হাসান গোর্কি : বিশেষ সৃষ্টি না হয়ে থাকলে মানুষের সমকক্ষ কোনো প্রাণি পৃথিবীতে নেই কেনো? অপ্রিয় হলেও একই প্রশ্ন পিঁপড়া, পঙ্গপাল বা ডলফিনেরও করার সুযোগ আছে। পিঁপড়ারা পৃথিবীতে বাস করছে ১৩ কোটি বছর ধরে। হোমো সেপিয়েন্স পৃথিবীতে এসেছে মোটামুটি ২ থেকে ৩ লক্ষ বছর আগে। অর্থাৎ পৃথিবীতে পিঁপড়া এসেছে আমাদের চেয়ে ১২ কোটি ৯৮ লক্ষ বছর আগে। পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ৮০০ কোটি; পিঁপড়ার আনুমানিক সংখ্যা ৫ কোয়াড্রিলিয়ন বা ৫০০০ লক্ষ কোটি (৫০০০০০০০০০০০০০০০) যা মানুষের সংখ্যার সাড়ে ছয় লক্ষ গুণ। ঝড়, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ¡াস, মহামারী বা বরফ যুগের বৈরিতা পেরিয়ে এন্টার্কটিকা বাদে পৃথিবীর ৬ মহাদেশে পিঁপড়ারা সুখে শান্তিতে বাস করছে। তারা প্রশ্ন করতেই পারে: তাদের সমকক্ষ কোনো প্রাণি পৃথিবীতে নেই কেনো! আসলে পৃথিবীর জন্য আমরা বা অন্য কোনো প্রাণি অপরিহার্য বা বিশেষ নই/নয়। অনেক পরে এসেও বুদ্ধিমত্তার উৎকর্ষের কারণে মানুষ পৃথিবীর আপাত দখল নিয়েছে। তবে এই দখলের প্রথম দাবিদার ছিলো নর বানরের অন্য এক প্রজাতি — নিয়ানডার্থাল। পরিপূর্ণ বিকাশের পর তারা আমাদের (হোমো সেপিয়েন্স) পাশাপাশি পৃথিবীতে বাস করেছে কম করে হলেও ৪০,০০০ বছর। আজ থেকে মাত্র ৩০ বা ৪০ হাজার বছর আগে তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। জার্মানির নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়ায় অবস্থিত ডুসেল নদীর তীরে একটি ছোট উপত্যকার নাম “The Neander Valley”। এটি মূলত একটি চুনাপাথরের রুক্ষ গিরিখাত যা জলপ্রপাত এবং প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া গুহার জন্য পরিচিত। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী জুড়ে শিল্প খননের মাধ্যমে এখান থেকে বেশিরভাগ চুনাপাথর অপসারণ করার ফলে উপত্যকার ভ‚-প্রকৃতি কিছুটা পাল্টে যায়। এই ধরনের একটি খনন অভিযানের সময় ১৮৫৬ সালে ‘ক্লাইন ফেল্ডহোফার গ্রোট’ নামে পরিচিত একটি গুহায় একদল নৃবিজ্ঞানী এমন কয়েকটা প্রায় অবিকৃত ফসিলের সন্ধান পান যাদের সাথে হোমো সেপিয়েন্সদের অনেক মিল আছে। প্রাপ্ত জীবাশ্মগুলোকে বিজ্ঞানীরা প্রথমে হোমো সেপিয়েন্সদের জীবাশ্ম বলে মনে করেছিলেন। পরে তাদের ভুল ভাঙে। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে এ্যাঙলো-আইরিশ ভ‚তত্ত¡বিদ উইলিয়াম কিং নিয়ান্ডার ভ্যালির নামে এই প্রজাতির নামকরণ করেন হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস।

সাধারণভাবে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে নিয়ানডার্থালরা আধুনিক মানুষের (সেপিয়েন্স) পূর্বপুরুষ। কিন্তু তারা আসলে ছিলো আমাদের মতো বৈশিষ্ট্যের ভিন্ন প্রাণি। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্যকে আমাদের নিকটতম জীবিত আত্মীয় শিম্পাঞ্জি এবং গরিলার পার্থক্যের সাথে তুলনা করা যায়। ‘আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’-র তথ্য অনুযায়ী প্রায় ছয় লক্ষ বছর আগে ইউরোপে প্রথম প্রাক-নিয়ানডার্থাল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মানব প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। তাদের আবাসস্থল ছিলো ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্য ও পশ্চিম অঞ্চল। গত শতকের শুরুতে প্রতœতত্ত¡বিদরা ইতালির পশ্চিম উপক‚লীয় শহর স্যান ফেলিস সিরসেও’র গুয়াত্তারি নামের এক বড় গুহায় নিয়ানডার্থাল মানবের নয়টি জীবাশ্মের সন্ধান পান। এগুলো ছিলো সাতটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, একটি নারী এবং একটি কিশোরের জীবাশ্ম। সাথে পান তাদের ব্যবহৃত পাথরের আসবাব, তৈজসপত্র ও অস্ত্রপাতি। কার্বন ডেটিং এর মাধ্যমে জানা গেছে এগুলো প্রায় এক লাখ বছরের পুরনো। নিয়ানডার্থাল মানবদের সর্বশেষ উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে জিব্রাল্টার প্রণালীর দক্ষিণমুখী উপক‚ল ও আইবেরীয় উপদ্বীপে (বর্তমান স্পেন, পর্তুগাল, অ্যান্ডোরা)। ভ‚মধ্যসাগরের পাথুরে তীরভ‚মির নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু, প্রচুর ফল ও শস্য উৎপাদনকারী উদ্ভিদ এবং সহজে মাংস পাওয়া যায় এমন প্রাণির বৈচিত্র্যময় সমাহার ভালভাবে টিকে থাকার জন্য তাদের সহায়ক হয়েছিল। হয়তো সেকারণে তারা টিকেও ছিলো দীর্ঘদিন। আমাদের (হোমো সেপিয়েন্স) শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে একটি উঁচু এবং গোলাকার খুলি (‘গেøাবুলার ব্রেনকেস) এবং তুলনামূলকভাবে সরু পেলভিস। জীবাশ্ম পরীক্ষা করে দেখা গেছে নিয়ানডার্থালদের মাথার খুলি ছিলো লম্বা ও পেলভিস ছিলো প্রশস্ত। আমাদের মধ্যকর্ণের যে তিনটি ক্ষুদ্র হাড় আমাদের শ্রবণশক্তিকে প্রখর ও নিখুঁত করে সেগুলো নিয়ানডার্থালদের ছিলনা। তবে তাদের মস্তিষ্কের আকার (গড়ে ১৬৫০ ঘন সেন্টিমিটার) ছিলো বর্তমান মানুষদের (গড়ে ১৫০০ ঘন সেন্টিমিটার) তুলনায় বড়। অর্থাৎ তারা যে যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিলো সেটা অনুমান করা যায় তাদের মস্তিষ্কের আকৃতি থেকে।

দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লম্বস গুহাতে পাওয়া নিয়ানডার্থালদের খোদাই করা পাথরের টুকরা (এরকম একটা কাজ শুধু মানুষের মতো কোনো সৃষ্টিশীল প্রাণির পক্ষেই করা সম্ভব)। ছবি: আনা জিমিনস্কি/এএফপি/গেটি

আমরা জানি, নিয়ানডার্থাল মানবদের নিয়ে দীর্ঘ গবেষণায় বিস্ময়কর এক সাফল্য এনে দিয়ে গত বছর চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল জিতে নিয়েছেন ড. সেভান্তে পেবো। বিলুপ্তির ৪০ হাজার বছর পর তাদের ‘ডিএনএ’ গঠনের নকশা নতুন করে তৈরি করেছেন তিনি। কাজটি কতটা কঠিন ছিলো তা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন,“কল্পনা করুন, একটি অভিধানের সবগুলো পাতা একটি কাগজ কাটার যন্ত্র (শ্রেডার) দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। অভিধানটি আপনাকে নতুন করে তৈরি করতে হবে। এবার কল্পনা করুন, ঐ অভিধানের কাটা কাগজের হাজার হাজার টুকরো অন্য বইয়ের কাগজের হাজার হাজার টুকরোর সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এবার সেই কাগজের টুকরোর স্তুপের ওপর এক কাপ কফি ঢেলে দিন। ফলাফল: একটি বিশাল কাগজের বল— যাতে মিশ্রিত রয়েছে লক্ষ লক্ষ অক্ষর, অনেক ছাপা কাগজের ছোট ছোট অংশ— যার মানে বোঝা যায় না, এবং যেগুলো আলাদা করে পড়লে রীতিমতো বিভ্রান্ত হতে হয়। এখন, সেই অভিধানটি আপনি কি আবার নতুন করে তৈরি করতে পারবেন?” অন্য কেউ না পারলেও পেবো এই অসাধ্যটি সাধন করতে পেরেছেন। এখন নিশ্চিত হওয়া গেছে আমাদের সমকক্ষ বা (মস্তিষ্কের আকার বিবেচনায়) আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান একটা প্রাণি পৃথিবীতে উদ্ভূত হয়ে ৫ লক্ষ বছরের বেশি সময় বসবাস করে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বছর কুড়ি আগে মার্কিন জার্নাল প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে ইউরোপীয় গবেষকদের একটি দল রোমানিয়ায় প্রাপ্ত ৩০ হাজার বছরের পুরনো কিছু মানব জীবাশ্মে নিয়ানডার্থাল বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাবার দাবি করেছিলেন। সেভান্তে পেবো নিয়ানডার্থালদের ডিএনএ’ নকশা তৈরি করার পর পুরো বিষয়টা সত্য বলে প্রমানিত হলো। আধুনিক মানুষের সমান বুদ্ধিমান আরও একটা প্রাণি প্রজাতি যে পৃথিবীতে এসেছিল সেটা কোনো ধর্ম গ্রন্থে লেখা নাই। দ্য বুক অব জেনেসিস-এ বংশানুক্রমিক ইতিহাস (অধ্যায় ১২-৫০) থেকে হিসাব করলে দেখা যায় হযরত আদম (আঃ)-র আগমন ঘটেছিল হযরত ঈসা (আঃ)-র ৩৭০০ বছর আগে, অর্থাৎ আজ থেকে ৫৭২৩ বছর আগে।

কিন্তু কার্বন ডেটিং কৌশল ব্যবহার করে প্রাপ্ত তথ্য থেকে বিজ্ঞান বলছে আধুনিক মানুষ পৃথিবীতে এসেছে ৬০-৭০ হাজার বছর আগে। আর সেই মানুষের পূর্বপুরুষ, নরবানরকে বিবেচনায় নিলে তারা এসেছে কমপক্ষে ৪০ লাখ বছর আগে। ১৯৬৫ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল তুকার্না (ছোটবেলায় ভ‚গোল বইয়ে এটাকে আমরা টিটিকাকা/ তিতিকাকা হ্রদ হিসেবে পড়েছি) হ্রদের পশ্চিম পাড়ের কানাপোই অঞ্চলে প্লায়োসিন যুগের (২৫,৮০,০০০ বছর আগে শুরু হয় এবং ১১,৭০০ আগে শেষ হয়) জীবাশ্মের সন্ধান পান। বিবর্তনবাদ অনুসারে প্লায়োসিন-প্লাইস্টোসিন যুগেই উদ্ভব ঘটেছে মানব জাতির। অস্ট্রেলোপিথেকাস অ্যানামেন্সিসরা প্রায় ৪০ লাখ বছর আগে উদ্ভূত হয়েছিল বলে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন। Nature সাময়িকীতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে (“New four-million-year-old hominid species from Kanapoi and Allia Bay, Kenya”, ১৭ আগস্ট ১৯৯৫) তাদের সম্পর্কে লেখা হয়েছে, “আবিষ্কার হওয়া এই খুলি থেকে বোঝা যায় আদিম এবং আধুনিক মানুষ- উভয় বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ ছিলো এরা। এই প্রজাতি লম্বা এবং শক্ত হাত থাকলেও সেই হাত না ব্যবহার করে শুধু দু’পায়েই হাঁটতো। এমনকি তারা সক্ষম পর্বতারোহী ছিলো বলেও বোঝা যাচ্ছে। এদের দন্ত-পাটি ছিলো বনমানুষ সুলভ। যেমন, এদের ছিলো বড় শ্ব-দন্ত (কুকুরের দাঁতের মতো তীক্ষ্ণ দাঁত), অধিবৃত্তের বদলে আয়তাকার দন্তসারি, সাদৃশ্যহীন প্রাকমাড়ি, মাড়ির দাঁত ও অগভীর তালু। কিন্তু এদের থেকেই যে আধুনিক মানুষ এসেছে তার প্রমাণ হলো হোমিনিডদের মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্যগুলোর বেশ কিছু অবশিষ্ট ছিলো।”

নিয়ানডার্থাল ও আধুনিক মানুষ উভয়-ই এসেছে এই সাধারণ পূর্বপুরুষÑ ‘অস্ট্রেলোপিথেকাস অ্যানামেন্সিস’ থেকে। ফলে তাদের মধ্যে সাদৃশ্য ছিলো অনেক। জেনেটিক গবেষণায় আগেই ধারণা পাওয়া গিয়েছিল যে, আমাদের ডিএনএ আমাদের পূর্বপুরুষ ও নিয়ানডার্থালদের থেকে ভাগাভাগি করে এসেছে। ড. সেভান্তে পেবোর আবিস্কার সেই ধারণাকে পূর্ণতা দিয়েছে। ইউরোপে হোমো স্যাপিয়েন্সদের আবির্ভাব ঘটেছিল আজ থেকে ৬০-৭০ হাজার বছর আগে। আর নিয়ানডার্থালদের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় ৬০০,০০০ – ৩৫০,০০০ বছর আগে। ৫০,০০০ বছর আগে এশিয়াতে এবং ৩০,০০০ বছর আগে ইউরোপে নিয়ানডার্থালরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে নিয়ানডার্থালদের সাথে আমরা বসবাস করেছি মোটামুটি ৩০-৪০ হাজার বছর বা আমাদের প্রাচীনতম সভ্যতার (মেসোপটেমিয়ান সিভিলাইজেশন) ৫ থেকে ৭ গুণ বেশি সময়। নিয়ানডার্থালরা বিলুপ্ত না হলে আজকের পৃথিবীতে হয়তো দু’টি সমান বুদ্ধিমান প্রাণি বাস করতো। তাদের মধ্যে শিল্প, সাহিত্য, প্রযুক্তি, শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রতিযোগিতা থাকতো। তারা বাস করতো পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে। পৃথিবীর মালিকানা নিয়ে তাদের মধ্যে যুদ্ধ হতো। আগেই লিখেছি নিয়ানডার্থালদের মস্তিষ্কের আকার আমাদের চেয়ে বড় ছিলো। বুদ্ধির দৌড়ে তারা এগিয়ে গেলে তারা হয়তো আমাদের গৃহপালিত বুদ্ধিমান প্রাণি হিসেবে ব্যবহার করতো। আর আমাদের বুদ্ধি বেশি হলে আমরাও একই কাজ করতাম।

নৃবিজ্ঞানীরা স্পেনের একটি গুহায় ৬৪,০০০ বছর আগে লাল অনুভূমিক ও উল্লম্ব রেখা দিয়ে নিয়ানডার্থালদের তৈরি এই মই আকৃতিতে কাটা স্তম্ভগুলোর সন্ধান পেয়েছেন। ছবি: P. SAURA

কথাগুলো কষ্টকল্পিত গল্পের মতো শোনাচ্ছে। কারণ আমাদের বিশ্বাস মানুষ এই পৃথিবীর আদি অন্তহীন অধিপতি। মানুষের বসবাসের উপযোগী করে ঈশ্বর এই পৃথিবীকে ফল-ফুল-প্রাণি-শস্য সম্ভারে সাজিয়েছেন। এই ঘোর কাটাতে একবার ভাবুন পৃথিবীতে উদ্ভিদ ও প্রাণির বসবাস শুরু হয়েছে মোটামুটি ৪০০ কোটি বছর আগে। আমরা ( হোমো সেপিয়েন্স) এসেছি ৭০ হাজার বছর আগে। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রাণময়তার ৫৭ হাজার ভাগের এক ভাগ সময় আমরা এখানে আছি। বাস্তুতন্ত্রের প্রাগৈতিহাসিক অধিবাসী ডাইনোসররা প্রায় ১৬ কোটি বছর পৃথিবীতে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করেছে।

তাদের উদ্ভব হয়েছিল আনুমানিক ২৩ কোটি বছর পূর্বে। আর তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে ক্রিটেশিয়াস যুগের শেষে, প্রায় সাড়ে ৬ কোটি বছর পূর্বে। তাদের রাজত্বের সেই ১৬ কোটি বছর জুড়ে পৃথিবীটা ছিলো ডাইনোসরময়। এখন সারা পৃথিবীর সবখানে যেমন মানুষের রাজত্ব দেখি, টাইম মেশিনে করে সেই সময়ে গেলে আমরা দেখবো বন-বাদার, সমভ‚মি–মরুভ‚মি, উপত্যকা-অধিত্যকা, পাহাড়-পর্বত জুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির কোটি কোটি ডাইনোসর বিষম আলস্যে ভর করে বসে আছে, শিকার ধরছে, তৃনভ‚মিতে বিশ্রাম করছে, রাজকীয় ভঙ্গিতে হেলে দুলে হেঁটে বেড়াচ্ছে প্রাচীন পৃথিবীর বেপথু প্রান্তর জুড়ে। বিজ্ঞানীদের ধারণা আজ থেকে প্রায় ছয় কোটি ৬০ লাখ বছর আগে মেক্সিকো উপসাগর তীরবর্তী ইউকাটান উপদ্বীপ এলাকায় ১২ কিলোমিটার চওড়া এক গ্রহাণুর আঘাতে যে বিস্ফোরণ ও পরিবেশগত পরিবর্তন হয়েছিল সেটাই ডাইনোসরদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার কারণ। প্রসঙ্গক্রমে একটা প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে— সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া ডাইনোসরের হাজার হাজার ফসিল পাওয়া যাচ্ছে। একটা জনপ্রিয় বিশ্বাস হলো আদম (আঃ) ছিলেন ৬০ হাত লম্বা। তিনি কি তাঁর হাতে ৬০ হাত ছিলেন নাকি আমাদের হাতে? আমাদের বিশ্বাস সত্য হলে আমাদের হাতে ৬০ হাত, ৩০ হাত, ২০ হাত বা ১০ হাত লম্বা ফসিল পৃথিবীতে একটাও পাওয়া যায়নি কেনো?

মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নিয়ানডার্থালরা আমাদের সমকক্ষ ছিলো বিজ্ঞানীদের এরকম বিশ্বাসে কতটা আস্থা রাখা যায়? খালি চোখে যে মঙ্গলগ্রহকে আমরা দেখি না পৃথিবীতে বসে বিজ্ঞানীরা সেখানে নভোযান পাঠিয়েছেন। খবরটা আমরা পত্রিকার পাতায় যেভাবে পড়ি কাজটা ততো সহজ নয়। ধরুন, একজন স্ট্রাইকার গোলে কিক করেছেন। আপনি একটা চলন্ত বাসের ছাদে বসে এমনভাবে একটা ডিম ছুঁড়বেন যেনো সেটা বলের পেছনে ছুটে গিয়ে আলতো করে বলের পিঠে বসে পড়ে এবং বলের পিঠে চেপে গোলে ঢুকে যায়। আমরা বুঝতে পারছি কাজটা খুবই কঠিন। বিজ্ঞানীরা চাঁদ বা অন্য গ্রহে যান নামানোর ক্ষেত্রে এর চেয়ে সহস্র গুণ বেশি কঠিন কাজটিই করেন। পৃথিবী ও গ্রহ-উপগ্রহগুলো ভিন্ন ভিন্ন অভিকর্ষ-মহাকর্ষ বল, আহ্নিক-বার্ষিক গতি নিয়ে দিগ্বিদিক ছুটে চলেছে। এর একটি থেকে অন্যটিতে পাড়ি জমাতে তাদের গতি ও বৈশিষ্ট্যের সবগুলোকে হিসেবে নিতে হয়। এর সহস্রাংশ বিচ্যুতি বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। অন্য কোথাও যান পাঠানোর পর তারা পৃথিবীতে বসে নির্দেশনা পাঠিয়ে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাদের পাঠানো নভোযানগুলো ঘুরে ঘুরে ভিন গ্রহের মাটি খুঁড়ে পরীক্ষা করে পৃথিবীতে ফলাফল পাঠাচ্ছে। অতএব হাতে থাকা হাজার হাজার জীবাশ্মের ডিএনএ পরীক্ষা করে এদের অতীত ইতিহাস বলে দেওয়া বিজ্ঞানীদের জন্য কঠিন হবার কথা নয়।

এবার তাহলে নৃবিজ্ঞানীদের বলা গল্পের বাকি অংশ শোনা যাক: মস্তিষ্কের আকার বড় হলেও হোমো নিয়ানডার্থালেনসিদের উচ্চতা আজকের মানুষের মতো ছিলো। শরীর ছিলো কিছুটা লোমশ। চেহারায় একমাত্র পার্থক্য ছিলো আমাদের চেয়ে তাদের নাক ছিলো চওড়া। তারা গোত্রবদ্ধভাবে বাস করতো এবং পাথুরে অস্ত্রের কৌশলী ব্যবহার রপ্ত করেছিল। তারা কুঠার, বর্শা ব্যবহার করে পশু শিকার করতো। তুকার্নার তীরে পাওয়া এক গুহায় পাথর কেটে তৈরি করা চিত্রে ম্যামথ শিকারের দৃশ্য দেখে নৃবিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে তারা পরিকল্পনা করে দলবদ্ধভাবে বৃহদকার পশুও শিকার করতে শিখেছিল।

৪১,৩০০ বছর আগে নিয়ানডার্থালদের ব্যবহৃত বাঁশি যা তারা গুহাভল্লুকের উরুর অস্থি থেকে তৈরি করেছিল

প্রায় ৫ লক্ষ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু করে ৩ লক্ষ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে এরা আফ্রিকার বর্তমান মরক্কো অঞ্চলে একটি শক্তিশালী জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল। এদের হাতে গড়ে ওঠা আদিম প্রস্তরযুগের সভ্যতার যে সব নিদর্শন পাওয়া গেছে তা থেকে অনুমান করা হয় যে তারা ভাষার ব্যবহার রপ্ত করতে পেরেছিল এবং অর্থপূর্ণ সরল বাক্যের সাহায্যে অন্যের কাছে পরিকল্পনা প্রকাশ করতে পারতো। এদের একটি শাখা ৩ লক্ষ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ইউরেশিয়ায় প্রবেশ করেছিল। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ¯েøাভেনিয়ার ডিভ্জে বেব-এ প্রতœতাত্তি¡ক ক্ষেত্রের একটি অনুভ‚মিক গুহা থেকে এদের তৈরি একটি বাঁশির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই বাঁশি ডিভ্জে বেব বাঁশি নামেই পরিচিতি পেয়েছে। কার্বন টেস্টে বাঁশিটির বয়স পাওয়া গেছে ৪১,৩০০ বছর। বাঁশিটি তৈরি হয়েছিল গুহাভল্লুকের উরুর অস্থি থেকে। এ থেকে ধারণা করা হয় যে নিয়ানডার্থালরা সঙ্গীত চর্চা করতেও অভ্যস্ত ছিলো। এমনকি তাদের তৈরি কিছু ভাস্কর্য থেকে এরকম ধারণাও স্পষ্ট হয় যে সেগুলো প্রার্থনার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। পৃথিবীতে পরে এসেও হোমো সেপিয়েন্সরা বুদ্ধি, কৌশল ও দক্ষতায় নিয়ানডার্থালদের চেয়ে এগিয়ে যায়। এর প্রধান কারণ ছিলো শব্দ উচ্চারণে সেপিয়েন্সদের শ্রেয়তর নৈপুণ্য- তাদের আলজিভ ছিলো নমনীয় ও সহজবশ্য যা উচ্চারিত শব্দের বিপুল ভিন্নতা তৈরি করতে পারে। ফলে মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তারা অনেক বেশি সুবিধা পেয়ে যায়।

বিবর্তনবাদের আলোচনায় একটি জনপ্রিয় পূর্বানুমান ছিলো, বানরদের কথা বলার মতো শারীরিক সক্ষমতা থাকলেও প্রয়োজনীয় নিউরাল মেকানিজমের অভাব রয়েছে। ১৯৬৯ সালে সায়েন্স জার্নাল-এ প্রকাশিত ফিলিপ লিবারম্যানের গবেষণা প্রবন্ধ এই ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দেয়। তিনি একটি মৃত বানরের ভোকাল অ্যানাটমি নিয়ে গবেষণা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, অন্যান্য প্রাইমেটরা তাদের স্বরযন্ত্রের অবস্থানের কারণে মানুষের মতো এতো বেশি স্বরের ভিন্নতা তৈরি করতে পারে না। এই দুর্বলতা নিয়ানডার্থালদেরও ছিলো। ফলে পরবর্তী সময়ে হোমো স্যাপিয়েন্সদের সাথে সংঘাতের ফলে এরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিষয়টা এভাবে কল্পনা করা যায়- একদল স্বাভাবিক শিশু এবং একদল বোবা শিশু পাশাপাশি দুটি অঞ্চলে বেড়ে উঠলো। বড় হবার পর তারা যদি পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয় তাহলে বোবা শিশুদের হেরে যাবার সম্ভাবনা বেশি থাকবে; কারণ বেড়ে ওঠার পথেই তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও পরিকল্পনা তৈরির ক্ষমতায় বড় পার্থক্য তৈরি হয়ে থাকবে। কিছু নৃতাত্তি¡ক মনে করেন জলবায়ুর পরিবর্তন বা মহামারীতেও নিয়ানডার্থালরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। অন্য অসমর্থিত ধারণা হলো খাদ্যাভাবের কারণে তারা ক্যানিবাল (মানুষ খেকো) হয়ে উঠেছিল। বড় বিপদে (যেমন অনেক বড় কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যা মানুষ কখনও দেখেনি) পড়লে এ কাজটি কিন্তু আমরাও করে ফেলতে পারি! শেষের অনুমানটি বিশ্বাস হচ্ছে না? ১৩ অক্টোবর, ১৯৭২, ওল্ড ক্রিশ্চিয়ান্স রাগবি ক্লাবের খেলোয়াড়রা উরুগুয়ে বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানে করে চিলিতে খেলতে যাচ্ছিলেন। আন্দিজ পর্বতমালার আর্জেন্টিনা অংশে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। ৭২ দিন পর জীবিত যে ১৬ জনকে উদ্ধার করা হয় তারা মৃত ২৫ জন সতীর্থের মাংস খেয়ে বেঁচে ছিলেন। এই ঘটনা নিয়ে নির্মিত মুভিটা দেখতে পারেন: (https://www.youtube.com/watch?v=SSBwZ6xF6kw)
অথবা পড়তে পারেন সুধাময় করের লেখা বই
আন্দেজের বন্দী ।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।