শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।
ন্যান্সিকে খুব সুন্দর একটা গাঢ় নীল ইভিনিং গাউন পছন্দ করে দিলাম, সাথে কি গয়না পড়বে তাও ঠিক হয়ে গেল। মুক্তার কানের এবং হাতের ব্রেসলেট। ন্যান্সির কাছে জানতে চাইলাম ওর ছেলে-মেয়েরা এটা কি ভাবে নিয়েছে? ন্যান্সি জানাল যে ওরা সবাই ভীষণ খুশি মায়ের জন্য এবং সবাই খুব উদগ্রীব জনের সাথে পরিচিত হবার জন্য, আজই সবার সাথে প্রথম দেখা হবে। বরং বেচারা জন খুব টেনশনে আছে ন্যান্সির ছেলে-মেয়েদের নিয়ে। ন্যান্সি নিশ্চিত করল যে জন এত মিষ্টি স্বভাবের যে সে নিশ্চিত যে সবাই ওকে ভীষণ পছন্দ করবে। ইচ্ছে হল ৭ তলায় গিয়ে এই মহামানব কে দেখে আসি। তা সম্ভব নয় বলে ন্যান্সিকে বললাম এর পরে ওরা যখন দু’জনে বাগানে হাটতে যাবে আমায় যেন বলে যায়, তাহলে আমি চট করে গিয়ে জনকে দেখে আসব। ন্যান্সি হেসে বলল “অবশ্যই”। স্টেশনে ফিরে এসে ভাবলাম কাউকে বলব কিনা, কিন্তু বললাম না। আজ সন্ধ্যায় ন্যান্সি যখন সেজেগুজে জনের হাত ধরে বেরবে তখন সবাই দেখবে। একেকজনের চেহারা কি হবে ভেবে খুব মজা পেলাম; দুঃখ যে সেটা দেখার জন্য আমি তখন এখানে উপস্থিত থাকব না। হাতের কাজ গোছাচ্ছি তখন রুহা এসে হাজির। আমি জানতে চাইলাম গুরপ্রীত কেমন আছে? রুহা বলল যে সে খুব ভাল আছে। বান্ধবী হয়েছে দু’ চারজন, তারা প্রতিদিন ওকে শেখাচ্ছে কেনেডিয়ান জীবনযাপন, এর মধ্যে তারা ক্যাসিনো ট্রিপ দিয়ে এসেছে। ক্যাসিনোর চাকচিক্য দেখে গুরপ্রিতের মাথা ঘুরে গিয়েছে। অনেক অনেক দিন পরে গুরপ্রীত যেন তাঁর পাখা মেলে দিয়েছে। ছেলের কথা মনে হলে মন খারাপ করে, মরে গেলে কে চিতায় তুলবে এই নিয়ে টেনশন করে কিন্তু ছেলের ভালর জন্য অনেক দোয়া করে সে, কিন্তু সে ভীষণ ভাল আছে এখন। স্বাস্থ্যও ভাল হয়েছে। আমার মনে হয় ছেলেও মায়ের জন্য মন খারাপ করে কিন্তু পরিস্থিতির চাপে সে এটা মেনে নিয়েছে। তারপরেও আমি মেনে নিতে পারি না এভাবে কেউ তার মাকে পরিত্যাগ করতে পারে! ইচ্ছে করলে নিশ্চই সে মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারত।
গুরপ্রিতকে নিয়ে আলোচনার শেষে রুহা জানাল আরেক ক্লায়েন্টের কথা, সে নিজের বাড়িতে ব্র্যাম্পটনে থাকে। নাম বিপিন দাসগুপ্ত। বিপিন যখন এই দেশে এসেছে তখন তাঁর বয়স ছিল ২২ আর এখন সে ৬৭ বছরের এক বৃদ্ধ যুবক। স¤প্রতি বিপিনের স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে আর এই কারণে সে সম্পূর্ন ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, নিজের দেখভাল করে না, একেবারে যবুথবু অবস্থা। বিপিনের ছেলে রুহাকে যোগাযোগ করে সাহায্য চেয়েছে। রুহা এর মধ্যে কয়েকবার গিয়ে অনেক সময় কাটিয়ে বিপিনের জড়তা ভাঙ্গিয়ে সাহায্য নেবার জন্য রাজি করিয়েছে, কিছুতেই সে মানতে রাজী নয় যে তাঁর সাহায্যের প্রয়োজন। বিপিনের দরকার কেউ এসে ঘরবাড়ি গুছিয়ে দেবে, বাজার করে দেবে, রান্না করে দেবে, ওর সাথে গল্প করবে আর কেয়ারগিভারের উপস্থিতে বিপিন শাওয়ার করবে। ওর স্ত্রী মেলিসা মারা যাবার পরে ও এত দূর্বল হয়ে গিয়েছে যে ও ভয় পায় শাওয়ার করতে গিয়ে ও পড়ে গেলে আর উঠতে পারবে না এবং কেউ সেটা জানতেও পারবে না। তাই কেয়ারগিভার উপস্থিতে সে দরজা ভেজানো রেখে বাথরুমে ঢুকবে শাওয়ার নিতে এবং কেয়ারগিভার কিছুক্ষণ পরে পরে দরজার বাইরে থেকে খোঁজ নেবে সে ঠিক আছে কিনা। রুহা আমাকে ওর নাম্বার দিল বলল ছেলেকে প্রয়োজন নেই আমি সরাসরি বিপিনের সাথে যোগাযোগ করে এপয়েন্টমেন্ট করতে পারি আর ছেলেকে এপয়েন্টমেন্টের তারিখ এবং সময় ই-মেইল করে দিলেই হবে। পারলে সে উপস্থিত থাকবে না পারলেও অসুবিধা নেই। আমি বললাম “তথাস্তু”। রুহা চলে গেলে আমি বিপিনকে কল করে কালকের জন্য আপয়েন্টমেন্ট করলাম।
এর মধ্যে ভিক্টোরিয়াকে হসপিটালে যেতে হয়েছিল। সে একা একা হাটাহাটি করতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল। প্যারামেডিক্স তাকে হসপিটালে নিয়ে সব চেক করে রেখে দিয়েছিল এক সপ্তাহের জন্য, ওর নাকি সিভিয়ার ডিহাইড্রেশন ছিল তাই হসপিটালে রেখে ওকে তরতাজা করে পাঠাচ্ছে! এই এক সপ্তাহ সবাই হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। ভিক্টোরিয়া থাকে রাইট উয়িংসে সেখানে যার ডিউটি পড়ে সে সেদিন নাকের-পানি, চোখের-পানিতে একাকার হয়।
ভিক্টোরিয়া চুল ধরে টানা থেকে ওয়াকিং স্টিক দিয়ে মার দেয়া পর্যন্ত কিছুই বাকি রাখে না। আজ ভিক্টোরিয়া ফিরে আসছে হোমে। সবার মধ্যে একটা ভয় আর অস্বস্তি। আমি খেয়াল করে দেখেছি ভিক্টোরিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয় তাহলে ও শান্ত থাকে, কিন্তু তাল মিলিয়ে চলতে গেলে মহা মুশকিল, যে কাজ ১০ মিনিটে সারতে হয় ভিক্টরিয়ার ক্ষেত্রে সেটা করতে ৩০ মিনিট লাগে। সব কেয়ারগিভাররা অনুযোগ করেছে যে সকাল বেলা ওদের দেরী হয়ে যায় ভিক্টোরিয়ার জন্য। হোম এডমিন পুরো ব্যাপারটা ক্ষতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে টমাসকে বলা হবে ওর জন্য সকালে যে প্রাইভেট নার্স আসে তার আওয়ার বাড়িয়ে দু’ঘন্টা করে দেবার জন্য। সে সাতটায় আসবে হোমের নার্সকে সাহায্য করবে ভিক্টোরিয়াকে রেডি করবার জন্য তারপরে ওকে নাস্তা খাইয়ে তবে যাবে। টমাসকে সব বুঝিয়ে বলাতে ও রাজি হল। হোমের নার্স কিছুটা সস্তি পেল যে যুদ্ধটা ওকে একাকে করতে হবে না।
জর্জের পরবারের পক্ষ থেকে কেউ এল না ওর রুম খালি করে দেবার জন্য। এমন কিছু ছিলও না ওর রুমে…একটা সিংগেল বিছানা, একটা ওয়ারড্রব, জানলার ধারে একটা ছোট্ট টেবিল আর একটা চেয়ার।
ওয়ারড্রবের ভেতরে কিছু জামা কাপড় আর বাথরুমে ওর টুকিটাকি। আজ স্যালভেশন আর্মি এসে ওর রুমটা খালি করে সব কিছু নিয়ে গেল। চীরকুমার জর্জ ওর সব বিষয়-সম্পত্তি ও আগেই সব বিলি বন্টন করে দিয়েছিল ভাই বোনের সন্তানদের মধ্যে। ওরা জর্জের খোঁজখবর করত কিন্তু জর্জের মৃত্যুর পুরো ঘটনায় ওরা ভীষণ ভাবে লজ্জিত এবং অপ্রস্তুত ছিল তাই কেউ এল না। হোম ওদেরকে যোগাযোগ করলে ওরাই বলেছিল স্যালভেশন আর্মিকে কল করতে। এখানে যারা থাকতে আসে তাঁরা মৃত্যুর পরে এখান থেকে বের হয়, যাবার সময় রেখে যায় খালি রুম আর কিছু স্মৃতি। রুমটা এক সময় অন্য কারো দখলে গিয়ে নতুন করে সাজে কিন্ত স্মৃতিটুকু রয়ে যায় আবছা হয়ে। মাসিমা আর জর্জকে হারিয়ে আমার মনে হয়েছিল আমার কোন আপনজন আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছে, সেই শোক আমি এখনো সামলে উঠতে পারিনি, ভাবলাম আমার শোক আমার কাছেই থাক আমি আগামীদিনের প্রস্তুতিতে ব্যাস্ত হলাম। বিপিন বাবুকে কাল দেখতে যাব। ওর জন্য একটা ফাইল রেডি করে ওঁর ছেলেকে ইমেইল করে দিলাম আগামীকালের সময়সূচী, রুহা যেমন বলেছে … ছেলে রিপ্লাই না করলেও কোন সমস্যা নেই। ব্র্যাম্পটনে বিপিনের বাড়ির কাছে থাকে এমন একজন কমিউনিটি কেয়ারগিভারকে খোঁজ করলাম এবং পেলাম প্রীতিকে। ইন্ডিয়ান নার্স প্রীতি, এখানে নিজের যোগ্যতায় এসেছে বরকে নিয়ে। এখন সে কেয়ারগিভার হিসেবে কাজ করছে এবং রেডি হচ্ছে ঘঈখঊঢ পরীক্ষার জন্য। পাশ করলে সে এখানে জঘ হিসেবে কাজ করবার সার্টিফিকেট পাবে। (ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা