সোনা কান্তি বড়ুয়া : মানুষের মন পশুর কোরবানি মানেই বিশ্বের সকল প্রাণী সুখী হোক এবং বিশ্বসৌভ্রতৃত্ব নিরাময়ে থাকুক। ধর্ম থাকে মানুষের অন্তরে এবং মানবপুত্র বুদ্ধ এক আলোকবর্তিকা! প্রসঙ্গত: সাহিত্যিক আবুল ফজলের মতে, “অবিশ্বাস্য সাধনা আর দীর্ঘ আত্মনিবিষ্ট ধ্যানে মহামানব বুদ্ধ এ মহাসত্যের উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন যে, সব প্রাণই মূল্যবান, সব প্রাণই পবিত্র। প্রাণ-হনন এক গর্হিত কর্ম। সর্ব জীবে দয়া, অহিংসা পরম ধর্ম, – এমন কথা আড়াই হাজার বছর আগে সত্যই অকল্পনীয় ছিল।” বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মান্ধ মুসলমান ক্ষমতাবানদের বলি হিন্দু বৌদ্ধ নির্যাতন! হিংসা পুষে রাখা কথাটা আমার পবিত্র মানব সত্তাকেই হনন করে রেখেছে। হিন্দু – বৌদ্ধদের কান্না বাংলাদেশে এখনও থামেনি!
আমাদের জাতীয় বিবেকের জবাবদিহিতার শক্তি মরে ধর্ম এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামক বিভিন্নভয় ভীতির কবলে। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক “আবুল ফজলের” রচিত প্রবন্ধ “মানবপুত্র বুদ্ধ”। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং রাষ্ট্রপতির শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। “মানবপুত্র বুদ্ধ” ও সমাজমনস্ক প্রবন্ধ পিপাসু বাঙালির আবেগের নাম প্রখ্যাত সাহিত্যিক “আবুল ফজল”। বৌদ্ধ দর্শনে ভালোবাসার চিরকালের প্রেমিক প্রখ্যাত সাহিত্যিক তিনি।
বৌদ্ধ দর্শন হল যুক্তির আলোকে সব বিশ্লেষণ করা, দেখা। বৌদ্ধ দর্শন ঈশ্বর ও ধর্মের বিষয়ে যুক্তির কষ্ঠিপাথরে সত্যকে অনুসন্ধান করা। সত্য মানেই সত্যই। একদিন “মানবপুত্র বুদ্ধ” সাহিত্যিক আবুল ফজলের রচিত বাংলা প্রবন্ধে সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে গভীর অবস্থানভূমি নির্ণয় করতেই তথ্যসূত্র নিয়ে এসেছে অনুভবী পাঠক! ভারত ও ভুটানের আগে তো কোন মুসলমান রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ধর্ম থাকে মানুষের অন্তরে, মসজিদে আজান হবে ঘন্টা বাজবে মন্দিরে। এই হলো অসা¤প্রদায়িক রাষ্ট্র। সকল ধর্মের মানুষ একত্রিত করে ধর্মবিদ্বেষী অমানুষগুলোকে কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। প্রসঙ্গত: শাহরিয়ার কবিরের মতে, “সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের উল্লেখ ধর্মীয় স¤প্রীতির ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক:!” বাংলাদেশে বৌদ্ধদের নামে রামুর বিশ্বাস্ ঘাতক মুসলমান (Moktar) রচিত ফেইসবুকে কোরাণের উপর পদচিহ্ন দিয়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের অন্তরালের রোহিঙ্গা রাজনীতি ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে সংঘটিত কক্সবাজারের রামুসহ সদর, উখিয়া ও টেকনাফের বৌদ্ধ বিহারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ১৯টি মামলা করা হয়।
বাংলাদেশের জাতীয় বিবেক সাহিত্যিক আবুল ফজলের ভাষায় : বুদ্ধকে অন্য এক লেখায় আমি ‘মানব পুত্র’ বলেছি। কথাটা আমার কাছে অর্থপূর্ণ। আর সে অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক এবং সার্বিক। মানব স্বভাবের এত গভীরে অন্য কেউ প্রবেশ করেছেন কিনা আমার জানা নেই। সত্যের সন্ধানে তিনি নিজে সংসার ত্যাগ করেছেন; কিন্তু প্রচলিত আত্মনির্যাতন-মূলক সন্ন্যাসকে করেছেন নিন্দা। মানুষের প্রয়োজনকে তিনি অস্বীকার করেননি কিন্তু অতিরেক আর অভিচারকে করেছেন নিষিদ্ধ। মানুষকে হতে বলেছেন মধ্যপন্থের অনুসারী। আর বলেছেন, এ হচ্ছে ‘প্রজ্ঞা পারমিতা’ মানে পরিপূর্ণ বিজ্ঞতা তথা Supreme Wisdom – যেখানে ভুল-ভ্রান্তির নেই কোন অনুপ্রবেশ।
প্রাণের অধিকারী বলে মানুষও প্রাণী- প্রাণহীন মানুষ স্রেফ জড় বস্তু, তখন জড় বস্তুর বেশি তার আর কোন মূল্য থাকে না। কাজেই প্রাণ এক অমূল্য সম্পদ, এক দুর্লভ ধন। মানুষই শুধু প্রাণের অধিকারী নয়- আরো অজস্র প্রাণী রয়েছে মর্তধামে। বুদ্ধি আর বিজ্ঞতার অপরিহার্য অনুষঙ্গ যুক্তি- যুক্তি বলে সব প্রাণই অমূল্য, শুধু মানুষের প্রাণটাই মূল্যবান এ বুদ্ধি কিম্বা যুক্তি গ্রাহ্য নয়। অবিশ্বাস্য সাধনা আর দীর্ঘ আত্মনিবিষ্ট ধ্যানে মহামানব বুদ্ধ এ মহাসত্যের উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন যে, সব প্রাণই মূল্যবান, সব প্রাণই পবিত্র। প্রাণ-হনন এক গর্হিত কর্ম।
সর্ব জীবে দয়া, অহিংসা পরম ধর্ম, – এমন কথা আড়াই হাজার বছর আগে সত্যই অকল্পনীয় ছিল।
মানবসভ্যতার তখনো শৈশবাবস্থা- জীবহত্যা তথা প্রাণী-শিকার তখনো তার অন্যতম জীবিকা। যুবরাজ সিদ্ধার্থই ছিলেন এর প্রথম অপবাদক। তখন বীরত্বের বা ক্ষত্রিয় ধর্মের পরাকাষ্ঠাই ছিল মৃগয়া বা পশু-শিকার। সিদ্ধার্থও ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশাবতংস।
তাই, ভেবে অবাক হতে হয় তেমন যুগে তেমন পরিবেশে কি করে একটা মানুষের এমন রূপান্তর ঘটলো। কোন অলৌকিক কিম্বা অতিপ্রাকৃত শক্তির আশ্রয় তিনি নেননি, যাননি তেমন অদৃশ্য, অজ্ঞাত ও অপ্রামাণ্য শক্তির কাছে। সর্বোতভাবে নির্ভর করেছেন আত্মশক্তির উপর, নিজের সাধনা আর আত্মোপলব্ধির উপর। আত্মোন্মোচন ঘটেছে তাঁর এভাবে। এভাবে ক্ষত্রিয় রাজকুমার গৌতম পৌঁছেছেন বুদ্ধত্বে। মানবিক সাধনার এক চরম দৃষ্টান্ত বুদ্ধ-জীবন। ত্যাগ-সংযমের পথে যে সাধনা তাই মূল্যবান ও ফলপ্রসূ। স্রেফ উপাসনা কিম্বা কর্মহীন প্রার্থনার কোন মূল্য নেই, তা শুধু নিষ্ক্রিয়তা আর জড় অভ্যাসেরই দিয়ে থাকে প্রশ্রয়। এতে কোনো আত্মোন্নতি ঘটেনা, ঘটেনা কোন রকম আত্মোপলব্ধি। অপরিসীম আর অবিরাম চেষ্টা আর উদ্যম-উদ্যোগ ছাড়া আত্মোন্নতি কিম্বা আত্মোপলব্ধির দ্বিতীয় কোন পথ নেই।
আত্মোন্নতি ও আত্মোপলব্ধিরই এক নাম প্রজ্ঞা। অন্যান্য বহু ধর্মে বিশ্বাসের রয়েছে এক বড় স্থান, বিশ্বাসের উপর অত্যন্ত জোর দেওয়া হয় ঐসব ধর্মে। বুদ্ধ তা করেননি। তাঁর মতে কর্মহীন উপাসনা যেমন নিষ্ফল তেমনি নিষ্ক্রিয় জড় বিশ্বাসও মূল্যহীন। মানুষের যা কিছু উপার্জন তা কর্মোদ্যমের পথেই লভ্য। জ্ঞানের তথা প্রজ্ঞা-পারমিতার যে আলোক-বর্তিকা বুদ্ধ মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন তাও তিনি লাভ করেছেন এ পথেই। মনে হয় বুদ্ধের শ্রেষ্ঠত্ব এখানে- ব্যক্তিগত সাধনা ছাড়া তিনি অন্য কিছুর উপর নির্ভর করেননি। তাঁর জীবন ও শিক্ষা ব্যক্তিগত সাধনারই জয় ঘোষণা।”
হিন্দু মুসলমানদের হিংসা পুষে রাখা ভারত “ভাগ’ কথাটা এখানে রক্তে রাঙানো ১৯৪৭ সাল ১৪ আগস্ট এবং ১৫ আগস্ট! দেশভাগ’ এখানে সর্বাত্মক : দেশের ভাগ, মানচিত্রের ভাগ, আত্মা, সম্পর্ক, যোগাযোগ, এমন কি আমার লিখিত “আমি’টির ও ভাগ, পার্টিশন আমার সর্বস্ব; আমার মানব সত্তাকেই বিভক্ত করে রেখেছে। ১৯৪৭ সাল ১৪ আগস্ট এবং ১৫ আগস্ট হিন্দু মুসলমানদের প্রাণ-হনন এক গর্হিতকর্ম (পশুর কোরবানি) এই নয় যে, পর ধর্মকে গালমন্দ করা। ধর্মান্ধ ইসলামি রাজনীতির এতো উলঙ্গ দর্প বাংলাদেশে কেন?
ধর্মীয় উন্মাদনা জাগিয়ে তুলে ইসলামি জঙ্গীরা মুসলমান হয়ে কোরাণের উপর পদচিহ্ন রচনা করেছে বৌদ্ধ বিহারে আগুন দিতে এবং ২০১২ সালে ২৯শে সেপ্টেম্বর রামু, উখিয়া ও পটিয়ায় বৌদ্ধ জনপদে আগুন দিয়ে তান্ডব দাহন করেছিল! পবিত্র কুরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াত (:১০৯ এবং ২২ : ৩৮) লঙ্ঘন করে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনী ও তার দোসর রাজাকার, আলবদর চক্র ইসলাম ধর্মকে তলোয়ার বানিয়ে অপব্যবহার করে ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা, ২ লক্ষ মা – বোনকে ধর্ষণ এবং বুদ্বিজীবি হত্যা করেছিল। মুক্তি যুদ্ধে ২ লক্ষ মা-বোনকে ধর্ষণ জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছিল! অথচ এই ধর্ষণ অপরাধের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনতে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করেছেন।
সাহিত্যিক আবুল ফজলের ভাষায় : “আত্মোপলব্ধির তথা প্রজ্ঞা-পারমিতায় পৌঁছার জন্য তিনি যে নির্দেশ দিয়েছেন, সেসবের দিকে তাকালেও বুঝতে পারা যাবে তিনি সর্বোতভাবে ব্যক্তিক সাধনার উপর দিয়েছেন জোর। দল বা সমাজবদ্ধভাবে আত্ম-উন্নতি ঘটেনা, আত্ম-উন্নতি ঘটে ব্যক্তিগত চেষ্টা, শ্রম আর সংযমের পথে। তাঁর নির্দেশিত পঞ্চশীলের সবক’টা শীলই ব্যক্তিগতভাবে আচরণীয় ও পালনীয়। প্রাণীহত্যা, পরস্বাপহরণ, অবৈধ যৌন সম্ভোগ না করা, মিথ্যা পরনিন্দা কিম্বা রূঢ়ভাবে কথা না বলা, মদ আর নেশাজনক বস্তু গ্রহণ না করা- ব্যক্তিগত জীবনে সংযম আর ত্যাগ ছাড়া এসব হওয়ার নয়। আনুষ্ঠানিক উপাসনা আর প্রার্থনার সাহায্যে এসব আয়ত্ব হতে পারে না কিছুতেই।
বুদ্ধের এসব নির্দেশ পালন খুব কঠিন বটে কিন্তু এতে কোন রকম জটিলতা কিম্বা দুর্জ্ঞেয়তা নেই, এ অত্যন্ত সরল ও সহজবোধ্য। রহস্যঘেরা দার্শনিক জটিলতাকে বুদ্ধ কোনদিন দেননি প্রশ্রয়। যেমন অনেক ধর্মের কোন কোন জিজ্ঞাসু প্রশ্ন তোলেন : মানুষ কে, কি? কোথা থেকে এসেছে? কোথায় যাবে? এ ধরনের অর্থহীন তথা উত্তরবিহীন প্রশ্নকে বুদ্ধ কখনো আমল দেননি। এসব প্রশ্ন মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে কিন্তু পারে না তাকে সৎজীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে। বুদ্ধের তাবৎ কথা ও কাজের মূল লক্ষ্য সৎ-মানুষ ও সৎ-জীবনের পথ নির্দেশ। চেষ্টা ও উদ্যমের ফলে ক্রমাগতই মানুষের ধ্যান-ধারণা ও মানসজীবনে বিবর্তন ঘটে চলছে। প্রাচীন বহু বিশ্বাস আর সংস্কার ত্যাগ করে মানুষ এখন অধিকতর আত্মবিকাশ ও আত্মোপলব্ধির পথে অগ্রগামী।”
বাংলা বর্ণমালার ইতিহাসে (প্রায় ২৬০০ বছর পূর্বে) বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতমবুদ্ধ বাল্যকালে যে বাংলা লিপি অধ্যায়ন করেছিলেন তা বাংলা বিশ্বকোষে (১৩শ ভাগ, পৃঃ ৬৫) সগৌরবে লিপিবদ্ধ এবং ইতিহাসে দেদীপ্যমান হয়ে আছে। রূপ এবং গৌতমবুদ্ধ বাংলাভাষাসহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা ব্রাহ্মণদের হাত থেকে রক্ষা করেন (দেশ, কোলকাতা ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ এবং নয়া দিগন্ত, এস. কে. বড়ুয়া, ২৫ আগষ্ট ২০১০)।! ভারত এবং বাংলাদেশে বগুড়ার পুন্ড্রবর্ধনে বাংলা ও ভারতের ভাষার জনক গৌতমবুদ্ধ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন!
বাংলাদেশের জাতীয় বিবেক সাহিত্যিক আবুল ফজলের ভাষায় : “একদিন মানুষ জল-বাতাস-অগ্নি আর চন্দ্র-সূর্যকে, এমন কি বজ্র আর মেঘগর্জনকেও দেবতা মানতো। কিন্তু এখন মানে না কেন? কারণ মানুষের বোধ আর বোধি অনেক বেড়েছে, কালের সঙ্গে সঙ্গে তার মানব-জীবন হয়েছে অনেক উন্নত। বুদ্ধের শিক্ষা আর নির্দেশ জীবনে গৃহীত হলে মানুষের আরো যে আত্মবিকাশ ঘটবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য নির্মাতা। এও বুদ্ধের এক অবিনশ্বর বাণী। এভাবে অতিপ্রাকৃত ও পরনির্ভরতার গ্লানি থেকে তিনি মানুষকে দিয়েছেন মুক্তি।
কথা আছে : মানুষ প্রবৃত্তির দাস। এ দাদত্ব থেকে মুক্তি ছাড়া মানুষ কখনো পরিপূর্ণ বোধ আর বোধিতে পৌঁছতে পারে না। একমাত্র আত্মশুদ্ধির পথেই এ দাসত্ব থেকে মুক্তি সম্ভব- সে পথের নির্দেশ রয়েছে বুদ্ধ-জীবনে, বুদ্ধের শিক্ষা আর বিধি-বিধানে, আদেশে আর নিষেধে।
মানুষ এখন শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে অনেক সভ্য হয়েছে, সভ্যতা ও সংস্কৃতির পথে এগিয়ে গেছে অনেক দূরে। তবুও পৃথিবীতে কোথাও শান্তি নেই। সংকটে, সংঘর্ষে পৃথিবী আজ জর্জরিত। যুদ্ধ-বিগ্রহ আর এসব মারামারি, খুনোখুনিতে যে হারছে তার মনে যেমন শান্তি নেই তেমনি শান্তি নেই জয়ী হচ্ছে যে তারও। ব্যক্তির বেলায় যেমন এ সত্য তেমনি দেশ ও জাতির বেলায়ও এ একবিন্দু মিথ্যা নয়। বুদ্ধ-শিষ্য অশোক জীবনের এ মহাসত্য দু’হাজার বছর আগে বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর মন্ত্র-গুরু বুদ্ধের জীবনাদর্শ আর শিক্ষার আলো। তাই বিজয়ী হয়েও জয়ের ফল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তিনি ত্যাগ আর অহিংসার জীবনকে নিয়েছিলেন বরণ করে। এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ।
বুদ্ধের জীবন মানুষের কাছে এক অবিনশ্বর আলোক-বর্তিকা- এ আলোক-বর্তিকা একদিন সম্রাট অশোককে যেমন সত্য, মনুষ্যত্ব আর শান্তির পথ দেখিয়েছিল, আজকের দিনেও সে পথ দেখাতে তা সক্ষম যদি মানুষ সশ্রদ্ধ চিত্তে এ আলোক-বর্তিকার দিকে নতুন করে ফিরে তাকায় আর বরণ করে নেয় তাঁকে সর্বান্তঃকরণে।
বুদ্ধ আর বৌদ্ধধর্ম প্রসঙ্গে আমাদের অর্থাৎ অ-বৌদ্ধদের মনে একটা রহস্য-ঘন বিস্ময় রয়েছে। এ বিস্ময়ের বড় কারণ অপরিচয়। বৌদ্ধ-বিশ্বাস আর ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে যারা জন্মাননি তাঁদের কাছে বুদ্ধ-জীবন আর বৌদ্ধ-ধর্ম সম্বন্ধীয় অনেক কিছুই দুর্জ্ঞেয়-বিরাট বৌদ্ধধর্ম শাস্ত্রের মহাসমুদ্র মন্থনের যোগ্যতা, ধৈর্য আর নিষ্ঠা আমাদের অনেকের নেই। ফলে যুগ যুগ ধরে পাশাপাশি থেকেও পরস্পরের ধর্ম ও ধর্মাচরণ সম্বন্ধে আমরা থেকে যায় অজ্ঞ। অজ্ঞতাই জন্ম দেয় বহু অবিশ্বাস আর সংশয়-সন্দেহের – যা কালক্রমে ঘৃণা-বিদ্বেষ, দ্ব›দ্ব-বিরোধ আর নানা অশুভ ক্রিয়া-কর্মের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ধর্ম-বিশ্বাস ও চেতনা মানুষের গভীরতম সত্তার জড়িত- তাই কোন মানুষকে সম্যকভাবে জানতে হলে তার এ সত্তার সঙ্গেও পরিচয় অত্যাবশ্যক। সে পরিচয়ের কোন ব্যবস্থা আদেদের শিক্ষাজীবনের কোন স্তরে যেমন নেই তেমনি আমাদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিও অনুক‚ল নয়। এর ফলে আমাদের জ্ঞান যে শুধু খণ্ডিত থেকে যায় তা নয়, একটা সুসংহত জাতি কিম্বা সমাজসত্তা গড়ে ওঠার পথেও আমাদের দেশে এ হয়ে আছে এক দুরতিক্রম্য বাধা। অন্ততঃ জ্ঞানের ক্ষেত্রে জাত্যভিমান তথা ধর্মীয় গোঁড়ামী অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমার বিশ্বাস আমাদের দেশের সব ধর্মাবলম্বীরাই এ অপরাধে অপরাধী।
মহামানব বুদ্ধের জীবন আর তাঁর শিক্ষা আমাকে আকর্ষণ করে তাঁর মানবিকতার জন্য। মানব চরিত্রের অতলে ডুব দিয়ে তিনি একদিকে খুঁজে বের করেছেন তার ক্লেদ, গ্লানি, দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি অন্যদিকে আবিষ্কার করেছেন তাতে অসীম শক্তি আর অনন্ত সম্ভাবনার বীজ- যা অঙ্কুরিত হয়ে রূপ নিতে সক্ষম ‘প্রজ্ঞা পারমিতায়’ অর্থাৎ পূর্ণ বিজ্ঞতায়। মানবিক শত বন্ধনে মানুষ বাঁধা যা সর্ব দুঃখ-কষ্ট আর শোক-সন্তাপের উৎস- এ বন্ধন-মুক্তির উপায় ও পথ বাৎলিয়েছেন বুদ্ধ। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, যার অর্থ : মানুষকে অধ্যয়ন করেই জানতে হয় মনুষ্যত্ব। মনুষ্যত্ব জানার প্রধানতম উপায় মানুষকে জানা, মানুষকে অধ্যয়ন করা।
মহাপুরুষ বুদ্ধ তাই করেছেন। মানুষকে অধ্যয়ন করেই তিনি জেনেছেন মানুষের মুক্তির নিদান। প্রজ্ঞার বিদ্যুৎঝলক যে তাঁর মনে সর্বপ্রথম ঝলসে উঠেছিল সে-ও তো পীড়িত, জরাগ্রস্ত আর মৃত মানুষকে দেখেই। যার ফলে মুহূর্তে শুধু যে তাঁর ব্যক্তি- জীবনে রূপান্তর ঘটে গেল তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে উদ্ঘাটিত হলো তাঁর অন্তর্লোকে সত্যের, করুণার আর প্রেমের এমন এক সূর্য-করোজ্জল দীপ্তি যার কোন তুলনা হয় না। এ মহাসত্যের পথ ধরেই শুরু হলো তাঁর সাধনা- যে সাধনার লক্ষ্য মানুষ আর মানুষের অন্তর্জীবন এবং তার রহস্য সন্ধান। সে সন্ধানে তিনি সফল হয়েছেন। হয়েছেন ‘জিন’ বা জয়ী। মানব সভ্যতার সূচনার যুগে এ সত্যই এক বিস্ময়কর ঘটনা। এক রাজপুত্র, সুন্দরী স্ত্রী আর সদ্যোজাত সন্তানকে জীবনের জন্য ছেড়ে সত্যের ও মানবমুক্তির সন্ধানে গৃহত্যাগ করে এক দুঃসহ বনজীবন বরণ করে নিয়েছেন মানুষের জন্য। এ তো এক অত্যাশ্চর্য শিহরণ। হয়তো মহাপুরুষদের জীবন এমনি অকল্পনীয়, অচিন্তনীয়ই হয়ে থাকে। না হয় তাঁরা মহাপুরুষ হলেন কি করে?
বুদ্ধ-জীবনের মতো ত্যাগ-সাধনা আর মনুষ্যত্বোপলব্ধির এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে সত্যই বিরল।
বুদ্ধের শিক্ষার চরমতম লক্ষ্য নির্বাণ। মানুষ ইন্দ্রিয়ের দাস- এ দাসত্বের চেয়ে হীনতম দাসত্ব আর নেই। এ বন্ধন মোচনের বাণীই তিনি শুনিয়েছেন মানুষকে। এ ছাড়া ভব-যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি নেই। ভব-যন্ত্রণার হাত থেকে চিরমুক্তিরই এক নাম নির্বাণ। ‘বিশ্বাসে মিলায়ে স্বর্গ’- এমন আপ্তবাক্যে বুদ্ধ বিশ্বাস করেন না। কর্মহীন বিশ্বাসতো স্রেফ নিষ্ক্রিয়তা, এতে প্রশ্রয় পায় জড়তা, শ্রম-বিমুখতা।
হিন্দু মুসলমান অন্ধ সা¤প্রদায়িকতায় রক্তাক্ত পাক ভারত বিভাজন অপরাধ ছিল! ৭১-এর পরাজিত শক্তিই হিংস্র জীব-জানোয়ারের চেয়েও ভয়ঙ্কর মানুষরূপী কোন জীব। সে সময় মামুনুলদের মতো দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, জাতীয় পতাকা, সঙ্গীত গিলে খাওয়ার মতো হায়েনার দল ছিলো না। ছিলো না ধর্মের নামে ধর্ম অবমাননা করার মতো ভয়ঙ্কর জীবের অস্তিত্ব। মা-বোনের সতীত্ব-সম্ভ্রম হরণ করার মতো দানবদের আনাগোনা। ছিলো না মন্দির-মসজিদ ভাঙার মহোৎসব। মামুনুলদের হুংকারে আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ, বঙ্গবন্ধু, ভাষা আন্দোলন, ৭ মার্চ, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, বৈশাখী উৎসবে আস্থাশীল মানুষ সবাই ভীত, শংকিত। বাংলাদেশের জন্মকে এরা প্রকাশ্যে অস্বীকার করে। তাদের হিংস্র হুংকারে আজ অন্য ধর্ম স¤প্রদায়ের মানুষের জন্য বাংলাদেশ আর নিরাপদ বাসযোগ্য নয়।
বাংলাদেশের জাতীয় বিবেক সাহিত্যিক আবুল ফজলের ভাষায় :
“বুদ্ধের শিক্ষা আর ধর্মের মর্মকথাই হলো- অবিরত আর অবিচলিত চেষ্টা। তিনি নিন্দা করেছেন অজ্ঞতা, লোভ আর হিংসা-বিদ্বেষকে। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এসবকে জড়শুদ্ধ উৎপাটিত করার দিয়েছেন নির্দেশ। শুধু বিশ্বাস বা উপাস্য কিম্বা আরাধ্যের নাম জপ করলে এ হওয়ার নয়। তাই বিশ্বাস কি উপাসনার উপর তিনি মোটেও জোর দেননি। কারণ ঐসবের মধ্যে ব্যক্তির কোন প্রচেষ্টা নেই, নিজেকে রূপান্তরিত করার নেই কোন প্রয়াস। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে, গড়ে তোলে তার চিন্তা, তার কথা, তার কর্ম। জড় অভ্যাস নয়। তাই মানুষ বিশ্বাসে তোতাপাখি হোক বুদ্ধ এ কখনও চাননি।
মানুষ সক্রিয় হোক। প্রয়াসী আর উদ্যােগী হোক এ তিনি চেয়েছেন, দিয়েছেন তেমন বিধান। সন্ন্যাস এসবের বিপরীত, সন্ন্যাসও এক রকম জড়তা। তাই কৃচ্ছ্র সাধনা ও সন্ন্যাস জীবনকেও তিনি করেছেন নিন্দা। সন্ন্যাস আত্মরতির প্রশ্রয় দিয়ে থাকে, মানুষের অন্তরে জাগিয়ে তোলে অহংবোধ। এসবের অসারতা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই বলেছেন- অকারণে শারীরিক কষ্টভোগ কখনো মুক্তির পথ নয়। নয় শান্তি কিম্বা প্রজ্ঞার পথ। মানব মনের উন্মেষ আর বিকাশ যেখানেই ঘটেছে, তা সবই চেষ্টা, জিজ্ঞাসা আর সন্ধানের পথেই হয়েছে, তারই ফল এসব। স্রেফ উপাসনার দ্বারা এসবের কিছুই হয়নি।
এ যাবত মানবসভ্যতার যা কিছু উন্নতি, তার সবই কর্ম, জিজ্ঞাসা আর সন্ধানের ফল। বুদ্ধের নিজের জীবনও ছিল তাই। এ পথেই তিনি মানব-মুক্তির মহাসনদ খুঁজে পেয়েছেন। পৃথিবীতে প্রাণের চেয়ে দুর্লভ সম্পদ আর নেই- তাই প্রাণহননের বিরুদ্ধে কঠোরতম নিষেধ তাঁর কন্ঠেই ধ্বনিত হয়েছে সর্বাগ্রে। তিনি যে শুধু অহিংসা মন্ত্রই পৃথিবীতে শুনিয়েছেন তা নয়, সে সঙ্গে শুনিয়েছেন কর্ম উদ্যোমের বাণীও। ধর্মপ্রবর্তকের মধ্যে সম্ভবতঃ একমাত্র তিনিই এমন দুঃসাহসিক কথা বলেছেন :-
“Prayer is useless, for what is required is effort. The time spent on prayer is lost and the time spent on effort to achieve something is not lost.”
অর্থাৎ স্রেফ উপাসনায় যে সময় ব্যয় করা হয় তা নিষ্ফল কিন্তু কোন কিছু উপার্জনের প্রচেষ্টায় যে সময় ব্যয় করা হয় তা ফলপ্রসূ।
এ মহামানব সব রকম সংস্কারের বিরোধী ছিলেন। তাই মানুষের প্রতি উদাত্ত আহ্বান : দূর করো পুরানো সংস্কারকে, বরণ করে নাও নতুনকে, পরিহার করো পাপ, শ্রেয়কে করো সঞ্চয়। সব রকম পাপ আর বাসনা কামনার বিরুদ্ধে করো বীর বিক্রমে সংগ্রাম। বৌদ্ধ অ-বৌদ্ধ সকলের দৃষ্টি, এ মহৎ বাণীর প্রতি আবার নতুন করে আকৃষ্ট হোক।
(উৎস : বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক “আবুল ফজল” রচিত প্রবন্ধ “মানবপুত্র বুদ্ধ”। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং রাষ্ট্রপতির শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি মূলত একজন চিন্তাশীল ও সমাজমনস্ক প্রবন্ধকার। তার প্রবন্ধে সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে গভীর ও স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। সাহিত্যিক আবুল ফজল এর জন্ম কেউচিয়া, সাতকানিয়া )!
বিশ্ববৌদ্ধ পুরস্কার প্রাপ্ত প্রখ্যাত মানবতাবাদী লেখক সোনা কান্তি বড়ুয়া (Bachelor of Arts, University of Toronto), সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো, খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা প্রবাসী কলামিষ্ঠ, লাইব্রেরীয়ান, বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব পত্রিকার সহ সম্পাদক এবং জাতিসংঘে বিশ্ববৌদ্ধ প্রতিনিধি!