শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।

৯.
ক্যমিউনিটিতেও আমাদের কিছু ক্লায়েন্ট রয়েছে। প্রয়োজনে তারাও সাহায্যের জন্য কল করে এবং তাঁদের বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে নির্ধারণ করা হয় কতটা সাহায্য তারা সরকারের কাছ থেকে পাবে এবং তাদেরকে ঘন্টায় কত করে দিতে হবে এই সার্ভিসের জন্য। এভাবেই আমার পরিচয় গুরপ্রীতের সাথে। এপয়েন্টমেন্টের নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে দেখি কংকালসার এক মহিলা বয়স অনুমান করলাম ৭০। ব্র্যাম্পটনে একটা স্টুডিও এপার্টমেন্টে সে থাকে। ঘরে আসবাব বলতে একটা সিঙ্গেল খাট, বিছানার চাদর মনে হয় কোনদিন ধোয়া হয়নি, একটা টেবিল আর একটা চেয়ার। রান্নাঘরে পেলাম একটা হাড়ি, একটা থালা, একটা কাপ আর কয়েকটা চামচ। ঘরের কর্নারে পড়ে আছে একটা টিনের বাক্স, বোঝা যায় সেটা একসময় বহু রঙে রঙিন ছিল। ঘরে একটা দম আটকানো গন্ধ, আমি তাড়াতাড়ি করে জানলাটা খুলে দিলাম, ঠান্ডা হাওয়ার এক ঝলক এসে ঘরে ঢুকল, গুরপ্রীত ঠান্ডায় একটু কেঁপে উঠল। আমি খুঁজেপেতে একটা মোটা চাদর পেলাম আর তাই ওর গায়ে জড়িয়ে দিলাম। ওর সাথে কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম এভাবে হবে না। গুরপ্রীত পাঞ্জাবি ভাষা ছাড়া কিছু বলতে এবং বুঝতে পারে না। হিন্দি হলে আমি চেস্টা করতে পারতাম। অফিসে কল করে পরিস্থিতির কথা জানালাম এবং বললাম যে ওঁকে এভাবে রেখে আমি যাব না আরো বললাম ওয়ার্কার লিস্ট দেখে এক পাঞ্জাবি মেয়েকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবার জন্য। আম্যান্ডা কিছুক্ষণ পরে কল করে আমায় জানাল যে হারপ্রীত নামে একটি মেয়ে এখান থেকে ২ কি।ম। দূরে একজন ক্লায়েন্ট কে এটেন্ড করছিল। ওর কাজ সবেমাত্র শেষ হয়েছে এবং ওকে আরো ২ ঘন্টার শিডিউল দিয়ে ওকে এখানে পাঠানো হচ্ছে। হারপ্রীত ১০ মিনিটে চলে আসবে। আমি এর মধ্যে গুরপ্রীতকে কয়েকবার হিন্দিতে বললাম ভয় না পেতে। আমি ঘুরে ঘুরে দেখে ম্যাপেল স্কোর সফটওয়্যারে সব নোট করতে থাকলাম।

দরজায় মৃদু শব্দ হতে বুঝলাম হারপ্রীত এসেছে, দরজা খুলে দেখি আরেক পাঞ্জাবি মহিলা, বলল ওর নাম আশা। এই সরকারি বিল্ডিংয়ে সে আর তার হাজবেন্ড থাকে। ভাঙ্গা হিন্দিতে বলল, গুরপ্রীত একদিন দরজার বাইরে বসে কাঁদছিল দেখে আশা এসে জানতে চেয়েছিল কি হয়েছে, পাঞ্জাবি ভাষী আশাকে পেয়ে গুরপ্রীত দুহাতে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিল। আশা ওর সোসাল ওয়ার্কারকে কল করে আজকের এই এপয়েন্টমেন্টের ব্যাবস্থা করেছিল। এই কথোপকথনের মাঝে হারপ্রীত এসে হাজির। আশার কাছ থেকে ওর এপার্টমেন্টের নাম্বার রেখে ওকে বললাম যে অনেক ধন্যবাদ গুরপ্রীতকে সাহায্য করবার জন্য, প্রয়োজনে আমরা ওর সাথে যোগাযোগ করব। আশা সম্বতি দিয়ে ধীরপায়ে এলভেটরের দিকে চলে গেল। হারপ্রীত এগিয়ে গিয়ে গুরপ্রীতের সাথে কথা বলতে শুরু করল। হারপ্রীতকে আমার কিছু বলে দিয়ে হয়নি, সে নিজে নিজেই অনেক প্রশ্ন করতে লাগল। এরপরে হারপ্রীত আমাকে যা বলল সেটা শুনে আমার অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠল।

হেলথ কার্ড দেখে জানলাম তার বয়স ৬০ এর কোটায়, অনাদরে অবহেলায় বুড়িয়ে গিয়েছিল সে। গুরপ্রীতের স্বামী মারা গিয়েছিল অনেক অল্প বয়সে, একটা মেয়ে আর একটা ছেলে নিয়ে অল্প বয়সী বিধবা অনেক কষ্ট করে বেঁচে ছিল। মেয়েটা খুব একটা পড়াশুনার সুযোগ পায়নি, অভাবের সংসার থেকে বাঁচার জন্য মাত্র ১৫ বছর বয়সে সে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল। ছেলেটাকে গুরপ্রীত পড়িয়েছিল ১০ ক্লাস অবধি। আমানদীপ সিং স্কুলে পড়ার পাশে গাড়ি সারানোর কাজ শিখেছিল। ২০ বছর বয়সী আমানদীপ কি করে ক্যানাডার ভিসা যোগার করে পাড়ি জমিয়েছিল এই দেশে। এরপরে আমানদীপ মাকে টাকা পাঠিয়েছে নিয়ম করে এবং তাই দিয়ে খেয়ে পড়ে গুরপ্রীত ভালই ছিল। এর ১৫ বছর বাদে আমানদীপ মাকে তার কাছে নিয়ে এসেছিল। গুরপ্রীত জানত যে আমানদীপ শাদী করে সংসারী হয়েছে এবং ওদের ২টা সন্তানও আছে। বিয়ের পরে আমানদীপের বউ দু’একবার গুরপ্রীতের সাথে কথা বলেছিল কিন্তু সে কথায় কোন আন্তরিকতা ছিল না। আমানদীপ যখন মাকে ক্যানাডায় আসবার জন্য ভিসা পাঠিয়েছিল গ্রামের অনেকে তখন গুরপ্রীতের সৌভাগ্যে চোখ টাটিয়েছিল।

গুরপ্রীত একসময়ে ক্যানাডায় এসে ছেলের সংসারে থিতু হল, ২ বেডরুমের একটা ফ্ল্যাটে থাকত ছেলে। এক রুমে ছেলে বউ আর তাঁদের দেড় বছর বয়সী পুত্র সন্তান আর একরুমে গুরপ্রীত সাথে তার ৩ বছর বয়সী নাতনী। ছেলে বউ দুজনেই কাজ করত। ছেলে একটা পাঞ্জাবী মেকানিক শপে গাড়ি সারাইয়ের কাজ করত আর বউ ঠিক কি করত সে জানে না। এই দুই বাচ্চা সামলানো এবং রান্না করা ছিল গুরপ্রীতের প্রধান কাজ। গুরপ্রীত ধীরে ধীরে বুঝেছিল যে ওদের একজন আয়ার প্রয়োজন ছিল এবং বিনা খরচে এমন আয়া কোথাও পাওয়া যাবে না। গুরপ্রীত অখুশী ছিল না ছেলের সংসার সামলানোর জন্য কিন্তু মায়ের প্রতি ওদের আচরণ ছিল আয়ার মতই। গুরপ্রীত অনেকবার ছেলেকে বলেছে তাকে মাহালে (পাঞ্জাবের একটি গ্রাম) পাঠিয়ে দেবার জন্য, অনুরোধ করেছে কিছু টাকা দিলে সে ২টা গাভী কিনে নেবে এবং দুধ বিক্রি করে তাই দিয়ে বেশ চলে যাবে, ছেলেকে টাকা পাঠাতে হবে না আর কিন্তু ছেলে এসব কথায় কোন আমল দেয়নি বরং বউ তাকে অকৃতজ্ঞ বলেছে, এত ভাল থাকতে পড়তে দিয়েছে তারপরেও সে চলে যেতে চায় তার নাতিদের ফেলে এইজন্যে। এর কোন উত্তর হয় না বলে গুরপ্রীত চুপ থাকত এবং ভাবত আসলেই তো; সে কিছুই করতে পারেনি তার সন্তানদের জন্য, ভাল খাবার পর্যন্ত দিতে পারেনি। বেচারা ছেলেটা একা একা কষ্ট করেই এতদূর এসেছে, বিদেশে এসে সে যদি মাকে পুরোপুরি ভুলে যেত কিইবা করতে পারত সে? বরং ছেলে তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে। সব ভুলে সে মনোযোগ দিয়ে ছেলের সংসার সামলাতো। একটাই কষ্ট ছিল যে ছেলে, না। দম আটকে আসত মাঝে মাঝে কিন্তু কিছু করার ছিল না। নাতি নাতনীরা বড় হতে লাগল আর ধীরে ধীরে গুরপ্রীতের প্রয়োজন ফুরিয়ে যেতে লাগল। শুনল নাতনী কমপ্লেইন করছে মায়ের কাছে যে তার কোন প্রাইভেসি নেই… দাদি, ভাইয়ের সাথে সে আর রুম শেয়ার করতে চায় না, তার নিজের রুম প্রয়োজন। তখন ছেলে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল সে দেশে যেতে চায় কিনা? কিন্তু গুরপ্রীত চায়নি, ততদিনে ওর শেষ শক্তিটুকুও ছেলের সংসারের জন্য ব্যাবহার করে ফেলেছে, ওর মেয়েটাও দেশে ক্যান্সার হয়ে মরে গিয়েছিল। ফিরে গিয়ে কার কাছে যাবে? কে দেখবে তাকে, রোগশোকে অনেকটাই কাতর এখন সে। হঠৎ করে নিজেকে বোঝা মনে হতে লাগল তার। নাতনীটাও সবসময় খারাপ ব্যাবহার করত ওর সাথে। গুরপ্রীত নিজেই জানতনা কেন এক কষ্ট তার জীবনে। সে তো কারো ক্ষতি করেনি কোনদিন, তবে কিসের জন্য এও শাস্তি তাঁর?
মানব – আত্মার গর্ব আর নাহি মোর,
চেয়ে তোর স্নিগ্ধশ্যাম মাতৃমুখ-পানে
ভালোবাসিয়াছি আমি ধূলিমাটি তোর।
জন্মেছি যে মর্ত-কোলে ঘৃণা করি তারে
ছুটিব না স্বর্গ আর মুক্তি খুঁজিবারে। (ক্রমাগত)
……………রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
– টরন্টো, কানাডা