হাসান গোর্কি : গত পর্বের লেখা (“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন ”) পড়ে এক বন্ধু মত দিয়েছেন, “শুধু ভালভাবে ভাষা রপ্ত করতে না পারার কারণে নিয়ানডার্থালরা সেপিয়েন্সদের কাছে পরাজিত হয়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে- এটা বিশ্বাস করা কঠিন।” আসলে এটা একটা অনুকল্প। এ’ধরণের হাইপোথিসিসে আস্থা তৈরি হবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় এগুলোর প্রত্যক্ষণ-অযোগ্যতা (Persuasion- incompetence)। যেমন গরু, বাঁধাকপি, ইঁদুর, কলমিলতা এবং আমরা যে একই উৎস থেকে উদ্ভূত হয়েছি তার জেনেটিক প্রমাণ আছে; তবে তার প্রত্যক্ষণযোগ্য প্রমাণ নেই। অর্থাৎ, এই প্রাণ প্রজাতিগুলোকে আমরা প্রি-মোরডিয়াল স্যুপ থেকে উদ্ভূত হতে দেখিনি। অথবা এক সময় চার হাত পায়ে হাঁটা প্রাইমেটদের একটি অংশ বিবর্তিত হয়ে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছিল- পেছনে গিয়ে সেই ঘটনাপ্রবাহ দেখে আসার সুযোগ নেই। কিন্তু সে’রকম যে ঘটেছে তার ধারাবাহিক সাক্ষ্য আছে। পৃথিবীর দখল নেওয়ার সময় সেপিয়েন্সরা নিয়ানডার্থালদের চেয়ে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে ভাষা নিয়ামক ভ‚মিকা পালন করেছে’- এটা যে একটা অনুকল্পিত ধারণা সেকথা শুরুতেই বলেছি। পাশাপাশি এটাও সত্য, কিছু প্রাণি যথেষ্ট বুদ্ধিমান হওয়া সত্তে¡ও ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার কারণে টিকে থাকার অতিরিক্ত কোনো গুরুত্ব-প্রভাব-প্রণিধান তৈরি করতে পারেনি।
মানুষের শেষ সাধারণ পূর্বপুরুষ হলো শিম্পাঞ্জি। দীর্ঘ ও জটিল সংকর প্রজাত্যায়নের কারণে নির্দিষ্ট সময়কাল বলা সম্ভব না হলেও দেড় কোটি থেকে এক কোটি ৩০ লাখ বছর আগে শিম্পাঞ্জি ও মানুষের পূর্বপুরুষ একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। এর মূল কারণ ছিলো মানুষের শরীরে থাকা FOXP2 নামের জিনটির এমাইনো এসিডের গঠনে কিছু পরিবর্তন। শিম্পাঞ্জির শরীরে থাকা একই জিনে সে পরিবর্তনটি ঘটেনি। মানুষের পরে শিম্পাঞ্জিকে প্রাণিকুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান মনে করা হয়। তারা সমাজবদ্ধভাবে বাস করে। অন্যের প্রতি হিংসা, সহানুভ‚তি, ক্ষোভ লালন ও প্রকাশ করতে পারে। তাদের শক্তিশালী স্বল্পমেয়াদী স্মৃতি রয়েছে। স্বল্প সময়ের বিবেচনায় তা আমাদের চেয়েও ভালো। এক পরীক্ষায় দেখা গেছে এরা এক সেকেন্ডেরও কম সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করার পর একটি মনিটরে সংখ্যার সুনির্দিষ্ট ক্রম এবং স্থান নির্ধারণ করতে পারে। কিন্তু মস্তিষ্কের বিকাশ থেমে যাওয়ায় তারা একটা কার্যকর ভাষা তৈরি করতে পারেনি। ফলে আমাদের মতো আগাতেও পারেনি।
বিপরীত পক্ষে মানুষের মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি পেতে পেতে বর্তমানে শিম্পাঞ্জির তুলনায় গড়ে ৩ গুণ হয়েছে। একই জিনগত পরিবর্তন মানুষের স্বরযন্ত্রের (বিশেষ করে আলজিভ, তালু গহ্বর) নমনীয়তায় ভ‚মিকা রেখেছে। ফলে মানুষ নতুন নতুন শব্দের মাধ্যমে নিজের চিন্তা/পরিকল্পনা অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পেরেছে। অন্য প্রাইমেটরা সেটা পারেনি,যদিও তাদের সাথে আমাদের জিনগত মিল গড়ে প্রায় ৯৮%। পশু শিকারের কথাই ধরা যাক। অন্য সব প্রাইমেট কিছু সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা সীমিত উদ্দীপক শব্দের সাহায্যে একটা পশুকে আক্রমণের উদ্যোগের কথা অন্যদের জানাতে পারতো (এখনও সেটাই পারে)। সেপিয়েন্সরা বুদ্ধির স্ফুরণ ঘটার প্রাথমিক পর্যায়ে যেভাবে শিকার করতো তা অনেকটা অন্য প্রাইমেটদের থেকে (বা এমনকি কিছুটা হায়েনা, বন্য কুকুর বা সিংহদের থেকে) অল্প উন্নত ছিলো। ধরা যাক, ঐ প্রাগৈতিহাসিক মানবদের তল্লাটে প্রতিদিন কয়েকটা মহিষ ঘাস খেতে আসে। তারা এতটা স্বাস্থ্যবান যে শারীরিক শক্তি দিয়ে তাদের কাবু করা সম্ভব নয়। ১০ সদস্যের শিকারী দলের নেতা বাকি ৯ জনকে ৩ ভাগে বিভক্ত করে ৩ ধরণের দায়িত্ব দিলেন। প্রথম দল বাম দিক থেকে চতুর্থ মহিষটিকে (ধরা যাক এটাই সবচেয়ে লোভনীয়, বড় বা দুর্বল) এমনভাবে তাড়া করবে যাতে সে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দ্বিতীয় দল এমনভাবে তার পথ রোধ করবে যেনো সে পাশের খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তৃতীয় দল নিশ্চিত করবে যে মহিষটি সাঁতরে খাল পার হয়ে না যায়। তারপর জলে আটকা পড়া মহিষটিকে সবাই মিলে পাথর-লাঠি-বর্শা দিয়ে আঘাত করে ধরে ফেলবে।
সেপিয়েন্সরা ধীরে ধীরে জটিল, চাতুর্যপূর্ণ ও কয়েক স্তর বিশিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করা এবং তা অন্যদের জানানোর ক্ষমতা অর্জন করেছিল। যেমন এই ১০ সদস্যের শিকারি দলের কথাই ধরা যাক। এবার তারা ঐ তৃণ ক্ষেত্রে একটা গর্ত খুঁড়ে তার ওপর কলাপাতা বিছিয়ে রাখলো। পাতার ওপর মহিষদের বিশেষ পছন্দের কিছু কাঁচা ঘাস এমনভাবে ছড়িয়ে রাখলো যাতে মহিষরা চলাচলের ক্ষেত্রে সাবধান হওয়া প্রয়োজন মনে না করে। ঐ ঘাস খেতে এসে একটা মহিষ গর্তে পড়ে গেলে সেটাকে তারা ধরে উল্লাস করে পুড়িয়ে খেলো। আমরা খেয়াল করলে দেখবো, প্রথম শিকারের ঘটনায় পরিকল্পনাটা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা সীমিত শব্দের মাধ্যমেই প্রকাশ করার সুযোগ দলনেতার ছিলো। যেমন ‘বাম দিক থেকে চতুর্থ মহিষটি’কে বুঝাতে সে তার হাতের তালুকে অন্য সদস্যদের দিকে ঘুরিয়ে তর্জনী নাড়াল। অথবা এমন কোনো শব্দ উচ্চারণ করলো যা থেকে তারা ৪ বা চতুর্থ বোঝে। আর ‘বাম থেকে শুরু’র বিষয়টা বুঝালো হাতের ইশারায়। কিন্তু দ্বিতীয় শিকারের ঘটনায় ভাষার তুলনামূলক জটিল ও সুসংগঠিত প্রয়োগের প্রয়োজন হয়েছে। দলনেতার মাথায় গর্তের ফাঁদ তৈরি করে মহিষ ধরার পরিকল্পনা এসে থাকলে সেটা শুধু ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমে অন্যদের বুঝিয়ে বলা কঠিন ছিলো। এরকম কিছু দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তা থেকেই মূলত ভাষার উৎপত্তি। ভাষা বিজ্ঞানকে ইংরেজিতে বলা হয় গøটোগনি। ভাষা বিজ্ঞানীরা আকার-ইঙ্গিত, নির্বাক অথবা প্রাক-ভাষা থেকে কীভাবে ব্যবহারিক ভাষা এসেছে তা স্পষ্ট করে বলতে পারেন না। তবে নিকট অতীতের কিছু তথ্য থেকে এবং বিভিন্ন অপ্রত্যক্ষ পদ্ধতি প্রয়োগ করে প্রক্রিয়াটা অনুমান করতে পারেন। যেমন, সংখ্যার উৎপত্তি ও সেগুলোর নামকরণ বিষয়ে কিছু চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়।
প্রায় ১০,০০০ বছর আগে পর্যন্ত মানুষ ছিলো শিকারি-জড়ক। এই যাযাবর মানুষেরা প্রাণি শিকার এবং বন্য খাদ্য সংগ্রহ করে বসবাস করতো। তারা প্রধানত বাস করতো প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম গুহায়। ধীরে ধীরে তারা প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর আধিপত্য পেতে শুরু করে এবং বাঁশ, বেত, বা উপড়ে পড়া বড় বৃক্ষের কান্ড-ডাল- গুঁড়ি ব্যবহার করে গৃহ নির্মাণ করতে শেখে। পশু শিকারের পরিবর্তে পশু পালন শুরু করে। অঙ্কের প্রাথমিক হিসাব তখন-ই তাদের শুরু করতে হয়েছিল। ধরা যাক, এক মেষ পালক ১০ টি মেষ নিয়ে মাঠে চড়াতে গেলো। দিনশেষে সে তাদের নিয়ে বাড়ি ফিরবে। সে কী করে বুঝবে, যে সংখ্যক ভেড়া নিয়ে সে মাঠে গিয়েছিল সেই সংখ্যক নিয়েই সে ফিরছে? এরকম ক্ষেত্রে সে থলেতে প্রত্যেক ভেড়ার জন্য একটা করে ছোট পাথর রাখতো। একটা ভেড়া ফিরলে সে একটা পাথর অন্য থলেতে রাখতো। ভেড়া ও পাথরের সংখ্যা মিলে গেলে সে তাদের নিয়ে বাড়ি ফিরতো। যদি দেখা যায় একটা পাথর উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে তাহলে সে বুঝতো একটা ভেড়া জঙ্গলে চলে গেছে বা নেকড়ের পেটে গেছে।
গোত্রবদ্ধ হবার প্রথম দিকে তারা গুহা, টিলা, উঁচু ভ‚মি বা পাহাড়ের ঢালে ছোট ভ্রম্যমাণ দলে বসবাস করতো। কৃষি কাজের জন্য তারা সমভ‚মিতে নেমে আসে। প্রকৃতিতে পাওয়া ফল-মুল ও শস্য দানা সংগ্রহের পাশাপাশি নিজেরাই কিছু চাষ করতে শুরু করে। পালিত পশু ও কৃষি জমির তত্ত¡াবধান এবং মজুত খাদ্যের সংরক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য তাদের স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধির সাথে সাথে শস্য, পশু, তৈজসপত্র, শিকারের হাতিয়ার— এসবের হিসাব রাখা জরুরি হয়ে পড়ে। ধরা যাক, প্রতিবেশী একটা গোত্র ১০ টি মেষ ধার নিতে চায়। এ নিয়ে দুই গোত্র আকার ইঙ্গিতে প্রস্তাব করে সম্মতিতে পৌঁছাতে পারে। দুই হাতের সবগুলো আঙুল দেখিয়ে সংখ্যার (১০ টি) ব্যাপারেও সম্মতিতে পৌঁছা গেলো। কিন্তু তাদের এমন একটা সাক্ষ্য দরকার যাতে ঠিক ১০ টি মেষ-ই ফেরত পাওয়া যায়। এরকম ক্ষেত্রে তারা কাদা মাটির একটা ফলক তৈরি করে তাতে মেষের সম সংখ্যক চিহ্ন (বৃত্ত, সরলরেখা বা অন্য কিছু) আঁকতো। একটা করে মেষ হস্তান্তরের সময় একটা চিহ্ন বসাতো। এরপর ঐ ফলকটিকে রোদে শুকিয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে সংরক্ষণ করতো।
প্রাগৈতিহাসিক মানবদের এই গণনা পদ্ধতি পরে বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতায়ও কমবেশি ব্যবহৃত হয়েছে; তবে তা কিছুটা উন্নত আকারে। যেমন তারা গণনার কাজে অ্যাবাকাস ব্যবহার করতো। অ্যাবাকাস হলো একটা গণনা যন্ত্র। একটি কাঠের ফ্রেমের বসানো ২/৩/৪ সারি তারে লাগানো গুটি ডানে বামে সরিয়ে এটা দিয়ে যোগ বিয়োগের কাজ করা যায়। ২০০১ সালে নীল নদের মোহনায় আবু কির উপসাগরের তলদেশে মূল ভ‚খণ্ড থেকে ৬.৫ কিলোমিটার দূরে হারিয়ে যাওয়া নগরী হেরাক্লিয়নের সন্ধান পাওয়া যায়: (https://www.youtube.com/watch?v=PQEyParVJyg। মিশরীয়রা তাদের ভাষায় এই শহরকে থনিস বা তাহোনে বলতো। এটা ছিলো আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর প্রতিষ্ঠার আগে মিশরের নৌ বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার। ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ব্রোঞ্জ নির্মিত কয়েকটা অ্যাবাকাসও পাওয়া গেছে। চীন ও জাপানের কিছু অঞ্চলে এখনও অ্যাবাকাসের ঐতিহ্যগত ব্যবহারের প্রচলন আছে। চীনে অ্যাবাকাসকে বলে সুয়ান পান। জাপানে বলা হয় সরোবান। এ থেকে অনুমান করা যায়, গণনার (অথবা ভাষার) লেখ্য রূপ আবিস্কার সহজ ছিলো না। যেমন জাপানি ভাষার লেখ্য রূপ (বুংগো, কাগো— উভয় রুপ-ই) এখনও মূলত কিছু সঙ্কেতের সমষ্টি।
ভাষা কি আসলেই নিয়ানডার্থালদের সাথে আমাদের এতো বড় পার্থক্য তৈরি করেছিল যে আমরা এর জোরে তাদের পরাস্ত করে টিকে গেলাম বা তারা নিজেরাই প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে পারলো না? রবীন্দ্রনাথের জয় পরাজয় গল্পে আমরা দেখি পুণ্ডরীক শেখরের সাথে কাব্য যুদ্ধে লিপ্ত হলেন এবং “সাধারণ জনমণ্ডলীর এই উন্মত্ততাকে ধিক্কারপূর্ণ হাস্যের দ্বারা অবজ্ঞা করিয়া পুণ্ডরীক আবার উঠিয়া দাঁড়াইলেন। দৃপ্ত গর্জনে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাক্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কে।” সকলে এক মুহূর্তে স্তব্ধ হইয়া গেল। তখন তিনি নানা ছন্দে অদ্ভুত পাণ্ডিত্য প্রকাশ করিয়া বেদ বেদান্ত আগম নিগম হইতে প্রমাণ করিতে লাগিলেনÑ বিশ্বের মধ্যে বাক্যই সর্বশ্রেষ্ঠ। বাক্যই সত্য, বাক্যই ব্রহ্ম। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর বাক্যের বশ, অতএব বাক্য তাঁহাদের অপেক্ষা বড়ো। ব্রহ্মা চারি মুখে বাক্যকে শেষ করিতে পারিতেছেন না; পঞ্চানন পাঁচ মুখে বাক্যের অন্ত না পাইয়া অবশেষে নীরবে ধ্যানপরায়ণ হইয়া বাক্য খুঁজিতেছেন। এমনি করিয়া পাণ্ডিত্যের উপর পাণ্ডিত্য এবং শাস্ত্রের উপর শাস্ত্র চাপাইয়া বাক্যের জন্য একটা অভ্রভেদী সিংহাসন নির্মাণ করিয়া বাক্যকে মর্ত্যলোক এবং সুরলোকের মস্তকের উপর বসাইয়া দিলেন এবং পুনর্বার বজ্রনিনাদে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাক্যের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কে।” আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ এখানে পুণ্ডরীকের বাক্যারম্বরসর্বস্ব পান্ডিত্যকে বিদ্রæপ করেছেন। কিন্তু বাস্তবে মানব সভ্যতা সৃষ্টি ও বিকাশের ক্ষেত্রে বাক্য ব্রহ্মার ভ‚মিকা-ই পালন করেছে। এ’ব্যাপারে সন্দেহ করার সুযোগ নেই যে ভাষা রপ্ত করতে না পারলে আমরা এখনও প্রস্তর যুগে বাস করতাম বা প্রকৃতির বৈরিতা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে নিয়ানডার্থালদের মতো বিলুপ্ত হয়ে যেতাম।
সামাজিক মিথস্ক্রিয়া শুরুর সেই আগের উদাহরণে ফেরত যাওয়া যাক। কোনো মানব গোত্রের কাছে প্রতিবেশী জনগোষ্ঠী (বাকি অংশ ৩১-এর পাতায় ধ)
প্রতীকী ভাষা ব্যবহার করে ১০টি ছাগল নিয়ে গেলো। তারা শিকারে ব্যর্থ হলে তাদের দলনেতা পরবর্তী মৌসুমে উৎপাদিত শস্য দিয়ে তা শোধ করার বিষয়ে চিন্তা করলো। এই চিন্তা প্রকাশের জন্য সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ যথেষ্ট নয়। সগোত্রীয়দের কাছে কোনভাবে বুঝানো গেলেও ধার নেওয়া পক্ষের কাছে সেটা বুঝাতে গেলে তারা বিপরীত কিছুও বুঝতে পারে। কারণ এখানে ছাগলের বিনিময়ে শস্যের প্রস্তাব আছে এবং সময়ের একটা বিকল্প প্রস্তাব আছে।
এটা বুঝানো কঠিন। ‘পরবর্তী মৌসুম’ একটা বিমূর্ত ধারণা। এটা বুঝাতে এমন একটা শব্দের দরকার যার অর্থ উভয় স¤প্রদায়ের কাছে অভিন্ন। প্রস্তাবটি হয়তো লোভনীয় বা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু ঠিকমতো বুঝাতে না পারার কারণে তাদের মধ্যে প্রাণ সংহারী সংঘাত বেঁধে যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৫ সালের ২৭ জুলাই মিত্র বাহিনী কর্তৃক দখলকৃত জার্মানির ব্রান্ডেনবার্গ স্টেটের রাজধানী পটসডাম থেকে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন, জাপানকে আত্মসমর্পণের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে একটা বিবৃতি রেডিওতে প্রচার করলে জাপানি নেতারা বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেন; কারণ এর শর্তগুলো ছিলো খুব-ই নমনীয় এবং যথেষ্ট সন্মানজনক। পরদিন, ২৮ জুলাই, প্রধানমন্ত্রী কানতারো সুজুকি জাপানি সাংবাদিকদের একটি প্রেস কনফারেন্সে জানালেন, মন্ত্রিসভা এখনও এব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। তিনি জাপানি ভাষায় যে শব্দটি (mokusatsu) ব্যবহার করেছিলেন তার দুটি অর্থ হয়- (১) অবজ্ঞার সাথে উপেক্ষা করা (‘ignore with contempt’) (২) কোনো প্রকার মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা’ (‘refrain from any comment’)। প্রধানমন্ত্রীর পুরো বক্তব্য পড়লে বোঝা যায় যে তিনি দ্বিতীয় অর্থে শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু জাপানি বার্তা সংস্থা প্রথম অর্থটিকে বেছে নিয়ে খবরটি প্রচার করে। সেই সূত্র ধরে ২৮ জুলাই লন্ডন টাইমস-এ প্রধান শিরোনাম হয়: ‘টোকিও টু ইগনোর অ্যালাইড টার্মস — ডিটারমিনেশন টু ফাইট অন’। এরপর হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলে যুক্তরাষ্ট্র।
বর্তমান সময়কে আমরা নাম দিয়েছি তথ্য প্রযুক্তির সভ্যতা। এটা আসলে মানুষের ভাষার-ই লিখিত রূপ। একটা Airbus-A 320 বিমান তৈরি করতে মোটামুটি ৩ লাখ ৪০ হাজার যন্ত্রাংশ জোড়া দিতে হয়। বিপুল সংখ্যক বিজ্ঞানী প্রয়োজন সমন্বয় করে এগুলো তৈরি করেন। গণনা ও ভাষার উদ্ভব না হলে এটা সম্ভব ছিলো না। প্রাগৈতিহাসিক মানবরা চাকা ও লিভার ব্যবহার করতে পারতো। গোলাকৃতি কোনো জিনিসকে যে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেটা গুবরে পোকাও জানে। জেনেটিক পরিবর্তনের কারণে উন্নত বুদ্ধিমত্তা অর্জনের পরও খুব প্রাথমিক এই প্রযুক্তিতে-ই মানুষ আটকে ছিলো কয়েক লক্ষ বছর। মানুষ সুদীর্ঘকাল তার ধারণা প্রকাশ ও অন্যের ধারণার সাথে তার সমন্বয় করতে পারেনি উপযুক্ত শব্দের অভাবে। ২৯ বা ৫১ সংখ্যা দুটিকে পাথরখণ্ড বা কাঠি দিয়ে অথবা মাটিতে দাগ কেটে প্রকাশ করা সম্ভব। কিন্তু ২৯৮৭৬৫ বা ৫১৪৪৩১ কে প্রকাশ করতে গেলে বিপুল আয়োজনের দরকার হবে। আর এদের ভগ্নাংশ (যেমন ২.৯৮৭৬৫ বা ৫.১৪৪৩১) কে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। ভাষা ব্যবহার করে আমরা এরকম কিছু অসম্ভব কাজকে সম্ভব করেছি বলেই আজকের এই আলো ঝলমল ব্যস্ত সভ্যতায় পৌঁছুতে পেরেছি। বানরদের মতো নন ডাইনামিক আলজিভের অধিকারী হলে আমরাও হয়তো ওদের সাথে বনে-বাদাড়ে বাস করতাম।
ধরুন, এক গুচ্ছ মানব শিশুকে অবিকল পৃথিবীর মতো অন্য এক গ্রহে রেখে আসা হলো। দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের সবাই বোবা অথবা আদিম নর বানরদের মতো দুর্বল স্বরযন্ত্রের অধিকারী। এক লাখ বছর পরে গিয়ে আমরা দেখতে পাবো তারা এই বিপুল বুদ্ধিমত্তা নিয়েও আজকের যুগের সিম্পাঞ্জি বা বানরদের চেয়ে অল্প উন্নত জীবন যাপন করছে। তারা লতা পাতা দিয়ে ঘর তৈরি করে বাস করছে। বীজ বুনে কিছু শস্যের পরিকল্পিত উৎপাদন করতে পারছে, গাছের ডাল কেটে শিকারের জন্য কিছু অস্ত্রপাতি তৈরি করেছে এবং গুবরে পোকাদের মতো গাছের গুঁড়ি ঠেলে নিয়ে এসে আগুন জ্বালিয়ে মাংস পুড়ে খাচ্ছে। আরও এক লক্ষ বছর পরে গেলে আমরা এই একই দৃশ্য দেখতে পাবো। কারণ ধারণা সংশ্লেষণের জন্য ভাষার দরকার। তারা আপনাকে আঙুল দেখিয়ে দুই ও পাঁচের পার্থক্য বুঝাতে পারবে; কিন্তু ৮৭ ও ৭৮ এর পার্থক্য বুঝাতে পারবে না। নাম দেওয়া না হলে এই সংখ্যা দুটি কয়টি এককের সমষ্টি তা আমরাও প্রকাশ করতে পারতাম না। মানবিক উন্নয়নের জন্য বিমূর্ত, নির্বস্তুক বা ভাবমূলক শব্দের প্রয়োজন। শারীরিক বা প্রতীকী ভাষায় এর শতাংশও প্রকাশ করা সম্ভব নয়। জীবনানন্দের বনলতা সেন বা এরিক মারিয়া রেমার্কেরঅল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট আমাদের মধ্যে যে আবেগ তৈরি করে তা আমাদের সভ্যতার বড় উপাদান। সেপিয়েন্স ছাড়া কেউ-ই এই আবেগের ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেনি। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী (৪০ লক্ষ গুণ বিবর্ধন ক্ষমতাসম্পন্ন) অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও পরমাণুকে দেখা যায় না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা তার গঠন বের করে ফেলেছেন এবং তা কাজেও লাগিয়েছেন। এর পেছনে বড় ভ‚মিকা রেখেছে ভাষা। সেপিয়েন্সদের মতো উন্নত স্বরযন্ত্রের মালিক হয়ে গেলে নিয়ানডার্থাল মানবরাও হয়তো টিকে থাকতো এবং তাদের সাথে আমাদের পৃথিবীর মালিকানা ভাগ করে নিতে হতো।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।