হাসান গোর্কি : স¤প্রতি ঢাকার একটি সংবাদপত্র খবরের শিরোনাম করেছে, “এশিয়ার সেরা ১০ এয়ারলাইন্সে জায়গা করতে চায় বিমান: সিইও”। এটা খুশি হবার মতো সংবাদ। আকাঙ্ক্ষার চেয়ে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভালো, যদি তা বাস্তবানুগ হয়। বাংলাদেশ বিমান এর আগেও কয়েকবার এ’রকম লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এবং ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ, লক্ষ্যের সাথে কর্মপদ্ধতির মিল ছিলো না। কারিগরি আধুনিকায়ন, নেটওয়ার্ক, সেবা, প্রশিক্ষণ, গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ঢেলে সাজানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন বিমানের সিইও সফিউল আজিম। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাস্তব চিত্রটা মাথায় রাখা দরকার হবে। তা না হলে আগের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাগুলোর মতো এটিও ব্যর্থ হতে পারে। পরিকল্পনা সাজানোর আগে বিশ্বব্যাপী এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির লাভ-লোকসানের বাস্তব চিত্রটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। না হলে সেটা একটা অবাস্তব উচ্চাভিলাষে পরিণত হতে পারে।

সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর ৩ কোটি ৩৪ লক্ষ ফ্লাইটে সাড়ে তিনশ’ কোটি যাত্রী বিমান ভ্রমণ করে। এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি গতবছর আয় করেছে ৭৮,২০০ কোটি ডলার বা ৭৮ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু লাভ সাকুল্যে ৯৫৮ মিলিয়ন ডলার। The International Air Transport Association (IATA)-র তথ্য অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে একটা টিকেট বিক্রির বিপরীতে এয়ারলাইন্সগুলোর গড় লাভ ৬.১২ ডলার। এই ওয়েবসাইটে দেওয়া চার্টের শিরোনামে লেখা হয়েছে “Airline profit per passenger not enough to buy a Big Mac in Switzerland” (Big Macs হলো, ম্যাকডোনাল্ডস এর হ্যামবার্গার)। ঢাকা- চট্টগ্রাম রুটে চলমান একটা বিলাসবহুল বাসের মালিকও টিকেট প্রতি এর চেয়ে বেশি লাভ করে। প্রশ্ন হতে পারে, এই অবিশ্বাস্য কম লাভে এয়ারলাইন্সগুলো তাদের সার্ভিস চালু রেখেছে কেনো? আসলে এটা গড় লাভ। কোনো এয়ারলাইন্স টিকেট প্রতি ১০০ ডলার লাভ করে। কেউ আবার ১০০ ডলার লোকসান দেয়। যেমন এক সময় ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে বিমানের ফ্লাইট ছিলো। প্রতি ফ্লাইটে লোকসান হতো প্রায় ১ কোটি টাকা। টিকেট প্রতি ২০০ ডলারের মতো। পৃথিবীতে প্রায় ৫০০০ নথিভুক্ত এয়ারলাইন্স আছে। এর অর্ধেকের মতো লোকসান দিয়ে চলে। ডেল্টা এয়ারলাইন্সকে সবচেয়ে ধারাবাহিকভাবে লাভজনক এয়ারলাইন্স হিসেবে মনে করা হয়। ২০১০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত তারা গড়ে লাভ করেছে ১০ বিলিয়ন ডলার। টিকেট প্রতি তাদের লাভ ১৫০ ডলারের বেশি। অন্যদিকে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭৭ বছরে খুব কম সময়-ই লাভের মুখ দেখেছে সৌদি এরাবিয়ান এয়ারলাইন্স- সাউদিয়া। ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ার হিসেবে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের নিজস্ব এয়ারলাইন্স আছে। এদের একটা বড় অংশ লোকসান দিয়ে চলে।

এ বছরের ৪ঠা জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠার ৫০ তম বার্ষিকী পালন করেছে। এই ৫০ বছরের মধ্যে ২৮ বছরই লোকসান গুনেছে প্রতিষ্ঠানটি। লোকসানের জন্য শুধু দুর্বল ব্যবস্থাপনা দায়ী ছিলো বিষয়টা এমন নয়। সিভিল এভিয়েশন একটা প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা। পৃথিবীর সব এয়ারলাইন্স কখনও না কখনও লোকসান দিয়েছে। ২২টি অর্থবছরে বিমান লাভের মুখ দেখেছে। এটাকে একটা ভালো লক্ষণ বলে মনে করা যেতে পারে। এ থেকে অন্তত বিশ্বাস করতে দোষ নেই যে বিমানকে স্থায়ীভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার সুযোগ আছে। প্রবাসে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি বাস করে। পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশের মানুষদের তুলনায় বাংলাদেশিদের নাড়ির টান বেশি। শুধু যদি এই প্রবাসীদের পছন্দের তালিকায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে এক নম্বরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় তাহলে ফ্লাইটগুলোতে আসন পাওয়া যাবে না। পাশাপাশি বিদেশীদের আকৃষ্ট করার জানা পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করতে হবে। যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে তার একটা তালিকা করা যাক:

জনবল: ১৯৯৬ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায় যে দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-এ ৫,২৫৩ জন কর্মকর্তা ছিলেন। সেসময় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স প্রায় সমান সংখ্যক দাফতরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে বিমানের চেয়ে দশগুন বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করতো। ২০০৭ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়। সেসময় চাহিদা অনুযায়ী জনবল সমন্বয়ের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা করা হয়নি। ফলে অদক্ষ-অপ্রয়জনীয় জনবলের বাড়তি বোঝা বিমান এখনও বহন করে চলেছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির বিস্ময়কর উন্নয়নের পেছনে আছে ফ্যাক্টরিগুলোর শীর্ষ পদে ভারত ও শ্রীলংকা থেকে নিয়ে আসা কর্মকর্তারা। বিমান যদি এই পথ অনুসরণ করে তাহলে একটা বড় ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মরত জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধি করা হলে কি বাইরে থেকে লোক আমদানীর বিকল্প বাদ দেওয়া সম্ভব না। বিদ্যা মাথায় থাকলে তা দিয়ে কোনো লাভ পাওয়া যায় না। লাভ পেতে গেলে বিদ্যাটা মাঠে খাটাতে হয়। যে কোনো কারণেই হোক জাতিগতভাবে কাজে ফাঁকি দেওয়া এবং দায়িত্ব এড়িয়ে চলার একটা প্রবণতা আমাদের মধ্যে আছে। ফলে প্রশিক্ষণ শেষে কর্মক্ষেত্রে ফিরে কর্মচারী-কর্মকর্তারা আগের মতোই চলতে থাকেন।

ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সততা- নিষ্ঠা-সময়ানুবর্তীতার বিপুল সুনাম আছে। চিত্রটা এ’রকম বিপরীত কেনো? বাংলাদেশে ফাঁকি দিয়ে এসে কানাডায় আমি ঘড়ির কাঁটা ধরে উদয়াস্ত কাজ করছি কেনো? এর কারণ, ব্যবস্থাপনা ও কর্ম-পরিবেশ। বিমান যদি কিছু বেশি টাকা বেতন দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সিভিল এভিয়েশনে কাজ করা সিইও এবং সব শাখার জন্য দক্ষ ‘ম্যানেজার’ আমদানী করে তাহলে চিত্রটা পাল্টে যাবে। এরকম সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রথমেই বিমানের (অন্য কথায় সরকারের) দেশপ্রেম নিয়ে কথা উঠবে। সেটা হজম করার জন্য তৈরি থাকতে হবে। দেশপ্রেম অর্থ দেশের অদক্ষ মানুষকে নিয়োগ দিয়ে দেশের ক্ষতি করা নয়। বিদেশিদের নিয়োগ দিয়ে বিমান যদি বছরে হাজার কোটি টাকা লাভ করে তার সুফল আমরা, দেশের জনগণ-ই ভোগ করবো, যেমন এখন পোশাক শিল্প খাত থেকে করছি। আগের অনুচ্ছেদের শেষে বিবেচ্য বিষয়গুলোর একটা তালিকা উপস্থাপনের প্রতিশ্রুতি ছিলো। কিন্তু বাস্তবে সেটি না করলেও চলে। শুধু উপরের দফাটি (জনবল বিন্যাস/আমদানী) বাস্তবায়ন করা গেলে বাকি কাজ সহজ হয়ে যাবে। ঐ দক্ষ জনশক্তি-ই করণীয়গুলো নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করবে। এরকম কেনো মনে হচ্ছে তা ব্যাখ্যা করতে আমার কিছু অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে চাই।

২০১২ সালে ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স-এ হ্যানয় যাবার পথে কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে অন্য টার্মিনালে সিগারেট খেতে গিয়ে কানেকটিং ফ্লাইট মিস করেছিলাম। এয়ারলাইন্স-এর কাউন্টারে গিয়ে বিস্তারিত বলার পর পরের দিনের টিকেট পেলাম। ২৪ ঘন্টা পর ফ্লাইট। আমার কাছে কোনো ডলার নেই। পকেটে ৭০ হাজার বাংলাদেশি টাকা। ঢাকা এয়ারপোর্টে ডলার কিনতে চেয়েছিলাম। দেরিতে বিমানবন্দরে পৌঁছার কারণে সেটা করতে পারিনি। ক্রেডিট কার্ড ব্যাগে ছিলো। সেটা হ্যানয় চলে গেছে। সোফায় ঘুমিয়ে কাটাতে হবে এবং না খেয়ে থাকতে হবে। আবার কাউন্টারে গিয়ে অবস্থার বর্ণনা দিলাম। আমাকে মেইন টার্মিনালের এয়ারসাইড ট্রানজিট হোটেলে বিনা পয়সায় থাকতে দেওয়া হলো। পরদিন হ্যানয় পৌঁছুলাম। আমার কাছে এশিয়া প্যাসিফিক রিসার্চ নেটওয়ার্কের আমন্ত্রণপত্র ছিলো। আমি “ভয়েস” এর প্রতিনিধি হিসেবে আমি সেখানে যাচ্ছিলাম। ঢাকা থেকে ভিসা নিয়ে যাইনি। কাউন্টারে দাঁড়ালাম। ২৫ ডলার দিতে হবে। আমার কাছে ডলার নাই। মাফ করে ভিসা দিয়ে দিলেন কাউন্টারে বসা ইমিগ্রেশন পুলিশের সদস্য। ২০১৯ সালে টরোন্ট ফিল্ম ফোরাম অফিসে সারারাত আড্ডা দিয়ে যখন এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম তখন ভিক্টোরিয়ার প্লেন চলে গেছে (এই ঘটনার জন্য দায়ী ছিলেন বাংলা কাগজের দুই কর্ণধার- জাহাঙ্গীর ভাই ও মনিস রফিক)। এয়ার কানাডার কাউন্টারে গিয়ে বলার পর বিনা পয়সায় পরবর্তী ফ্লাইটের টিকেট পেলাম। ভিক্টোরিয়া পৌঁছার পর দেখলাম আমার লাগেজ নেই। তিনদিন পর তারা সেটা বাসায় পৌঁছে দিলো। কমপেন্সেসন পেলাম ৭৫০ ডলার।

২০২০ সালে আমি টরোন্ট থেকে ঢাকা যাচ্ছি। এয়ারপোর্টে পৌঁছুতে দেরি হয়েছে। বোর্ডিং করার সময় উইন্ডো সিট চাইলাম। পাওয়া গেলো না। আমি বড় কর্মকর্তা ধরণের এক মহিলাকে একটা ফাঁকা ডেস্কে বসে থাকতে দেখে ধর্না দিলাম। বললাম, উইন্ডো সিটে না বসলে আমার দম বন্ধ লাগে। ‘দেরিতে বোর্ডিং করলে উইন্ডো পাওয়া যায় না’ বলে উনি আমাকে মৃদু তিরস্কার করলেন এবং বিজনেস ক্লাসের দুটি (টরোন্ট-দুবাই, দুবাই-ঢাকা) বোর্ডিং পাস দিয়ে দিলেন। আমি বরাবর গরীব যাত্রী। “দ্য লাঞ্চিয়ন” গল্পে সমারসেট মম ‘চিপেস্ট ডিস অন দ্য মেনু’ খুঁজেছিলেন। আমি বিমান ভ্রমণ শুরু করার পর থেকে সব সময় সবচেয়ে সস্তা টিকেট খুঁজি। ১০০ ডলার বাঁচানোর জন্য ২২ ঘন্টা হিথ্রো এয়ারপোর্টের সোফায় ঘুমানোর ইতিহাস আছে আমার। এমিরেটস আমাকে বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণের যে সুযোগ করে দিলেছিলো তার জন্য অতিরিক্ত কিছু তাদের করতে হয়নি। এটা ছিলো উন্নত ব্যবস্থাপনার ফসল। আমার পেছনে তাদের অতিরিক্ত কোনো খরচ হয়নি। বিজনেস ক্লাসের একটা শূন্য আসনে বসিয়ে দিয়েছে মাত্র। ২০১৮ সালে ক্যাথে প্যাসিফিকে ওয়ারশ থেকে কাথমন্ডু যাচ্ছিলাম। ফ্লাইট টাইম সাড়ে ১১ ঘন্টা। আমার ডান হাঁটুতে ইনজুরি আছে। বেশিক্ষণ একটানা বসে থাকতে পারি না। আমি প্যাসেজের মধ্যে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে থাকছিলাম। এক এয়ার হোস্টেস আমাকে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে আমি কারণ বললাম। সে আমাকে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন আমার আসন ছেড়ে অন্য আসনে যেতে সম্মত আছি কিনা। সম্মতি জানালাম। তিনি আমাকে বিজনেস ক্লাসে নিয়ে বসিয়ে দিলেন।

এবার দেশের এয়ারলাইন্স-এ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বলি। গত ২৫ বছরে আমি বাংলাদেশ বিমানের একটা মাত্র আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে উঠেছি। এবার সেই ঘটনা (নাকি ‘দুর্ঘটনা’ বলবো বুঝতে পারছি না) শুনুন। ২০২১-র জানুয়ারিতে আমার ভিক্টোরিয়া- ভ্যাঙ্কুভার- হিথ্রো ফ্লাইট ছিলো এয়ার কানাডায়। আমি অনলাইন উইন্ডো সিট নিলাম। যাত্রার আগে কয়েক দফা ইমেইল পেলাম, যেগুলোতে বলা হয়েছে আমি কী কী সাথে নিতে পারবো, কী কী পারবো না; কীভাবে অনলাইন বোর্ডিং করতে পারবো, কোভিড প্রটোকল কীভাবে মানতে হবে — এরকম আরও অনেক কিছু। হিথ্রো থেকে ঢাকা ফ্লাইট ছিলো বিমানে। তাদের দিক থেকে কোনো ইমেইল পাইনি। বিমানের ওয়েব সাইটে গিয়ে আসন পছন্দ করার অপশন না পেয়ে ইমেইল করলাম। উত্তর নেই। এমনকি অটোমেটেড আনসারও নেই। ঢাকায় ফোন করলাম। বলা হলো আগে সিট পছন্দ করার সুযোগ নেই। এয়ারপোর্টে গিয়ে বোর্ডিং এর সময় এটা করতে হবে। বিমানে কর্মরত ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোন করে সাহায্য চাইলাম। উনি জানালার পাশে সিটের ব্যবস্থা করে দিলেন।

হিথ্রো থেকে ঢাকা ফ্লাইটে ওঠার পর আমার মনে হলো বগুড়ার নারুয়ামালা হাটে ইদের গরু কিনতে ঢুকেছি। জানালার পাশে আমার আসন দখল করে বসে থাকা মহিলাকে উঠাতে না পেরে এয়ার হোস্টেস আমাকে জানালার পাশে একটা আসনের ব্যবস্থা করে দিলেন। বয়িং ৮৭৮- ড্রিমলাইনারের হেডফোন-জ্যাক লাগানোর পয়েন্ট বাম হাতলের নিচে। আমি সেটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বেল টিপলাম। কেউ এলো না। কিছুক্ষণ পর প্যাসেজ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক স্টুয়ার্ডের সাহায্য চাইলাম। উনি বললেন, “সিটের নিচে খুঁজে দেখুন। অবশ্যই আছে”। আমি তার বিরুদ্ধে অপেশাদার আচরণের অভিযোগ করবো বলায় দয়া করে আমাকে সাহায্য করে চলে গেলেন। ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে কোভিড সংক্রান্ত মামলায় পড়লাম। কানাডা থেকে নিয়ে যাওয়া প্রুফ তাদের পছন্দ হচ্ছে না। আমার কানাডিয়ান পাসপোর্টে “নো ভিসা রিকোয়ারড” সিল নেওয়া আছে। আমি পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বুঝাতে ব্যর্থ হলাম যে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী আর দশ বাংলাদেশি যাত্রীর মতো আমার জন্যও ‘সেলফ কোয়ারেন্টাইন’- ই যথেষ্ট। পরে তার দেওয়া তালিকা থেকে একটা হোটেলে অনলাইন বুকিং দিয়ে কয়েক কাউন্টার ঘুরে বহু কষ্টে ঘর্মাক্ত কলেবরে ঘন্টা দুই পর ছাড়া পেলাম। লাগেজ বেল্টে গিয়ে দেখলাম, আমার একটা লাগেজ নেই। অভিযোগ খাতায় বিস্তারিত লিখে বাড়ি চলে গেলাম।

খাতাটার চেহারা এখনও আমার মনে আছে — গত শতাব্দীতে বাঁধাই করা হয়তো। ৭ কর্ম দিবসের মধ্যে লাগেজের ব্যাপারে আমাকে জানানোর কথা। ১০ দিন পর সংশ্লিষ্ট নম্বরে কল করলে এক পিয়ন ধরে বলল, “ম্যাডাম লাঞ্চে আছেন।” লাঞ্চ শেষে পরদিন তিনি ফোন করে জানালেন, তল্লাশি চলছে। দ্রুত ফলাফল জানা যাবে। আরও ৭ দিন পর ফোন করে জানলাম নো রেজাল্ট। এবার আমি বগুড়া থেকে ঢাকা গেলাম। বিমানে কর্মরত আমার চাচাতো ভাইয়ের শরনাপন্ন হলাম। তিনি বহু খোঁজ খবর করে জানালেন লাগেজটি হিথ্রোতে আছে। এক মাস পর সেটা হাতে পাওয়ার পর দেখলাম লাগেজ ভাঙা। কিছু পণ্য নেই। ক্ষতিপূরণ দাবী করে আবেদন করলাম। তদবির করে সেটা পেলামও। কিন্তু বিমান আমার যে সময় ও শ্রম কেড়ে নিলো সেটা আমার যাত্রার আনন্দকে বিড়ম্বনায় রূপান্তরিত করলো। এটা ছিলো আমার জন্য এক ভীতিকর অভিজ্ঞতা। এর পরের অভিজ্ঞতাটা স্বপ্নের মতো। দুই মাস পর কানাডা ফেরার পথে ঢাকা এয়ারপোর্টে বিমানের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা এবং তৎপরতা ছিলো বিস্ময়কররকম ভালো। আমার মনে হলো হাতে চিমটি কেটে দেখা উচিৎ আমি ঠিক দেখছি কিনা। স¤প্রতি টরোন্ট থেকে বিমানে ঢাকা ভ্রমণের সময় একই রকম ভালো অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন আমার এক বন্ধু।

উপরে বর্ণিত অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতাগুলোর সারমর্ম এই যে সেবা বলতে যা বুঝায় সেটা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স রপ্ত করেনি। বরং হয়রানি শিল্পে বুৎপত্তি অর্জন করেছে। উন্নত প্রশিক্ষণে কি কাজ হতে পারে? না, সে সম্ভাবনা শূন্য। আমি একবার এমিরেটস এ ঢাকা থেকে টরোন্ট আসার তারিখ বদল করতে তাদের ঢাকা অফিসে ফোন করেছিলাম। কয়েক দফা যাদের সাথে কথা বললাম তাদের সবাই বাংলাদেশি। কথা বলে বুঝলাম, তারা অমনোযোগী ও অপেশাদার; অনেকটা বাংলাদেশের সরকারি অফিসে কর্মরতদের মতো। ঐ কর্মকর্তারা যখন অন্য কোনো দেশে এমিরেটস এর অফিসে বদলী হয়ে যান তখন পূর্ণ পেশাদার হয়ে ওঠেন। সমস্যাটা আসলে বাংলাদেশিদের মানসিক গঠনে। এই লেখার শুরুর দিকে দক্ষ ও নিষ্ঠাবান জনবল আমদানীর কথা বলা হয়েছে। এটা আমার একটা সুপারিশ মাত্র। এতে কতোটা কাজ হবে সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করার সুযোগ আছে। এ প্রসঙ্গে প্রচলিত একটা গল্প বলা যাক।

এক সরকারি অফিসে একজন নতুন বড় বাবু এলেন। প্রথমেই তিনি ঘুষের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিলেন। কিন্তু একজন কর্মচারীর ঘুষ খাওয়া বন্ধ করতে পারলেন না। ধরা যাক তার নাম রহিম মিয়া। বিভিন্ন বিভাগে বদলী করেও তাকে ঠেকানো গেলো না। অবশেষে তাকে এমন একটা কাজে পাঠানো হলো যেখানে ঘুষ খাওয়ার সুযোগ নাই। নদীর পাড়ে একটা ঘর তৈরি করে তাকে সেখানে বসিয়ে দেওয়া হলো। রহিম মিয়ার দায়িত্ব হলো নদীর ঢেউ গোনা। নদীতে সারাদিন কয়টা ঢেউ বয়ে যায় তা খাতায় লিখে রাখেন তিনি। সকাল ৯টায় অফিস শুরু হয়ে ৫ টায় শেষ হয়। কিন্তু রহিম মিয়া তার অফিসে যান ভোর ৬ টায়। ফেরেন সন্ধ্যা ৬ টায়। এমনকি ছুটির দিনও তিনি অফিস করেন। বর্ষা, খরা, ঘূর্ণিঝড় কিছুই তাকে ঠেকাতে পারে না। বরবাবু তার এই অভূতপূর্ব পরিবর্তনে মুগ্ধ হয়ে তাকে শাস্তিমূলক পদায়নের গ্লানি থেকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং মূল অফিসে কাজ শুরু করার আদেশ জারি করলেন। কিন্তু রহিম মিয়া আসতে রাজি নন। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো নতুন পদে তার আয় বেড়েছে কয়েক গুণ। নদীতে নৌকা চলার সময় ঢেউ ভেঙে যায়। রহিম মিয়া নির্ভুলভাবে ঢেউ গুনতে পারেন না। তাই তিনি সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অপরাধে নৌকার মাঝিদের জরিমানা করেন। নিজের টাকা খরচ করে সরকারি রশিদ ও সীল তৈরি করে নিয়েছেন তিনি। রশিদের শিরোনাম- তরঙ্গ ভঙ্গ জরিমানা।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা