শারমীন শরীফ: শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।
লিলি গায়ানা থেকে এসেছে ২৫ বছর আগে। মা বাবার সাথে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে যখন এসেছিল তখন ওর বয়স পনেরো। এখানে এসে ও স্কুল শেষ করেছে। পরে PSW course করে কাজে ঢুকে গিয়েছে। বিয়েও হয়েছে তাড়াতাড়ি। ওর ২০/২২ বছরের ছেলে মেয়ে রয়েছে। গায়ানিজ কমিউনিটিতে আরেক গায়ানিজ ছেলের সাথে পরিচয় এবং ২ পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সন্তানও আসতে দেরি হয়নি। এ পর্যন্ত গল্পটা খুবি সাদামাটা। ২টা সন্তান নিয়ে যখন ওদের ব্যাস্ত সংসার তখন হঠাৎ করে ওর স্বামী অসুস্থ। খুব টায়ার্ড থাকত, তারপরে শুরু হল হঠাৎ করে বø্যাক আউট হওয়া। পরীক্ষা নিরীক্ষার শেষে আবিস্কার হল যে তার মাথায় টিউমার হয়েছে। লিলি মাথায় হাত দিয়ে পড়ল। টিউমার খুব তাড়াতাড়ি অপসারণ করতে হবে কারণ এটা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। ডাক্তার বলল এটা একটা বিনাইন টিউমার কিন্তু অপারেশনটা অনেক রিস্কি। এটা মাথার এমন একটা জায়গায় হয়েছে যে অপারেশনের পরে ওর ডান পাশ প্যারালাইজড হয়ে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর বেশি দেরী করা উচিৎ নয়। লিলির সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। সময়মত অপারেশন হল এবং লিলির স্বামীর ডান পাশ অবশ হয়ে গেল। শুরু হল ওর নতুন জীবন যুদ্ধ। একদিকে স্বামীর সেবা, ছোট বাচ্চাদের স্কুলে দেয়া নেয়া, ঘর সামলানো সাথে ফুলটাইম কাজ। মেয়েটা যেন মেশিন হয়ে উঠেছিল। ওর সুবিধার জন্য নাইট শিফট বেঁছে নিল। কাজ থেকে ফিরতে সকাল ৭.৩০ বেজে যেত। ফিরে গিয়েই বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর তরিঘরি শুরু হত। ওদের স্কুলে দিয়ে এসে স্বামীকে সাহায্য করত বিছানা থেকে উঠে দিন শুরু করার জন্য, তাকে নাস্তা বানিয়ে খাইয়ে তবে ও ঘুমাতে যেত। বাচ্চাদের স্কুল ছুটির আগে উঠে যেত। ওদের স্কুল থেকে এনে তারপরে শুরু হত রান্না বান্না, সবার সবকিছু গুছিয়ে রেখে আবার কাজে চলে যেত। এভাবে চলেছে বছরের পর বছর। এখন বাচ্চারা বেশ বড় আর ওর স্বামীও অনেক ফিজিও থেরাপির পরে এখন বেশ ভাল। বাঁ হাত দিয়ে অনেক কাজ করতে শিখেছে। এতকিছুর পরেও আমি লিলির মুখ কখনো মলিন দেখিনি। সব সময় একটা মিষ্টি হাসি ওর মুখে।
লিলির গল্প আমি এই জন্য করলাম যে আজ আমি যখন লিলিকে দেখলাম কাজে, দেখলাম ওর মুখটা শুকনো। আমার কেমন লাগল। কাজের শেষে ও অফিসে বসে যখন শিফট ফাইল ফিলাপ করছিল তখন আমি মৃদু স্বরে জানতে চেয়েছিলাম সব ঠিক আছে কিনা। কিছু বললনা লিলি, মাথা নিচু করে লিখে চলল। আমি ওর কাধে হাত রাখতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমি তো অবাক, লিলিকে আমি জড়িয়ে রাখলাম কিছুক্ষণ। কিছুটা ধাতস্ত হয়ে লিলি বলল যে ওর স্বামীর মাথায় আবার একটা টিউমার হয়েছে এবং আবার অপারেশন করতে হবে। ডক্তারেরা এবারে শংকিত! ওরা বলেছে যে সে যদি বেঁচে যায় তবে পুরোপুরি প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে। লিলি বলল, ‘মনিরা- বিয়ের পরে ৭/৮ বছর খুব সুন্দর গিয়েছে আমার জীবন, তারপর থেকে যে ঝড় শুরু হয়েছে তা আর থামল না, একটা স্বাভাবিক জীবন আমি পাইনি। তারপরেও একসময় এই জীবনেই আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু আবার? এবার আমি সামলাবো কি করে? আর পারছি না আমি, আর ভাল লাগছে না। খারাপ সময়ের পরে নাকি ভাল সময় আসে! আমার তো খারাপের পরে খারাপ সময় আসছে।’ লিলি আরো বলল যে ওর ছেলেটা নাকি কুসঙ্গে পড়ে ড্রাগস নিতে শুরু করেছিল, ওকে নিয়ে ডাক্তার, রিহ্যাব এইসব চলছে। এর মধ্যে আবার এই খবর।
আমি সত্যি বাক্যহারা হয়ে বসেছিলাম। এর কি সান্তনা হয়? মানুষ জন্মায় কেন? কে আমাদের পরিচালনা করে? কেন কিছু মানুষ শুধু যুদ্ধ করেই যায়। যুদ্ধ শেষে একসময় মৃত্যু! তাহলে এই জীবনটার মানে কি হয়? মানুষ নাকি জন্মেই তার ঋণ শোধ করে যায়। কিসের ঋণ? কার কাছে ঋণ? এই নিয়ে অনেক যুক্তি তর্ক সম্ভব কিন্তু আমি জানি সঠিক উত্তর কারো জানা নেই। কিসের একটা আশায় আমরা ছুটে চলছি। কিছু একটা হবে, কিন্তু কি হবে কখন হবে জানা নেই। চলতে হবে চলছি। আমি সত্যি মাঝা মাঝে ঘৃণা করি এই ছাপোষা জীবন, আবার হয়ত কোন একটা সুখকর মূহুর্তে মনে হয়- আহা কত সুন্দর এই বেঁচে থাকা! কি পরস্পরবিরোধী আমাদের মনস্তত্ব!
লিলির জন্য মায়ায় আমার অন্তরটা ছেয়ে গেল। বাচ্চারাও ওর কষ্ট বুঝলো না। যে যার জীবন নিয়ে ব্যাস্ত শুধু লিলি মনে হয় দাসখত লিখে বসে আছে যে সে সব কিছু সুন্দরমত চালিয়ে নেবে তার ভাল লাগুক আর নাই লাগুক। লিলিকে আমি বললাম যে তার কিছু লাগলে সে নিঃসংকোচে আমায় বলতে পারে। এ কথাটা বলার জন্য বলা হয়ত। জানি লিলি কখনোই মুখ ফুটে বলবে না কিছু লাগলে। তাই আরো নির্দিস্ট করে বললাম যে, কাজে শিফট নিয়ে বা ছুটির প্রয়োজন হলে, সিক লিভ নিয়ে তার যদি কিছু লাগে আমি সাহায্য করতে পারবো। লিলি চোখ মুছে ধন্যবাদ জানালো।
সে জানালো অপারেশনের তারিখ হলে আমায় জানাবে, তখন যেন আমি ২ দিনের ছুটি মঞ্জুর করি। লিলি সব গুছিয়ে বাড়ি চলে গেল। আমি paid sick leave to take care of a family member নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করলাম। হোমের পলিসি দেখলাম। জানলাম যে লিলি compassionate care benefits পেতে পারে এবং ওর কাজও থাকবে। সে যখনই ফিরে আসুক সে তার কাজ ফেরত পাবে। সব ইনফরমাশন নিয়ে গুছিয়ে রাখলাম। কাল লিলি কাজে এলে এগুলো ওকে দিয়ে বলব ঐজ এ কথা বলবার জন্য। আজ হোমে লাঞ্চের পরে বেশ সারা জেগেছে। নতুন একজন রেসিডেন্ট আসছে। এই সময়টাতে সবারই বুকটা একটু দুরদুর করে; কে আসবে, সে কেমন হবে? ইদানিং যোগ হয়েছেৃসে ভিক্টোরিয়ার মত হবে কিনা এইসব চিন্তা।
কেয়ারগিভারদের চিন্তা সব থেকে বেশি কারণ ওদেরকে সবকিছু মোকাবেলা করতে হয়। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে যে ভিক্টোরিয়া যে কোনদিন রিলিজড হবে এবং ওকে আবার এম্ব্যুলেন্সে করে পৌঁছে দিয়ে যাবে হোমে। শুনে কেয়ারগিভারদের মুখ শুকনো। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা অনেক মজা করি কিন্তু জানি যে আসলে এটা মোটেই মজা করার কোন বিষয় নয়। যে পরিমান এবিউস ওরা সয়ে নেয় প্রতিদিন যে মাস শেষে কেয়ারগিভারদের একটা করে মেডেল দেয়া উচিৎ।
নতুন রেসিডেন্ট আসছে জোড়ায়। স্বামী-স্ত্রী একসাথে একটা বড় রুম নিয়েছে। জন আর কেইট, জনের বয়স আশি আর কেইট বিরাশী বছরের। তার দু’জন নিজেরা আর নিজেদের দেখা-শোনা করতে পারে না। নিজের বাড়িতে থেকে বাড়িঘর সামলানো, তিন বেলার খাবার তৈরি এসব করতে এখন কষ্ট হয় ওদের। কেইটের মাইল্ড ডেমেনশিয়া ধরা পরেছে। সে চুলায় খাবার বসিয়ে গিয়ে ঘুমিতে পড়েছিল। একদম ভূলে গিয়েছিল যে চুলা জ্বলছে। প্রায় আগুন ধরে গিয়েছিল, ধোঁয়ার গন্ধে জন রান্না ঘরে গিয়ে দেখে যে প্রায় আগুন ধরছে। ওদের দুই মেয়ে তাদের বয়সও পঞ্চাশোর্ধ। তারাও নিজেদের নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যাস্ত। সবাই আলোচনা করে আমাদের হোমে এপ্পলাই করে রেখেছিল। অবশেষে ওরা আসছে হোমে। মেয়েরা এসে রুম ঘুছাচ্ছে আজকে। দু’টো খাট রুমার ২ পাশে, সাথে দু’পাশে দু’জনার ওয়ারড্রোব। মাঝখানে দু’টা আড়ামদায়ক চেয়ার একটা টি-টেবল আর একটা টিভি। খুব নিপাট করে সাজানো। দুইবোন আর তাদের ছেলে মেয়েরা এসে সুন্দর করে গুছিয়ে দিয়ে গেল। এমন কি কাপড়গুলো পর্যন্ত এনে পাট পাট করে গুছিয়ে ড্রয়ারে তুলে দিল। বাথরুমে ব্রাশ, পেস্ট, সাবার, তোয়ালে সব গুছানো। ওরা চলে যাবার পরে রুমে ঢুকে দেখে মনে হল কোন একটা হোটেল রুমে ঢুকে পড়েছি। ভাল লাগল জেনে যে একটা সুখী পরিবার আসছে অনেকদিন পরে। মেয়েরা আমাদের জন্য চকলেট আর বিস্কিটের টিন উপহার নিয়ে এসেছিল। আমি একটা স্টিকি পেপারে লিখলাম “Treat from our new resident John & Kate, please help yourself”, টিন দুটো আমি ডেস্কের উপরে রেখে দিলাম। (ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা