শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।
পরেরে দিন কোন ঝামেলা ছাড়াই গিয়ে হাজির হলাম বিপিন বাবুর বাড়িতে। ওর পুরো নাম বিপিন দাসগুপ্ত। বিপিন বাবুকে দেখে আমার খুব মন খারাপ হল। মলিন মুখের হাড্ডিসার একজন মানুষ। মুখ দেখে মনে হল এর বেঁচে থাকবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। বিপিন বাবু কোন এক কালে বাঙালি ছিলেন বটে সেই বাঙালিত্তে¡র কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই আর, দেখেও বোঝার উপায় নেই। সৌজন্য বিনিময়ের পরে আমি জানতে চাইলাম, উনি বাংলা বলতে পারেন কিনা।
বললেন, পারেন এবং হিন্দিও বলতে পারেন। শুনে খুশী হলাম, ভাবলাম একেবারে যায়নি তাহলে! আমি তখন বাংলায় নমস্কার জানালাম। ওনার মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই, মনে হল যে আমি বাংলা বলব এটাই যেন স্বাভাবিক। যাই হোক, আসল কথায় যাবার আগে আমি এটা সেটা নিয়ে কথা বলছিলাম গুমোট ভাবটা কাটানোর জন্য। দেয়ালে অনেকগুলো সাদা-কালো ছবি লাগানো, উঠে গিয়ে ওদের অনেক পারিবারিক ছবি দেখলাম। দু’জনের ছবি, বাচ্চাদের নিয়ে ছবি। আমি একটা ছবির দিকে ইশারা করে জানতে চাইলাম, এটা ওঁর আর ওঁর স্ত্রীর ছবি কিনা। বিপিন বাবু মাথা নেড়ে সায় জানালেন। কি অপূর্ব জুটি। আমি মুখ ফুটে বলেই ফেললাম যে, ওঁরা দারুণ জুটি ছিল। বিপিন বাবু ৬ ফুট লম্বা আর ওঁর স্ত্রী ৫ ফুট সাত। এখন বিপিন বাবুকে দেখলে মনে হয় ৫ ফুট সাত। শুকিয়ে ছোট হয়ে, কুঁজো হয়ে গিয়েছেন।
ভীষণ সুশ্রী একটা জুটি। ছবি নিয়ে কথা বলতে শুরু করতেই বিপিন বাবু যেন বদলে গেলেন। স্মৃতির দ্বার খুলে দিলেন আমার কাছে, জড়তা ভেঙ্গে আসল মানুষটি বেরিয়ে এল। মেলিসা সাদা কেনেডিয়ান, সে একজন নার্স ছিল। বিপিন বাবু ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময় সকার খেলতে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছিলেন। হাসপাতালে গেলে মেলিসা ওর পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিল আর সেই ছিল ওদের প্রথম দেখা। আহা! এ যেন উত্তম-সুচিত্রার সিনেমার গল্প! এর পরে অকারণেই অনেকবার বিপিন বাবু হাসপাতালে ফিরে ফিরে গিয়েছেন মেলিসার সাথে কথা বলবার জন্য। বিপিনের বন্ধুরা ওঁকে অনেক চটাতো এই নিয়ে কিন্তু ও সেটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করত। ধীরে ধীরে মেলিসা সহজ হলে বিপিন ওকে ডেটিংএ নিয়ে যায়। প্রথমদিন ওরা ডিনারে গিয়েছিল, পরের বারে ক্লাবে পুল খেলা আর ড্রিংক এভাবে সপ্তাহে কয়েকবার মেলিসার সাথে দেখা হতে লাগল। ক্রমশ জমে উঠেছিল প্রণয় আর এর ২ বছর পরে পরিণয়। এই সম্পর্কের কারণে বিপিন বাবুকে হারাতে হয়েছিল দেশে রেখে আসা ওর মা, বাবা, ভাইবোনকে। কিন্তু এখানে পেয়েছিলেন নতুন এক পরিবার। মেলিসার পরিবার ওঁকে আপন করে নিয়েছিল।
বিয়ে করে সংসার পেতে সম্পূর্ণ একজন কেনেডিয়ান বনে গিয়েছিলেন। কোলকাতায় গিয়েছিলেন কয়েকবার, মাতা ও পিতার মৃত্যু সংবাদে। কিন্তু সম্পর্ক সেই সুরে আর বাজেনি কারো সাথে, সবাই ওকে আখ্যা দিয়েছিল স্বার্থপর হিসেবে। উনি সেটা মাথা পেতে নিয়েছেন এবং সেই নিয়ে তিনিও আর ভাবেননি। এখানে ভরা সংসার ছিল তাঁর, কত কাজ, কত দায়িত্ব। সেন্টিমেন্টাল হবার মত সময় ছিল না। ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে নিজেদের সংসার গড়ল একসময় আর ওরাও ওঁদের বড় বাড়ি ছেড়ে দিয়ে এই ছোট্ট এপার্টমেন্টে উঠে এল।
দু’রুমের টাউনহাউজ কন্ডো, ছোট্ট কমিউনিটি। পায়ে হেটেই কাছের প্লাজাতে যাওয়া যায়, সেখানে রয়েছে ছোট্ট একটা ক্যাফে সেখানে প্রায় প্রতিদিন ওদের কমিউনিটির অন্য বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা বসত।
দু’জনেই অবসর নিয়ে অলস জীবন কাটাচ্ছিল, কমতি ছিল না কোনকিছুর। কিন্তু এরই মধ্যে ছন্দপতন। ওদের এত সুখ বিধাতার যেন সইলো না। তেমন কিছুই না ছোট্ট একটা অপারেশন করে বাড়ি এল মেলিসা কিন্তু দু’দিন পরেই শুরু হল কমপ্লিকেশন। ইমার্জেন্সী কল করে হসপিটালে নিয়ে গেল মেলিসাকে। কয়েকদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পরে মেলিসা হেরে গেল জীবনের কাছে। বিপিন বাবু কিছুতেই বুঝতে পারছেন না কি করে কি হল? কেন মেলিসাকে এভাবে চলে যেতে হল। জীবনটা ব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়ে কেবল শুরু হয়েছিল অবসর জীবন। মেলিসার একটা বাকেট লিস্ট ছিল, তার মধ্যে ছিল কিছু দেশের নাম যেগুলো ঘুরে দেখার খুব শখ ছিল ওদের, কিছুই হল না। বিপিন বাবু আমাকে ল্যান্ড ফোনে মেলিসার ভয়েস রেকর্ড শোনাল। বলল ফোন এলে সে প্রথম বারে ফোন ধরে না রিং বেজে সেটা ভয়েসমেইলে যেতে দেয়, ভয়েস রেকর্ডে মেলসার গলা ভেসে এলে সে চুপচাপ বসে শোনে ওর গলা আর মনে হয় এইতো কাছে-ধারেই সে কোথাও আছে। বলতে বলতে বিপিন বাবুর গলা ধরে এল। চোখ মুছল সে। ওঁর পুরো জীবনটা যেন ছায়াছবির মত আমার চোখের সম্মুখ দিয়ে ভেসে চলে গেল, গায়ে কাঁটা দিল আমার! ওঁর সন্তানরা ভীষণ সাপোর্টিভ, ছেলে অটোয়াতে থাকে আর মেয়ে থাকে আমেরিকার পিটসবার্গে। মেলিসার চলে যাবার খবরে দু’জনেই ছুটে এসেছিল। তিন দিন পরে মেয়ে ফিরে যায় তার সংসারে আর ছেলের বউও বাচ্চাকে নিয়ে তিনদিন পরে চলে গেলেও ছেলে ওর কাছে দু’ সপ্তাহ ছিল। দিনরাত সময় দিয়েছে বাবাকে। বাবাকে ক্যাফেতে নিয়ে গিয়ে বাবার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছে ঘন্টার পর ঘন্টা। ছেলে চলে যাবার পরে ওর বন্ধুরাই ওর ভীষণ খোঁজ খবর করে আর ওরাই ছেলেকে জানিয়েছে ওর বর্তমান অবস্থার কথা এবং সেই সাথে আমাদের কোম্পানির খোঁজও দিয়েছে ছেলেকে। বিপিন বাবুর এই বন্ধুরা কেউ ওনার পূর্বপরিচিত নয়, সবাই এই কমিউনিটিতেই থাকে। বোঝা গেল এটা একটা রিটায়ার্টমেন্ট কমিউনিটি।
ফর্মগুলো ফিলাপ করতে করতে আমরা আরো বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে থাকলাম। উনি একটা খুব দার্শনিক কথা বললেন হঠাৎ করে, বললেন যে; একা একা অনেক চিন্তা করেন তিনি, ভেবে বের করেছেন যে উনি ওনার পাপের শাস্তি ভোগ করছেন। নিজের মা-বাবা, ভাই-বোনদের জন্য কখনো কোন আকর্ষণ বোধ করেননি, বা কোন অপরাধ বোধেও ভোগেননি।
তাঁর চিন্তা ধারাটা এমন ছিল যে, মা-বাব সন্তানদের জন্য যা করেছে তা ওদের কর্তব্য থেকে করেছে, কোন বিনিময় কর্ত্যব্যের কথা ভাবেনি কখনো। কিছু পাওয়ার আশায় কিছু করেনি এবং সেও তাঁর সন্তানদের জন্য করেছে কোন বিনিময়ের আশায় নয়। বিপিন বাবুর মা-বাবা সচ্ছল ছিলেন, তারা কিছু চাননি বিপিন বাবুর কাছে কিন্তু সন্তানের কাছ থেকে ভালবাসা আশা করেছিলেন নিশ্চই, বিপিন বাবু কোন কারণ ছাড়া সেটাও দিতে অপারগ ছিলেন। কেন যে তিনি ওদের প্রতি কোন বন্ধন অনুভব করেননি সেটা তিনি জানেন না। বাবা কিছুটা রাশ গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন, প্রয়োজন ছাড়া কথা হত না, কিন্তু মা খুবই মমতাশীল একজন মানুষ ছিলেন। মা-সন্তানের স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল ওদের মধ্যে, ভাই বোনদের মাঝেও খুনসুটি ছিল তাহলে কেন ওর মাঝে এই বিরাগ কোথা থেকে এসেছিল? অনেক ভেবেও বিপিন বাবু এটা বের করতে পারেননি।
নিজের সংসার শুরু হতে তিনি দেখেছেন যে মেলিসাই ছিল সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু এবং তাকে ঘিরেই আবর্তিত হত ওদের জীবন। বিপিন বাবুর সাথে ওঁর সন্তানদের একটা দূরত্ব ছিল যেমন ছিল নিজের বাবার সাথে। সন্তানদের প্রতি সব কর্তব্য পালন করেছেন যেমনটি করেছিলেন ওঁর পিতা। কিন্তু ওর সন্তানরা ওঁর মত নয়। স্ত্রী বিয়োগের পরে সে টের পেয়েছে সন্তানরা কত কাছের, কি করে ওরা বাবাকে আগলে রেখেছে। ছেলে-মেয়ে রোজ দু’বার করে কল করে ওঁর খোঁজ নিচ্ছে। সুবিধা অসুবিধার কথা জানতে চাচ্ছে, বাবাকে কত কিছুতে উৎসাহ দিচ্ছে এমন কি পাশের ফ্ল্যাটে বাবার বন্ধুকেও কল করে বাবার ভাল মন্দের বিষয়ে জানতে চাচ্ছে। নিজের সাথে তুলনা করেছেন নিজের সন্তানদের। বিপিন বাবু নিশ্চিত যে ওরা ওঁর থেকে শতগুণে ভাল। এতদিনে উনি উপলব্ধি করেছেন যে তিনি আসলেই একজন স্বার্থপর মানুষ ছিলেন আর এই জন্যই তিনি পিতা-মাতার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেননি। তিনি এখন দু’বেলা সন্তানদের কলের অপেক্ষায় থাকেন, মন খারাপ হয় কল আসতে দেরী হলে বা কোন এক সন্ধ্যায় যদি কল না আসে। বিপিন বাবু এখন জানেন ওর মা-বাবা এভাবেই হয়ত ওর চিঠির অপেক্ষায় থাকত! তিনি এখন নিজের সন্তানদের জন্য দুরন্ত এক মায়া বোধ করেন আর সেই সাথে নিজের পিতামাতার কষ্ট যেন তাঁর বুকে শেল হয়ে বেধে। এইসব কিছুই এখন ভীষণ পীড়া দেয় ওঁকে। রাতে ঘুমাতে গেলে এইসব আকাশ-পাতাল ভাবনা ঘুমাতে দেয় না ওকে।
আমি বুঝালাম যে ঘরকন্নার সাহায্য ছাড়াও ওঁর আরো অনেক বেশী সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে। এই নিয়ে রুহার সাথে বিশদ আলাপ করতে হবে। আমি শুধু বললাম যে নিজেকে অপরাধী ভাবতে থাকলে কোন কিছুর সমাধান হবে না কিন্তু সে এখনো চাইলে তাঁর ভাইবোনদের সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে পারে। ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন যে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। অনেক দূরে সরে গিয়েছেন তিনি। তাও আমি বললাম একবার গিয়ে কোলকাতা থেকে ঘুরে আসতে। কিছু বললেন না তিনি। (ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা