হাসান গোর্কি : মানব সভ্যতার শুরু থেকে প্রায় পুরোটা সময় বিশ্বাস করে আসা হয়েছে যে পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ শুরু হয়েছিল অতীন্দ্রিয় কোনো শক্তির ইচ্ছায়। বিশ্বাস করা হতো, প্রাণিদের মধ্যে একটা অলৌকিক উপাদান আছে যা তাদের জড় বস্তু থেকে আলাদা করে। এই ধারণাকে বলে প্রাণবাদ। এমনকি মাত্র ২০০ বছর আগেও বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ এই ধারণায় বিশ্বাস করতেন। প্রাণবাদী জীববিজ্ঞানী জোহানেস রেইঙ্ক প্রাণের যান্ত্রিক ব্যাখ্যার অপর্যাপ্ততা প্রমাণের জন্য পরীক্ষাযোগ্য অনুমান প্রস্তাব করেছিলেন; কিন্তু পরীক্ষাগুলি প্রাণবাদের পক্ষে সমর্থন প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এই অর্থে জীববিজ্ঞানীরা এখন প্রাণবাদকে ‘পরীক্ষামূলক প্রমাণ দ্বারা খন্ডন করা হয়েছে’ বলে মনে করেন। এখন এটিকে একটি স্থগিত করা বৈজ্ঞানিক তত্ত¡ অথবা ছদ্মবিজ্ঞান (pseudoscience) হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বিপরীতে বিশ্বাস করা হয় যে প্রাণ একটি রাসায়নিক সংগঠন। জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তি তত্ত¡ যুগপৎভাবে তৈরি করেন রুশ প্রাণরসায়নবিদ আলেকজান্ডার ওপারিন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী জে.বি.এস. হালডেন।
১৯২৪ সালে রুশ ভাষায় লেখা ওপারিনের গবেষণাপত্রের (Proiskhozhdenie zhizni) ইংরেজি অনুবাদ The origin of life লন্ডন থেকে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। তাতে তিনি যা দাবি করেন তার মূল কথা হলো, একটি জীবিত প্রাণী এবং প্রাণহীন পদার্থের মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। বস্তুর জটিল সংমিশ্রণ ও বিবর্তন প্রক্রিয়ার একটা অংশ হিসেবে জীবনের উদ্ভাস (manifestations) ও বৈশিষ্ট্যগুলি উদ্ভূত হয়েছে। আদি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল মিথেন, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন এবং জলীয় বাষ্পে পূর্ণ ছিলো। তাঁর মতে, এগুলোই মূলত পৃথিবীতে স্বপ্রণোদিত ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাণ সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করেছিল। পদার্থের অণুর আণবিক কাঠামোতে যে রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য আছে তা নিজের থেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ হবার আসক্তি ধারণ করে। জটিলতর হবার সাথে সাথে অণুগুলির মিথস্ক্রিয়া উপযুক্ত পরিবেশে জৈব যৌগ তৈরি করে। ওপারিনের মতে, প্রতিযোগিতা, কোষের বৃদ্ধির গতি, যোগ্যতমের বেঁচে থাকা, অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম এবং সব শেষে, প্রাকৃতিক নির্বাচন আধুনিক দিনের জীবন্ত বস্তুর বৈশিষ্টিক সংগঠনের রূপ নির্ধারণ করেছে। ওপারিনের গবেষণাপত্রটির ইংরেজি অনুবাদের পিডিএফ লিঙ্ক: https://breadtagsagas.com/wp-content/uploads/2015/12/AI-Oparin-The-Origin-of-Life.pdf
জীব বিজ্ঞানের দাবি, জীবনের শুরু হয়েছিল খুব-ই সরল্ভাবে। প্রি-মোরডিয়াল স্যুপ থেকে প্রথম প্রাণ ছিলো প্রাণ ও অ-প্রাণের মাঝামাঝি একটা কিছু। এভাবে প্রাণ সৃষ্টি হয়ে থাকলে এখন তা হচ্ছে না কেনো? আধুনিক জীববিজ্ঞান বলছে, সাড়ে চারশ’ কোটি বছর আগেকার পৃথিবী-ই শুধু প্রাণ সৃষ্টির জন্য উপযুক্ত ছিলো। আজকের পৃথিবী আর সেরকম নেই। জৈব রাসায়নিক পদার্থের উদ্ভবের জন্য যে আদিম বিজারকীয় পরিবেশের দরকার তা বহু আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আদি পৃথিবীতে উচ্চশক্তির বিকিরণের প্রভাবে নানা ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থ নিজেদের মধ্যে বিক্রিয়ার মাধ্যমে আরো জটিল জৈব পদার্থ উৎপন্ন করে যা পরবর্তীতে ঝিল্লি তৈরি করে। ঝিল্লিবদ্ধ প্রোটিনয়েডগুলো (জৈবিকভাবে গঠিত অ্যামিনো অ্যাসিডের পলিমার) ক্রমে ক্রমে এনজাইম ধারণ করতে থাকে। ফলে তারা বিপাক ক্রিয়ার ক্ষমতা অর্জন করে, বংশগতির সংকেত ব্যবহার করে নিজের প্রতিকৃতি তৈরি করতে ও পরিব্যক্তি বা মিটেশন ঘটাতে সক্ষম হয়।
এভাবেই পৃথিবীতে একটা সময় প্রথম, আদি ও সরল জীবনের আবির্ভাব ঘটে। এই ব্যাখ্যার বিপরীতে সৃষ্টিবাদীরা তাদের নিজস্ব গণনা পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখান যে প্রাণ সৃষ্টির জন্য দরকারী প্রোটিন ঘটনাক্রমে (এই শব্দটিও তাদের তৈরি করা) উদ্ভূত হওয়া অসম্ভব। যে প্রশ্নটি করা হয় তা হলো, একটা প্রোটিন, ঝিল্লী বা জীব কোষ তৈরি হতে যে প্রায় সংখ্যাতীত বিকল্পের মাত্র একটি-ই ঘটতে হবে সেটা ঘটলো কেনো? আমার এক বন্ধু (তিনি আমার অনেক লেখার বিষয়বস্তু যোগান) কয়েকদিন আগে Origin: Probability of a Single Protein Forming by Chance (Philip C) শিরোনামের একটা ভিডিয়ো পাঠিয়েছেন (https://www.youtube.com/watch?v=W1_KEVaCyaA )। যেখানে বলা হচ্ছে দৈবক্রমে একটা প্রোটিন তৈরি হবার সম্ভাবনা 1×10164 ভাগের একভাগ।
ইশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য এই হিসাবটি প্রায়-ই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বলা হয় এই অতি ক্ষুদ্র সম্ভাবনা থেকে প্রাণ সৃষ্টি সম্ভব নয়। অতএব, একজন ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনার আছেন যিনি পরিকল্পনা করে মহাজগৎ ও প্রাণ সৃষ্টি করেছেন।
হ্যাঁ, এটা একটা সহজ সমাধান। কৌতূহল চেপে রেখে এই দার্শনিক জবাব মেনে নিলে একটা আপাত সমাধান পাওয়া যায়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞান দিয়ে ভাবতে চান। নাচ-গান বৃদ্ধি পেলে ভ‚মিকম্প হয় এই সমাধানে সন্তুষ্ট না থেকে তাঁরা ভ‚মিকম্পের কারণ খুঁজে বের করেছেন। মানুষের যে হৃৎপিণ্ডকে আবেগের আকর মনে করা হয় সেটি শূকরের হৃৎপিণ্ড দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছেন। দৈবতার গণনাগুলি প্রায় সবসময়-ই কিছু ভুল অনুমানকে ভিত্তি করে করা হয়। এই ভিডিয়োতে দেওয়া হিসেবে সেটাই করা হয়েছে- ধরে নেওয়া হয়েছে যে একটি প্রোটিনের অনেকগুলি অ্যামিনো অ্যাসিড অবস্থানের প্রত্যেকটিকে অবশ্যই সেই অবস্থানের জন্য উপযুক্ত একটি নির্দিষ্ট অ্যামিনো অ্যাসিড দ্বারা পূরণ করতে হবে। যেহেতু প্রতিটি অবস্থানের জন্য ২০টি আলাদা অ্যামিনো অ্যাসিড বিকল্প রয়েছে, তাই এলোমেলোভাবে ২০০টি অ্যামিনো অ্যাসিডের একটি স্ট্রিং সঠিক ক্রমে পাওয়ার সম্ভাবনা আপনি যদি একটা ক্যালকুলেটরে হিসাব করেন তাহলে প্রায় শূন্যের সমান একটা মান পাবেন। এইভাবে, সৃষ্টিবাদীরা বলছেন, অ্যামিনো অ্যাসিডের ক্রমানুসারে আপনি কার্যত এমন প্রোটিন পেতে পারেন না। কিন্তু প্রোটিন, এমনকি আধুনিক উচ্চ বিকশিত বিশেষ প্রোটিন, নির্দিষ্টতার সেই ডিগ্রির সাথে তৈরি হয় না। অনেক প্রোটিনের গঠন এটা নিশ্চিত করে যে তারা অ্যামিনো অ্যাসিডের ছোট সাবইউনিট সিকোয়েন্স দিয়ে তৈরি হয়েছিল অথবা তাদের একটি সাধারণ ধাতব-জৈব মজ্জা (metalo-organic core) কোর রয়েছে যা আজকের জটিল এনজাইমের আদিম উপাদান হিসাবে একা কাজ করতে পারে। William M. Thwaites তাঁর New Proteins Without God’s Help শিরোনামে এক গবেষণাপত্রে লিখেছেন, “সৃষ্টিবাদী গণনাগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রোটিন উদ্ভবের প্রায় শূন্য সম্ভাবনার কথা বলে মূলত দুটি ভুল বিশ্বাসের কারণে: (১) তাঁরা এমন একটি নির্দিষ্টতা ধরে নেন যা বাস্তব প্রোটিনের অস্তিত্বে নেই এবং (২) তাঁরা ধরে নেন, নবগঠিত প্রোটিনগুলি অবশ্যই এমন হতে যে তারা তাদের পুরানো অবস্থার-ই বিকশিত প্রতিরূপ।”
দৈবভাবে প্রোটিন অণু সৃষ্টির সম্ভাবনা বিষয়ে ইনস্টিটিউট ফর ক্রিয়েশন রিসার্চ (আইসিআর) এর পরিচালক ডুয়ান গিশ বলেছেন (১৯৭৬), “অনুঘটকের প্রভাবে সক্রিয় একটি প্রোটিন অণু নিশ্চিত সুযোগে উদ্ভূত হওয়ার জন্য যে সময় প্রয়োজন তা পৃথিবীর অনুমিত বয়সের বিলিয়ন গুণ হবে।” প্রথম কথা হচ্ছে যে, দৈবতা কখনও ক্রম অনুসরণ করে না। IATA-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ৩৬ লাখ ফ্লাইটের মধ্যে মাত্র একটি ফ্লাইট প্রাণহানি ঘটানোর মতো গুরুতর দুর্ঘটনায় পড়ে। তার অর্থ বিমান ভ্রমণের সময় যে কোনো একজন বিমানযাত্রীর মৃত্যুঝুঁকি ৩৬ লাখ ভাগের ১ ভাগ। কোনো যাত্রী যদি ১ কোটি ৪৪ লাখ ঘণ্টা উড্ডয়ন করেন, তাহলে তাঁর একবার বিমান দুর্ঘটনায় পড়ার আশঙ্কা আছে। তিনি যদি প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে বিমান ভ্রমণ করেন, তাহলে ১১ হাজার ৮০০ বছরের মধ্যে তার প্রাণ হারানোর আশঙ্কা একবার। ঐ যাত্রী যদি ধরে নেন তিনি ১১ হাজার ৮০০ বছর পর দুর্ঘটনায় পড়বেন তাহলে ভুল হবে। তার জীবনের প্রথম ফ্লাইটে-ই তিনি দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করতে পারেন। একইভাবে দৈবক্রমে প্রোটিন অণুর উদ্ভব পৃথিবীর প্রথম প্রহরে ঘটা বিচিত্র নয়। সেরকম ঘটেছে বলেই আমরা পৃথিবীতে এসেছি। না ঘটলে পৃথিবী অন্য গ্রহগুলোর মতো বিরান প্রান্তর থেকে যেতো।
পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব কি অবশ্যম্ভাবী ছিলো? কিছু তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন প্রাণের উপাদান মহাজগতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। Peter Spotts তাঁর Raw materials for life may predate Earth’s formation গবেষণাপত্রে দাবি করেছেন, মহাবিশ্বের যেখানেই প্রাণ সৃষ্টির উপযোগী পরিবেশ আছে সেখানেই প্রাণ আছে। তাঁর এই দাবির স্বপক্ষে কিছু প্রমাণও পাওয়া যায়। নক্ষত্র, নিহারীকা, মহাশূন্য- সবখানে অজৈব পদার্থের অণু থেকে জটিল জৈব মনোমার (একটি অণু যা একটি পলিমার গঠনের জন্য অন্যান্য অভিন্ন অণুর সাথে আবদ্ধ হতে পারে) গঠনের বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে। ১৯৮৬ সালে হ্যালির ধূমকেতু যখন পৃথিবীর কাছাকাছি আসে তখন ইউরোপীয় মহাকাশ এজেন্সি গিয়োটো নামের এক মহাশূন্যযান পাঠিয়েছিল সেটা পর্যবেক্ষণ করতে। অনুসন্ধানে ঐ ধূমকেতুর মধ্যে চিনি, অ্যালডিহাইড, অ্যালকোহল, এবং এসিডের সমন্বয়ে গঠিত ফরমালডিহাইডের পলিমার পাওয়া গেছে [(সেসময় একজন ধর্মবেত্তা দাবি করেছিলেন, ইসা (আঃ) তাঁর চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তনের আগে ধূমকেতুর পিঠে চেপে পৃথিবীর অবস্থা দেখতে এসেছেন]। পৃথিবীতে পাওয়া উল্কা পিণ্ডে নানা ধরনের জটিল জৈব যৌগের সন্ধান পাওয়ার তথ্য আমরা প্রায়-ই সংবাদপত্রে পড়ে থাকি। ২০১৬ সালের আগস্টে গবেষকরা ৩৭০ কোটি বছর আগেকার এক আণুবীক্ষণিক অনুজীবের ফসিলের সন্ধান পেয়েছেন। এপোলো মিশনের মাধ্যমে চাঁদ থেকে নিয়ে আসা শিলাখণ্ড বিশ্লেষণ করে ছয়টি এমিনো এসিড পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, আগ্নেয়গিরির গ্যাসের মধ্যকার ধাতব কার্বাইড ও উত্তপ্ত গলিত লাভা পানির সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোকার্বন তৈরি করে।
সৃষ্টিবাদীরা এক সময় বলতেন, প্রাণির শরীরে আছে এমন কোনো উপাদান ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা গেলে এটা ধারণা করা যাবে যে প্রাণ রাসায়নিক বিক্রিয়ার ধারাবাহিক অনুক্রমের ফসল। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে জীব বিজ্ঞানী বারজেলিয়াস দাবি করেন যে, জৈব যৌগসমূহ জীব দেহে উপস্থিত কোনো রহস্যময় প্রাণশক্তির প্রভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকে। এগুলোকে পরীক্ষাগারে তৈরি করা সম্ভব নয়। এই তত্ত¡কে বারজেলিয়াসের প্রাণশক্তি মতবাদ বলা হয়ে থাকে। এই মতবাদ প্রচারের মাত্র ১৩ বছরের মাথায় (১৮২৮ সালে) বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক ভোলার অ্যামোনিয়া সায়ানেটের দ্রবণ উত্তপ্ত করে পৃথক সম্পৃক্ত দ্রবণ তৈরি করেন এবং অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে (বাকি অংশ ৩১-এর পাতায় ধ)
তাতে ইউরিয়া পেয়ে যান। ফলে শতাব্দীকাল ধরে প্রচলিত প্রাণশক্তি মতবাদের অবসান ঘটে। কারণ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মূত্রে নাইট্রোজেনধারী যৌগের মধ্যে ইউরিয়া প্রধান। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে অজৈব পদার্থ থেকে কৃত্রিমভাবে জৈব যৌগ সংশ্লেষণ করা সম্ভব।
প্রাণের প্রধান উৎস হিসেবে গণ্য করা হয় অ্যামিনো অ্যাসিডকে। এই অমূল্য উপাদানটি কি প্রকৃতির পরীক্ষাগারে নিজে নিজে উদ্ভূত হতে পেরেছিল? বিজ্ঞানীরা এখন সেরকম-ই মনে করছেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর হ্যারল্ড উরের ছাত্র ছিলেন স্ট্যানলি মিলার। মিলার তখন রসায়নে পিএইচডি করছেন। ১৯৫২ সালে প্রফেসর উরের তত্ত¡াবধানে মিলার পরীক্ষাগারে আদি পৃথিবীর পরিবেশ তৈরি করে দেখতে চাইলেন কী ঘটে। পরীক্ষাটা ছিলো খুব সাধারণ। তিনি একটি কাঁচের জার হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া ও মিথেন দিয়ে পূর্ণ করলেন। অন্য একটি জারের অর্ধেকটা পানি দিয়ে পূর্ণ করলেন (প্রচলিত তত্ত¡ অনুযায়ী এই চারটি-ই ছিলো আদি পৃথিবীর প্রকৃতির মূল উপাদান)। এই দুটি জারকে তিনি যুক্ত করলেন একটা কাঁচের পাইপ দিয়ে। ধারণা করা হয় যে আদি পৃথিবীতে মুহুর্মুহু বজ্রপাত ঘটতো। তাই প্রথম জারে তিনি থেমে থেমে বৈদ্যুতিক প্রবাহ চালিত করতে থাকলেন। দেখলেন, প্রথম জারের পানি কিছুটা গোলাপী আভা ধারণ করেছে। এক সপ্তাহ এই প্রক্রিয়াটা চালাবার পর তিনি লক্ষ করলেন, পানির রং গাঢ় লাল হয়ে গেছে। বোঝা গেল জারে জৈব রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ তৈরি হয়েছে। পরে পরীক্ষা করে মিলার সেই দ্রবণটিতে ৫টি অ্যামিনো অ্যাসিড সনাক্ত করতে পারলেন। সেগুলি হলো গ্লাইসিন, আলফা-অ্যালানিন, বিটা অ্যালানিন, অ্যাস্পার্টিক অ্যাসিড ও আলফা-অ্যামিনোবিউট্রিক এসিড।
এ’ধরণের প্রমাণ থেকে এটা বিশ্বাস করা বিজ্ঞানীদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হলো যে প্রকৃতিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আদি কোষ তৈরি হয়ে থাকতে পারে। তবে তারা এটাও মেনে নিলেন যে যদি আদি-কোষ থেকে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের বিকাশ প্রমাণ করতে হয় তাহলে দেখাতে হবে আরএনএ কীভাবে কোষের অভ্যন্তরে নিজেই নিজের প্রতিলিপি জন্ম দেয়। কয়েক দশক ধরে চেষ্টা চলছে। বিজ্ঞানীরা এখনও এরকম কিছু করে দেখাতে পারেননি। বাতিল হয়ে যাওয়া প্রাণশক্তি মতবাদে বিশ্বাসীরা বৌদ্ধ ধর্ম ছাড়া অন্য বড় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর সমর্থনে বলে চলেছেন, “জীববিজ্ঞান এটা পারবে না।” যদি পারে তখন হয়তো তারা নতুন দাবি নিয়ে হাজির হবেন— “অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরির উপাদান আদি পৃথিবীতে ছিলো কেনো তার ব্যাখ্যা দাও।” এক সময় বৃষ্টিপাত, আগুন, সাইক্লোন, ভ‚মিধ্বস বা ভ‚মিকম্পের উৎস হিসেবে দেবতা/ ঈশ্বরের ইচ্ছার কথা বলা হয়েছে। বিজ্ঞান এসবের কারণ ব্যাখ্যা করার সাথে সাথে সৃষ্টিবাদীরা পিছিয়ে গিয়ে নতুন এমন কিছু উপকরণের সন্ধান করেছেন যা বিজ্ঞানীরা এখনও জানেন না। ব্যাপারটা এরকম- আপনি যেহেতু জানেন না বজ্রপাত কেনো হয় তাই আপনাকে স্বীকার করে নিতে হবে এটা বৃষ্টির দেবতার কাজ।
প্রাণ সৃষ্টির প্রথম অবস্থাটা বিজ্ঞানীরা এখনও খুব ভালো করে জানেন না। কিন্তু তাঁরা এটা অনেকটা নিশ্চিত হয়েছেন যে প্রাণ পুরোপুরি-ই একটা জৈব-রাসায়নিক ঘটনা প্রবাহ। এর শুরুর মুহূর্ত নির্ণয় করা কঠিন; অথবা অসম্ভব; কারণ প্রাণ হয়তো একটা চক্রাকার প্রবাহের নাম। চক্রাকারে ঘুরতে থাকা প্রকৃতির নিয়ম। পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য, গ্যালাক্সির মধ্যে ঘুরতে থাকে। জলেরা ক্লান্তিহীন পাহাড়-সমুদ্র-পাহাড় করতে থাকে। এই নিয়ম আমরাও মেনে চলি। অফিস-বাসা-অফিস করতে করতে মরে যাই। নৃত্য শিল্পীরা স্টেজে উঠে ঘুরে ঘুরে নাচেন। আমরা তীর্থ স্থানকে বেষ্টন করে চক্রাকারে ঘুরি। কেউ মন্দির, গির্জা বা কাবার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেলে তার কোনো অর্থ থাকবে না। জীবন চক্রটাও এরকম। পুরো মহাজগৎ এই নিয়মে চলে। আপনি একটা শিমের বিচি ৩ বছর হাঁড়িতে রেখে দিলেন। এরপর একদিন মাটিতে পুঁতে দিয়ে দেখলেন তা থেকে অঙ্কুর বের হয়েছে। এই উদ্ভিদের প্রাণের শুরুর মুহূর্ত কোনটি ছিল? হাঁড়িতে থাকার সময়? মাটিতে পোঁতার সময়? আর্দ্র হবার সময়? মাটি ফুঁড়ে পাতা বের করার সময়? প্রথম বৃষ্টিপাতে উদ্বেলিত দখিণা সমীরে পত্র-পল্লবের স্নেহার্দ্র ছায়ায় তার প্রথম পুস্পের কুঁড়ি যখন পৃথিবীর আকাশে বিস্ময় বিমিশ্র চোখে তাকায়, সেই মুহূর্তটি? আসলে এসবের কোনটি-ই নয়। আমরা পেছনে গেলে দেখবো এটা একটা প্রান্তহীন অনন্ত প্রবাহ। এই শিমের বিচির প্রাণ ছিলো পৃথিবীর বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া জড় অণুর মধ্যে। পৃথিবী এই অণুগুলো পেয়েছে তার পিতৃনক্ষত্র থেকে। আজ থেকে ৫০০ কোটি বছর পর সূর্য যখন রেড জায়ান্টে পরিণত হবে তখন আমরা সবাই তার মধ্যে আবার বিলীন হয়ে যাবো। এভাবে পিছিয়ে যেতে থাকলে আমরা দেখবো প্রাণের অন্তহীন প্রবাহ ছড়িয়ে আছে মহা-জগৎময়:
“চারিদিকে বেজে ওঠে অন্ধকার সমুদ্রের স্বর-
নতুন রাত্রির সাথে পৃথিবীর বিবাহের গান!
ফসল উঠিছে ফ’লে- রসে রসে ভরিছে শিকড় ;
লক্ষ নক্ষত্রের সাথে কথা কয় পৃথিবীর প্রাণ!
সে কোন প্রথম ভোরে পৃথিবীতে ছিল যে সন্তান
অঙ্কুরের মতো আজ জেগেছে সে জীবনের বেগে!
আমার দেহের গন্ধে পাই তার শরীরের ঘ্রাণ-
সিন্ধুর ফেনার গন্ধ আমার শরীরে আছে লেগে!
পৃথিবী রয়েছে জেগে চক্ষু মেলে- তার সাথে সে-ও আছে জেগে!”
(জীবন, ধূসর পাণ্ডুলিপি, জীবনানন্দ দাশ)
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা