শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।

১২.
গুরপ্রীতের সাথে দেখা হবার ৩ সপ্তাহ শেষে রুহা একদিন হাসি মুখে এসে জানালো যে জন্য হাম্বার হসপিটালের সামনের বিল্ডিং এ গুরপ্রীতের জন্য এক বেডরুমের একটা এপার্টমেন্ট পাওয়া গিয়েছে, স্পেসাল নিড কারণ দেখিয়ে কাজটা দ্রæততার শেষ করেছে রুহা। তাঁর জন্য মাসিক ভাতার ব্যাবস্থাও হয়েছে। ২/১ দিনের মধ্যেই পোটলা-পুটলি ঘুছিয়ে গুরপ্রীতকে এখানে নিয়ে আসা হবে। রুহা রিকোয়েস্ট করল বাসা বদলের দিন হারপ্রীত এবং সাথে আরো একজনকে ৩ ঘণ্টার জন্য শিডিউল দিয়ে রাখতে। আমি হারপ্রীতের সাথে একজন পুরুষ নার্সকে শিডিউলে বসিয়ে দিলাম। বেচারা হারপ্রীতকে যাতে কম মালপত্র টানতে হয় সেই জন্য পুরুষ নার্সকে শিডিউলে বসালাম। এই বিল্ডিং এ প্রায় সবাই ইন্ডিয়ান অধ্যুষিত। আমি ভাবলাম অবশেষে গুরপ্রীত ভাল থাকবে, এবার ওর ঠিক মত চিকিৎসা হবে, খাওয়ার কষ্ট থাকবে না, সামাজিকতা করার জন্য প্রচুর লোকজন পাবে। এই বিল্ডিংএর সিনিয়রদের মাসে একবার নিয়ম করে বাস ভর্তি করে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হয় সারাদিনের জন্য। গুরপ্রীত সেটাও এনজয় করবে। বেঁচে থাকার একটা ব্যাবস্থা আমরা হয়ত করে দিতে পারছি কিন্তু অপমান, অবহেলার কষ্ট সে ভুলবে কি করে? একটা কথা মনে খচ খচ করছিল, গুরপ্রীতের ছেলে জানে না ওর মায়ের নতুন আস্তানার কথা। ভুল করেও যদি বা কোনদিন তার মায়ের কথা মনে হয় বা মাকে দেখতে ইচ্ছে হয়, সে খুঁজে পাবে না গুরপ্রীতকে। আমি রুহাকে বললাম গুরপ্রীতকে নিয়ে চলে আসার আগে সে যেন মনে করে ওর নতুন ঠিকানাটা অফিস সুপারের কাছে দিয়ে আসে।

গুরপ্রীতের একটা গতি হওয়াতে আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। রুহা চলে যাবার পরে আমি একটু ব্রেক নিয়ে কফি আনতে গেলাম নিজের জন্য। নার্সিং স্টেশন থেকে বেড়োতেই এলিভেটর, তাকিয়ে দেখলাম অনেক মালপত্র জড় করা সেখানে। মনে পড়ল এরিখের শূন্য রুম ভর্তি করতে আজ আসছে ভিক্টোরিয়া। সে ক্রনিক ডিপ্রেশন এবং এংজাইটির রুগি, তার ফাইল বলছে সে খুবই লাউড এবং অন্যদের প্রতি এবিউসিভ। নার্সদের কথা ভেবেই মায়া হল, সব অত্যাচার ওদের হজম করতে হয়। খেয়াল হল যে আজকের ইভিনিং শিফটের নার্স এবং কাল সকালের নার্সকে ভিক্টোরিয়ার ইনফরমেশন দিয়ে প্রিপেয়ার করতে হবে, সাথে ভিক্টোরিয়ার কেয়ার প্ল্যান রেডি করতে হবে। কাজের কথা মনে হতেই ফুরফুরে মেজাজের ঘোর কেটে গেল। আমি দ্রæত পায়ে ডাইনিং হলে গেলাম কফির উদ্দেশ্যে।

মেশিনে সব সময়ে আগুন গরম কফি থাকে। কফি নিচ্ছি এমন সময় কিচেন থেকে কুক ন্যান্সি ডাকল। আমি কফি নিয়ে কিচেনের দরজায় গিয়ে দাড়ালাম। ন্যান্সি একটা প্লেটে গরম গরম কয়েকটা মাফিন দিয়ে বলল, নার্সিং স্টেশনে নিয়ে সবাই মিলে খেতে। আমি বেশ অবাক হলাম, সাধারনত আমরা কিচেন থেকে কফি ছাড়া কোন খাবার খেতে পারি না, অনুমতি নেই। আমি ন্যান্সিকে বললাম যে খাবার নিলে আমি ঝামেলায় পড়ব। ন্যান্সি হেসে বলল ভয় না পেতে, কারন এগুলো হোমের নয়। মাফিনের ডো সে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। ন্যান্সির বড় মেয়ের প্রথম সন্তান হয়েছে গতকাল রাতে, সে গ্র্যান্ডমা হয়েছে আর সেই খুশিতে আমাদের মিষ্টি মুখ করাচ্ছে। আমি খুবই খুশী হয়ে একটা হাগ দিয়ে অভিনন্দন জানালান নতুন নানিকে।

ন্যান্সি আর ওর বর ফিলিপিন্স থেকে এসেছিল বহু আগে। এখানেই ওর দুই মেয়ের জন্ম। ওরা বড় হয়েছে কেনেডিয়ান কেতাতে। দুই মেয়ের সাথে ছিল ন্যান্সির অনবরত যুদ্ধ। ওদের কিছুই ন্যান্সির পছন্দ নয় আর মেয়েরা মায়ের এত শাসন মানতে রাজি নয়। ন্যান্সির বর চুপচাপ মানুষ, সে কোন ঝামেলার মধ্যে নেই। বড় মেয়েটা স্কুল থেকেই অনেক বয়ফ্রেন্ড বদলেছে, ডিপ্লোমা শেষ করে সে ঘোষণা দিয়েছে যে সে তার বর্তমান গাইয়ানিজ বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করতে চায়। অনেক কাহিনী করে বয়ফ্রেন্ড তাকে প্রপোজ করেছে। ছেলেটাকে ন্যান্সির পছন্দ ছিল না, এটা বলতেই মেয়ে ভীষন রেগে গিয়েছিল। ওদের মতামতের তোয়াক্কা না করে মেয়ে বিয়ে করেছিল ওই বয়ফ্রেন্ডকে। কিন্তু কি এক আজব কারণে বিয়ের ১ সপ্তাহের মাথায় মেয়ে তার সদ্য নতুন বর কয়ে ছেড়ে মায়ের কাছে চলে এল। সে কিছুতেই বলে না কি হয়েছে, সারাক্ষন দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে শুয়ে থাকে। মেয়ের অবস্থা দেখে ওরা ভয় পেয়ে গেল। মেয়ের বাবা বলল মেয়েকে- “নিজের মত থাকতে দাও, কোন প্রশ্ন কর না, ধীরে ধীরে ঠীক হয়ে যাবে।” শুধু খাবার সময় মেয়ে দরজা খুলে বের হত, এমন করে সপ্তাহ খানেক কাটানোর পরে সে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়েছিল এবং জানিয়েছিল যে সে ২ মাসের অন্তস্বত্তা, এই সাথে এও জানিয়েছিল যে বরের কাছে আর ফিরে যাবে না। কেন যাবে না এই কারণটি আজ পর্যন্ত মেয়ে বলেনি কাউকে। ওরাও আর এই নিয়ে ঝামেলা করেনি, মেয়ে ভাল আছে এতেই মহা খুশী। অনেক অপেরক্ষার শেষে কাল মেয়ে তার মা হল। অনেক বছর পরে ওদের ঘরে ছোট্ট একটা মানুষের আবির্ভাব, ভীষণ খুশি সবাই।

আমিও খুশি মনে মাফিনের প্লেট নিয়ে নার্সিং ষ্টেশনে ফিরে এলাম। ওখানে কেউ নেই তখন। ছোট্ট একটা নোট লিখলাম এই বলে যে “নতুন গ্র্যান্ড মা ন্যান্সির পক্ষ থেকে আমাদের জন্য ট্রীট, প্লিজ এনজয়” – সাথে এও লিখালাম যে প্ল্যান করেছি ন্যান্সির নাতনিকে কিছু একটা উপহার দেব, কেউ অংশগ্রহণ করতে চাইলে সামনে রাখা কাপে টাকা রাখতে। দিনের শেষে কাপে ২৫০ ডলার জমা হয়ে গেল। ডিসিশন হল “টয়েস আর আস” থেকে গিফট কার্ড কিনে দেয়া হবে। দিনের শেষে যখন রেডি হচ্ছি বাড়ি যাবার জন্য তখন হঠাৎ বাদিকের উয়ংসে একটা সোরগোল শুরু হল। দৌড়ে গেলাম, গিয়ে দেখি মাসিমার ঘরের সামনে জটলা। মাসিমা ফ্লোরে পড়ে আছেন। নার্স অলরেডি ৯১১ কল করেছে, আমি গিয়ে মাসিমার মাথার নীচে একটা বালিস দিয়ে পাশে বসলাম। এম্বুলেন্স চলে এল, ওরা মাসিমাকে নিয়ে চলে যাবার সময় আমি জেনে নিলাম কোন হসপিটালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সবাই চলে যেতে আমি মাসিমার রুম বন্ধ করে দিলাম, নার্সিং ষ্টেশনে ফিরে গিয়ে অরুণ কে কল করে সব জানালাম। কেমন একটা ব্যাথা বুকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম;
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।……সুকান্ত
(ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা