হাসান গোর্কি : “বার্নার্ড শ গেছেন আমেরিকায়। টিকেট কেটে লোক এসেছে তাঁর বক্তৃতা শুনতে। হলভর্তি শ্রোতা। আলোচনার এক পর্যায়ে বার্নার্ড শ বললেন, ‘আমি পর্যালোচনা করে দেখেছি, শতকরা ৫০ জন আমেরিকান আসলেই বোকা।’ শোনামাত্র দর্শকরা বিরক্ত। পরের দিনের বিক্রি হওয়া অগ্রিম টিকেট অনেকেই ফেরত দিয়ে চলে যাবে, এমন ভয় দেখা দিল। আয়োজকরা বার্নার্ড শ-র কাছে স্লিপ পাঠিয়ে এই আশঙ্কা জানালেন। বার্নার্ড শ স্লিপ পড়ে বললেন, ‘আমি আরেকটি পর্যালোচনায় দেখেছি, শতকরা ৫০ জন আমেরিকান বেশ বুদ্ধিমান।’ বলার সাথে সাথে ব্যাপক হাততালি। শ্রোতারা মহাখুশি।” কাহিনিটা শ্রদ্ধেয় লেখক জাকির তালুকদার স¤প্রতি তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন। এখানে যা ঘটেছে তা হলো, বার্নার্ড শ’ যখন বললেন, ‘শতকরা ৫০ জন আমেরিকান আসলেই বোকা‘, তখন শ্রোতাদের প্রত্যেকে আলাদা করে ভেবেছেন যে এই নোবেল বিজয়ী নাট্যকার তাকে অপমান করছেন। কিন্তু তিনি যখন বললেন, ‘শতকরা ৫০ জন আমেরিকান বেশ বুদ্ধিমান’ তখন তারা প্রত্যেকে আলাদা করে বিশ্বাস করেছেন যে তিনি ঐ ৫০%-র অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বাসের শাব্দিক হলো, কোনকিছুর ওপর (বিশেষত প্রমাণ ছাড়া) আস্থা রাখা। ‘যা কিছু আমার’ তা সত্য ও উত্তম- এটা বিশ্বাস করতে আমাদের ইচ্ছা করে।

আমার পিতামহ আজ থেকে ১৩০ বছর আগে চাঁদা তুলে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র যোগাড় করে বগুড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অর্ধ শতাব্দী ধরে আমি আমার পরিবারের কাছে জেনে এসেছি তিনি ছিলেন পূর্ব বগুড়ার অন্ধকার যুগে শিক্ষার আলোকবর্তিকা ছড়ানো প্রধান মানুষ। গত বছর ঐ স্কুলের এক পুনর্মিলণী অনুষ্ঠানে অনেকের স্মৃতিচারণ থেকে জানলাম, আমার পিতামহ ছিলেন উদ্যোক্তাদের একজন ও বেতনভুক্ত প্রধান শিক্ষক; ঐ স্কুল প্রতিষ্ঠায় এলাকার দুই জন বিত্তবান মানুষের অবদান আমার পিতামহের চেয়ে অনেক বেশি ছিলো। তাঁরা জমি ও অর্থ দিয়েছেন এবং ব্রিটিশ সরকারের উচ্চ দপ্তর থেকে স্কুলের অনুমোদন নিয়ে এসেছেন। কিছু মানুষের ভাষ্য, আমার পিতামহের লক্ষ্য যতটা না জনকল্যাণ ছিলো, তার চেয়ে বেশি ছিলো নিজের কল্যাণ। কিন্তু আমি এই বিপরীত মত মানি না। আমার নিজের বিশ্বাস এই তথ্য/ধারণা দিয়ে যাতে কলুষিত না হয় তার জন্য এখনও মনে মনে যুক্তি খুঁজে চলেছি। এরকম কিছু বিশ্বাসে ভর করেই আমরা চলি — বুদ্ধিমান প্রাণি হিসেবে এটা এক ধরণের অনিবার্য আচরণ, অন্তর্জাত ভ্রমণবীথি। আমরা চেষ্টা করলেও অন্য বৃক্ষে যেতে পারি না। (বাইরে থেকে দেখে আমরা যতটুকু বুঝতে পারি, অন্য প্রাণিদের ক্ষেত্রেও এরকম-ই সত্য)।

শুধু বিশ্বাসে নির্ভর করার কিছু খারাপ দিক আছে। বিজ্ঞানের কথা সত্য ধরে নিলে আদি পৃথিবীতে তৈরি হওয়া প্রিবায়োটিক স্যুপ থেকে এককোষী প্রাণি, বহুকোষী সামুদ্রিক প্রাণি; ডাঙায় উঠে এসে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নরবানর হয়ে পৃথিবীতে বুদ্ধিমান মানুষের আবির্ভাবের বয়স মোটামুটি অর্ধ লক্ষ বছর। প্যালিওঅ্যান্থ্রোপোলজি হলো নৃবিজ্ঞানের তুলনামূলক একটি নতুন শাখা যাতে জীববিজ্ঞানের কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত যা মূলত হোমো সেপিয়েন্সের সাথে পূর্ব পুরুষদের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য আলোচনা করে। বিজ্ঞানের এই শাখা গবেষণা করে ধারণা দিয়েছে যে মোটামুটি ৩ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে হোমো ইরেকটাস, হোমো হেইডেলবার্গেনসিস হয়ে হোমো সেপিয়েন্সের পূর্ব পুরুষদের আবির্ভাব ঘটে। তারা দলবদ্ধভাবে শিকার করা, বসবাসের জন্য গৃহ/আশ্রয়স্থল নির্মাণ করা এবং প্রকৃতিজাত শস্য দানা সংগ্রহ করার কৌশল রপ্ত করে। দীর্ঘ সময় দলবদ্ধভাবে বসবাস করার কারণে তাদের ভাষার গঠন ধীরে ধীরে উন্নত হয়। মোটামুটি পঞ্চাশ লক্ষ বছর আগে তারা কিছু অমূর্ত ( নির্বস্তুক, ধারণাগত) বিষয়ে কথা বলার মতো শব্দ ব্যবহার করতে শেখে। কাঠ, পাথর, বালি দিয়ে কিছু অবয়ব বানায় যার কিছু শিল্প মূল্য আছে কিন্তু ব্যবহারিক মূল্য নাই। এসময়-ই তারা প্রার্থনার জন্য প্রকৃতির শক্তিমন্ত উপাদান ( যেমন, পাহাড়, নদী, হ্রদ, সমুদ্র, বৃক্ষ, পশু) নির্বাচন করে; এভাবে তৈরি হয় ধর্মের প্রাথমিক অবয়ব।

আবির্ভাব থেকে শুরু করে এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় মানুষকে চলতে হয়েছে প্রধানত অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাসে ভর করে। ফলে এই দুটি জিনিস আমাদের মনোজগতের গভীরে এতটা স্থায়ী আসন করে নিয়েছে যে তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। আর সে ধারণা যদি নিজের সম্পর্কে হয় তা থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। আমাদের মস্তিষ্কের সেলগুলো আমাদের হয়ে অবিশ্রান্ত কাজ করে। তাদের দেওয়া বিবেচনায় আমরা সিদ্ধান্ত নিই, পথ চলি। ধরা যাক তারা আমাকে বুদ্ধিমান বলে রায় দিলো। বন্ধু, আত্মীয়, পরিবার ও প্রতিবেশীরা আমাকে নির্বোধ বলে রায় দিলেন। আমার নিজের মাথায় থাকা বিচারকরা নিজেদের রায়ের বিপরীতে গিয়ে দ্বিতীয় পক্ষের রায় মানবে কেনো! বিশ্বাসের একটা বড় অংশ তৈরি হয় অজ্ঞতা থেকে বা জানার সুযোগের অভাবে। রাতের বেলা সূর্য কোথায় যায় এ নিয়ে প্রাচীনকালের মানুষদের আগ্রহ ছিলো। কেউ ভাবতো গহিন অরণ্যের ওপারে, কেউ ভাবতো সমুদ্রে, কেউ বিশ্বাস করতো পঙ্কিল জলাশয়ে, কেউ ভাবতো ঈশ্বরের পদতলে গিয়ে সে বিশ্রাম নেয়। পরদিন ভোরে সাত ঘোড়ার সোনার রথ তাকে টেনে পূর্ব থেকে পশ্চিম আকাশে নিয়ে যায়। এই বিশ্বাসগুলো এখন আমাদের বিনোদনের উপাদান। কিন্তু তাদের কাছে এগুলো শতভাগ সত্যি ছিলো; যেমন এখনও আমাদের কাছে অনেক অতীন্দ্রিয় শক্তি সত্য। আজ থেকে মাত্র হাজার খানেক বছর আগেও জনপ্রিয় ধারণা ছিলো,হৃৎপিণ্ড হলো মানুষের অনুভূতির কেন্দ্র ও উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়াকলাপগুলির উৎস যা মানুষের সমস্ত স্বজ্ঞাত কর্মের পিছনের কারণ।

এখন আমরা জানি, আমাদের চিন্তা ও অনুভূতির কেন্দ্র আমাদের মস্তিস্ক। আমাদের মস্তিস্ক কীভাবে কাজ করে তার একটা বড় অংশ এখনও অজানা। তাই আমরা শরীরের মধ্যে একটা অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি কল্পনা করে নিয়েছি। একটা কিছু বুঝতে অপারগ হলে সেখানে অতীন্দ্রিয় কিছু বসিয়ে দেওয়া আমাদের গুহাবাসী পূর্বপুরুষদের কাছে পাওয়া মিলিয়ন বছরের পুরনো অভ্যাস। নিউরোসায়েন্স এখন ওষুধ খাইয়ে মানুষের আবেগের পরিবর্তন ঘটাতে পারছে। আজ থেকে একশ’ বছর পর হয়তো মস্তিষ্কের গঠন আরও অনেক স্পষ্টভাবে জানা যাবে; নিউরোসার্জনরা অস্ত্রোপচার করে আবেগ, অনুভূতি, বুদ্ধিমত্তা, বিশ্বাস, ধারণার পরিবর্তন ঘটাবেন। ধরা যাক ঈশ্বরে অবিশ্বাসী একজন ছেলেকে নিয়ে বাবা মা বিপদে আছেন। ঐ ছেলে নিজেও চায় তার মধ্যে ঈশ্বর বিশ্বাস তৈরি হোক। সে বাবা মার সাথে নিউরোসার্জনের কাছে গেলো। তার মস্তিষ্কের যে কোষগুলো অবিশ্বাসের জন্য দায়ী নিউরোসার্জন সেগুলো কেটে ফেলে দিলেন এবং বাবা বা মার মস্তিস্ক থেকে ঈশ্বর বিশ্বাসের জন্য দায়ী সমসংখ্যক সেল সেখানে প্রতিস্থাপন করলেন। পরদিন থেকে বালক মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি শোনার জন্য অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে শুরু করলো। এরকম ঘটার সম্ভাবনাকে অনেকের কাছে হয়তো দূর কল্পনা মনে হচ্ছে।

আসলে এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখছি তার সব-ই একসময় দূর কল্পনা ছিলো। সম্রাট আকবর এতো বড় সাম্রাজ্যের মালিক হয়েও ভাবতে পারেননি যে মানুষ চাঁদে যাবে। যারা আমার এই পূর্বানুমান মানতে পারছেন না তারা ১৯৫৩ সালে প্যাসিফিক টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ কোম্পানির পরিচালক মার্ক আর সুলিভানের অনুমানের বিষয়টি দেখুন। ঐ বছর ১১ এপ্রিল তারিখে The Tacoma News Tribune-কে তিনি বলেছিলেন, “এটি আমার ভবিষ্যদ্বাণী: চূড়ান্ত বিকাশে, টেলিফোন নামক যন্ত্রটি ব্যক্তি বহন করবে; সম্ভবত আজ যেমন আমরা একটি ঘড়ি বহন করি। ডায়াল বা সমতুল্য কিছুর দরকার হবে না। এবং আমি মনে করি ব্যবহারকারীরা কথা বলার সময় একে অপরকে দেখতেও সক্ষম হবে, যদি তারা চায়। কে জানে এটি আসলে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষাতে অনুবাদও করতে পারবে কিনা!” খবরটির শিরোনামে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস নিবন্ধের ক্লিপিংয়ে সুলিভানের প্রাজ্ঞ-শব্দযুক্ত বাক্যটি (ভবিষ্যতে টেলিফোনের হাত থেকে নিষ্কৃতি মিলবে না) বেঁচে আছে। নিষ্কৃতি শব্দটি তিনি ইতিবাচক অর্থে-ই হয়তো ব্যবহার করেছিলেন। এখন এটাকে profetic মনে হচ্ছে। সেলফোন আমাদের জীবনের সাথে এতটা জড়িয়ে গেছে যে তা আমাদের ব্যক্তিগত পরিসরে বিড়ম্বনারও কারণ হয়েছে। তিনি এরকম চিন্তা করেছিলেন সেই সময় যখন রোটারি ফোন আমেরিকান পরিবারগুলিতে সবচেয়ে উন্নত ব্যক্তিগত যোগাযোগের যন্ত্র ছিল। সাত দশক আগে তাঁর এই অনুমান হয়তো ১০ জনে ৯ জন অবিশ্বাস করেছে।

আমাদের অতীন্দ্রিয় বিশ্বাসের সবগুলো অজ্ঞতা থেকে আসে এমন নয়; এর কিছু আসে আমাদের দার্শনিক জিজ্ঞাসা থেকে। কিন্তু দার্শনিক জিজ্ঞাসার উৎসও অজ্ঞতা। দর্শন শাস্ত্রে অজ্ঞতা শব্দটি নেতিবাচক নয়; এর অর্থ অজ্ঞানতা বা মূর্খতা নয়। এর অর্থ ‘না জানার অবস্থা’। ইলেকট্রন কণা নিউক্লিয়াসকে প্রদক্ষিণ করে কিনা সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা অজ্ঞ। এর অর্থ এটা নয় যে এ বিষয়ে তারা মূর্খ বা জ্ঞানহীন। বরং এভাবে বোঝা প্রথাসিদ্ধ যে এই তথ্যটা তারা জানেন না।

এক সময় ধারণা করা হতো, সব প্রাণিকে ‘জোরায় জোরায়’ সৃষ্টি করা হয়েছে অর্থাৎ তাদের স্ত্রী ও পুরুষ ভাগ আছে। তখন মানুষের এটা জানা ছিলো না যে পৃথিবীতে অনেক উভলিঙ্গ প্রাণি যেমন, কেঁচো, বলি জোঁক, কৃমি, শামুক, অক্টোপাস বাস করে। প্লাটিহেলমিনথিস পর্বের প্রাণীদের টারবেলারিয়া শ্রেণির অধিকাংশ প্রাণি-ই উভলিঙ্গ। এটাও অজানা ছিলো যে কিছু প্রাণি অযৌন বংশ বিস্তার করে, যেমন প্রোটোজোয়া। দুটি ভিন্ন লিঙ্গের গ্যামেটের মিলনে ভ্রূণ সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে যৌন জনন বলা হয়। আর কোনো প্রাণি যখন নিজেই বিভাজিত হয়ে অবিকল প্রতিলিপি ও স্বতন্ত্র অপত্য তৈরি করে তখন তাকে অযৌন জনন বলে। প্রাণ সৃষ্টির শুরুতে, বিশেষ করে এককোষী প্রাণি থেকে বহুকোষী প্রাণিতে রূপান্তরের সময় সকল প্রাণি ও উদ্ভিদ অযৌন বংশ বিস্তার করতো। আমাদের আণুবীক্ষণিক পূর্ব পুরুষদের শরীরে একই সাথে পুং ও স্ত্রী জনন কোষ ছিলো। এখনও অনেক প্রাণি ও উদ্ভিদ সেই বৈশিষ্ট্য থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। উদাহরণ হিসেবে আমাদের সামনেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আছে। বিবর্তন নিয়ে আপত্তি তোলার সময় অনেকে প্রশ্ন করেন, ‘প্রথম মানুষটি পৃথিবীতে কীভাবে এলো’। খুব জনপ্রিয় একটা প্রশ্ন — ‘মুরগি নাকি ডিম আগে এসেছে’। আসলে এদের কেউ আগে আসেনি। মুরগির পূর্ব পুরুষদের শরীরের পুং ও স্ত্রী বৈশিষ্ট্যের বাহক দুটি অংশ ছিলো; দেহের আকার বৃদ্ধির কারণে অংশ দুটি এক সময় আলাদা হয়ে মোরগ ও মুরগিতে রূপান্তরিত হয়েছে। মানুষ, অন্য প্রাণি ও উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। সেকারণে প্রথম মানুষ বলে কিছু থাকার সুযোগ ছিলো না। ছবির মুরগিটি/মোরগটি উভলিঙ্গ। এর বাম দিকটা পুরুষ। খেয়াল করে দেখুন এর বাম পা মোটা ও বলিষ্ঠ। এদিকের মাংসপেশী স্ফীত। রং ও আলাদা। এর ডান দিকটা স্ত্রী বৈশিষ্ট্য বহন করে। ডান দিকের পা কৃশ, পালকের রং গাঢ়। বিজ্ঞানীরা এই অবস্থাকে বলেন গাইনানড্রোমরফিজম। ScienceNewsExplorers ম্যাগাজিনের মার্চ ২৮, ২০১০ সংখ্যায় Half rooster, half hen শিরোনামে প্রকাশিত এই লেখাটা পড়তে পারেন (https://www.snexplores.org/article/half-rooster-half-hen)।

বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীতে আমরা যেসব জীবের সঙ্গে পরিচিত, তাদের মধ্যে দশ লাখের বেশি প্রাণি প্রজাতি এবং চার লাখের মতো উদ্ভিদ-প্রজাতি শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এদের প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য আলাদা। আমরা মানব দেহের সংগঠনের অকল্পনীয় জটিলতা দেখে হতবিহ্বল হই এবং দ্রুত এই বিশ্বাসে পৌঁছে যাই যে এটা এক অতীন্দ্রিয় মহাশক্তির সুচিন্তিত কৌশলের অনন্য নির্মাণ। শিম্পাঞ্জি, পিঁপড়া, প্রজাপতি, সিংহ, ইলিশ মাছ- সবার শরীরে হৃৎপিণ্ড, রক্ত সংবহনতন্ত্র, পাকস্থলী, রক্ত নালী, পেইন রিসিপটর আছে; মস্তিষ্কে নিউরন সেল আছে। এগুলোর সংগঠন মানুষেরটার মতই কঠিন। ঈশ্বর তৈরি করে থাকলে ধরে ধরে সবাইকেই আলাদা করে তৈরি করেছেন। জীব বিজ্ঞান বলছে এক কোষী প্রাণ থেকে বিবর্তিত হয়ে সবাই এসেছে; কোনো প্রাণি বা উদ্ভিদকে আলাদাভাবে তৈরি করা হয়নি। ফলে পৃথিবীর সকল প্রাণি এমনকি উদ্ভিদের সাথেও মানুষের ডিএনএ-র বিস্ময়কর মিল পাওয়া যায়। এই তালিকায় মানুষের সাথে অন্য প্রাণি/ উদ্ভিদের জেনেটিক মিলের নমুনা দেখুন:

এই তালিকা থেকে বুঝতে সহজ হয় কেনো বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন যে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে একই উৎস থেকে। কোনো নতুন ওষুধ বাজারে ছাড়ার আগে উদ্ভাবকরা প্রায়-ই তা ইঁদুরের (মানুষের সাথে ডিএনএ-র মিল ৯৭.৭%) ওপর প্রয়োগ করেন এবং প্রাপ্ত ফলাফল থেকে বুঝতে পারেন তা মানুষের শরীরে কতটা কাজ করবে। গতবছর ৫৭ বছর বয়সী এক আমেরিকানের দেহে শূকরের (মানুষের সাথে ডিএনএ-র মিল ৯৮%) হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়েছে (https://www.bbc.com/bengali/news-59947868)। এরকম সংখ্যাতীত চাক্ষুস উদাহরণ থাকার পরও বিবর্তন বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হলো আমাদের মনে লালন করা একটা বিপরীত বিশ্বাস। আমার প্র-প্র-প্র পিতামহ ব্যাকটেরিয়া ছিলেন এমন ভাবনা মাথায় নিতে গেলে আত্মসম্ভ্রমে লাগে। ভাবতে ভালো লাগে আমাদের একটা সোনালি অতীত ছিলো এবং মর্ত্যে আগমনের একটা বর্ণাঢ্য, জ্যোতির্ময় অর্থপূর্ণ ইতিহাস ছিলো। জ্ঞানের প্রশ্নে কোনো একক ও সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নেই। তবে বিশ্বাস জ্ঞানের কোনো শাখা নয়। যুক্তিবিদ্যার কাজ হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের জন্য বিভিন্ন প্রমাণের মূল্যায়ন। আর দর্শনের উপজীব্য হলো, বিশ্বসত্তার প্রকৃতি, মানুষের জ্ঞানের ক্ষমতা-অক্ষমতার সীমা, বস্তু ও ভাবের সম্পর্ক, চিন্তার চর্চা বিকাশের উপায় এবং ন্যায়-অন্যায় বোধের ভিত্তি সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি। এই চর্চায় বিশ্বাসের বিপরীতে অনুসন্ধানকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। যুক্তিবাদী জ্ঞানতত্তে¡র পুরোধা ছিলেন ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত। ১৬৩৭ সালে প্রকাশিত ডিসকোর্স অন মেথড গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, কোনো বিবৃতিকে, সেটা যতই সর্বজন গ্রাহ্য হোক, প্রশ্ন করা ছাড়া গ্রহণ করা উচিৎ নয়। এর দ্বারা তিনি স্পষ্টত-ই ক্রিয়েশনিজমে শর্তহীন বিশ্বাসের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন। এ বইয়ে তিনি যুক্তির মহত্ত¡, প্রাকৃতিক নিয়মের অপরিবর্তনীয়তা, বস্তুর সত্য এবং অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য এবং ইন্দ্রিয়ানুভূতির মূল হিসেবে ভৌত জগতের প্রতিফলন নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমরা যারা ‘বিশ্বাস’কে একটা সমাধান মনে করছি তাদের জন্য বইটি পাঠ্য হতে পারে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত বইটির পিডিএফ লিংক: https://rauterberg.employee.id.tue.nl/lecturenotes/DDM110%20CAS/Descartes-1637%20Discourse%20on%20Method.pdf

‘ইন্দ্রিয়ানুভূতির মূল হিসেবে ভৌত জগতের প্রতিফলন’ নিয়ে বই লিখে ফেললেও তিনি একবার প্রেমে পড়েছিলেন এবং আত্মার আবেগ নিয়ে প্রেমিকাকে বিস্তর চিঠি লিখেছিলেন। সুইডেনের রানী ক্রিসটিয়ানা ছিলেন শিল্পবোদ্ধা। দেকার্তের বই পরে তিনি মুগ্ধ হন। দেকার্ত তখন হল্যান্ডে ছিলেন। রানী স্টকহোমে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে দেকার্তকে চিঠি পাঠান। দেকার্ত খুশি হয়ে উত্তর দেন। এরপর তাঁরা অনেক পত্র বিনিময় করেছেন যেগুলোর বিষয়বস্তু ছিলো মূলত প্রেম ও আত্মার আবেগ। এক সময় রানীর পীড়াপীড়িতে দেকার্ত হল্যান্ড ছেড়ে সুইডেনে চলে যান। রানী নিয়মিত প্রত্যুষে দেকার্তের কাছে গণিত ও দর্শনশাস্ত্র শিখতেন। ভোরের হিম হাওয়ায় নিয়মিত অভিসারে বের হয়ে তাঁর ঠাণ্ডা লেগে যায়। তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন এবং ১৬৫০ সালে ৫৩ বছর বয়সে স্টকহোমে মারা যান।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।