সোনা কান্তি বড়ুয়া : মনের ঘরে বসত করে ‘ভালোবাসা! এক জীবনে ভালোবাসার সব ইচ্ছেগুলো পূরণ হবে এমন কখনোই হতে পারে না বরঞ্চ কিছু অপূর্ণ ইচ্ছে প্রতিনিয়ত দীর্ঘশ্বাস হয়ে ধাওয়া করে! বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,
“আনন্দধারা বহিছে ভুবনে / বসিয়া আছ কেন আপন মনে,
স্বার্থ নিমগন কী কারণে / বসিয়া আছ কেন আপন মনে!
চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয় প্রসারি / ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি
প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে / আনন্দধারা বহিছে ভুবনে
দিনরজনী কত অমৃত রস উথলি যায় অনন্ত গগনে / আনন্দধারা বহিছে ভুবনে!”

মোবাইলের নেশাতুর রঙিন পর্দায়; সখী, ভালোবাসা কারে কয়? তরুণ-তরুণীরা পড়াশোনার বদলে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠছে অবাধ যৌনতার হাতছানিতে; এমনকি বিবাহিত-অবিবাহিত পুরুষ-রমণীরা লিপ্ত হয়ে পড়ছে পরকীয়া নামক অনিয়ন্ত্রিত ও সামাজিকভাবে অস্বীকৃত এক অসুস্থ সম্পর্কে; ফলত বহু দম্পতির মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস এবং দাম্পত্য কলহ; স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির সুন্দর ভবিষ্যৎ হারিয়ে যাচ্ছে গভীর অন্ধকারে; আর প্রযুক্তির এই নেতিবাচকতার প্রবল প্লাবনে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের স্বপ্নের ভবিষ্যৎ।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে লেখা কালিপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতুম প্যাঁচার নক্সা’ বইয়ে হিন্দু বৈষ্ণবতন্ত্রে ধর্মের ছদ্মবেশে জনগণকে গোলাম বানাতে ধর্মান্ধ রাজনীতি! মনুষ্যত্বের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে নতুন বিয়ে হলে হিন্দু বৈষ্ণবতন্ত্রে নির্লজ্জ গুরুসেবা না করে স্বামী সহবাস করবার অনুমতি ছিল না। সখী, “‘হুতুম প্যাঁচার নক্সা’ বইয়ে “বৈষ্ণবতন্ত্রে নির্লজ্জ ব্রাহ্মণ গুরুর চিটিংবাজ নতুন বিয়ের গুরুপ্রসাদী প্রথায় (পরকীয়া} কারে কয়? হিন্দু ধর্মের ইতিহাসের পাতা থেকে চিটিংবাজ ব্রাহ্মণ গুরুর পরকীয়া করার ষড়যন্ত্র! গুরু প্রসাদী প্রথায় নতুন বিয়ে হলে গুরুসেবা না করে স্বামীসহবাস করবার অনুমতি ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে লেখা কালিপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতুম প্যাঁচার নক্সা’ বইয়ের ৬০ পৃষ্ঠার পর থেকে এই প্রথার মোটামুটি ভালো বিবরণ মেলে, বিয়ের সময় কনের গুরুপ্রসাদী হবে! বর খাটের নিচ থেকে উঠে এসে গুরুদেবের চরম ধোলাই করলেন। ধোলাই খেয়ে নির্লজ্জ গুরুদেব সজোরে চিৎকার করতে থাকেন। কালিপ্রসন্ন তার বইয়ে গুরুপ্রসাদী প্রথার এরকম বিবরণ দিয়েছেনঃ পূর্বে মেদিনীপুর অঞ্চলে বৈষ্ণবতন্ত্রের গুরুপ্রসাদী প্রথা প্রচলিত ছিল।” বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,
“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।

ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।
মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়–
বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়।
হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়–
আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়!”

মনুষ্যত্বের আদর্শ থেকে বিচ্যুত না-হয়ে মানবতার সেবায় ধর্ম বা রাজনীতি করুন, কিন্তু সাধারণের মন সদা চঞ্চল-বিক্ষুদ্ধ। কেন এই অস্থিররতা? মনে মৈত্রী করুণ রস, বাণী অমৃত পদ। “যেথায় আছি যে যেখানে / বাঁধন আছে প্রানে প্রানে।” লোভ-দ্বেষ-মোহ তথা অবিদ্যা আর তৃষ্ণার তাড়নায় মনের ঘরে বসত করে ‘ভালোবাসা! তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি, শত রূপে শত বার! সখী, ভালোবাসা সে কি কেবলই চোখের জল? ‘ভালোবাসা ‘ভালোবাসা সখী, ভালোবাসা কারে কয়! বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,
সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে?
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’-
সখী, ভালোবাসা কারে কয়!
সে কি কেবলই যাতনাময়।
সে কি কেবলই চোখের জল? সে কি কেবলই দুখের শ্বাস?
লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে এমন দুখের আশ।
আমার চোখে তো সকলই শোভন,
সকলই নবীন, সকলই বিমল, সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন,
বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল- সকলই আমার মতো।
তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়, হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়-
না জানে বেদন, না জানে রোদন, না জানে সাধের যাতনা যত।
ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে, জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,
হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে আকাশের তারা তেয়াগে কায়।
আমার মতন সুখী কে আছে। আয় সখী, আয় আমার কাছে-
সুখী হৃদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ।
প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা-
একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা।”

সবার হাতেহাতে দামি মোবাইল ফোন আর তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ সেই মহামূল্যবান বস্তুটিতে; তারা একসঙ্গে থেকেও বড্ড একা আর নিঃসঙ্গ ভেতরে ভেতরে! এক ভোগসর্বস্ব প্রজন্ম বোধহীন আর স্বপ্নহীনভাবে বেড়ে উঠছে দিনে দিনে; তারা তো ভবিষ্যতের বোঝা ছাড়া আর কিছু নয়! ফেসবুক কিংবা ইউটিউবের কন্টেন্টে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কোমলমতি কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে যে কোনো বয়সের নারী-পুরুষের মোবাইল কিংবা টিভির পর্দায় চলে আসছে অনাকাক্সিক্ষত আপত্তিকর ভিডিও ক্লিপ; যা দর্শন করে অনেক কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী ফেসবুক আজ বিপথগামী হয়ে পড়ছে।

চর্যাপদে সখী, ভালোবাসা কারে কয়! বাংলা ভাষার প্রথম বই চর্যাপদ! চর্যাপদে (পদ ৪) সবরী বালী (উর্বশী) যুবতী রমণী ধুমকেতুর মতো আর্বিভূত হয়েই তার ডাগর চোখের অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে কাকে যেনো খুঁজজে। চর্যাপদে এই চিত্রকল্পগুলিই চর্যার সাহিত্যমূল্য বহন করছে। গুণ্ডরীপাদের একটি পদ পার্থিব প্রেমের তীব্র আর্তিতে জীবন্ত: “যোইণি তঁই বিণু খনহিঁ ন জীবমি। / তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমি” (পদ ৪, অর্থাৎ যোগিনী, তোমাকে ছাড়া মুহুর্তকালও বাঁচব না। তোমার মুখ চুম্বন করে কমলরস অর্থাৎ পদ্মমধু পান করব।) হৃদয়াকর্ষক সৌন্দর্যের পারিজাত ঐ উর্বশী রমণীর বাঁধ ভাঙ্গা উত্তাল যৌবনের চমকপ্রদ রঙ আর রূপ। তার চেহারা আর চটকদারী বেশভূষায় মনে হয়েছিলো যেন এক স্বপ্নপরী “বাংলার অপরূপ কন্যা। তারপরই দেখি, চোখেমুখের বিচিত্র ইশারায় কাকে যেনো কী একটা সংকেত শবরপাদের একটি পদে দেখা যায় নরনারীর প্রেমের এক অপূর্ব চিত্রণ-
উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।
উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি।
ণিঅ ঘরনি ণামে সহজ সুন্দারী।।
ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী।
একেলী সবরী এ বণ হিণ্ডই কর্ণ কুণ্ডলবজ্রধারী।।”

চারপাশের রূপরসময় পৃথিবীর সৌন্দর্য তাঁরা অকুণ্ঠ পান করে তাঁদের কাব্যকে সজীব ও প্রাণোচ্ছল করে তুলেছিলেন। এই কারণে তৎকালীন বাংলার ভূগোল ও সমাজ সম্পর্কে যে স্পষ্ট ছবি চর্যাপদ থেকে পাওয়া যায়, তা সেই সময়কার বাঙালির ইতিহাস রচনায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান!

(পদ ২৮, অর্থাৎ উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে। তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালিকা। নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। শবর-শবরীর প্রেমে পাগল হলো। কামনার রঙে তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম। শয্যা পাতা হলো। শবর-শবরী প্রেমাবেশে রাত্রিযাপন করলো।) আবার সমাজ ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদ ও আধুনিক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঢেণ্ঢণের পদে দেখা যায় – “টালত মোর ঘর নাহি পরবেষী। / হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী।” (পদ ৩৩, অর্থাৎ- টিলার উপর আমার ঘর, কোনও প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতেও ভাত নেই, তবু নিত্য অতিথি আসে।)

কোনও কোনও পদে নিছক দর্শনকথা অসামান্য চিত্ররূপের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। চাটিল লিখছেন, “ভবণই গহণগম্ভীরা বেগেঁ বাহী। দুআন্তে চিখিল মাঝেঁ ন ঠাহী।” (পদ ৫, অর্থাৎ – ভবনদী গহন ও গম্ভীর অর্থাৎ প্রবল বেগে প্রবহমান। তার দুইতীর কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল।) আবার কখনও বা তত্তে¡র ব্যাখ্যায় যে প্রহেলিকার অবতারণা করা হয়েছে, সেগুলিও অসামান্য সাহিত্যগুণমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। যেমন: কুক্কুরীপাদ লিখেছেন, “দুলি দুহি পিটা ধরন ন জাই। / রুখের তেন্তুলি কুম্ভীরে খাঅ।।” (পদ ২, অর্থাৎ- মাদী কাছিম দোহন করে দুধ পাত্রে রাখা যাচ্ছে না। গাছের তেঁতুল কুমিরে খাচ্ছে।)[

রূপসী বাংলার ভালোবাসার কবি জীবনানন্দ দাশের “বনলতা সেন” নামক কবিতায় ‘ভালোবাসার সম্পর্ক! তিনি (কবি জীবনানন্দ দাশ ) নিজেই স্বীয় রচনার অর্থায়ন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন যদিও শেষাবধি তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে কবি নিজেই নিজ রচনার কড়া সমালোচক ছিলেন। তাই সাড়ে আট শত কবিতার বেশি কবিতা লিখলেও তিনি জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও কাব্যসংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। এমনকি রূপসী বাংলার সম্পূর্ণ প্রস্তুত পাণ্ডুলিপি তোরঙ্গে মজুদ থাকলেও তা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি জীবনানন্দ দাশ। তবে তিনি এ কাব্যগ্রন্থটির নাম দিয়েছিলেন বাংলার ত্রস্ত নীলিমা যা তার মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত এবং রূপসী বাংলা প্রচ্ছদনামে প্রকাশিত হয়। আরেকটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয় মৃত্যু পরবর্তীকালে যা বেলা অবেলা কালবেলা নামে প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত (১৯৫৩) হয়। ১৯৫৫ সালে শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছিল ! রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়,
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”

চর্যাগীতিতে ব্যবহৃত উপমা ও রূপকল্পগুলি তৎকালীন বাংলার সমাজজীবন, পরিবারজীবন ও প্রাকৃতিক উপাদান থেকে সংগৃহীত। প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন, সেই যুগে বাংলার ভৌগোলিক সীমা আজকের পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বাইরেও পূর্বে অসম ও পশ্চিমে বিহার, ঝাড়খণ্ড ও পূর্ব উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। চর্যাকারগণ সাধক হলেও কাঠখোট্টা তত্ত¡জ্ঞানী ছিলেন না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুবরের ভাষায়,
তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
শুনি সেই অতীত কাহিনী,
প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলনকথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে
দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া
তোমারি মুরতি এসে,
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।
আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদিকালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা
কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে,
মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।
আজি সেই চিরদিবসের প্রেম
অবসান লভিয়াছে
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ,
নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে
সকল প্রেমের স্মৃতি–
সকল কালের সকল কবির গীতি।

মনের ঘরে বসত করে ‘ভালোবাসা! কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।” বিশ্বকবির ভাষায়, আমার মতন সুখী কে আছে। আয় সখী, আয় আমার কাছে! সখী, ভালোবাসা, সে কি কেবলই যাতনাময় – প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা / একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা। বিশ্বকবি “এইটাই স্বাভাবিক নতুবা বেচেঁ থাকাটা একঘেয়ে হয়ে যাবে। কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়,
“হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন,
পথের পাতার মতো তুমিও তখন!
আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে?
অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার।
তোমার আকাশ ‘আলো’ জীবনের ধার
ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই, শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে।
আমি চ’লে যাবো—তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ’পরে;
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।”

কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে অর্জিত ইতিবাচক বিষয়গুলো যেন ক্রমেই হেরে যাচ্ছে তার ভয়ংকর আর নেতিবাচক প্রভাবের কাছে। ফেসবুক ও ইউটিউবের প্রতি আমাদের অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত আসক্তি যে কোনোভাবেই হোক না কেন কাটিয়ে উঠতে হবে আর গ্রহণ করতে হবে তার ইতিবাচক বিষয়গুলো এবং সেজন্য আমাদের টেবিলের আপেল কাটার ছুরি দিয়ে আমাদের আপেলই কাটতে হবে এবং তা কাটতে হবে অবশ্যই সচেতনতা ও সতর্কতার সঙ্গে; আর তা না হলে ঘটে যেতে পারে আঙুল কেটে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা; এমনকি অপব্যবহারের কারণে বর্ণিতভাবে ক্রমেই বেড়ে যেতে পারে হত্যা কিংবা আত্মহত্যার মতো মারাত্মক ঘটনাও। অসুস্থ সম্পর্কে; ফলত বহু দম্পতির মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস এবং দাম্পত্য কলহ; স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির সুন্দর ভবিষ্যৎ হারিয়ে যাচ্ছে গভীর অন্ধকারে; আর প্রযুক্তির এই নেতিবাচকতার প্রবল প্লাবনে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের স্বপ্নের ভবিষ্যৎ।

“বাংলার অপরূপ রূপ / বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ / খুঁজিতে যাই না আর! “রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা! পুরাণের জগৎ জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়, তাতেতিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ অভিধায় খ্যাত হয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘নির্জনতম কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে, অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে ‘শুদ্ধতম কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। সমালোচকদের অনেকে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি বলে মনে করেন। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মাঝে রয়েছে রূপসী বাংলা, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, বেলা অবেলা কালবেলা, শ্রেষ্ঠ কবিতা ইত্যাদি। এবং রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়,

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ!
খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে
‘ভোরের দোয়েলপাখি’ চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
‘জাম’ ‘বট’ ‘কাঠালের’ ‘হিজলের’ অশখের করে আছে চুপ;
ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;
মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই হিজল — বট — তমালের নীল ছায়া
বাংলার অপরূপ রূপ দেখেছিল;……!”

জীবনানন্দ কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। তিনি ‘সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্র’ নামে একটি সংস্থার সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এই সংস্থার মুখপত্র দ্ব›দ্ব পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক নিযুক্ত হন। মাঝে তিনি কিছুকাল খড়গপুর কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তার জনপ্রিয় কবিতার বই বনলতা সেন সিগনেট প্রেস কর্তৃক পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয়। বইটি পাঠকানুক‚ল্য লাভ করে এবং নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন-কর্তৃক ঘোষিত “রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কার” জয় করে। মৃত্যুর কিছু পূর্বে হাওড়া গার্লস কলেজ-এ অধ্যাপনার চাকুরি জুটে গেলে তার কলকাতা জীবনের অপরিসীম দৈন্যদশার সুরাহা হয়। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।

বিশ্ববৌদ্ধ পুরস্কার প্রাপ্ত প্রখ্যাত মানবতাবাদী লেখক সোনা কান্তি বড়ুয়া (Bachelor of Arts, University of Toronto), The Author’s World famous and glorious New Book entitled ÒPRE – VEDIC MOHENJODARO BUDDHISM & MEDITATION IN THE NUCLEAR AGE , (516 Pages) “ সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো, খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা প্রবাসী কলামিষ্ঠ, লাইব্রেরীয়ান, বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব পত্রিকার সহ সম্পাদক এবং জাতিসংঘে বিশ্ববৌদ্ধ প্রতিনিধি !