শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।

আমার প্রেগন্যান্সির ৪ মাস চলছে। শরীরটা ইদানং ভাল থাকে না। মর্নিং সিকনেসটাই সব থেকে বাজে কিন্তু আমার ক্ষেত্রে হয়েছে যে আমার সারাদিনটাই ভীষণ খারাপ কাটে। কোনকিছু খেয়েই পেটে রাখতে পারি না, সব বেরিয়ে যায় আর যার কারণে শরীর ভীষন দুর্বল। তবুও সকালে উঠতে হয় এবং নিয়ম মেনে কাজে যেতে হয়।
আজকাল কেন যেন কাজে যেতে ইচ্ছে হয় না, কাজের প্রতি কেমন একটা অনীহা জন্মেছে! কাজের জায়গায় সব কিছু যেন প্রাণ হারিয়ে ফেলেছে এমন মনে হয়।

আমার এই হোমের কাজের জীবনের সময়টুকুতে আমি মাসিমা এবং জর্জের সাথে খুব ঘনিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। জর্জের সাথে হোমের সবারই একটা ভাল সম্পর্ক ছিল কিন্তু মাসিমা আসবার পরে জর্জের সাথে আমার একটা আলাদা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল মাসিমার কারণে। আর মাসিমার বন্ধু বলতে ছিলাম আমি আর জর্জ। আমি সব কিছু থেকে মাসিমাকে রক্ষা করতে চাইতাম বা আগলে রাখতে চাইতাম। তারপরে সেই ভূমিকার অনেকটা দখল করে নিয়েছিল জর্জ। জর্জ বুঝেতে পেরেছিল মাসিমার প্রয়োজন। যতদিন মাসিমা ছিলেন জর্জের ডিপ্রেশনটা একেবারেই ছিল না, সে তার ফ্রি সময়টুকুর প্রায় অনেকটা মাসিমাকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকত। মাসিমা চলে যাবার পরে জর্জ ভেঙে টুকরো হয়ে গিয়েছিল, ওর কথা ছিল একটাই…সবাই একে একে চলে যায় ওর জীবন থেকে, ও কেন যায় না? জর্জের প্রাণশক্তি শূণ্যের কোটায় নেমে গিয়েছিল। জর্জের বিষন্নতা দেখলে আমার নিজেরই কেমন দম আঁটকে আসত। আমি নিশ্চিত মাসিমা এবং জর্জ এখন অপার শান্তিতে বিরাজ করছে কোথাও কিন্তু আমার মন কেমন দমে গিয়েছে। কেন যেন কিছুতেই আর মন বসে না এখানে, কেমন খালি খালি লাগে হোমটাকে। নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছি আর এত ঘনিষ্ট হব না কোন রেসিডেন্টের সাথে। কিন্তু প্রতিজ্ঞা কতটা রাখতে পারবো জানি না! ঘটনা সৃষ্টি হয়, সম্পর্ক তৈরি হয় এবং এর কোনটাই ইচ্ছাকৃত ভাবে হয় না, হয়ে যায়!

হোমে যখন কোন রেসিডেন্টের জন্মদিন আসে তখন আমরা সবাই মিলে একটা কার্ড সাইন করি, হোমের তরফ থেকে ফুল বা ফুলের একটা গাছ দেয়া হয়। ক্লায়েন্টের ফ্যামিলি কেক বা ক্লায়েন্টের পছন্দের কোন খাবার নিয়ে আসে। আজ ন্যান্সির জন্মদিন। ন্যান্সি একদম চুপচাপ একজন ক্লায়েন্ট, তাকে নিয়ে বলবার মত কোন গল্প আমার জানা নেই, আবার অনেক গল্প আছে! কিন্তু ন্যান্সি নিজেই হোমে তাঁর গল্প সৃষ্টি করল। তার বয়স ৭১, এমন কিছু বয়স তাঁর নয়, আর দেখতে আরো কম লাগে। সে নিজের কাজকম্ম নিজেই সব করতে পারে, বড় কোন অসুখ-বিসুখও তাঁর নেই। তার নিজের বাড়িতেই সে থাকতে পারত আরো অনেক দিন কিন্তু সে হোমে থাকতে চেয়েছে, কারণ হল বাড়িতে একা একা তার ভাল লাগে না। সে নিজে একজন নার্স ছিল। খুবই কর্মব্যাস্ত জীবন ছিল ন্যান্সির। অবসর নেবার পরে যতদিন পেরেছে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছে সে, এখন আর বাইরে ঘোরাঘুরির শক্তি নেই বলে এক জায়গায় আস্তানা গাড়তে হয়েছে। ন্যান্সি ছেলে-মেয়েকে বলে হোমে থাকতে এসেছে এইজন্য যে এখানে সে বন্ধু বানাতে পারবে, প্রয়োজনে ভলান্টিয়ারি করতে পারবে। রোজ দুপুরের পরে রেসিডেন্টদের যখন রিক্রিয়েশনের সময় আসে সে এক ঘন্টা করে সেখানে ভলান্টিয়ার করে। রিক্রিয়েশন টাইমটা সবার কাছেই খুব প্রিয় কারণ তখন অনেক রকম খেলা হয়, পুরষ্কার দেয়া হয় আর এই জন্য সব থেকে জনপ্রিয় গেম হল বিংগো কারণ এই খেলায় পুরষ্কার পাওয়া যায়। সবার পছন্দের পুরষ্কার হল – “ক্লিনেক্স বক্স” এর পরে রয়েছে চকলেট বা লেমন ক্যাণ্ডি, মজার কিছু লেখা চায়ের কাপ, কারো হাতে বোনা উলের কোন গলাবন্ধ, জুতা বা শাল। ন্যান্সি এই বিংগো গেমটা পরিচালনা করে এবং শুধু তাই নয় সে সব সময় উল দিয়ে কিছু না কিছু বুনছে এবং বিংগো খেলায় তার বোনা কিছু একটা থাকবেই। ন্যান্সি পুরুষ মহলে বেশ জনপ্রিয় কিন্তু মেয়ে মহলে ততটা নয়। বেশির ভাগ মেয়েরা ওকে হিংসা করে কারণ ন্যান্সি খুব স্মার্ট, অনেক গুণ এবং তার থেকে বড় কথা হল সব পুরুষদের ওকে খুব পছন্দ।

ন্যান্সির জন্মদিনের কারণে, যথারীতি আমরা অফিসের পক্ষ থেকে কার্ড রেডি করেছি এবং সুন্দর একটা ফুলের গাছ ওকে দিয়েছি আমরা। সদা স্মিতমুখ মিষ্টি ন্যান্সিকে আমার খুব পছন্দ। আমি দুপুরের পরে ন্যান্সির রুমে গেলাম ওকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য। গিয়ে দেখি ন্যান্সির রুম ফুলের তোড়ায় ভরে আছে। ওর বাচ্চারা ওর জন্য অনেক ফুল পাঠিয়েছে এবং হোমের অনেক পুরুষ রেসিডেন্টও ওর জন্য ফুল এনেছে। আমি তো অবাক হয়ে বললাম যে- “ন্যান্সি তুমি তো দেখি অনেক জনপ্রিয় একজন মানুষ।!” ন্যান্সি লজ্জা পেয়ে একটু হাসল। আমাকে বলল কোন একটা ফুলের তোড়া পছন্দ করে নিয়ে যাবার জন্য, না হলে সব নষ্ট হবে। আমি বললাম আজ থাক, আজ এই সব ফুল তুমি এনজয় কর, আগামীকাল এসে কিছু ফুল ডাইনিং হলে নিয়ে রাখব, সবার ভাল লাগবে। খুব খুশী হল শুনে, বলল সেও হেল্প করবে আমাকে কিন্তু সময় থাকলে আমি এখন ওকে একটু সাহায্য করতে পারব কিনা। আমি খুশী হয়ে বললাম অবশ্যই, বল কি করতে হবে। ন্যান্সি জানালো যে সন্ধ্যাবেলা ওর ছেলে আর মেয়ে, নাতি, নাতনিরা ওকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাবে বার্থডে ট্রিট করবার জন্য কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল যে ন্যান্সি ওর বয়ফ্রেন্ড কয়ে নিয়ে যাবে সাথে করে অতএব আমি ওকে পোষাক পছন্দে সাহায্য করতে পারব কিনা? আমি চোখ কপালে তুলে বললাম -“তোমার বয়ফ্রেন্ড? কে সে? কই আমি জানি না তো!” ন্যান্সি হেসে বলল,- “ছেলে-মেয়েরা ছাড়া আপাতত আর কেউ জানে না, এইযে তোমাকে বললাম”, খুব খুশি হয়ে ওকে ধন্যবাদ দিলাম ন্যান্সিকে আমাকে এই অনারটুকু করবার জন্য। বললাম, “তুমি তো বাইরেই যাও না তেমন, বয়ফ্রেন্ড এল কোত্থেকে? নাকি আগেই ছিল?” আমাকে আরো অবার করে দিইয়ে ন্যান্সি বলল যে সে বাইরের কেউ নয়, এই হোমেই থাকে সে। শুনে আমার ভিরমি খাবার দশা। কে, কখন, কি… কেউ কিছুই টের পেল না? টের পেলে এই নিয়ে কত কথা হত দিনরাত। আমার অবস্থা দেখে ন্যান্সি হেসেই শেষ, পরে বলল যে ওর নাম জন এবং সে হোমের সাত তলার বাসিন্দা। তখন আমি বুঝলাম যে কেন কেউ কিছু টের পায়নি।
হোমের সাত তলায় যারা থাকে তারা অনেক বেশী ইন্ডিপেন্ডেন্ট, একটু বেশী পয়সাওয়ালাও বটে। সবাই সিঙ্গেল রুমে থাকে, সকাল, দুপুর, বিকেল নার্স ওদের ওষুধ খাওয়ায় আর সবাই ডাইনিং হলে গিয়ে যে যার মত খাবার খেয়ে আসে, রুম ক্লিন করবার জন্য “মলি মেইড” ভাড়া করে নিয়ে আসে। ন্যান্সিরও সাত তলাতেই থাকবার কথা কিন্তু ওখানে রুম খালি ছিল না বলে ন্যান্সি আট তলায় থাকছে, কিন্তু সে নাকি সাত তলায় রুমের জন্য দরখাস্ত দিয়ে রেখেছে। রুম খালি হলেই সেখানে চলে যাবে। ন্যান্সি জানালো একদিন সে বাগানে বসে উল বুনছিল তখন জন এসে হ্যালো বলে ওর পাশে বসে গল্প জুড়ে দিয়েছিল। এরপর আস্তে-ধীরে,কথায়-কথায় ওদের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছে এবং তাদের এখনকার সম্পর্কটা বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ডের মত হয়ে গিয়েছে। হাত তুলে আমায় দেখালো একটা বিশাল ফুলের তোড়া আর এক বক্স চকলেট ওটা জনের উপহার। ন্যান্সি বলল তোড়ায় লাগানো কার্ডটা এনে পড়তে। দেখলাম সেখানে লেখা আছে- “Love has no age, no limit; and no death. Lets live and laugh together. Happy birthday to my love, my Savior Nancy”- from John Belford. আমার কি যে ভাল লাগল বোঝাতে পারবো না বলে! সত্যিই তো ভালবাসার কোন বয়স নেই কিন্তু আমাদের সমাজ বৃদ্ধ বয়সের প্রেমকে বলে ভীমরতি। আমি মনে মনে ভাবলাম ন্যান্সিকে ভীমরতিতে ধরেছে, ভেবেই হেসে ফেললাম কারণ ভাবনাটা মানালো না বা যথাযথ হল না….. ভীমরতি শব্দটায় বাঙালীদেরকেই শুধু মানায়। আমি ন্যান্সির অনুমতি নিয়ে ওকে জোড়ে একটা হাগ দিলাম, বললাম; তোমার কাছ থেকে একটু প্রাণশক্তি ধার নেই ন্যান্সি, অনেক অনেক শুভেচ্ছা তোমাকে! সেও আমাকে জোড়ে একটা হাগ দিল, বলল – “you’ve just started your life Monira, Keep your face always toward the sunshine!” (ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা