হাসান গোর্কি : পরম সত্য বলে কিছু থেকে থাকলে আমাদের সেটা বোঝার আশা নেই। যে পদার্থ দিয়ে মহাজগৎ, পৃথিবী, বৃক্ষ, নদী, পর্বত, প্রাণিক‚ল এবং আমাদের শরীর গঠিত তার অস্তিত্ব বিষয়ে বিজ্ঞান নিশ্চিত নয়। অদ্ভুত শোনালেও ঘুরেফিরে কথাটা এ’রকম-ই। এর আগের বেশ কিছু নিবন্ধে আমরা দেখেছি, বিজ্ঞানীদের (বিশেষ করে কোয়ান্টাম ফিজিসিস্টদের) ধারণা পদার্থের আদি ও মূল রূপ হলো তরঙ্গ। পদার্থ ভাঙতে থাকলে শেষে গিয়ে তরঙ্গ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। সর্বেশ্বরবাদী দার্শনিকরা আরও এক ধাপ এগিয়ে (নাকি পিছিয়ে?) গিয়ে বলছেন, মহাজগৎ কারণের অবভাস বা ইচ্ছাময়তার অসীম বিচ্ছুরণ। যুক্তিবিদ্যার কারণ আর দর্শনের ‘কারণ’ এক নয়। দর্শনের কারণ হলো অতীন্দ্রিয় ইচ্ছামালার সমষ্টি যা মহাজগৎ তৈরি করেছে। তা হতে পারে চেতনাময়, হতে পারে অন্ধ (ব্লাইন্ড)। আর অবভাস হলো প্রতিচ্ছায়া রূপে (বিশেষত ভ্রমাত্মক রূপে) কোনকিছুর প্রকাশ। এই দর্শনে বস্তুসমষ্টি বা মহাজগৎকে অবাস্তব, অলীক বা অস্তিত্বহীন মনে করা হয়েছে। তাই মায়া বা বিভ্রমকে মনে করা হয়েছে আদি সত্যে উপনীত হবার স্তর। তাঁদের ধারণা, চৈতন্য যখন বস্তুর স্তর অতিক্রম করে ‘কারণ’-এ লীন হয় তখন আমরা তাকে বিভ্রম মনে করি কিন্তু সেটা-ই মূল সত্য। সাধু সন্ন্যাসীরা এভাবে-ই দীর্ঘ ধ্যানের মাধ্যমে সত্যের সন্ধান করেন। জীব বিজ্ঞানীদের ধারণা, বিষয়টি শতভাগ জৈবিক। স্মরণ-বিস্মরণ, স্পষ্টতা-অস্পষ্টতা, প্রত্যক্ষণ-মায়া সব-ই মস্তিষ্কের জৈব-রাসায়নিক কর্মযজ্ঞের ফসল। আমরা খেয়াল করলে দেখব, অসুস্থতা, অতিরিক্ত ক্লান্তি, নেশাজনিত ঘোর, ধ্যানমগ্নতা (যেমন, প্রার্থনা) বা মাত্রাতিরিক্ত আনন্দের সময় কখনও কখনও আমাদের পরিপার্শ্বকে অবাস্তব মনে হয়। কৈশোরে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ফুটবল ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তে আমি জয়সূচক গোল করেছিলাম। এরপর শুধু একটা গগণবিদারী চিৎকার শুনেছিলাম। পরবর্তী ১০, ২০ বা ৩০ সেকেন্ড আশপাশের সবকিছু ছায়ার মতো দেখেছি। আমি দৌড়ে মাঝ মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছিল না যে আমার পা মাটিতে স্পর্শ করছে এবং যা ঘটছে তা বাস্তব।
মাঝে মাঝে বহুদিনের চেনা তল্লাট-পথ-জনপদ এমনকি নিজের ঘরকে আমাদের অচেনা লাগে। বাবা-মা বা একসাথে বাস করা খুব কাছের মানুষের মুখটা অপরিচিত লাগে। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে সন্দেহ হয় আসলে আমি তার সাথে কোনভাবে সম্পর্কিত কিনা! বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়াও এরকম ঘটতে পারে। শৈশবের কিছু না কিছু ঘটনা আমাদের সবার মনে দাগ কেটে আছে। খেয়াল করে দেখুন সে’সবের কোনো কোনোটি স্বপ্নের মতো অস্পষ্ট, ধূসর। আমরা ভাবতে থাকি এ’রকম একটা সময় কি আসলে কখনও ছিলো! এ’রকম ঘটনা কি আসলে ঘটেছিল! জীববিজ্ঞানে এর ব্যাখ্যা হলো— আমাদের মস্তিষ্কের কোষে জমা থাকা তথ্যগুলো ব্যবহৃত না হলে মস্তিস্ক সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে ফেলে। যেমন ধরুন, পাঁচ বছর বয়সে আপনি নৌকায় করে নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেদিন উজ্জ্বল সূর্যালোক ছিলো, মৃদু-মসৃণ বায়ুপ্রবাহ ছিলো, গভীর নীলাকাশ জুড়ে গিরিখাতের মতো ঢেউ খেলানো শুভ্র মেঘের ধীর-গম্ভীর সন্তরণ ছিলো, কাকলি ছিলো, কলতান ছিলো। এর প্রায় পুরোটা আপনার স্মৃতিতে আছে। এর প্রধান কারণ ঐ সময় ভালো লাগার অনুভ‚তির তীব্রতা এতটা প্রখর ছিলো যে মস্তিষ্কের কোষগুলো তা ভবিষ্যতে ব্যবহার করার জন্য যত্ন করে সংরক্ষণ করেছে। নানাবাড়িতে গিয়ে তৃতীয় দিন দুপুরে আপনি রুই মাছ এবং হেলেঞ্চা শাক দিয়ে ভাত খেয়েছিলেন। এই ঘটনা বেশি গুরুত্ব বহন করে না বলে মস্তিস্ক সেটা হয়তো এক মাসও ধরে রাখেনি।
আবার কোনো ঘটনা যতোই গুরুত্বহীন হোক না কেনো, পুনরাবৃত্তির কারণে তা আমাদের স্মৃতিতে থেকে যায়। আমরা তৃতীয় শ্রেণিতে নামতা পড়েছি 7 X 13= 91। এটি বাকি জীবনে অনেকবার ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়েছে। ফলে প্রথম শিক্ষণটিকে মস্তিস্ক এমনভাবে সংরক্ষণ করেছে যেনো তা দ্রুত প্রত্যাহ্যান (retrive) করা যায়। অতিন্দ্রীয়তায় আমাদের বিশ্বাসের বড় ভিত্তি হলো মায়া-বিভ্রম বা ইলুউশন।
অতীন্দ্রিয় কোনকিছুর অনুধাবনযোগ্য প্রমাণ নেই। আর যা কিছুর অনুধাবনযোগ্য প্রমাণ আছে তা অতিন্দ্রীয়তা নয়। কিন্তু বেশিরভাগ ইলিউশনের প্রমাণ পাওয়া যায়। শারীরিক ও মনস্তাত্তি¡ক জগতের বিভ্রম পরীক্ষা করা যায় এবং এর সাথে আমাদের উপলব্ধি ও বাস্তবতা কীভাবে জড়িত তা ব্যাখ্যাও করা যায়। ভৌত জগতের বিভ্রমগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে-ই চমকপ্রদ যা আমাদের সংবেদনশীলতা ও ইন্দ্রিয়ানুভ‚তির সঠিকতা সম্পর্কে আমাদের সন্দিগ্ধ করে তোলে। এই বিভ্রমগুলি দৃষ্টি, শ্রবণ, স্পর্শ এবং স্বাদসহ বিভিন্ন ইন্দ্রিয় জুড়ে পাওয়া যায়। এদের প্রকৃতি এবং প্রক্রিয়া অন্বেষণ করলে কীভাবে ভৌত জগতে আমাদের উপলব্ধির হেরফের হয় সেটা আমরা বুঝতে পারি। অপটিক্যাল ইলিউশন হলো ভৌত জগতের সবচেয়ে সুপরিচিত বিভ্রম। এই চাক্ষুষ বিভ্রমগুলি আমাদের মস্তিষ্কের ভিজ্যুয়াল তথ্যের ব্যাখ্যা এবং প্রক্রিয়াজাত করার উপায়কে কাজে লাগায় এবং প্রায়শ দৃশ্যের বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা থেকে প্রতারণামূলকভাবে ভিন্ন উপলব্ধি উৎপাদন করে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা ছোটবেলা থেকে কমবেশি সবাই মুলার লেয়ার ইলিউশনের সাথে পরিচিত। এই বিভ্রমে সমান দৈর্ঘ্যের দু’টি রেখা আঁকা হয়। এদের একটির দুই মাথায় আঁকা তীরচিহ্নগুলি ভিতরের দিক নির্দেশ করে এবং অন্যটির তীরচিহ্নগুলি বাইরের দিক নির্দেশ করে? তাদের প্রকৃত সমতা থাকা সত্তে¡ও আমরা বহির্মুখী তীর চিহ্নের সাথে থাকা রেখাটিকে ভেতরের দিক নির্দেশক তীরের সাথে থাকা রেখাটির চেয়ে দীর্ঘ হিসাবে উপলব্ধি করি এবং তাদের দৈর্ঘ্য সম্পর্কে ভুল ধারণা করি।
উপরের ছবিতে অ অংশের মাঝের বৃত্তটির তুলনায় ই অংশের অংশের মাঝের বৃত্তটিকে কিছুটা বড় দেখা যাচ্ছে। কম্পাস বা স্কেল দিয়ে মাপলে আমরা দেখব, বৃত্ত দুটি আকারে সমান। তাহলে আমরা এদের অসমান দেখছি কেনো? এর কারণ হলো, আমাদের মস্তিস্ক প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান বস্তুগুলোর আকারের মধ্যে তুলনা করে চলে। মস্তিস্ক এটা প্রয়োজনে-ই করে। সে একটা কাপের মুখের পরিধির সাথে চা চামচের আকারের তুলনা করে এবং বুঝতে পারে যে এই চামচ কাপের মধ্যে ঢুকানো যাবে। বাসায় ঢোকার সময় দরজার আকার দেখে বুঝতে পারে যে এর মধ্যে দিয়ে আমি ঢুকতে পারব। কিন্তু ভেন্টিলেটার দিয়ে বা জানালার শিক গলে ঢুকতে গেলে আটকে যেতে পারি। তুলনা করার এই অভ্যাস থেকে আমরা যখন এই চিত্রের A অংশের মাঝের বৃত্তটির দিকে তাকাচ্ছি তখন অবচেতন মনে-ই তাকে ঘিরে থাকা ৫টি বড় বৃত্তের সাথে তার আকারের তুলনা করছি এবং তাকে ছোট দেখতে পাচ্ছি। বিপরীতক্রমে ই অংশের মাঝের বৃত্তটিকে তাকে ঘিরে থাকা ৮টি ক্ষুদ্র বৃত্তের তুলনায় বড় দেখতে পাচ্ছি। এখানে কাজ করছে বিপরীত তুলনা। ফলে A ও B অংশের মাঝের বৃত্ত দুটিকে যখন তুলনা করতে যাচ্ছি তখন আমাদের মস্তিষ্কে জমা হয়ে যাওয়া তথ্য (“A অংশের মাঝের বৃত্ত ছোট” বা “B অংশের মাঝের বড়”) দিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছি। এই বিভ্রমটিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি আশেপাশের প্রসঙ্গ এবং সংকেতগুলি আমাদের ভিজ্যুয়াল সিস্টেমকে প্রাভাবিত করেছে এবং বৃত্ত দু’টির আকার সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করেছে। বিষয়টা অনেকটা এ’রকম- আপনি পরিবারের ৫ সদস্য ও কাজের মেয়েকে নিয়ে একটা বস্তিতে ঘুরতে গেলেন। গাড়ি থেকে নামার পর আপনাদের তুলনায় কাজের মেয়েকে তার পোশাকের কারণে কম উজ্জ্বল দেখাবে। আবার ঐ কাজের মেয়ে বস্তিতে ঢুকে গেলে অন্য পাঁচ জনের তুলনায় তাকেই উজ্জ্বল দেখাবে।
বৃষ্টিপাতের চিত্র আঁকার সময় আমরা তির্যক কিছু রেখা আঁকি। কারণ, আমরা বৃষ্টির ফোঁটাকে এ’রকম আকৃতিতেই দেখতে পাই। আসলে তাদের আকৃতি কিছুটা ডিম্বাকার। স্লো মোশনে দেখলে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। এই বিভ্রান্তির কারণ হলো, আমাদের চোখের রেটিনায় পড়া যে কোনো কিছুর ছবি এক সেকেন্ডের ১২ ভাগের এক ভাগ সময় স্থায়ী থাকে। এ’সময়ের মধ্যে বৃষ্টির ফোঁটা যতোটা দূরত্ব পাড়ি দেয় সেই দূরত্বের সবটুকু আমাদের রেটিনায় এক সাথে ধরা পড়ে। ফলে ঐ বৃষ্টির ফোঁটাকে আমরা লম্বা শলাকার মতো দেখি। আমাদের চোখের এই বৈশিষ্ট্যকে মাথায় রেখেই চলচ্চিত্র তৈরির কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। একটা সেলুলয়েড ফিতায় কোনো ঘটনার স্থির চিত্র ধারাবাহিকভাবে তোলা হয়। ধরা যাক এক সেকেন্ডে ১০টি হিসেবে এক মিনিটে ৬০০ ছবি তোলা হলো। এরপর ঐ ফিতার ওপর আলো ফেলে সেটাকে এক মিনিটে টেনে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে আসা হলো। ফিতার স্বচ্ছ আবরণ ভেদ করে যে পর্দায় আলো পড়বে সেখানে তাকালে আমাদের মনে হবে আমরা একটা চলমান দৃশ্য দেখছি। কারণ একটা ছবির চিত্র রেটিনায় থাকা অবস্থায়-ই পরের ছবিটা এসে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের সাথে একটা কুকুর থাকলে সে পর্দায় একটার পর একটা দ্রæত ধাবমান স্থির চিত্র দেখবে। বেশিরভাগ প্রাণির রেটিনায় তৈরি হওয়া চিত্র স্থায়ী হয় না; ফলে তারা সিনেমা দেখতে গেলে আমাদের মতো মজা পাবে না। মুভি তৈরির প্রথম দিকে ক্যামেরার ছবি তোলার গতি ধীর ছিলো। তাই সে’সময়ের ছবিগুলোতে পাত্র-পাত্রীদের ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে দেখা যায়, অনেকটা এখনকার সিসি টিভির মতো। খরচ কমানোর জন্য সিসি টিভির ছবি তোলার গতি কমিয়ে রাখা হয়। যে কোনো ভিডিয়োর ক্ষেত্রেও একই কৌশল প্রয়োগ করা হয়। খুব ধীর গতিতে চালালে আমরা স্থির চিত্রগুলোকে দেখতে পাবো।
সৌদি আরবে জিনের ভ্যালি বলে একটা জায়গা আছে যেখানে ইঞ্জিন চালু করা ছাড়াই গাড়ি সামনের দিকে চলে। এটাকে অনেকে অতীন্দ্রিয় কিছু বলে মনে করে। আসলে এ’রকম স্থান পৃথিবীতে ৭০টির মতো আছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও আছে। এগুলোকে বলা হয় ম্যাগনেটিক হিল, ম্যাজিক হিল বা গ্রাভিটি হিল। এখানে নির্মিত রাস্তাকে বলা হয় ম্যাজিক রোড। এটা ল্যান্ডস্কেপ থেকে সৃষ্ট একটা অপটিক্যাল ইলিউশন। আপাত দৃষ্টিতে গাড়ি পাহাড় বেয়ে উপরের দিকে চলছে বলে মনে হলেও আসলে গাড়ি নিচের দিকেই চলে। যে বিন্দু থেকে গাড়িটি চলতে শুরু করে সেই বিন্দু থেকে পৃথিবীর কেন্দ্রের দূরত্ব, যে বিন্দুর দিকে গাড়িটি চলতে শুরু করে সেখান থেকে পৃথিবীর কেন্দ্রের দূরত্বের থেকে বেশি। গন্তব্যের অতিরিক্ত মাধ্যাকর্ষণ গাড়িটিকে সামনে টেনে নিয়ে যায়। গন্তব্যের দিকের পাহাড়গুলোর সাথে পেছনের দিকের পাহাড়গুলোর উচ্চতা তুলনা করার মতো তৃতীয় কোনো নির্দেশক ঐ অঞ্চলে নেই বলে সামনের পাহাড়গুলোকে উঁচু মনে হয়। নিচুতে উড়তে থাকা বিমান যখন কাঁত হয় তখন জানালা দিয়ে সমতল ভ‚পৃষ্ঠকে পাহাড়ের ঢালের মতো দেখায় এবং বিমান যে নিজেই কাৎ হয়ে আছে সেটা বুঝতে পারা যায় না। আবার প্রিন্ট করা/কাগজে আঁকা ছবি/চিত্রকর্মও একটা ইলুশন। সেখানে মানুষ-গাছ-পাহাড়ের ছবির শুধু দৈর্ঘ্য-প্রস্থ থাকে। কিন্তু দেখার সময় সেগুলোকে আমরা (বেধ সহ) ত্রিমাত্রিক দেখি। আমরা বিভ্রান্ত হই আমাদের ভৌত অভিজ্ঞতা দিয়ে।
শ্রবণ বিভ্রমও অনেকটা মস্তিষ্কের অভ্যস্ততা ও আকাঙ্ক্ষার ফসল। আমার এক আত্মীয়ার শিশুপুত্র সর্বক্ষণ মায়ের পেছনে ঘুরঘুর করে এবং তাকে ‘মানি’ বলে ডাকতে থাকে। আমার আত্মীয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, “সে তোমাকে কী বলে ডাকে?” সে বললো, “মামনি।” কয়েকবার ভালো করে শোনার পর সে বুঝতে পারল যে বেবিটা তাকে স্পষ্ট ‘মানি’ বলে ডাকে। এখানে মা তার পূর্ব ধারণার সাথে আকাঙ্ক্ষা মিলিয়ে নিয়ে এতদিন ‘মামনি’ শুনে এসেছে। এভাবে ধ্বনি উদ্দীপনা আমাদের শ্রবণশক্তির বিভ্রম ঘটায় এবং এমন উপলব্ধিমূলক অভিজ্ঞতা তৈরি করে যা শারীরিক বাস্তবতা থেকে আলাদা। একটি সুপরিচিত শ্রবণ বিভ্রম হল শেপার্ড টোন বিভ্রম, যা ‘সোনিক নাপিত মেরু’ নামেও পরিচিত। রজার নিউল্যান্ড শেপার্ড ছিলেন একজন আমেরিকান জ্ঞানতাত্তি¡ক বিজ্ঞানী যিনি গতবছর মারা গেছেন। তাকে স্থানিক সম্পর্কের গবেষণার জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি পরিসংখ্যানগত উপাত্ত উপস্থাপনের মাধ্যমে ‘শেপার্ড টেবিল’ নামক অপটিক্যাল ইলিউশন এবং ‘শেপার্ড টোন’ নামক শ্রবণ বিভ্রম নির্ণয় পদ্ধতি আবিস্কার করেছিলেন। এটি একটি শব্দ বিভ্রম যা ক্রমাগত আরোহী বা অবরোহী পিচের একটি শ্রবণ বিভ্রম তৈরি করে। বিষয়টা ভালো করে বুঝতে নিচের ইউ টিউবে এই ভিডিয়োটি দেখুন। লক্ষ করুন টোনের বেস পিচ ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী বা নি¤œগামী হচ্ছে বলে মনে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা উচ্চ বা নি¤œ হয় না কিন্তু অসীম পর্যন্ত সে’রকম হচ্ছে বলে ধারণা তৈরি করে এবং একঘেয়েমি ও বিরক্তি উৎপাদন করে। শক্ত মনের দাগী আসামীদের অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য এই শেপার্ড টোন ব্যবহার করা হয়। এটি তাদের কক্ষে দীর্ঘ সময় বাজানো হয় যাতে বিরক্ত হয়ে তারা স্বীকারোক্তি দেয়। https://www.youtube.com/watch?v=oEW3F8B-lhU
ভৌত জগতের বিভ্রম শুধুমাত্র দৃষ্টি এবং শ্রবণে সীমাবদ্ধ নয় বরং অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মধ্যেও প্রসারিত। উদাহরণস্বরূপ, ‘রাবার হ্যান্ড বিভ্রম’ হলো একটি স্পর্শকাতর বিভ্রম যা আমাদের শারীরিক সচেতনতার স্থিতিস্থাপকতার প্রমাণ হিসেবে দেখা হয়। এই পরীক্ষায়, একটি রাবারের হাত একজন অংশগ্রহণকারীর সামনে তার শরীরের সাথে লাগিয়ে রাখা হয়। তার আসল হাতটি কাপড়ের মধ্যে লুকানো থাকে। অন্য হাতটিও সামনের টেবিলে রাখা হয়। এরপর দুই হাতে-ই একসাথে মসৃণ ব্রাশ দিয়ে কিছুক্ষণ ছোঁয়া দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে ঐ ব্যক্তির মস্তিষ্কে অবচেতন ও অস্পষ্টভাবে এই ধারণা সঞ্চারিত হয় যে ঐ প্লাস্টিক হাতটিও তার শরীরের অংশ। এরপর হঠাৎ ঐ রাবারের হাতে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়। এতে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে।
স্বাদের বিভ্রমের অনেক উদাহরণ আমাদের চারপাশে-ই আমরা দেখি। আমার বাবা পোলাও খেতে পছন্দ করতেন। একদিন রাতের খাবার হিসেবে পোলাও রান্না হলো। বাবা জানলেন, পাচক আমার বড় আপা। খেতে বসে বিষম বিতৃষ্ণা সহ অর্ধাহারে উঠে গেলেন। পরদিন দুপুরে ঐ পোলাও গরম করে মা’র নতুন রান্না বলে টেবিলে দেওয়া হলো। বাবা এবারের রান্নাকে বিপুল প্রশংসায় ভাসিয়ে তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে উঠলেন। বাবার এই বিভ্রমটি তৈরি হয়েছিল পূর্বানুমান থেকে। এ’ধরণের বিভ্রমের একটি বিখ্যাত পরীক্ষ্রা নাম ছিলো ওয়াইন প্ল্যাসিবো ইফেক্ট। পরীক্ষাটি স্বাদের বিভ্রমের একটি উদাহরণ যা দেখায় কীভাবে বিষয়ভিত্তিক বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা আমাদের সংবেদনশীল অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করতে পারে। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের একই ওয়াইন দেওয়া হয়। একদলকে দেওয়া বোতলগুলোর গায়ে ব্যয়বহুল ও উচ্চ-মানের ওয়াইন এবং অন্য দলকে দেওয়া বোতলগুলোর গায়ে সস্তা ও নি¤œ-মানের ওয়াইনের লেবেল লাগিয়ে দেওয়া হয়। পার্টি শেষে প্রথম দল তাদের ওয়াইনকে তৃপ্তিদায়ক (এমনকি কেউ কেউ সুগন্ধযুক্ত) হিসেবে বর্ণনা করে। দ্বিতীয় দল নিতান্ত ভদ্রতাসূচক আলাপচারিতার মাধ্যমে পার্টি শেষ করে। খেয়াল করে দেখুন এখানেও কাজ করেছে প্রত্যাশা, প্রেক্ষাপট ও পূর্বানুমান। মনস্তাত্তি¡ক জগতের এই বিভ্রম বিষয়ে আগ্রহীরা “Why Wine Tastes Better When It Costs More” শিরোনামে TIME ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এই নিবন্ধটি পড়তে পারেন: https://time.com/4902359/wine-tastes-better-when-it-costs-more/
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।