মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।
কুড়ি.
১৯৬২ সালে সত্যজিৎ রায় ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিটি বানালেন। অনেক দিক দিয়ে ছবিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রথম সত্যজিৎ নিজের কাহিনী নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরি করলেন এবং এই প্রথম তিনি ছবিতে রং নিয়ে এলেন। আর এই প্রথম কাহিনীর সাথে সময় এবং স্থানের সামুজ্য আনলেন। এখানে রঙের এক বিশাল ভূমিকা আছে। দুই বোন, অনিমা আর মনীষার শাড়ি, অলংকার, ঠোঁটের রং আর কপালের টিপ একই সঙ্গে তাদের সামাজিক অবস্থান, তাদের চরিত্র এবং জায়গা বা পরিবেশের কথাও বলে দেয়। উজ্জ্বল রঙ শুধু সেই অশ্বারোহী শিশুটির গায়ে যাকে কোন সমস্যা বা ভাবনা আক্রমণ করেনি। শুধু তাই নয়, প্রতিটি ছোটো বা বড় চরিত্রের পোশাকেও তাদের সামাজিক পরিবেশ আর মূল্যবোধ ধরা পড়ে; সেই সঙ্গে ঘন্টা দুয়েকের সীমানায় দার্জিলিং পাহাড়ের দৃশ্যের ঘন ঘন বদল কখনো রোদ, কখনো কুয়াশা, পাইনের সারি, উঁচু নিচু পথ, ম্যাল প্রতিটিই এই রঙিন ছবিতে কাহিনীর চরিত্র হয়ে গিয়েছে। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সম্বন্ধে আরো একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হল, এই ছবিটা সম্পূর্ণই আউটডোরে শ্যুটিং হয়েছে। দশ রিলের ছবিটির জন্য সত্যজিৎ সময় নিয়েছেন মাত্র ছাব্বিশ দিন।
১৯৬২ সালেই সত্যজিৎকে অপ্রত্যাশিতভাবে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ‘অভিযান’ ছবির কাজ করতে হয়। মূলত সত্যজিতের বন্ধু বিজয় চট্টোপাধ্যায় ছবিটি তৈরির কথা ভেবেছিলেন এবং সত্যজিৎকে দিয়ে তিনি ছবিটির চিত্রনাট্যও তৈরি করিয়ে নিয়েছিলেন। শ্যুটিং লোকেশন দেখার জন্য বিজয় চট্টোপাধ্যায় এবং বংশী চন্দ্রগুপ্ত সত্যজিৎকে বাংলা-বিহার সীমান্তে অবস্থিত বীরভূমের দুবরাজপুরে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানকার, দৃশ্যপট বিশেষ করে মস্ত মস্ত পাথর ছড়ানো পাহাড় দেখে সত্যজিৎ অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ঐসব দৃশ্যগুলোকে কাজে লাগাবার জন্য চিত্রনাট্যের সংশোধন করেন। ‘অভিযান’ ছবির প্রথমদিনের শ্যুটিং এ সত্যজিৎ হাজির ছিলেন। বন্ধুকে কিছু পরামর্শও দিলেন। শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের অনুরোধে সত্যজিৎকেই এই ছবির নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। একশ পঞ্চাশ মিনিটের এই ছবিটি সত্যজিতের দীর্ঘতম সৃষ্টি। বিজয় চট্টোপাধ্যায়ের পরিকল্পনা মতোই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নরসিং চরিত্রের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর গুলাবি চরিত্রের জন্য সত্যজিৎ রায়ের ওয়াহিদা রহমানকে পছন্দ হয়েছিল। সেই সময় ওয়াহিদা রহমান বোম্বের নামকরা নায়িকা। একটি ছবির জন্য তিনি যে পরিমাণ পারিশ্রমিক নিতেন তাতে গোটা অভিযান ছবির কাজ হয়ে যাবে। তারপরও সত্যজিৎ রায় ওয়াহিদা রহমানকে অভিযানে অভিনয় করার জন্য পাঠালেন। ওয়াহিদা রহমানের কাছে সত্যজিতের বার্তা নিয়ে গেল বন্ধু বিজয় চট্ট্যোপাধ্যায় এবং অনিল চৌধুরী। সত্যজিতের ছবিতে অভিনয় করার জন্য ওয়াহিদা রহমান সাথে সাথে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ‘অভিযান’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য যে পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন তা ছিল সেই সময়কার বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ওয়াহিদার একদিনের উপার্জন। ‘অভিযান’ ছবিটি সকলকেই মুগ্ধ করেছিল এবং খুব ভাল চলেছিল।
১৯৬৪ সালের ১৮ মার্চ ঢাকায় এক চলচ্চিত্র উৎসবের শেষের দিনে ‘মহানগর’ এর প্রদর্শনী হয়। প্রবল উৎসাহে সেদিন বেশ কয়েক হাজার দর্শক টিকিটের জন্য লাইন দিয়েছিলেন; প্রচুর জনসমাগমে সেদিন এক ধরনের হাঙ্গামা শুরু হয়ে যায় এবং পুলিশকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য লাঠিচার্জ করতে হয়। ফলাফল স্বরূপ প্রায় ১৫০ জন আহত হয়। অতিরিক্ত প্রদর্শনীয় দাবিতে কর্তৃপক্ষ সেদিন সকাল দশটা থেকে পরের দিন সকাল ৪.৩০টা পর্যন্ত এক নাগাড়ে ছবিটির ১০ বার প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে।
১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার পল্টন ময়দানে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আপ্লুত সত্যজিৎ বলেছিলেন- ‘কয়েক বছর আগে যখন এখানে ‘মহানগর’ ছবিটি দেখানো হয়েছিল, তাতে এখানকার জনসাধারণ কি ধরনের আগ্রহ, কৌতুহল প্রকাশ করেছিল এবং তার ফলে কী ঘটনার উদ্ভব হয়েছিল, সে খবর আমার কানে যখন পৌঁছায়। আমি সে কথা বিশ্বাস করিনি, কিন্তু তারপর এখান থেকে বহু বন্ধু আমাকে চিঠি লিখে, খবরের কাগজের খবর কেটে পাঠিয়েছিলেন। ….. বিস্ময়ে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভাবতে পারিনি যে এটা হতে পারে। একজন শিল্পীর এর চেয়ে বড় সম্মান, এর থেকে গর্বের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না।’ ১৯৬৩-র ভারতের রাষ্ট্রীয় মানপত্র পেয়েছিল ছবিটি।
নরেন মিত্রের লেখা অবতরণিকা ও আকিঞ্চন গল্প নিয়ে ১৯৬২ সালে সত্যজিৎ শুরু করলেন ‘মহানগর’ ছবির কাজ। মাধবী মুখোপাধ্যায়কে আরতি চরিত্রের জন্য নেয়া হয়। ইতোপূর্বে মাধবী মৃণাল সেনের ‘বাইশে শ্রাবণ’ এবং ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণ রেখা’য় অভিনয় করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে উৎখাত হয়ে স্বপরিবারে মাধবী কোলকাতায় এসেছিলেন।
সত্যজিৎ রায় যখন ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য রবীন্দ্রনাথকে সুক্ষ্মভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। তখনই তিনি নষ্টনীড় গল্পের পান্ডুলিপিটা দেখেন। সেখানে পান্ডুলিপির মার্জিনে কবির হাতে লেখা ‘হেকেটি’ শব্দের উল্লেখ ছিল। যারা রবীন্দ্রনাথের জীবনটা একটু ভালভাবে পড়েছেন। তারা নিশ্চয় জানেন, রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বন্ধুদের কাছে তাঁর স্ত্রী কাদম্বরী দেবী গ্রিক দেবী ‘হেকেটি’ নামে পরিচিত ছিল। সেই হিসেবে সত্যজিতের কাছে নষ্টনীড় গল্পটি রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনীর একাংশ বলে মনে হয়েছিল। বাংলা ১৩০৮ সালে ভারতী পত্রিকা নষ্টনীড় তিন সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নষ্টনীড় ছবির শ্যুটিং শুরু হয়। সত্যজিৎ রায় ছবিটির নাম প্রধান চরিত্রের নামের সাথে মিল রেখে রাখলেন ‘চারুলতা’।
নষ্টনীড় এর পান্ডুলিপি দেখে সত্যজিতের মনে হয়েছিল এই কাহিনীতে রবীন্দ্রনাথের এক গহন আত্মকথার অনুভূতি কিছুটা চিত্রিত হয়েছে। পান্ডুলিপিতে এক নারীর মুখের ছবি দেখে সত্যজিতের সেই ধারণা আরো বিশ্বস্ত হয়। তাঁর গভীর বিশ্বাস ছিল চারু আর কেউ নয়। তিনি হচ্ছেন কাদম্বরী দেবী নিজে আর অমল রবীন্দ্রনাথের যৌবনের প্রতিচ্ছবি। হয়তো বাংলার সমাজে চিরকালই এমন প্রচ্ছন্ন প্রণয় বহমান।
কিশোর কুমারের গলা সত্যজিৎ খুব পছন্দ করতেন। ‘চারুলতা’ ছবির রবীন্দ্র সঙ্গীত, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ কিশোর কুমারকে দিয়ে গাওয়াবেন বলে ঠিক করলেন। সত্যজিৎ রায় কিশোর কুমারকে কলকাতায় আসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তখন তিনি এত ব্যস্ত ছিলেন যে, বেশ কিছু মাস তাঁর একটি দিনও ফাঁকা ছিল না। বিব্রত কিশোর কুমার সত্যজিৎ রায়কে বিশেষভাবে অনুরোধ করলেন বোম্বেতে যাওয়ার জন্য। সত্যজিৎ রায় বোম্বেতে গিয়ে কিশোর কুমারের কণ্ঠে গানটি রেকর্ডিং করলেন। এই গানে পিয়ানো বাজিয়েছিলেন সত্যজিৎ নিজেই। দেশী-বিদেশী সুরের মিশ্রণের কথায় তিনি বলেছিলেন, ‘দ্য পসিবিলিটিজ অফ ফিউজিং ইন্ডিয়ান এন্ড ওয়েস্টার্ণ মিউজিক বিগ্যান টু ইন্টারেস্ট মি ফ্রম চারুলতা অন। আই বিগ্যান টু রিয়ালাইজ দ্যাট, অ্যাট সাম পয়েন্ট, মিউজিক ইজ ওয়ান।’
১৯৬৫ সালে সত্যজিৎ রায় ‘নায়ক’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তৈরি করলেন। স্বভাবত উত্তম কুমার তখনই নির্বাচিত হলেন। এই ছবির জন্য উত্তম কুমারকে নির্বাচন করার খবর যখন বেরোল, তখন চারিদিকে এক শোরগোল পড়ে গিয়েছিল যে, সত্যজিৎ স্টার নিয়ে ছবি করার কথা বলে কম্প্রোমাইজ করছেন, অনেকে এমনও মন্তব্য করলেন যে, ‘সত্যজিৎ বাবু এবার পথে এসেছেন, এবার উত্তম কুমারকে নিয়ে ছবি করছেন।’ সত্যজিৎ রায় অবশ্য নিজেই মনে করেন, … বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে উত্তম কুমার ছাড়া আর কেউ পারেনি, পুরুষদের মধ্যে তাঁকে একমাত্র স্টার বলা যায়। উত্তম কুমারকে সত্যজিতের ভাল লাগতো তাঁর চরিত্রের সাবলীলতা, ব্যক্তিত্ব আর অভিনয়ের জন্য।
মূলত উত্তম কুমারের কথা ভেবেই সত্যজিৎ ‘নায়ক’ ছবির চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন। কারণ ছবিতে এমন এক অভিনেতার কথা বলা হয়েছে যে স্টার হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে গেছেন। উত্তম কুমারের কাজে সত্যজিৎ রায় খুবই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। পরিচালক যা চেয়েছিলেন উত্তম কুমার হুবহু সেটাই করতেন এবং অধিকাংশ শট একবারে ‘ওকে’ হয়ে যেতো। শ্যুটিং এর সময় উত্তম কুমার লোকেশনে চুপচাপ বসে থাকতেন। তেমন কারো সাথে কথা বলতেন না। মনে হত ধ্যানস্থ হয়ে ভাবছেন কিভাবে সত্যজিৎ রায় যা চাইছেন একেবারে সেটাই দেওয়া যায়। সত্যজিৎ রায় বার বার বলতেন, ‘অনেকের সঙ্গে আমি কাজ করেছি, কাজ করে আনন্দও পেয়েছি। কিন্তু উত্তমের মতো কেউ নেই, উত্তমের মতো কেউ হবেও না।’ ‘নায়ক’ ছবিতে বাংলা চলচ্চিত্রের মহাপরিচালকের সাথে মহানায়কের এক অদ্ভুত সমন্বয় ঘটেছিল।
নায়ক সম্পূর্ণরূপে উত্তম কুমার কেন্দ্রীক ছবি, তার উৎস, পরিণতি ও সাফল্যে তাঁর অবদান সত্যজিৎ রায় সব সময় কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করেছেন। উত্তম কুমার সত্যজিৎ রায়ের পরের ছবি ‘চিড়িয়াখানা’তেও অভিনয় করলেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিড়িয়াখানা কাহিনী অবলম্বনে এই ছবিতে উত্তম ডিটেকটিভ ব্যোমবেশ বক্সীর চরিত্রে অভিনয় করলেন। ছবিটির জন্য সত্যজিৎ রায় ১৯৬৮ সালে শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে ভারত সরকারের পুরস্কার পান।
‘চিড়িয়াখানা’র শ্যুটিং চলাকালীন সময়ে পুত্র স›দ্বীপ পিতার কাছে আবদার করলেন ছোটদের জন্য একটি ছবি তৈরি করার জন্য। সেই সময় উত্তম কুমারের অসুস্থতার জন্য বেশ কয়েকদিন শ্যুটিং বন্ধ ছিল। সেই অবসরে সত্যজিৎ রায় পুত্রের আবদার রক্ষার্থে ছোটদের ছবির চিত্রনাট্য নিয়ে ভাবতে লাগলেন। পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়ের কাহিনী থেকেই তিনি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ নামে একটি ছোটদের ছবির এক ধরনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই সময় ছবির বাজেট ছিল চার লক্ষ টাকা যা রীতিমত সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। রাজস্থানের দুটি বিখ্যাত কেল্লা দুই রাজার প্রাসাদ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ইনডোরে এ ছবির জন্য বিশাল সেট দর্শকদের আশ্চর্য করে দিয়েছিল। আউটডোরের শ্যুটিংগুলো হয়েছে বীরভূম, যোধপুর, জয়সলমির, বুন্দি ও কুফরি অঞ্চলে। যদিও শিশুদের জন্য ছবিটি তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু এর মধ্যে যে অন্তর্নিহিত অর্থ রাখলেন তিনি যা আমাদের প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি কটাক্ষ করে। অদ্ভুত আনন্দ দেওয়ার সাথে চিন্তিত দর্শকদের একটু গভীরতর বাণীও দিলেন সত্যজিৎ রায়। ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ‘গোপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির উপস্থাপনায় মনে হয় এটির আবেদন কখনো শেষ হবার নয়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৬৯ সালে সত্যজিৎ রায় ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র কাজ শুরু করেন। সত্যজিৎ রায়ের আধুনিক চলচ্চিত্র এটি। যার সময়কাল খুব সমসাময়িক। চার বন্ধু হঠাৎ কয়েকটি দিন একটু অন্য রকমভাবে কাটানোর জন্য শহর জীবনের নিজেদের ব্যস্ততা এড়িয়ে ছুটে যায় শান্ত প্রকৃতির কোলে। এই প্রকৃতির কোল সাধারণ সরল মানুষদের বাস। টাইটলস্-এ মাদলের ধ্বনি আর কয়্যার-এর মতো আদিবাসীদের উচ্চস্বর সঙ্গীতে যে তীব্র আনন্দের উন্মাদনা বা পত্রবহুল শাল অরণ্যের যে প্রাণচঞ্চল প্রতিশ্রুতি তার সঙ্গে বস্তুত এই চারটি চরিত্রের কোন যোগাযোগ ঘটে না। ফরেস্ট বাংলাতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ল্যান্ডস্কেপ পরিবর্তিত হয়। পাতা ঝরা শীর্ণ বৃক্ষরাজি আর শুকনো নদীর ধু ধু বালির চড়ায় রিক্ততা প্রকাশ হয়ে পড়ে। চার বন্ধুর জীবনের উন্মাদনা, হৈ চৈ, আনন্দ এবং অপর্ণার মত এক মেয়েকে বনের এমন নিরব পরিবেশের পাওয়ার আনন্দ দর্শকদের হয়তো ক্ষণিকের জন্য শহরের ছাঁচে ফেলা আনন্দের কাছে নিয়ে যায়, এই আনন্দের সাথে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী নাচ গানের আনন্দ আরো অপরূপ ঘন অরণ্য পরিবেশের কথা মনে করিয়ে দেয় আমাদের। কিন্তু যখন হাঁটে বা চায়ের দোকানে বুভুক্ষু মলিন মুখ দেখা যায় তখন বুঝতে বাকি থাকে না এরা শুধু প্রাকৃতিক ঐ সম্পদের পাহারাদার। এগুলো ভোগ করার অধিকার তাদের নেই। বাংলোর চৌকিদার পরিবারের দুর্দশা অথবা অর্থ বিনিময়ে আদিবাসী মেয়ে দুলির ওপর হরিনাথের দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন এবং দুলিকে সুন্দর নগর জীবনের মিছে স্বপ্ন দেখিয়ে নিজের পাশবিকতাকে চরিতার্থ করার মধ্য দিয়ে পরিচালক আমাদের সামনে তুলে ধরেন শহরের এই কেদাক্ত মানসিকতার কাছে কিভাবে অরণ্যের সরলতা লাঞ্ছিত হয়েছে। বলা হয়, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ থেকে সত্যজিৎ চলচ্চিত্রে এক নতুন অধ্যায়ের শুরু। এমন হতে পারে এ চলচ্চিত্র তাঁর পরবর্তী চলচ্চিত্রের কথামুখ, কিংবা সমসাময়িক কাল ও মানুষ সম্পর্কে কোন ট্রিলজীর প্রথম পর্ব। ছবিটি পাশ্চাত্যে যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছে। সত্যজিৎ নিজেই বলেছেন, ‘আমি মনে করি, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এক যথার্থ বাংলা ছবি। আমি ভাবতেই পারিনি পশ্চিমের দর্শক এত সহজে এই ছবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবে। এটা একদম বাংলা ফিল্ম।’
একই বছর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আরেকটি উপন্যাসের কাহিনী নিয়ে সত্যজিৎ রায় তৈরি করলেন ‘প্রতিদ্ব›দ্বী’ ছবিটি। তাঁর নায়ক শিক্ষিত ও বেকার সিদ্ধার্থ চৌধুরী। সত্যজিৎ রায় এমন একটি চরিত্রের প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করলেন। ষাটের দশকের শেষে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল। ‘শ্রেণী শত্রু খতম’ রবে গজিয়ে উঠছে নকশাল আন্দোলন আর অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে কোন্দল। এমন অবস্থায় সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রবল অস্থিরতায় যুবসমাজ দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য। কোলকাতা নগরী অশান্ত। এমন বিক্ষুব্ধ এক শহরের পটভূমিতে বর্তমান কালের এক নাগরিক যুবককে নিয়ে ঘুরতে থাকে এই ছবির গল্প।
পূর্বের ছবিতে সত্যজিৎ রায় উপন্যাসের গল্প থেকে অনেকটা সরে এসেছেন, সেজন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছবিটা দেখে খুশী হতে পারেননি। কিন্তু ‘প্রতিদ্ব›দ্বী’ ছবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সত্যিকারের সন্তুষ্ট করতে পেরেছিল। (চলবে)