মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
সাতাশ.
যারা শিক্ষা বিভাগে কখনো কাজ করেননি, এমন কারো সাথে কথা বলে আমার বারবার মনে হয়েছে, তারা মনে করে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর চেয়ে ধনী প্রাইভেট স্কুলে পড়ানোটা অনেক বেশি সহজ। এটা সত্য, ওদের ঐ ভাবনাটার কিছু সত্যতা আছে। ওমন প্রাইভেট স্কুলে চকচকে ও ভালো ভালো সুযোগ সুবিধা থাকে এবং নিয়ম শৃংখলার বিষয়টাও প্রশংসার দাবী রাখে। কিন্তু ওটার মধ্যে একটা ব্যবস্যা থাকে, বিষয়টা বিশেষভাবে বুঝা যেতো যখন ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মা’র সাথে ওদের সন্তানদের বিষয়ে কথা হতো। হাজার হাজার ডলার টিউশন ফি দেবার পর যদি কখনও কোনো বাবা-মা দেখতো তার সন্তান খুব ভালো ফলাফল করছে না, তখন তারা খুব বেশি হতাশ হয়ে পড়তেন। সন্তানের বিষয় নিয়ে শিক্ষক আর বাবা-মা’র কথোপকথনের পর দেখা যেতো অনেক সময়ই বাবা-মা’রা এক তরফাভাবে শিক্ষকদের ওপর দায়ভার চাপিয়ে দিতেন এবং অনেক সময়ই কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করে দিতেন এমনকি অনেক সময় হুমকিও দিতেন যে তাদের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার ফলাফল ভালো না হলে তারা তাদের অন্য স্কুলে ভর্তি করাবেন। আমি সব সময়ই ছাত্রছাত্রীদের আসল চিত্রটা তাদের বাবা-মা’র কাছে উপস্থাপন করতাম। আমার যদি কখনও মনে হতো কোনো ছাত্র বা ছাত্রীর পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফলাফল না হওয়ার জন্য তার পরিবারও কিছুটা দায়ী, তাহলে আমি অকপটে সেটা সেই বাবা-মা’কে স্মরণ করিয়ে দিতাম। আর এটা অনেক সময়ই অনেকের ভালো লাগতো না, আবার এটা অনেক সময় তাদের অর্থের দম্ভকে হোঁচট খাওয়াতো।
মাঝে মধ্যে আমার পড়ানোর ধরনের জন্য ওয়েস্ট পয়েন্ট গ্রে’র রক্ষণশীল কর্তৃপক্ষের কাছে আমাকে বিড়ম্বিত অবস্থার মধ্য পড়তে হতো। ওয়েইনী নামের এক ছাত্রের কিছু বিষয় এখানে উল্লেখ করতে ইচ্ছে করছে। সে প্রায় নিয়মিতই স্কুলের পোষাকের নিয়মটা ভাংগার চেষ্টা চালিয়ে যেতো। দেখা যেতো সে প্রায়ই তার টাইটা ঢিলা করে রাখতো আর বেল্টের সাথে লটকে থাকা একটা চেন বেঁধে রাখতো। সে দেখতে সুদর্শন ছিল, আর তাকে দেখেই মনে হতো সে আত্মপ্রত্যয়ী ঘরানার একজন যার মধ্য এক বিপ্লবী ভাব কাজ করে। তার পোষাক পরা নিয়ে অসংখ্য বার কথা শোনার পর একদিন ওয়েইনী আমাকে বলেছিল, ‘স্যার, এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আমার বাহ্যিক পোশাক নিয়ে সব সময় কথা বলা হচ্ছে, আমাকে যদি এ কারণে বারবার কথা শুনতে হয়, তাহলে তো এটাও নিয়ম আছে, মেয়েদের স্কার্টটা কখনো তাদের হাঁটুর এক ইঞ্চি ওপরে উঠবে না। তারাতো কখনো সেই নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করে না, তাদেরকে এ ব্যাপারে কিছু বলাও হয় না। কিন্তু কেনো শুধু আমাকে ধরা হচ্ছে, বিষয়টা কি একপেশে হয়ে যাচ্ছে না!’
স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের লেখা নিয়ে একটি পত্রিকা বের করা আর সেটা দেখভালের দায়িত্ব ছিল আমার। এই দায়িত্বটা পালন করার জন্য আমি সেই সব লেখা সংগ্রহের ব্যবস্থা করতাম যেগুলো সত্যি সত্যি ছেলেমেয়েরা পড়তে ভালোবাসতো, আমি কখনো বাবা-মা’রা সন্তানদের জাতে তোলার জন্য যেসব লেখা পড়াতে চাইতেন, অথচ সেগুলো তাদের সন্তানদের কাছে নিরাশ ও নিরান্দময় ঠেকতো ওমন কোনো লেখা আমি কখনো ঐ পত্রিকায় রাখতাম না। আমি একদিন ওয়েইনী’কে কাছে ডেকে বললাম, সে যে কারণের জন্য ‘একপেশে’ শব্দটা ব্যবহার করেছে, সেটা নিয়ে কি একটি লেখা লিখতে পারবে। আমার কথা মত সে লিখেছিল, তার লেখাটা ছিল কিভাবে পুরুষ শিক্ষকরা ছাত্রীদের ছোট হয়ে যাওয়া স্কার্ট নিয়ে কথা বলতে অস্বস্তিবোধ করে। বিষয়টা সবাই বুঝতো, কিন্তু কেউ এ ব্যাপারে কথা বলতো না। ওয়েইনী’ই এই বিষয়টার ওপর প্রথম আলোকপাত করে।
আমি মনে করি, যখন ওয়েইনী’র লেখাটা স্কুলের পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, স্কুল কর্তৃপক্ষের যেভাবে বিষয়টা নিয়ে ভাবা উচিৎ ছিল তারা তেমন কিছু করে নি। তারা স্কুলের নিয়মের প্রতি অবজ্ঞা জানানোর জন্য ওয়েইনী’কে শুধু সতর্কই করে দেয় নি, বরং স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত পত্রিকাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। ওয়েস্ট পয়েন্ট গ্রে স্কুলের এই সিদ্ধান্তটা আমাকে খুবই ব্যথিত করেছিল, আর আমি তখনই বুঝে গিয়েছিলাম আমার জন্য শিক্ষক হিসেবে কাজ করার উপযুক্ত জায়গা সেটা নয়, আর আমিও তাদের জন্য যোগ্য কোনো শিক্ষক নই। ওর কিছুদিন পরেই আমি ভ্যাংকুভারের পাবলিক স্কুলে শিক্ষকের চাকুরী নিয়েছিলাম।
তারপরও আমি জোর দিয়েই বলতে চাই, ওয়েস্ট গ্রে পয়েন্ট এর দিনগুলো আমি খুবই উপভোগ করেছিলাম। ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকরা সত্যিই খুবই মেধাবী আর একাগ্রচিত্তের ছিল, সেই সাথে সেই শুরুর সময় স্কুলটা তার সব প্রতিক‚লতা জয় করে ভালোভাবে সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। এখনো আমার খুব ভালো লাগে যখন দেখি ওয়েস্ট পয়েন্ট গ্রে একাডেমী সব দিক দিয়েই ব্রিটিশ কলম্বিয়ার একটি সেরা স্কুল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
প্রাইভেট শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আমার মধ্যে একটা নেতিবাচক অবস্থান তৈরী হয়েছিল যদিও আমার নিজের স্কুলে পড়ার সময় সেটা আমার নজরে পড়েনি। ব্রেবফ এ আমি দেখেছি ছাত্র ভর্তির প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ ছিল মেধার ভিত্তিতে। অন্যদিকে কানাডার অনেক স্কুলের মত ওয়েস্ট পয়েন্ট গ্রে’তে ভর্তির প্রক্রিয়াটা শিক্ষার্থীর মেধার চেয়ে টিউশন ফি’র উপরই মূলত নির্ভর করতো। যদিও কিছু বৃত্তি বা বার্সারীর ব্যবস্থা থাকতো, কিন্তু অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই খুবই সুবিধাসম্পন্ন জীবন যাপন করতো, গ্রীষ্মে হয়তো তারা টেনিস ক্যাম্পাসে যেতো বা ইউরোপ ভ্রমণ উপভোগ করতো। এ ধরনের অনেক ছেলেমেয়েদের আমি ওয়েস্ট পয়েন্ট গ্রে’তে পেয়েছি। কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগতো যখন তাদের মধ্যে বস্তুবাদী ভাবনার বিষয়টা খুব বেশী প্রকট আকারে দেখা যেতো। মাঝে মধ্যে আমার কানে আসতো, কেউ হয়তো আলাপ করছে তারা লটারীতে টাকা জিতলে কী করবে, মাঝে মাঝে আমার মনে হতো তারা অর্থনৈতিকভাবে একেবারে বঞ্চিত কোনো পরিবেশে বড় হওয়া সব শিশুর দল। তারা যে লটারীর স্বপ্ন দেখতো, তা কিন্তু ছিল দশ বা বিশ মিলিয়নের, তারা কখনো এক মিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন দেখতো না। তাদের সেই টাকা খরচের ভাবনার মধ্যে কিন্তু থাকতো প্রমোদ তরী আর ব্যক্তিগত জেট বিমানে ঘুরে বেড়ানো।
আমি যখন আমাদের সমাজের উপার্জন বৈষম্যের বিষয়টা আলোচনা করি, আমার প্রায় মনে পড়ে সেই সব ছেলেমেয়ে আর তাদের পরিবারের কথা যাদের সাথে আমার দেখা হয়েছিল সেই স্কুলে পড়ানোর সময়। অভিভাবক শিক্ষক নৈশভোজে আমি যখন অভিভাবকদের মুখোমুখি হতাম, তখন দেখেছি তারা ব্যক্তিগত জীবনে সবাই সফল আর কঠোর পরিশ্রমী। তাদের সেই অর্থ সম্পদ ছিল তাদের সম্মান নির্ধারণের জায়গা। আর তাদের ছেলেমেয়েরা তাদের আশেপাশের বৃহৎ সমাজের সাধারণ মানুষদের জীবনটা কেমন তার সম্পর্কে কোন জ্ঞানই রাখতো না।
আমার বেড়ে উঠার সাথে সাথে আমি ধনীদের অনেক ছেলেমেয়েকে দেখেছি। আমি নিজেও অনেক সুযোগ সুবিধার মধ্যে বড় হয়েছি, এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে পারি, আমি আমার বাবার সাথে ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু বাবাকে কখনো বলতে শুনেনি যে অর্থ সম্পদ উপার্জনই হচ্ছে জীবনের প্রধান লক্ষ্য। জীবনে একবারও বাবাকে এমন কথা উচ্চারণ করতে দেখেনি। বরং আমি একবার আনন্দচ্ছ¡লে বলে ফেলেছিলাম, আমার যদি নিজের একটা জেট বিমান থাকতো আর আমি যদি নিজের মতো করে ক্যারিবিয়ান দ্বীপে বাস করতে পারতাম!!! আমার এই আনন্দ-উচ্ছ¡াসটা বাবাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল। একবার যখন আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তিনি তার সন্তানদের মধ্যে কি ধরনের মূল্যবোধ দেখতে চান। এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কখনোই তাদেরকে বস্তুবাদী চিন্তার দাস হিসেবে দেখতে চাই না। আমি চাই তারা সব সময় ভালো খাবার খাক, ভালো বই পড়ুক আর তাদের ছুটির দিনগুলো তারা উপভোগ করুক। এটাই আমার চাওয়া। কিন্তু তাদের কেউ যদি বস্তুবাদী ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে বা ভোগ বিলাসের কাছে নতজানু থাকে তাহলে বুঝবো তারা দাসত্বের জীবন বরণ করে নিয়েছে।’ সত্যি বলতে কি, তিনি তার এই ভাবনার মূল্যবোধগুলো তার সন্তানদের জীবনে ঢুকিয়ে দিতে সফল হয়েছিলেন।
আমার বাবাকে প্রায়ই যে বিষয়গুলো অস্বস্তিতে রাখতো সেগুলো থেকে কিন্তু পাবলিক শিক্ষা ব্যবস্থাও একেবারে মুক্ত ছিল না। ওয়েস্ট পয়েন্ট গ্রে একাডেমীর পর আমি ভ্যাংকুভারের স্যার উইনস্টন চার্চিল সেকেন্ডারী স্কুলে পড়ানো শুরু করি। ওখানকার ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত ধনী পরিবার থেকে আসতো না, কিন্তু অনেককে দেখেছি সেই বস্তুবাদী চিন্তা চেতনার আবর্তে নিজেদের ডুবিয়ে ফেলতে।
স্যার উইনস্টন চার্চিল স্কুলেই আমি একটু দূর থেকে শুনেছিলাম একজন আরেক জনকে বলছে, ‘আমার বাবা একটা নতুন চাকরী পেয়েছে, আর এই চাকরী পেয়েই বাবা একটা মার্সিডিজ গাড়ী কিনেছেন।’ আমি লক্ষ্য করেছিলাম ছেলেটি এর জন্য খুবই গর্ব অনুভব করছিল আর তার এই আনন্দের সংবাদটা অন্য কাউকে সে না
বলে থাকতে পারছিল না।
আমি তাদেরকে কাছে ডেকে বলেছিলাম, ‘এসো, এই বিষয়টা নিয়ে একটু কথা বলা যাক। অবশ্যই একটা সুন্দর নতুন গাড়ী থাকা মানে সেটা অনেক আনন্দের ব্যাপার। কিন্তু দিনের শেষে যখন তুমি একটু ভাববে, তখন দেখবে সেটা শুধুই একটা গাড়ী, যেটার সাহায্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া যায়।’ তারপর আমি তাদের আরো বলেছিলাম, ‘অনেক সময় তোমার বাবা চাকুরীর যে পদোন্নতি পেয়েছেন এর জন্য তাকে তার জীবনের সব শখ আহ্লাদ ত্যাগ করতে হয়েছে। তিনি হয়তো অনেক বেশী দায়িত্ব পেয়েছেন, কিন্তু এর জন্য তাকে কিন্তু এখন অনেক বেশী চাপের মধ্যে থাকতে হয়। তুমি এখন একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবে তোমার বাবা তার কাজ নিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশী চিন্তিত থাকেন। সেই সাথে তিনি কিন্তু এখন আরো বেশী পরিশ্রম করেন আর আগের চেয়ে আরো বেশী সময় ধরে কাজ করেন। তুমি হয়তো তোমাদের ড্রাইভ ওয়ে’তে একটা সুন্দর আর নতুন গাড়ী পেয়েছো, কিন্তু তুমি তার জন্য তোমার বাবার সাথে কাটানোর জন্য আগের মত বেশী সময় পাচ্ছো না। তোমাদের শুধু আমি একটু ভাবতে বলছি, এমন স্বপ্ন আর উচ্ছ¡াস সত্যিই তোমাদের কতটুকু আনন্দ দিচ্ছে।’
আমি বিভিন্ন সময়ে জীবনের চাওয়া পাওয়া আর মূল্যবোধ বা স্বপ্ন নিয়ে বিভিন্নভাবে তাদের বলার চেষ্টা করেছি আর সব সময় চেয়েছি আমার ছাত্র ছাত্রীরা যেন জীবনে সত্যিকারের সৌন্দর্যটা খুঁজে পায়, এবং আমার ভাবতে ভালো লাগে, এদের মধ্যে আমি অন্তত কিছুজনকে পেয়েছি যারা আমার এই কথাকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করে সেই অনুযায়ী তাদের জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছে। (চলবে)
মনিস রফিক : চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো, কানাডা