Home কলাম সবার ভাষা আর সংস্কৃতি যেন আরো শক্তিশালী হয়

সবার ভাষা আর সংস্কৃতি যেন আরো শক্তিশালী হয়

মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

 

ছিচল্লিশ.
সেই রাতে যখন আমি সবার সাথে আমার বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠেছিলাম, তখনই আমার ভেতরের সত্ত¡া আমাকে আস্তে করে জানিয়েছিল, আমার কঠিন কঠোর যুদ্ধ কেবল শুরু হলো। আমার বন্ধু বান্ধব আর প্রিয়জনদের সাথে আমার সামনে এগিয়ে যাবার রূপরেখা নিয়েও আমার মতানৈক্য চলছিল। আমার বন্ধুরা আমাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল, আমাকে আসল লড়াই করতে হবে সেই সময়ের পার্লামেন্ট সদস্য ভিভিয়ান বারবোট এর সাথে। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে বারবোট একজন শিক্ষাবিদ, নারীবাদী ও স্থানীয় হাইতিয়ান কমিউনিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে খুবই পরিচিত ছিলেন। তিনি লিবারেল মন্ত্রীসভার প্রভাবশালী মন্ত্রী পিয়েরে পেটিগ্রিউ’কে হারিয়ে পাপিনিউ এর সংসদ সদস্য হয়েছেন। ভিভিয়ান বারবোট যে কোনো দিক দিয়েই একজন শক্তিশালী প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন, আর আমি যদি সত্যি তাঁকে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে হারাতে চাই, তাহলে আমার সামান্যতম সময় নষ্ট করার মত কোনো সময় ছিল না।

আমার মনে হয়েছিল, আমার প্রথম কাজ হচ্ছে, খুবই অভিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটা কার্যকরী দল গঠন করা, যাদের মূল কাজ হচ্ছে নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্ব পালন। রেইনী আর ফ্রাংকো আমার এই কাজের জন্য সবচেয়ে যোগ্য ছিলেন, কিন্তু সেই সময়ে তারা দু’জনেই পূর্ব থেকেই অন্য এক কাজে যোগ দেবার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। আমার বন্ধুরা আর পরিবারের সদস্যরা এই নির্বাচনের শেষ দিকে প্রচুর সময় দেওয়ার সাথে সাথে অনেক খাটা খাটুনী করেছে, কিন্তু ফেডারেল নির্বাচনের সেই দীর্ঘ সময়ের লড়াইয়ে তাদেরকে প্রতিদিন কাছে পাবার প্রত্যাশা কোনোভাবেই আমার করা উচিৎ হবে না।

আমার প্রথম যে পদের জন্য লোক নিয়োগ করা খুব বেশী প্রয়োজন হয়ে পড়ে, সেটা ছিল একজন ক্যাম্পেইন ম্যানেজার নিয়োগ করা। আমার মনে হয়েছিল, এই পদের যোগ্য মানুষটিকে আমি আমার বিজয়ের সেই রাতে সেই বিজয় উৎসব কক্ষেই দেখেছিলাম। রেইনীই লুইস অ্যালেক্সান্ডার ন্যান্থিয়ার’কে এনেছিলেন ব্যালট পরীক্ষক হিসেবে কাজ করানোর জন্য। আমার ‘কাতিমাভিক’ এ কাজ করার সময় অটোয়াতে খুবই অল্প সময়ের জন্য তার সাথে কথা হয়েছিল। মাত্র ত্রিশ বছরেই অ্যালেক্স খুবই দক্ষতার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী প্রচরণায় দায়িত্ব পালন করেছিল। এ ব্যাপারে সে তার মা জ্যাকলিন ল্যান্থিয়ারের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা আর শিক্ষা দুটোই পেয়েছিল। জ্যাকলিন ল্যান্থিয়ার কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জ্যা ক্রেতিয়েন এর পক্ষে বলিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন। অ্যালেক্সের বেড়ে উঠা আর অভিজ্ঞতা আমার ভালোই লেগেছিল, সেই সাথে আমি আরো মুগ্ধ হয়েছিলাম, পরবর্তী নির্বাচনে আমাদের জয়ের ব্যাপারে তার ইতিবাচক মনোভাব আর কাজ করার ইচ্ছা দেখে। আমার আগামী নির্বাচনে জয়ের কৌশল নিয়ে তার সাথে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তার একটা ছোট্ট বাক্য আমার মনে ধরে গিয়েছিলো। আর সেই বাক্য শুনে তার প্রতি আমার ভালো লাগা বেড়ে গিয়েছিল অনেক গুণ। সে বলেছিল, ‘জাস্টিন, পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত, তুমি এমনভাবে চলবে বা কাজ করবে যেন সবাই মনে করে তুমি পাপিনিউ এর সংসদ সদস্য হয়ে গেছো।’

লিবারেল পার্টি থেকে নির্বাচন করার জন্য মনোনয়ন পাওয়ার লড়াই’য়ের সময়ও আমি এই কৌশলটা কিছুটা অবলম্বন করেছিলাম। প্রতিটি রেস্টুরেন্ট, প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব, যে কোনো উৎসব, ফান্ড রাইজিং, প্যারেড, ফ্যাশন শো, চিত্র প্রদর্শনী, বাজার, টাউন হল মিটিং অথবা পাপিনিউ’তে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমন যে কোনো অনুষ্ঠানে আমি সব সময় উপস্থিত থাকতাম। আমি মানুষের সাথে হাত মিলাতাম আর কথা বলতাম। তবে আমি কখনোই তাদের সাথে ভোট নিয়ে কোনো কথা বলতাম না, আর তখনো ভোটের কোনো তারিখও ঠিক হয়নি। আমি আসলে তাদের সাথে কথা বলতে চাইতাম, তাদের সাথে পরিচিত হতে চাইতাম। আমি বিশ্বাস করতাম, এর পর আমার নির্বাচনী প্রচরণায় তারা যখন আমাকে দেখবে, তখন তাদের কাছে একেবারে অপরিচিত কোন ব্যক্তি থাকবো না, আর ভোট দেবার সময় তারা যেন ভাবতে পারে, আমি তাদেরই একজন। কারণ যখন তারা ভোট দিতে যাবে, তখন নিশ্চয় মনে করবে, আমিই সেই ব্যক্তি যে তাদের যে কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তাদের সাথে কথা বলেছি, তাদের বিষয় জানতে চেয়েছি আর তাদের সাথে হাত মিলিয়েছি। আমার মনে হয়েছিল, মাঠ পর্যায়ে ভোটের জন্য কাজ করার জন্য এটাই হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল বা পথ, আর এই ভাবে আগামী নির্বাচনের পথে এগুনোর জন্য আমি আর অপেক্ষা না করে কাজে নেমে পড়লাম।

অনেক বছর ধরেই অ্যালেক্সের দাদা পাপিনিউ’তে একটা লন্ড্রী’র দোকান চালাতেন। ঐ এলাকার বেশীর ভাগ পরিবারই নিজেদের বাড়ীতে লন্ড্রী করার মেশিনপত্র বসানোর ক্ষমতা রাখতো না, ফলে ঐ জায়গাটা একটা স্থানীয়দের জমায়েতের স্থান হিসেবে গড়ে উঠেছিল। কারণ যারা লন্ড্রী করতে আসতেন, তারা প্রায় সবাই’ই লন্ড্রী মেশিনে কাপড় দিয়ে হয়তো কারো সাথে গল্পে মেতে উঠতেন, কেউ বা বই পড়তেন বা সেলাই করতেন। আমার মনে হয়েছিল, অ্যালেক্সই হচ্ছে সেই উপযুক্ত ব্যক্তি যে আমাকে ঐ জায়গার ভোটারদের সাথে ভালোভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে।

২০০৭ এর বসন্তের পর থেকে ২০০৮ এর অক্টোবরের সাধারণ নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত আমার প্রতিদিনের কাজই ছিল বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে হাজির হয়ে মানুষের সাথে কথা বলা। আমি বলছি না যে, ঐ দেড় বছরে আমি পাপিনিউ’র প্রতিটি ভোটারের সাথে কথা বলেছি। তবে আমি এটা বলছি, আমি যদি সবার সাথে কথা বলতে না পারি, সেটা কিন্তু আমার চেষ্টার ত্রুটির জন্য নয়।

যেখানেই আমি উপস্থিত হতাম এবং যার সাথেই আমি কথা বলতাম, আমি সব সময়ই চাইতাম তাদেরকে রাজনীতি নিয়ে আমার ভাবনাগুলো জানানোর। অনেকেই রাজনীতি মানেই দলে দলে বিভাজনের কথা বলে বা নিজের দলের কাজকর্ম বা পরিকল্পনাকে ভালো বলে প্রতিপক্ষকে ছোট করতে চাই। কিন্তু আমি কখনোই ওমনটি করতে চাই নি এবং আমি কখনোই ঐ পথে হাঁটতে চাই নি। আমার ভিতর যে সব মূল্যবোধ কাজ করে অথবা আমি আমার চারপাশে যেসব আদর্শের বাস্তবায়ন দেখতে চাই, আমি সেগুলো নিয়েই মূলত পাপিনিউ’র সবার সাথে কথা বলতাম। কে কোন ধর্মের বা বর্ণের অথবা কোন ভাষার সেটা কখনোই আমার বিবেচ্য ছিল না। আমি বিশ্বাস করতাম মানুষ হিসেবে আমাদের সবারই কিছু বিশেষ মূল্যবোধ আছে, যেগুলো জাতি ধর্ম আর সংস্কৃতির গণ্ডীতে কখনোই আবদ্ধ থাকে না।
ভিলেরে এলাকায় কাজ করতে গিয়ে আমাকে বেশ কিছু আদর্শিক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কানাডায় কুইবেকদের অবস্থান আর মর্যাদা নিয়ে বারবার অনেক প্রশ্নের উত্তর আমাকে প্রতিনিয়ত দিতে হতো। আমি প্রায়ই একটা দরজায় গিয়ে নক করতাম। আমি সব সময়ই দেখতাম দরজাটা খোলা থাকতো, দেখতাম ভেতরে একজন বসে আছেন। ভেতর থেকে আমাকে দেখে একটা আবছা আলোর পরিবেশ থেকে বলে উঠতেন, ‘আমি কখনোই তোমাকে ভোট দিবো না।’ তারপর ভিতর থেকে আরো কয়েকটি কণ্ঠস্বর ভেসে আসতো, আর তারা জানাতো, ‘আমরা তোমার মতকে সমর্থন করি না।’

পাপিনিউ’তে সাধারণ মানুষের সাথে জাস্টিন ট্রুডো

‘ওহ…’ আমি কিছুটা বন্ধুসুলভ হাসি হেসে বলতাম, ‘তোমরা কি পরিবেশ বিষয়ে আমার সাথে একমত নও? নাকি সামাজিক অনুষ্ঠান, শিক্ষা বা স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে একমত নও? না, এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেটাতে বলা হচ্ছে সবার জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধা আছে? নাকি, আমি মি. হারপারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি বলে?’
‘না, না, ঐ সব ব্যাপারে আমরা তোমার সাথে একমত। আমরা শুধু কুইবেকের ব্যাপারে তোমার সাথে একমত হতে পারছি না।’

‘ও আচ্ছা, তাহলে ওই একটা বিষয় ছাড়া এই কুইবেকে ফরাসী ভাষা ও সংস্কৃতির রক্ষা করা বিষয়ে তাহলে আমাদের মধ্যে আর মতানৈক্য নেই। আমি একান্তভাবে মনে করি, যেখানেই আমাদের সন্দেহ বা বুঝার সমস্যা থাকবে, সেখানেই আমরা একমত হবো না, আমি এটাও মনে করি, আমরা যদি আমাদের একমত না হওয়া বিষয়গুলো নিয়ে ভালোভাবে আলোচনা করি, তাহলে এর মধ্য দিয়ে কিন্তু একটা সুন্দর গ্রহণযোগ্য পথ বের হয়ে আসবে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সবার ভাষা ও সংস্কৃতি যেন আরো শক্তিশালী হয় এবং একে অপরের ভাষা এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে যেন সবাই জানতে পারি। আমি কখনোই নিজের মধ্যে গুটিয়ে থেকে একে অপরের সম্পর্কের মধ্যে দেয়াল দেয়াকে মানতে পারি না।’

এভাবেই আমাদের কথপোকথন চলতো, আমি তাদেরকে উপলদ্ধি করিয়েছিলাম, তাদের সাথে কথা বলে সত্যিই আমার খুব ভালো লাগতো, আমি তাদেরকে এও বলতাম, তারা আমাকে ভোট দিক আর নাই দিক, তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমি অটোয়ায় বলিষ্ঠভাবে কথা বলবো।

আমি সব সময় সতর্ক থাকতাম যেনো কোনভাবেই সেই সময়ের পাপিনিউ এর সংসদ সদস্য ভিভিয়ান বারবোট আমার কোনো কাজে অসম্মানীত না হন। তিনি তাঁর সারাজীবনে যে সব কাজ করেছেন, তার প্রতি সব সময় আমার গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল। আমি একান্তভাবে সব সময়ই বিশ্বাস করি, ব্যক্তিগত আক্রমণ চালিয়ে কখনোই ভোটারদের ভালোবাসা আর সমর্থন পাওয়া যায় না। (চলবে)

Exit mobile version