হাসান গোর্কি : স¤প্রতি অ্যামাজন থেকে Lyn Smith-র লেখা Remembering: Voices of the Holocaust বইটা (ই-বুক) ১২ ডলারে কিনে পড়লাম। বইটিতে হিটলারের থার্ড রাইখের উত্থান ও পতন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে হলোকস্ট এবং তা থেকে বেঁচে যাওয়া লোকদের দেওয়া বিবরণ আছে। রাইখ অর্থ শাসন বা সাম্রাজ্য। ঐতিহাসিকভাবে, প্রথম রাইখ ছিল মধ্যযুগীয় রোমান সাম্রাজ্য যা ১৮০৬ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। দ্বিতীয় রাইখ হলো ১৮৭১-১৯১৮ সময়ের জার্মান সাম্রাজ্য। আর ১৯৩৩-’৪৫ সালের নাৎসি শাসনকে বলা হয় থার্ড রাইখ। উল্লেখিত বইটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া লোকদের অভিজ্ঞতার বিবরণ আছে। তাদের বর্ণনা মূলত ওয়াশিংটন ডিসি-র হলোকস্ট মিউজিয়াম এবং লন্ডনের ইম্পেরিয়াল ওয়ার মিউজিয়ামের জন্য রেকর্ড করা হয়েছিল? এটা ছিলো অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুর গণহত্যার বর্ণনা। যুদ্ধ শেষে নুরেমবার্গ ট্রায়ালে ১২ জন এবং টোকিয়ো ট্রায়ালে ৭ জন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পালিয়ে থেকে যারা বিচার এড়িয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগ চলে যান দক্ষিণ আমেরিকায়। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ কয়েক দশক ব্যাপী তাদের খোঁজে যে গোপন অভিযান চালায় তা ছিলো অভাবনীয়রকম রোমহর্ষক ও অবিশ্বাস্য নাটকীয়তায় ভরা।
অটো এডলফ আইখম্যান ছিলেন নাৎসি বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার বাহিনী হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও অস্টিয়া দখল করে। সে’সময় শুধু হাঙ্গেরিতে বসবাসকারী ৭ লক্ষ ইহুদির মধ্যে ৪ লক্ষ আইখম্যানের বাহিনীর হাতে নিহত হয়। এমনকি বার্লিন থেকে হত্যা বন্ধের নির্দেশ আসার পরও ২ দিন তিনি তা চালিয়েছিলেন যাতে তার হাতে বন্দী থাকা ইহুদিদের কেউ বেঁচে না থাকে। ২৪ ডিসেম্বর ১৯৪৪-এ, সোভিয়েতরা হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট ঘিরে ফিললে আইখম্যান সেখান থেকে পালিয়ে যান। তিনি বার্লিনে ফিরে আসেন এবং অপরাধমূলক কর্মকাÐের রেকর্ড পুড়িয়ে ফেলেন। পরিচয় লুকাতে অটো হেনিঙ্গার নামে একজন নিহত সৈনিকের তথ্য ব্যবহার করে নিজের মিথ্যা পরিচয়পত্র তৈরি করেন। যুদ্ধ শেষে আইখম্যান মার্কিন বাহিনীর হাতে বন্দী হন। কিন্তু তার পরিচয় প্রকাশিত হয়নি। অন্য সৈনিকদের মতো তাকেও ব্যারাকে রাখা হয়। মার্কিন গোয়েন্দারা ধারণা করেছিলেন যে আইখম্যান বন্দী হওয়া সৈনিকদের মধ্যে থেকে থাকতে পারেন; কারণ তিনি বার্লিন ফেরার পর অন্য কোথাও গিয়েছেন এমন তথ্য নেই। তাকে যে খোঁজা হচ্ছে সেটা বুঝে আইখম্যান পালিয়ে উত্তরাঞ্চলীয় ছোট জনপদ লুনেবার্গ হিথে গিয়ে নতুন পরিচয়ে কৃষিকাজ শুরু করেন। একসময় সেখানে থাকাও তিনি অনিরাপদ মনে করেন এবং বিশপ অ্যালোইস হুডাল পরিচালিত একটি সংস্থার মাধ্যমে ইতালিতে বসবাসকারী একজন অস্ট্রিয়ান ধর্মগুরুর সহায়তায় রিকার্ডো ক্লেমেন্ট নামে একটি মিথ্যা পরিচয়পত্র তৈরি করেন। এর ফলে তিনি রেডক্রস পাসপোর্ট পান এবং ১৯৫০-র জুনে জেনোয়া থেকে জাহাজে বুয়েনেস আইরেস যান।
বারবার নাম-পরিচয় পরিবর্তন করায় দীর্ঘদিন মোসাদ আইখম্যানের অবস্থান জানতে পারেনি। ১৯৫৫ সালে বিগত ৫ বছরে রেডক্রস থেকে ইস্যুকৃত পাসপোর্টের তালিকা চুরি করেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া সাইমন উইসেনথাল যিনি সে’সময় রেডক্রসে চাকরি করতেন। আসলে তিনি ছিলেন মোসাদের এজেন্ট, গোপনে ইউরোপে নাৎসি শিকারীদের একটি নেটওয়ার্কের হয়ে কাজ করতেন। রেডক্রসের পাসপোর্টে রিকার্ডো ক্লেমেন্টের যে পরিচয় উল্লেখ আছে সেই সূত্র ধরে মোসাদের এজেন্টরা জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর ডুসেলডর্ফ-এ গিয়ে সেই লোকের সন্ধান পান। তিনি ছিলেন ভিন্ন লোক। তখন তারা অনুমান করেন যে এই ব্যক্তির পরিচয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে আইখম্যান দক্ষিণ আমেরিকায় চলে গিয়ে থাকতে পারেন। তার খোঁজে মোসাদের একদল এজেন্ট আর্জেন্টিনা চলে যান। তারা ভিন্ন ভিন্ন দেশের পাসপোর্ট তৈরি করে কয়েকটি ভিন্ন তারিখে সেখানে যান এবং বিভিন্ন পরিচয়ে বাস করতে থাকেন। যেমন এই দলের সদস্য জেভি আহরোনি সেখানে গিয়ে আইরিশ পরিচয়ে আর্জেন্টিনা থেকে চুনাপাথন, গ্রানাইট ও মার্বেল রপ্তানীর দোকান খুলে বসেন। আমরা জানি যতো সহজে বলে যাওয়া হচ্ছে ঘটনাগুলো ঘটানো তার চেয়ে শতগুণ কঠিন ছিলো। এই অভিযান নিয়ে শুধু ইংরেজিতে-ই গোটা পঞ্চাশেক বই লেখা হয়েছে। Neal Bascomb এর লেখা Hunting Eichmann বইটা আমার সংগ্রহে আছে। সিক্রেট এজেন্টদের নিয়ে পৃথিবীতে যতো বই লেখা হয়েছে বা মুভি তৈরি হয়েছে তার যে কোনটির কল্পনার চেয়ে রোমহর্ষক ছিলো এই বাস্তব অভিযান। কমপক্ষে শ’দুয়েক পৃষ্ঠার একটা বই লিখলে ঘটনাটা ভালভাবে বর্ণনা করা সম্ভব।
পাঁচ বছরের মাথায় জেভি আহরোনি আইখম্যানের মতো লম্বা নাকের এক ব্যক্তির সন্ধান পান এবং তাকে অনুসরণ করে বুয়েনোস আইরেসের শহরতলীতে তার বাড়ি চিনে আসেন। তিনি লক্ষ করেন এই ব্যক্তি বাড়ি এবং অফিস ছাড়া কোথাও যান না, কারো সাথে মেশেন না। কিন্তু এই ব্যক্তি আইখম্যান কিনা তা নিশ্চিত হওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিলনা। আইখম্যান যে বাসে অফিস থেকে ফিরতেন ঠিক সন্ধ্যা ৭:৪৫-এ সেটা তার বাড়ির কাছের স্টপে পৌঁছুত। জেভি আহরোনি গাড়িতে বসে শক্তিশালী ক্যামেরা দিয়ে বিভিন্ন এঙ্গেলে কয়েকটা ছবি তুলে মোসাদের সদর দপ্তর তেল আবিবে পাঠান। সেখান থেকে নিশ্চিত করা হয় যে আহরোনি আইখম্যানের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। কিন্তু একদিন দেখা গেলো আইখম্যান বাস থেকে নামেননি। পরদিন আহরোনি আইখম্যানের অফিসের সামনে অপেক্ষা করতে থাকলেন। আইখম্যান অফিস থেকে বের হবার পর তার বাস অনুসরণ করে গিয়ে দেখলেন তিনি শহরের ঠিক বিপরীত প্রান্তে বাসা নিয়েছেন। তেল আবিব থেকে আহরোনিকে এক ব্যক্তির ঠিকানা দিয়ে তার সাথে দেখা করতে বলা হলো। ঐ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি ছিলেন এক আর্জেন্টাইন ইহুদি। আহরোনি তার সাথে দেখা করে আইখম্যানের নতুন বাসার যে ঠিকানা পেলেন সেটা তাঁর দেখা বাসার সাথে মিলে গেলো। ঐ ব্যক্তি জানতেন না যে তিনি আইখম্যানের বাসার ঠিকানা দিচ্ছেন; তিনি তাকে রিকার্ডো ক্লেমেন্ট হিসেবে চিনতেন। আইখম্যান যে আর্জেন্টিনায় আছেন সেটা তখন খুব উচ্চ পদস্থ কিছু লোক ছাড়া কেউ জানতো না। আহরোনি ১০০ পেসোর একটা নোট জিকজ্যাক করে কেটে অর্ধেকটা ঐ ব্যক্তিকে দিয়ে বললেন, “আপনি এ’ব্যাপারে শুধু তার সাথে-ই কথা বলবেন যে নোটের এই বাকি অংশ নিয়ে আসবে।” এবার আহরোনি আরও নিশ্চিত হলেন যে পালিয়ে বেড়ানো এই ব্যক্তি-ই আইখম্যান। তাকে হত্যা করা সম্ভব; কিন্তু তাদের লক্ষ্য তাকে অপহরণ করে ৯ হাজার মাইল দূরে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া। এই দূরত্ব বাংলাদেশ থেকে কানাডার দূরত্বেরও ১৩০০ মাইল বেশি। এছাড়া আর্জেন্টিনা নাৎসিদের প্রতি সহানুভ‚তিশীল একটি রাষ্ট্র।
১৯৬০ সালের মে দিবসের অনুষ্ঠানে ইসরায়েল থেকে প্রায় এক প্লেন বোঝাই করে প্রতিনিধি দল পাঠানো হলো। তখন সবাই ধারণা করলো যে আর্জেন্টিনার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য এটা করা হয়েছে। ১৯৫৯-র জুলাই থেকে দেওয়া ইসরায়েলের বেশ কিছু সরকারি বিবৃতি থেকেও সেরকম আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। ঐ প্রতিনিধি দলে স্টুয়ার্ড, বিমানবালা, ড্রাইভার, পাইলট, ক্যামেরাম্যান এসবের ছদ্মবেশে ছিলেন কমান্ডো, চিকিৎসক, নার্স, সুটার, এনেস্থেটিস্ট যারা আসলে মোসাদের উচ্চ প্রশিক্ষিত এজেন্ট। ১১ মে সন্ধ্যায় রাফি ইতান, পিটার মালকিন, জেভি আহরোনি, ইয়াকভ মেইদাদ এবং মোশে তাবর ৩টি গাড়ি নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে আইখম্যানের বাসার কাছে অপেক্ষা করছিলেন। এর মধ্যে দুটি গাড়িতে ভুয়া নম্বরপ্লেট লাগানো ছিলো। ৮টা ৫ মিনিটে আইখম্যান বাস থেকে নেমে বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। কিছুটা নির্জন জায়গায় পৌঁছুলে রাফি ইতান ও মোশে তাবর তাকে ধাক্কা দিয়ে ফুটপাথে ফেলে দিলেন এবং গাড়ির পেছন সিটে তুলে ফেললেন। এসময় জেভি আহরোনি তার দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ইঞ্জিন উচ্চ শব্দে চালাতে থাকলেন যাতে আইখম্যানের চিৎকার বা ধস্তাধস্তির শব্দ কেউ শুনতে না পায়। আহরোনি ও মেইদাদ নিজেদের গাড়ি রেখে ইতানের গাড়িতে পেছনের সিটে শোয়া আইখম্যানের পা ও মাথার কাছে বসলেন এবং রশি দিয়ে তার হাত-পা বাঁধলেন। আহরোনি আইখম্যানকে জার্মান ভাষায় বললেন, “আপনি নিশ্চয়-ই বুঝতে পেরেছেন আমি কে। এক চুল নড়াচড়া করলে গুলি করে দেবো।” আইখম্যান কোনো কথা বলছিলেন না। কারণ তাতে নিশ্চিত করা হয় যে তিনি জার্মান ভাষা বোঝেন। আহরোনি এবার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে উত্তেজিতভাবে জার্মান ভাষাতেই বললেন, “এক চুল নড়াচড়া করলে গুলি করে দেবো।” এবার আইখম্যান খাঁটি জার্মান ভাষায় বললেন, “আমি ইতোমধ্যে ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছি।” আহরোনি নিশ্চিত হলেন যে তিনি ঠিক লোকটিকে-ই ধরেছেন। এই অপহরণ অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাফি ইতান যিনি ২০১৯ সালে ৯২ বছর বয়সে মারা গেছেন।
অপহরণস্থল থেকে তাদের গন্তব্য (তাদের বাসা) দক্ষিণ দিকে। কিন্তু ইতান গাড়ি চালিয়ে অনেকটা উত্তরে গিয়ে নম্বর প্লেট পরিবর্তন করে অন্য পথে দক্ষিণে রওনা হলেন। তাদের সবগুলো গাড়িতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নম্বর প্লেট পরিবর্তন করার ব্যবস্থা ছিলো। মোশে তাবর অন্য গাড়ি নিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেলেন। দক্ষিণে বাঁক নেওয়ার আগে তিনি-ও তার গাড়ির নম্বর প্লেট পরিবর্তন করে নিলেন। পুলিশ যদি ঘটনা বুঝতে পেরে তাদের তাড়া করে অথবা পরবর্তীতে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে তাহলে যাতে তাদের খুঁজে না পায় সেজন্যে এই ব্যবস্থা। আহরোনির গাড়িটা তারা ইচ্ছা করে ঘটনাস্থলে ফেলে গেলেন। যাবার আগে তারা গাড়ির সামনের চাকা ফুটো করে দিয়ে গেলেন। এই গাড়িটা তারা এক ড্রাগ ডিলারের কাছে কিনেছিলেন যার কিছু মাফিয়া গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ ছিলো। আইখম্যান অফিসে অনুপস্থিত থাকায় তার খোঁজ পড়লো। পুলিশ তার বাসায় গিয়ে কাউকে না পেয়ে সামনে পড়ে থাকা গাড়ির সূত্র ধরে অণুসন্ধান শুরু করলো। পুলিশের ধারণা হলো আইখম্যানকে (তাদের নথি অনুযায়ী রিকার্ডো ক্লেমেন্টকে) অপহরণ করার সময় গাড়িটির চাকা ফেটে গেলে অপহরণকারীরা সেটা ফেলে গেছে। আত্মগোপনে থাকা ঐ ড্রাগ ডিলারকে এই অপহরণের জন্য দায়ী মনে করে পুলিশ তাকে খুঁজতে শুরু করলো।
ওদিকে গোপন আস্তানায় আইখম্যানকে আটকে রেখে মোসাদ সদস্যরা একটা নথিতে আইখম্যানের স্বাক্ষর আদায় করে নিলেন যেখানে তিনি ইসরায়েলে গিয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে সম্মতি দেন। মে দিবস উপলক্ষ্যে যাওয়া ইসরায়েলি প্রতিনিধদলের ফিরে আসার তারিখ ইচ্ছা করে লম্বা সময় দিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছিল, অপহরণের কাজ বিলম্বিত হলে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। ২০ মার্চ ভোর রাতে আইখম্যানকে চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে একটা কাঠের বাক্সে ভরা হলো। এই বাক্সতে করে ইসরায়েল থেকে ভারি বাদ্যযন্ত্র আনা হয়েছিল। বানিজ্যিক বিমান হলে এই বাক্সটি লাগেজ হিসেবে যাওয়ার কথা। নিজেদের বিমান বলে তারা এটা কেবিনে নিতে পেরেছিলেন। বিমান ছাড়ার পর তাকে বের করে শুশ্রূষা করা হয় যাতে ইসরায়েলে পৌঁছার আগেই তিনি মরে না যান। ২১ মার্চ আইখম্যানকে বহনকারী বিমান তেল আবিবে পৌঁছে। ২৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ন নেসেটে (ইসরায়েলি পার্লামেন্ট) ঘোষণা করেন, ‘আইখম্যানকে আটক করা হয়েছে। এখন তিনি ইসরায়েলে আছেন।’ এই খবর শুনে সারা বিশ্ব হতবাক হয়ে যায়। আর্জেন্টিনার সাথে ইসরায়েলের গুরুতর ক‚টনৈতিক সংকট দেখা দেয়। আর্জেন্টিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগে নালিশ করে। ইসরায়েল যুক্তি দেখায় যে আইখম্যান স্বেচ্ছায় ইসরায়েলে গিয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে রাজি হয়ে সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। ইসরায়েলের আদালতে আইখম্যানের বিচারে মৃত্যুদণ্ড হয়। সুপ্রিম কোর্টে তার আপিল খারিজ হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হবার কয়েক ঘন্টার মধ্যে ৩১ মে ১৯৬২, মধ্যরাতে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে ওঠার সময় তিনি বলেন, “জার্মানি দীর্ঘজীবী হোক। আর্জেন্টিনা দীর্ঘজীবী হোক। অস্ট্রিয়া দীর্ঘজীবী হোক। এই তিনটি দেশের সাথে আমি সবচেয়ে বেশি সংযুক্ত হয়েছি, যা আমি ভুলব না। আমি আমার স্ত্রী, আমার পরিবার এবং আমার বন্ধুদের শুভেচ্ছা জানাই। আমি প্রস্তুত। শীঘ্রই আমরা, সেই জার্মান পুরুষেরা যারা পিতৃভ‚মির জন্য যুদ্ধ করেছি, আবার মিলিত হবো ঈশ্বরের কৃপার ছায়াতলে।” আইখম্যানের ইচ্ছা অনুযায়ী ফাঁসির পর তার মৃতদেহ পুড়িয়ে ভস্ম সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়।
হারবার্টস কুকুরস ছিলেন একজন লাটভিয়ান বিমানচালক যিনি হলোকস্টে লাটভিয়ায় ইহুদিদের ওপর বৃহত্তম গণহত্যা চালিয়েছিলেন। লাটভিয়ান ভাষায় কুকুরস অর্থ চিনি। আমরা যেমন ছেলেমেয়েদের নাম মধু, আঙ্গুর, জুঁই রাখি এই আশায় যে সে শান্তশিষ্ট ও সুবোধ হবে, তার বাবা-মায়ের আশাও হয়তো সে’রকম ছিলো। ১৯৪১ সালের গ্রীষ্মে জার্মানি লাটভিয়া দখল করে নেয়। সে’সময়, কুকুরস নবগঠিত লাটভিয়ান ভাড়াটে পুলিশ ইউনিট, আরজ কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার হন এবং ইহুদিদের গণহত্যায় নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধ শেষে তিনি ব্রাজিলে পালিয়ে যান। যুদ্ধাপরাধীদের খোঁজে মোসাদ দক্ষিণ আমেরিকায় যে এজেন্টদের পাঠায় তাদের একদল ব্রাজিলে গিয়ে বিমান কেনাবেচার এজেন্সি খুলে ব্যবসা শুরু করেন এবং কুকুরসকে খুঁজতে থাকেন। ব্রাজিলে আসার সময় কুকুরস নাম-পরিচয় বদল করেছিলেন। তিনি যে জাহাজে ব্রাজিল গিয়েছিলেন এজেন্টরা তার সন্ধান পান এবং যাত্রীদের তালিকাও পেয়ে যান। ঐ তালিকার মানুষদের সম্পর্কে পাঁচ বছর ধরে খোঁজ খবর নেওয়ার পর রিও-ডি-জেনিরিওর শহরতলীতে তারা এমন এক ব্যক্তির সন্ধান পান যিনি সরকারি বাসায় থাকেন এবং জীবিকার জন্য কোনো কাজ করেন না। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর তিনি বাড়ির কাছের একটা রেস্টুরেন্টে কফি খেতে যান এবং দীর্ঘ সময় একা বসে থাকেন। এজেন্টদের মধ্যে ছিলেন ইয়াকভ মেইদাদ যিনি ১৯৬০ সালে আর্জেন্টিনায় অ্যাডলফ আইখম্যানকে আটকে অংশ নিয়েছিলেন। ইয়াকভ ঐ রেস্টুরেন্টে সন্ধ্যায় সময় কাটাতে শুরু করেন। এক সময় তাদের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময় শুরু হয়। বেশ কিছুদিন এ’রকম চলার পর কুকুরস নিজ আগ্রহে ইয়াকভ এর সাথে কথা বলেন। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। ইয়াকভ কুকুরসকে তার অফিসে ভালো বেতনে চাকরি দেন।
তাকে আটক করে ব্রাজিল থেকে ইসরায়েল নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলো না। কারণ তিনি ব্রাজিল সরকারের আশ্রয়েই সেখানে বাস করছিলেন। কুকুরসকে বলা হয়, উরুগুয়েতে নতুন অফিস খোলা হবে। তিনি চাইলে সেই অফিসের প্রধান হিসেবে কিছুটা বেশি বেতনে যোগ দিতে পারেন। কুকুরস রাজি হয়ে উরুগুয়ে চলে যান এবং শহরের কেন্দ্রে তার অফিসের কাছে বাসা ভাড়া নেন। পরিকল্পনা ছিলো তাকে অজ্ঞান করে দক্ষিণ আটলান্টিকে অপেক্ষমাণ ইয়টে নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখান থেকে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হবে। অভিযাত্রীর ছদ্মবেশে যে দুটি ইয়টে মোসাদের এজেন্টরা অপেক্ষা করছিলেন সেগুলো প্রবল সামুদ্রিক ঝড়ে দিকভ্রান্ত হয়ে আর্জেন্টিনার উপক‚লে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সমুদ্রে ভাসার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে ইয়াকভকে পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হয়। মন্টেভিডি অফিসের কর্মকর্তাদেরর কয়েকজন ছিলেন মোসাদের এজেন্ট। শহরতলীর নির্জন এলাকায় তাদের একজনের জন্য একটা বাসা ভাড়া করা হয়। সেখানে কুকুরসকে ডিনারে আমন্ত্রণ করেন ঐ কর্মকর্তা। তারা যখন খাবার টেবিলে ছিলেন তখন অন্য দুই সহযোগী সহ সেখানে প্রবেশ করেন ইয়াকভ। সেখানে তারা কুকুরসকে হত্যা করেন এবং পরদিন ইসরায়েলের ফ্লাইট ধরেন। দুই দিন পর উরুগুয়ের সোশ্যাল সারভিসেস ডিপার্টমেন্ট থেকে আর্থিক সহায়তার চেক আনতে না যাওয়ায় কুকুরসকে ফোন করা হয়। না পেয়ে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ গিয়ে মৃতদেহ উদ্ধার করে।
এছাড়া আরও বেশ ক’জন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীকে মোসাদ হত্যা বা আটক করে। জোসেফ রুডলফ মেঙ্গেল ছিলেন বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনীর এস এস অফিসার এবং চিকিৎসক। পোল্যান্ডের Auschwitz-2 কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদি বন্দীদের উপর তিনি জীবনঘাতী পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। সেখানে তিনি চিকিৎসক দলের একজন সদস্য ছিলেন যারা গ্যাস চেম্বারে হত্যার জন্য বন্দী নির্বাচন করতেন। যুদ্ধের পর তিনি পালিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বাস করে আসছিলেন। মোসাদ সদস্যরা অবশেষে ১৯৮৫ সালে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার ৪০ বছর পর) তাকে সনাক্ত করে তেল আবিবে খবর পাঠান।
কিছুদিন পর তাকে তার গৃহে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, ধরে আনতে ব্যর্থ হয়ে ৭৭ বছর বয়স্ক মেঙ্গেলকে মোসাদ এজেন্টরা সুয়েরেজ লাইন দিয়ে বাসায় বিষাক্ত গ্যাস ঢুকিয়ে হত্যা করেন। এডুয়ার্ড রোশম্যান ছিলেন একজন অস্ট্রিয়ান নাৎসি (এস এস) অফিসার। তিনিও অসংখ্য বেসামরিক ইহুদি হত্যার সাথে জড়িত ছিলেন। ফ্রেডরিক ফোরসিথের দ্য ওডেসা ফাইল উপন্যাসে (পরে এই নামে একটা চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে) তার নিষ্ঠুরতার বিবরণ পাওয়া যায়। সাইমন উইসেনথাল মোসাদের সহযোগী হিসেবে চার দশক নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের খোঁজে দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় সবগুলো দেশ চষে বেড়িয়েছেন। তিনি ১৯৭৭ সালে রোশম্যানকে আর্জেন্টিনায় খুঁজে বের করেন। আর্জেন্টিনা সরকার প্রকাশ্যে তাকে মোসাদের কাছে হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গোপনে প্যারাগুয়েতে পালানোর অনুমতি দেয়। মোসাদ সদস্যরা তাকে অনুসরণ করে উরুগুয়েতে যান। এরপর নিজের ফ্ল্যাটে রোশম্যানের মৃতদেহ পাওয়া যায়। প্রথমে আত্মহত্যা মনে করা হলেও পরে পরিপার্শ্বিক সাক্ষ্য বিবেচনা করে ধারণা করা হয় যে এটা মোসাদের কাজ। কারণ, তার ডাইনিং টেবিলে পাওয়া কলা পরীক্ষা করে পটাশিয়াম সায়ানাইড পাওয়া গিয়েছিল।
ডিঙ্কো সাকিচ ছিলেন একজন ক্রোয়েশিয়ান সামরিক অফিসার। তিনি জার্মানির পক্ষে জেসেনোভাক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন। যুদ্ধ শেষে তিনিও পালিয়ে আর্জেন্টিনায় চলে গিয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালে মোসাদ এজেন্ট জুরফ তাকে বুয়েন্স আয়ারাস-এ খুঁজে বের করে অপহরণের ফাঁদ তৈরি করেন। বিপদ বুঝতে পেরে সাকিচ আর্জেন্টাইন পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাকে ক্রোয়েশিয়ায় প্রত্যর্পণ করা হয়। বিচারে তার ২০ বছর কারাদণ্ড হয়। ট্রেবিøঙ্কা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের কমান্ড্যান্ট ফ্রাঞ্জ স্ট্যাঙ্গল এবং তার ডেপুটি জোসেফ শোয়ামবার্গারকে মোসাদের এজেন্টরা যথাক্রমে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে খুঁজে পেয়েছিলেন। শোয়ামবার্গার শান্তিয়াগোয় পালানোর পথে চিলি সীমান্তে মোসাদ সদস্যদের হাতে আটক হন। ১৯৯০ সালে তাকে পশ্চিম জার্মানিতে প্রত্যর্পণ করা হয়। বিচারে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং তিনি ২০০৪ সালে কারাগারে মারা যান। ফ্রাঞ্জ স্ট্যাঙ্গল ১৯৬৭ সালে সাও পাওলোতে মোসাদ এজেন্ট উইসেনথালের হাতে ধরা পড়েন। তাকে জার্মানিতে প্রত্যর্পণ করা হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে তিনি কারাগারে মারা যান। অন্য এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধী গুস্তাভ ওয়াগনারকে ১৯৭৮ সালে মোসাদ এজেন্টরা ব্রাজিলের সিয়ারা স্টেটের এক প্রত্যন্ত এলাকা থেকে খুঁজে বের করেছিলেন। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কিন্তু ব্রাজিল তাকে পশ্চিম জার্মানির কাছে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেছিল। ১৯৮০ সালে ৭৮ বছর বয়স্ক এই যুদ্ধাপরাধীকে তার বাড়িতে যখন মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তখন সবাই ধরে নিয়েছিলেন মোসাদ তাকে হত্যা করেছে। কিন্তু পরে দেখা যায় তার মৃত্যু ছিলো বার্ধক্যজনিত।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া।