রাশেদ নবী : এ বছরের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন তানজানিয়া-বংশোদ্ভূত উপন্যাসিক আব্দুলরাজাক গরনা। এই সংবাদ নোবেল পুরস্কার পর্যবেক্ষকদের সম্ভবত হতাশ করেছে, কারণ আব্দুলরাজাক তাদের সম্ভাব্য বিজয়ীদের তালিকায় ছিল না। নিউ ইয়র্ক টাইমস বা দি গার্ডিয়ান এর ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক হলে এই পুরস্কার পেত ফরাসি স্মৃতিকথক আ্যনি আরনো। গত বছর এই পুরস্কার পায় আমেরিকান কবি লুইস গ্লাক। সে কারণে অনেক পর্যবেক্ষক অনুমান করেছিল ভারসাম্য বজায় রাখবার জন্য এ বছর সুইডিশ একাডেমি বাছাই করবে আমেরিকার বাইরে থেকে কাউকে- একজন পুরুষ এবং গদ্যসাহিত্যিক। তাদের সে অনুমান ঠিক হয়েছে, তবে ইউরোপীয় সাহিত্যিকদের প্রতি তাদের পক্ষপাত একাডেমির পূর্ণ সমর্থন পায়নি।
পূর্ণ সমর্থন না পেলেও বলতে হবে আংশিক সমর্থন পেয়েছে, কারণ প্রথমত, আব্দুলরাজাকের উপন্যাসের ভাষা ইংরেজি। গত দশটি নোবেল পুরস্কারের পাঁচটিই পায় ইংরেজি ভাষার সাহিত্যিকরা। দ্বিতীয়ত, আব্দুলরাজাকের জন্ম তানজানিয়ায় হলেও সে ইংল্যান্ডের নাগরিক। আঠার বছর বয়সে জানজিবার বিপ্লবের (১৯৬৪) পরে সে চলে যায় ইংল্যান্ডে। পরে সেখানে সে কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচডি অর্জন করে এবং স¤প্রতি অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই উত্তর-উপনিবেশ সাহিত্যের অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত ছিল।
ইংল্যান্ডে বাস করলেও আব্দুলরাজাক মনে করে তার দেশ তানজানিয়া, বা আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে জানজিবার প্রদেশ, যেখানে তার জন্ম। তরুণ বয়সের স্মৃতি এবং বহিরাগত হিসাবে তার ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞতা সক্রিয়ভাবে রূপায়িত করেছে তার উপন্যাসের প্রেক্ষিত, কাহিনী ও চরিত্র। উপনিবেশবাদের অভিঘাত, উপনিবেশোত্তর সমাজের ভঙ্গুরতা, রিফিউজি, ও নিজ সমাজ থেকে উৎপাটন তার গল্প ও প্রবন্ধের অভিন্ন বিষয়বস্তু। কাহিনীর গভীরে না গিয়েও শুধু তার গল্প উপন্যাসের শিরোনাম থেকেই এটা অনুমান করা যায় এইসব উওর-উপনিবেশিক সমস্যা কত গভীরভাবে তার চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে। সুইডিশ কমিটির বিবৃতি অনুযায়ী আব্দুলরাজাককে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে হয়েছে উপনিবেশবাদের প্রভাব সম্পর্কে ও রিফিউজিদের ভাগ্য নিয়ে তার আপোষহীন ও সংবেদনশীল অধ্যয়নের জন্য। তার চরিত্রদের কেউ পূর্ব আফ্রিকায় জীবন ও সমাজ নির্মাণে সংগ্রামরত আর কেউ পূর্ব আফ্রিকা থেকে উৎপাটিত ইংল্যান্ডের শরণার্থী বা অভিবাসী। তারা উদ্যম নিয়ে জীবন গড়তে, নিজেকে ও প্রিয়জনকে ভালোবাসতে সচেষ্ট হয়, কিন্তু তাদের আকাঙ্খা প্রায়শ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
তার উপন্যাসের সংখ্যা দশটি। প্রথম উপন্যাস “মেমরি অব ডেপারচার” বা “প্রস্থানের স্মৃতি” লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। তবে তাকে জনপ্রিয় করে তোলে ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত তার চতুর্থ উপন্যাস, “প্যারাডাইজ” বা “স্বর্গ”। এই উপন্যাস বুকার পুরস্কারের জন্য চুড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়। পরে আরো দুটি উপন্যাস “বাই দি সি” বা “সাগর পারে” (২০০১) ও “ডেজারশন” বা “পলায়ন” (২০০৫) বুকারের প্রাথমিক তালিকায় স্থান পায়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল নোবেল পুরস্কার ছাড়া অন্য নোবেল বিজয়ীর মত আব্দুলরাজাক কোনো উল্লেখযোগ্য পুরস্কার পায়নি। অন্য নোবেল বিজয়ীর মত তার গ্রন্থ বাণিজ্যিক সফলতাও লাভ করেনি।
“স্বর্গ” উপন্যাসের কাহিনী গড়ে ওঠে বালক ইউসুফের জীবনকে কেন্দ্র করে। ইউসুফের জন্ম উপনিবেশক তানজানিয়ার একটি কাল্পনিক শহরে। তার বয়স যখন বারো বছর, তখন তার ঋণগ্রস্থ পিতা তাকে এক বণিকের কাছে বিক্রি করে। সেই বণিকের কাফেলার সাথে ভ্রমণ করতে করতে ইউসুফ আবিষ্কার করে আফ্রিকা, প্রত্যক্ষ করে উপজাতিদের মধ্য সংঘাত, কুসংস্কার, মারি, দাসত্ব। ইউসুফের বড় হয়ে ওঠার গল্প পর্যায়ক্রমে উপস্থাপন করে আফ্রিকান সমাজের বহুমাত্রিকতা। বর্হিজগত যাকে কৃষ্ণকায় আফ্রিকা বলে জানে সেখানে বহিরাগত আরব ও ভারতীয় বণিক, ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি ও ইউরোপীয় কৃষক কৃষ্ণকায় আফ্রিকানদের সাথে সহাবস্থানের জন্য প্রতিনিয়ত বোঝাপড়া করে। ইউসুফ বড় হয়ে ওঠে। এক সময় তার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয় বয়স্ক বণিকের কনিষ্ঠ, তরুণী স্ত্রী আমিনার সাথে। আমিনা ইউসুফের মত আরেক দাস শ্রমিকের বোন। বণিকের কাফেলা তানজানিয়ায় ফিরে আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে যখন জার্মানী তানজানিয়া দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যে জার্মান বাহিনীকে ইউসুফ ঘৃণার চোখে দেখত, সেই বাহিনীতে যোগ দিতে অবশেষে সে আমিনাকে ছেড়ে চলে যায়।
আব্দুলরাজাকের উপন্যাসগুলির একটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হল তার চরিত্ররা প্রতিনিয়ত একটি নতুন জীবন খুঁজে বেড়ায়। নোবেল কমিটির সভাপতি এ্যান্ডার্স ওলসন এর দৃষ্টিতে তারা মহাদেশ থেকে মহাদেশে, সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতিতে এবং অতীত জীবন থেকে নিকট-ভবিষ্যতের জীবনে ভ্রমণরত, কিন্তু তাদের বসবাস অন্তর্র্বতীকালীন শূন্যতার ভিতর। আব্দুলরাজাক তার চরিত্রদের মধ্যে সচেতনভাবে এই অস্থিরতা তৈরি করেছে, কিন্তু তা নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা পুনসৃষ্টি করবার জন্য নয়, বরং ব্যক্তির উপর উপনিবেশোত্তর সমাজের প্রভাব বিশ্লেষণের জন্য। তার ভাষায়, মানুষ নানভাবে একটি গোষ্ঠীর অংশে পরিণত হয় অথবা তা হতে না পেরে বিচ্ছিন্ন বোধ করে। কিন্তু কি কারণে বা কি ভাবে কেউ অন্তর্ভূক্ত হয় আর কেউ বাইরে পড়ে থাকে? গত অর্ধ শতক ধরে তার গল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে সে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে।
অর্ধ শতক পরে, বায়ত্তর বছর বয়সে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি আব্দুলরাজাককে নিশ্চয় আশ্বস্ত করেছে যে তার এই প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। নোবেল কমিটির সভাপতি এ্যান্ডার্স ওলসন চমৎকারভাবে আব্দুলরাজাকের কৃতিত্বের সারসংক্ষেপ করেছেঃ
“সত্য অন্বেষণে গরনার অঙ্গীকার এবং লঘুকরণের প্রতি তার অনীহা দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মত। এই অঙ্গীকার যেমন তাকে নিরেট তেমনি আপোষহীন করে তোলে বিশেষত যখন সে মানুষের ভাগ্য অনুসরণ করে পরম সহানুভূতি এবং অনমনীয় আনুগত্যের সাথে। তার উপন্যাস বাঁধাধরা ছকের প্রতি বিমুখ; তার উপন্যাস আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত করে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির পূর্ব আফ্রিকার দিকে, যে বৈচিত্র্য আমাদের অনেকের অজানা। গরনার সাহিত্যের জগতে সবকিছু বদলায় – স্মৃতি, নাম, আত্মপরিচয়।”
সমালোচকরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আব্দুলরাজাকের চরিত্রদের আত্মপরিচয় বদল ও তার সংকট নিয়ে আলোচনা করে আসছে। সন্দেহ নেই তার নোবেল পুরস্কার বিজয় এই আলোচনাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে।
রাশেদ নবী : লেখক, অটোয়া, কানাডা