শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।

জর্জ যাবার জন্য এত উতলা হয়েছিল যে ওকে এভাবে চলে যেতে হল। ওঁর এভাবে যাওয়াটা আমার কাছে আত্মঘাতী মনে হয়েছিল। বারবারা মারা গিয়েছিল দু’দিন পরে। পুরো ব্যাপারটা ভীষণভাবে গোল পাকিয়ে গিয়েছিল। জর্জ যথেষ্ট অনুভূতশীল এবং বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ ছিল, সে কেন এভাবে বারবারাকে নিয়ে ওই অবস্থায় গাড়ি চালিয়েছিল সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। বারবারার ফ্যামিলি হোমকে স্যু করল, বলল হোমের দায়িত্বহীনতার কারণে বারবারাকে প্রাণ দিতে হল। এক বিশাল ইনভেস্টিগেশন শুরু হল। আমাকে কয়েকবার গিয়ে পুংখানুপুংখ বর্ণনা দিতে হল সেদিন কি হয়েছিল, আমি সেদিন জর্জকে দেখেছিলাম কিনা, তখন সে কি অবস্থায় ছিল… ইত্যাদি। পরে বারবাবার রুমমেটের কাছে থেকে জেনেছিলাম যে, বারবারার কয়েকটা জিনিসের কেনার প্রয়োজন ছিল এবং আগেও জর্জ ওকে ওয়ালমার্টে অনেকবার নিয়ে গিয়েছে তাই আজকেও বারবারা জর্জকে আবার অনুরোধ করেছিল আর জর্জও কোন কথা না বলে উঠে চলেগিয়েছিল বারবারার সাথে। আমার মনে হয়েছিল অরুণের সাথে কথা বলার পরে ও অস্থির হয়ে ড্রিংক করা শুরু করেছিল। দুপরে সে লাঞ্চও করেনি এবং বারবারা এসে বাইরে যেতে চাইলে ও ডিপ্রেশন থেকে খানিকাটা মুক্তি পাবার জন্য রাজি হয়ে গিয়েছিল। এত কিছু ভাবার মত অবস্থা হয়ত ওর ছিল না। আমাদের সবার প্রিয় জর্জ এভাবে বিদায় নেবে ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। নিয়তি মানুষকে মনে হয় এভাবেই টানে। জর্জের জন্য আমি প্রার্থনা করেছিলাম, হয়ত সারা ওকে নিতে এসেছিল। হয়ত মাসিমাও এসেছিল জর্জকে স্বাগতম জানানোর জন্য। জীবনের উপরে জর্জের বিতৃষ্ণা এসে ভর করেছিল, অবশেষে…
বলো শান্তি, বলো শান্তি
দেহ – সাথে সব ক্লান্তি
পুড়ে হোক ছাই। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

একসপ্তাহের মধ্যে আটতলায় ৩টি মৃত্যু, সব কিছু কেমন থমথমে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জীবন তো জীবনের মত চলবে আর সেই পথে মাসিমার রুম পূর্ণ করতে এসেছিল গুনেজ। তার বয়স আশি। ছোটখাট, হাসিখুশী এক মানুষ। কিন্তু ও নাকি এমন হাসিখুশী আগে ছিল না। বাইশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম স্বামীর হাত ধরে গায়ানা থেকে ক্যানাডা এসেছিল। প্রথম সংসার টিকেছিল মাত্র ৪ বছর, গুনেজের স্বামী অন্য এক রমণীর প্রেমে পরে গুনেজকে ফেলে চলে যায় কিন্তু ততদিনে গুনেজ কেনেডিয়ান জীবনকে আত্মস্থ করে নিয়েছিল। এসেই দুজনকেই কাজ নিতে হয়েছিল বিধায় গুনেজ অসহায় ছিল না; স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতায় সে কষ্ট পেয়েছিল বটে কিন্তু ভেঙে পড়েনি। ওদের এক বেডরুমের এপার্টমেন্টে গুনেজ একদিন একজন রুমমেট নিয়ে এসেছিল, আরেক ডিভোর্সি হ্যান্ডসাম গায়ানিজ এক লোককে। প্রেম জমে উঠতে বেশি দেরী হয়নি। দু’জন দু’জনকে বোঝার জন্য সময় নিয়েছিল এক বছর তারপর বিয়ে এবং সংসার। এই ঘরে গুনেজের ৩ কন্যা সন্তান, গুনেজের স্বামী লী-রয়ের আগের ঘরে এক মেয়ে, যে কিনা মায়ের সাথে থাকত। লী-রয়ের প্রথম মেয়ের নাম ভানেসা, বেচারি তেমনভাবে বাবার আদর পায়নি। কারণ গুনেজ কিছুতেই পছন্দ করত না তার মেয়েদের ফেলে লী-রয় ভানেসাকে সময় দিক। ভানেসার বয়স যখন তের তখন ভানেসার মা আরেক লোককে বিয়ে করে ভানেসাকে ফেলে চলে যায়। লী-রয় উপায়ান্ত না দেখে গুনেজকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভানেসাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। কিন্তু গুনেজের শর্ত ছিল যে মেয়েকে নিয়ে লী-রয় কোনরকম আদিখ্যেতা করতে পারবে না। অতএব সংসার বাঁচানোর জন্য লী-রয় সব শর্ত মেনে নিয়েছিল এবং সেটা পালনও করেছিল। ভানেসা ওদের সাথে থাকতে শুরু করার পর থেকে লী-রয় ওকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলত, আগে বরং ভানেসা বাবাকে এর থেকে বেশি পেত। কাকতালীয়ভাবে তিন বোনের সাথে ভানেসার খুব বন্ধুত্ব হয় এবং গুনেজের তিন মেয়ে ভানেসাকে বড় বোনের মত ভীষণ ভালোবাসত যেটা কিনা গুনেজের চক্ষুশূল ছিল। কিন্তু ওরা তিন বোন মা’কে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে ভানেসাকে আপন করে নিয়েছিল। আমি মনে করি বোনদের এই ভালোবাসা ভানেসাই অর্জন করেছিল নিশ্চিত। পাঁচটি বছর সব সয়ে ভানেসা ওই বাড়িতে টিকতে পেরেছিল শুধুমাত্র তিন বোনের ভালোবাসার কারণে। আঠারোতে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় এবং নিজের মত থাকতে শুরু করে কিন্তু বোনদের সাথে তার যোগাযোগ ছিল ঠিক আগের মত।

ভানেসা বাড়ি ছেড়ে গেলে গুনেজ যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিন কিন্তু কিছুদিনেই বুঝেছিল যে ভানেসাকে ওর জীবন থেকে বাদ দেয়া কিছুতেই সম্ভব না। কারণ গুনেজের বড় মেয়ে এলিসা এখন স্কুল ছুটির পরে বাসায় না এসে ভানেসার বাসায় গিয়ে বসে থাকে, মাঝে মাঝে রাতেও থেকে যায়। কোনভাবেই গুনেজ এটা বন্ধ করতে পারেনি বরং এই নিয়ে কিছু বললে এলিসা চীত্কার করে বাড়ি মাথায় করত। এলিসাও বয়ফ্রেন্ড যোগার করে ফেলল এবং তাকে নিয়ে ভানেসার বাসাতেই বেশি সময় কাটাতো। গুনেজের টেবিলে আমি লী-রয়ের ছবি দেখেছি, সে আসলেই হ্যান্ডসাম ছিল। লী-রয় গুনেজের সাথে সুখী ছিল না সে তাই সে বাইরে সুখ খুঁজতে শুরু করল এবং মেয়ে পটাতে সে নাকি ওস্তাদ ছিল। গুনেজের বলার ধরণে আমি হেসে ফেলেছিলাম। গুনেজ যখন বুঝতে পেরেছিল ততদিনে সব কেমন হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।

গুনেজের ভাষায়; “একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম যে – সব জাহান্নামে যাক, আমি আর পরোয়া করি না, দেদারসে ক্লাবে যেতে শুরু করলাম আর মদ গিলতে শুরু করলাম”। সংসার টিকে গেল কিন্তু বাকি সব গোল্লায় গেল। এলিসা বাড়ি ছেড়ে ভানেসার সাথে থাকতে চলে গেল, পরের দুই মেয়েও যার যেমন ইচ্ছে মত চলতে লাগল, লী-রয়ও এক সময়ে হাল ছেড়ে দিল। গুনেজ বলল এরপরে সে যেন দ্রুত বুড়ো হয়ে যেতে শুরু করল। লী-রয়ের মৃত্যুর পরে মেয়েরা ওকে নার্সিংহোমে রেখে গেল। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হল হোমে গুনেজের ছোট দুই মেয়ে কখনোই আসে না, এলিসা মাঝে মধ্যে আসে বরং ভানেসাই সব থেকে বেশী আসে এবং ওর দেখাশোনা করে। ভানেসার সাথেই এখন ওর সব থেকে বেশী সখ্যতা গুনেজের, কি অবাক কান্ড! আমাদের কল্পনায়ও আসে না ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে! গুনেজ জীবনে ভাল কিছু নিশ্চই করেছিল আর তাই শেষ জীবন ওকে এমন একটা অপূর্ব উপহার দিল। ওদের গল্প না জানালে বোঝার কোন উপায় নেই যে ভানেসা ওর নিজের মেয়ে তো নয়ই বরং কোন এককালে শত্রু ছিল। ভানেসাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কি করে এমন আশ্চর্য কান্ড হল, ভানেসা বলেছিল; নিজের সংসার হবার পরে ও বুঝেছিল যে গুনেজ নিরাপত্তাহীনতায় ভূগত কিন্তু তারপরেও পাঁচ বছর থাকতে দিয়েছিল। জীবনে কম ঝড় তো সয়নি গুনেজ আর তাই সে এমন আচরণ করত। সে গুনেজকে মাফ করে দিয়েছে অনেক আগে। বুড়িকে দেখার কেউ নেই বলে এগিয়ে এসেছে আর বুড়িও বিপদে পরে ভানেসার সাথে ভাব করে নিয়েছে, বলে হেসে ফেলেছিল। নিজের মা কোথায় ভানেসা জানে না আর জানতেও চায় না। আমি অবাক হয়ে ভানেসার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবিছিলাম…কি আশ্চর্য এই পৃথিবী! (ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা