদের পূর্বপুরুষের বসতভিটা
ধানী জমি বাজারে ব্যবসার ঘর
হাত বদল হয়ে যায়
কুমার তীরে মাছ ধরার সাগরার জায়গা
সরে গেছে বাঁশের সাঁকো
(জয়নাল হয়ে গেছে বেকার)
তার জায়গায় কাট-লহা কনক্রিটের পুল
মেঠো পথের রাস্তায়
এখন বালি সুরকি এসফেল্ট
রাস্তার দুপাশে তাল খেজুর বটের জায়গায়
ইউক্লিপ্টাস, মেহগনী
রাস্তায় বড় বটগাছের জায়গায়
কনক্রিটের যাত্রী ছাওনী
আমাদের পুরাতন স্কুল বাড়ি
যার দেয়ালে, ছাদে জন্মেছিল
আতনজালা গাছ রাশি রাশি
সেখানে এখন ঝকঝকে দালান বাড়ি।
পঞ্চবটী তলায় পাকা বেদী
মসজিদ মন্দির বাদ নেই
সেখানেও ইট লোহার গাঁথুনি
আর আমিও কত কত দূরে সরে গেছি
তবু আমার শৈশব কৈশোর আর তারুণ্যের হাতছানি।

মা

আমার জন্মের পর
আমার মায়ের নাম পাল্টে যায়
তাঁর মা-বাবার দেয়া নাম ‘আমেনা’
এই নামে তাঁর মা’ই আর ডাকেনা
আমার মায়ের নাম হয়ে গেছে টুকুর মা
নানা বাড়ি আমাদের বাড়ি দুই গ্রামের প্রতিবেশী
সকলেই ডাকে আমার মাকে টুকুর মা
আমার মায়ের কাছে
কবি মানেই দু’জন
রবীন্দ্রনাথ নজরুল
তাদের মাথাভর্তি লম্বা চুল
আমার মাথায় চুল লম্বা হলেই
মা বলতেন কবির চুল
মা কি জানে
আমি কবিতা লিখেছি
গোপনে গোপনে কয়েকটা
যদিও হয়নি কবিতা তার একটা
তবুও আমার মায়ের কাছে
আমি কবি
মা আর আমি এখন
পরস্পরের কাছে ছবি