গত ১৬ই অক্টোবর টরন্টোর লবঙ্গ রেস্টুরেন্টে জসিম মল্লিককে শুভেচ্ছা জানান টরন্টোবাসী। (বাম থেকে) শহিদুল ইসলাম মিন্টু, লুৎফর রহমান রিটন, আসাদ চৌধুরী এবং জসিম মল্লিক।

অনলাইন ডেস্ক : টরন্টোর সাহিত্য জগতের পরিচিত মুখ কথাসাহিত্যিক জসিম মল্লিক বাংলা একাডেমির সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার ২০২২ এর জন্য মনোনীত হয়েছেন। গত ১০ই অক্টোবর বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি সূত্রে জানানো হয়, এ বছর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কারের জন্য কানাডা প্রবাসী বাংলা ভাষার লেখক জসিম মল্লিক এবং মার্কিন গবেষক ও লেখক ক্যারোলিন রাইটকে মনোনীত করা হয়েছে।

সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জসিম মল্লিককে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। জীবন যে এক আশ্চর্য্য গল্প, বয়ান; জসিম মল্লিক তার নিপুণ কারিগর। যে জীবনকে নিবারণ করা যায় না, অনিবার্য; জসিম সেই কাহিনীই তুলে ধরেন। গভীর বোধ, বেদনা আর বিহ্বলতা না থাকলে জীবনকে কতটুকুই বা বোঝা যায়। বোঝে মানুষ? হয়তো তা বুঝতেই জসিম ছুটে যান বরিশাল থেকে টরন্টো, মরক্কো থেকে মেক্সিকো, দুবাই থেকে ডালাস, আবার টোকিও থেকে মিলানো। পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। ডানা ঝাপটানো পাখির মতোন। এই বয়ে চলা, উড়ে চলাই তাকে ঋদ্ধ করেছে, জীবনের বোধ ও গভীরতায় করেছে সমৃদ্ধ। তাই হতাশাকে প্রশ্রয় দেন না তিনি। জসিমের লেখায় ও যাপনে তাই ফুটে উঠে। কেননা জসিম জানেন, জীবন মানেই ব্যর্থতা না, সেখানে সফলতাও আছে, শুধু ব্যর্থ বলে কোন জীবন নেই। তা তিনি বিশ্বাসও করেন না। তাই জসিমের চরিত্ররা হারতে হারতে জিতে যায, জিততে জিততে হেরে যায়। কিন্তু সেই হেরে যাওয়াটা সৈয়দ ওয়ালি উল্লাহর উজানে মৃত্যুর মতো। পাওলো কোয়েলহোর আবার তল থেকে উঠে আসার মতো, হারাকু মুরাকামির ভাঙচুর ভাঙচুর শব্দের মধ্যেও জয়ের প্রবল স্বপ্ন। বিশ্ব ভূগোলের অভিজ্ঞতা ও বাসিন্দা তিনি। তাই তার কাহিনী, চরিত্র নির্দিষ্ট কোন ভূগোল নির্দেশ করে না। তাই তার বলা রাঢ়িখালের মেয়েটির গল্প হয়ে উঠে টরন্টোর জেনিফারের গল্প। এই যে স্পর্শ বিন্দুকে ছুঁয়ে যাওয়া ও এক হওয়া-এটাই লেখককে বৈশ্বিক মর্যাদা দেয়। আন্তর্জাতিকতায় জসিম মল্লিক তাই ভিন্নধারার এক কাহিনীকথক। স্বতন্ত্র, বলিষ্ট, উচ্চ মার্গীয়। জসিম মল্লিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। জনপ্রিয় পত্রিকা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাংবাদিকতা করেছেন, কথাসাহিত্যিক হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন মঞ্চে আমন্ত্রিত হয়েছেন, বক্তৃতা করেছেন। লিখেছেন অসংখ্য উপন্যাস, গল্প, ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা। ভৌগলিক রেখা আর সীমানায় বিশ্বাস করেন না বলেই হয়তো জসিম মানুষকে আশ্চর্য্য ছুঁতে পারেন।

কলেজ জীবন থেকেই লেখালেখির শুরু। বরিশাল বিএম কলেজ এবং বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন এবং কলেজ ম্যাগাজিন, স্থানীয় এবং ঢাকার পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে যাত্রা। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় যোগ দেন। শৈশব থেকেই অনেক লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন এবং বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। সেই সব লড়াই সংগ্রাম আর বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখছেন অনেক গল্প, উপন্যাস, নিবন্ধ এবং স্মৃতিকথা। জীবন, সমাজ আর মানুষের মনোজাগতিক নানা বিষয় ফুটে ওঠেছে তার লেখনীতে। সম্পর্কের সূ² বিষয়গুলোকে অনুপঙ্খভাবে তুলে আনেন তার লেখায়। প্রকৃতি, গ্রাম আর নাগরিক জীবনের টানাপোড়েন তার লেখার প্রধান উপজীব্য।
জসিম মল্লিক বাংলা একাডেমি, জাতীয় প্রেসক্লাব এবং বরিশাল ক্লাবের সদস্য এবং বাংলাদেশ জনসংযোগ সমিতির শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক ছিলেন। ২০০৩ সাল থেকে দুই সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে কানাডার টরন্টোতে স্থায়ীভাবে বাস করছেন। টরন্টো থেকে প্রকাশিত প্রবাসী কন্ঠ, ভোরের আলো এবং নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশে প্রতিদিন ও প্রথম আলো পত্রিকার নিয়মিত কলাম লেখক। বাংলাদেশের জনপ্রিয় পত্রিকা সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সাপ্তাহিক২০০০ এ সাংবাদিকতা করেছেন। টরন্টো বইমেলার অন্যতম আয়োজক সদস্য। এছাড়া একুশে গ্রন্থমেলা, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি, কোলকাতা বইমেলায় নিয়মিত যোগ দেন। এ পর্যন্ত ৪০টির মতো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

জসিম মল্লিক এর জন্ম ১৯৬১ সালের ১৭ মার্চ বরিশালের সাগরদি’তে। তাঁর পিতা হাতেম আলী মল্লিক এবং মাতা হালিমা বেগম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। তাঁর নেশা ভ্রমণ ও বই পড়া। তিনি স্ত্রী জেসমিন এবং ছেলে অর্ক ও মেয়ে অরিত্রি সহ কানাডার টরন্টোতে বসবাস করেন।

জসিম মল্লিকের উল্লেখযোগ্য বইগুলি হচ্ছে,
উপন্যাস : অভিমান, একজন মাধবী, পরীর মতো মেয়ে, স্পর্শ
ছোট গল্প : জীবন বারে বারে আসে, কোনো কথা ছিলনা, নির্বাচিত গল্প, ভালবাসার সংকলন
নিবন্ধ : এখানে প্রাণের স্রোত, নক্ষত্রের আগুন ভরা রাতে, পৃথিবীর মানুষের ভীড়
স্মৃতিকথা : হৃদয়ে প্রেমের দিন, স্বপ্ন কাজল মাখা, শুধু আকাশ জানে, মায়া ভরা এই সংসারে, আমার মা ।
প্রবাসে বসবাসকারী বাঙালি লেখক এবং বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন তাঁদের বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতিবছর ২ জনকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পুরস্কার প্রদান করা হয়। বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের চেক, সম্মাননাপত্র ও সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়। জসিম মল্লিক এর আগে টরন্টো থেকে এই পুরস্কারে সম্মানীত হয়েছেন, কবি ইকবাল হাসান, লেখক সৈয়দ ইকবাল, কবি মাসুদ খান এবং কথাসাহিত্যিক সালমা বাণী।
জসিম মল্লিক বাংলা একাডেমির সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ পুরস্কার ২০২২ পাওয়ায় ‘বাংলা কাগজ’ এর পক্ষ থেকে ভালোবাসা ও অভিনন্দন।