অনলাইন ডেস্ক : করোনাকালে নিম্নআয়ের মানুষের কর্মহীনতা বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের কর্মসূচী দিয়ে তাদেরকে সহায়তা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ত্রান সহায়তা ছাড়াও নগদ অর্থ বিতরন করেছে সরকার। কিন্তু সরকারের এসব কর্মসূচীর পরও গরীব অসহায় নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট কমেনি। কাজের সুবিধা কমে যাবার কারনে নতুন করে বেকার হয়েছেন অনেকে। তাদের অনেকেই বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন।
বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৮-২০১৯ অর্থবছর শেষে দেশে তিন কোটি ২৮ লাখ মানুষ দরিদ্র ছিল। করোনাকালে দেশে নতুন করে আরো এক কোটি ৬৩ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (বিআইডিএস)। সেই হিসাবে দেশে এই করোনাকালে পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ বেঁচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি সংস্থা করোনা পরিস্থিতির কারনে গ্রামীন জনপদে মানুষের জীবনে যে কষ্ট নেমে এসেছে তার একটি চিত্র দিয়েছে। সংগঠনটি মে মাসের মধ্যভাগ থেকে জুন পর্যন্ত আট বিভাগে ৩৭ জেলার মোট ৮৩৪ জন দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষের ওপর এক জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে দেখা গেছে— লকডাউনের সময় দেশের ৯৮ দশমিক ৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষ কাজ হারিয়েছেন। প্রায় ৮৭ শতাংশ দরিদ্র মানুষের খাবার পেতে প্রচণ্ড বেগ পেতে হয়েছে। ৫ শতাংশ মানুষ এক বেলা খেয়েছেন; দুই বেলা অভুক্ত থেকেছেন। অধিকাংশ শিশু, গর্ভবতী মা স্বাভাবিক খাবার ও পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ৮৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষ দাবি করেছেন—সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে পাওয়া খাদ্যসহ অন্যান্য সহায়তা ছিল খুবই অপ্রতুল। এই দুর্দশা লকডাইন উঠে যাওয়ার পরও তেমন একটা উন্নতি হয়নি। খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। সংগঠনটি তাদের রিপোর্টে বেশ কয়েকটি কেস-স্টাডিও দিয়েছে।
৫০ বছর বয়সি দিপালী রংপা। গারো পাহাড়ে তার বসবাস। লকডাউন শুরুর পর এই দিনমজুরের সব কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তখন চার সদস্যের পরিবার নিয়ে বিপদে পড়েন দিপালী। কিছুদিন জমানো সামান্য টাকা দিয়ে চলেন। তা-ও ফুরিয়ে যায় কিন্তু লকডাউন ওঠে না। কাজও মেলে না। তাই বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে বিক্রি করে কোনো রকম চলেছেন। ক্ষুধা মেটাতে বনের আলু সংগ্রহ করেছেন প্রায় প্রতিদিনই। শুধু দিপালী রংপা নন। শেরপুরের ঝিনাইগাতীর টিলা ও বনভূমিতে গারো ও হাজং জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯৫ শতাংশ পরিবারের একই দশা। তারা সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে কিছু সাহায্য পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল খুবই সামান্য।
কুড়িগ্রামের উলিপুর পৌর শহরে মর্জিনা টি স্টলের কর্মচারী ২৩ বছরের আমিনুল ইসলাম। মহামারির কারণে লকডাউনে বন্ধ হয়ে যায় চায়ের দোকান। চাকরি হারিয়ে ছোট্ট শিশু ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন এই তরুণ।
আমিনুল, দিপালীর মতো গৃহকর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, ভ্যানচালক, ট্যাক্সিড্রাইভারসহ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক পেশায় কর্মরত নিম্নআয়ের প্রায় সবাই মহামারি করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নড়বড়ে হয়ে গেছে তাদের খাদ্য নিরাপত্তা। আয় উপার্জন হারিয়ে নিম্নআয়ের আরো বহু মানুষ দারিদ্র্য রেখার নিচে চলে আসার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘যারা দরিদ্র আছেন এবং নতুন করে যারা দরিদ্র হচ্ছেন করোনাকালে তাদের লড়াইটা হবে বেঁচে থাকার। এই লড়াইয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের দায়িত্ব রাষ্ট্রের নিতে হবে। নতুন যারা দরিদ্র তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন তাদের তালিকা প্রণয়নে মাঠপর্যায়ের এনজিও কর্মীদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা তালিকা প্রণয়নে সমন্বয় করতে পারেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকার দরিদ্র পরিবারগুলোকে ঈদ উপলক্ষ্যে দুই হাজার পাঁচশত করে টাকা দিয়েছিল। সঠিক তালিকা করে দরিদ্র ও দারিদ্র্যসীমার নিচে যারা আছেন তাদের এই সাহায্য আরো কয়েক মাস দেওয়া উচিত।’ মহামারির এই সময়ে শিশুরা যাতে পুষ্টিহীনতায় না ভোগে সেক্ষেত্রে স্কুলের ‘মিড ডে মিল’ চালু অথবা মায়েদের সমিতি করে শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার বিতরণ করারও পরামর্শ দেন সাবেক এই গভর্নর। তিনি বলেন, সরকার যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তা দ্রুত মানুষের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। সহায়তা বণ্টনে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার এনজিওগুলোকে আরো বেশি করে সম্পৃক্ত করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে দিশেহারা মানুষ এই মুহূর্তে বন্যার কারণে আরো বিপন্ন বোধ করছে। বন্যা প্রলম্বিত হলে চরসহ নিম্নাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের বাড়িঘর, পুকুরের মাছ, গবাদি পশু ও ফসল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আরো নিঃস্ব হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকারের পাশাপাশি অসহায় এসব দুঃখী-দরিদ্র মানুষের পাশে সবাইকে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘এই সংকটকালে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে সাহায্য করতে হবে। পাঁচ কোটির বেশি মানুষকে প্রতিদিন খাদ্য দেওয়া বেশি দিন সম্ভব নয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকার বৃহত্ ও ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য যে প্রণোদনা ঘোষণা করছে তা দ্রুত ছাড় দিতে হবে। তা না হলে আবারও নতুন করে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়বে।’ ড. নাজনীন বলেন, ‘যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা যেমন ছোট ব্যবসায়ী, দোকানদার, হকার এরকম উদ্যোক্তাদের মোবাইল পরিষেবার মাধ্যমে ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া যেতে পারে। যাতে তারা এই সময়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন।’