শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।

১১.
সেদিন সকালে উঠে দেখি চারিদিক স্নো পড়ে সাদা হয়ে আছে; তখনো ঝরছে অবিরত। এপ্রিল স্নো পড়ার সময় না কিন্তু প্রকৃতির আচরণ দেখে মনে হল ৬ মাসের বিদায়ী ভালবাসা জানাতে শেষ চুম্বন দিয়ে যাচ্ছে। কাজে যাবার জন্য আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরোলাম। বাইরে বেরিয়ে স্নোর মধ্যে হাটতে হাটতে ভাবলাম কফির দোকান পর্যন্ত হেটে গিয়ে কফি নিয়ে তবে আজ বাসে উঠব। প্রকৃতির এই ভালবাসা কিছুতেই আজ পায়ে ঠেলব না, সাদরে গ্রহন করে নেব। বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জিহবা বের করলাম স্নো খাবার জন্য, মুখের উপরে ঝরে পড়ল সাদা বরফের গুরো, অসীম আনন্দে ভরে গেন মন। জানি কাজে গিয়ে ঢোকার সাথে সাথে আমি বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব, নিজের জীবনের সুখ, অসঙ্গতিটুকুকে দরজার বাইরে অপেক্ষমাণ রেখে একঝাক বৃদ্ধশিশুদের মাঝে বিলীন হয়ে যাব আট ঘন্টার জন্য, তখন ওদের প্রয়োজনটাই সব থেকে মূল্যবান, আর কিছু নয়। বাসে বসে কফি খেতে খেতে বাইরের অপরুপ সৌন্দর্য দু’চোখে শুষে নিচ্ছিলাম। ভাবছিলাম জীবন কি অদ্ভুত, জীবনের লাগামটা যতই ধরতে চাই ততই যেন যে সে আপন ইচ্ছেতে বয়ে চলে। আমার ধারণা, কখন কখন পরিস্থিতি মানুষের জীবনকে চালনা করে, তখন যেন নিজের হাতে লাগামটা আর থাকে না, তখন জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিতে হয় আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হয় আবার হাল ধরবার জন্য। যারা নিজেদের পরিস্থিতি এবং পারিপার্শিকতা সম্বন্ধে সদা সতর্ক থাকেন তাদের নিতান্তই কষ্ট হয় মানিয়ে নিত বা এভাবে বয়ে চলতে। এটা একান্তই আমার নিজস্ব মতামত, দ্বিমত অবিশ্যই রয়েছে।

আজ সবকিছুই যেন ধীরে চলছে। টেবিলে বসে একটার পর একটা ক্লায়েন্ট ফাইল ডাটা বেইসে ঢোকাচ্ছিলাম হঠাত করে মাসিমা আর জর্জ এসে হাজির। মাসিমার শরীরের অবনতি হচ্ছে ধীরে ধীরে। ওষুধ আর তেমন ভাবে কাজ করছে না। ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। তাতে অবশ্য মাসিমার কোন আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। তিনি নিয়ম করে প্রার্থনা করেন এবং প্রস্তুতি নেন মৃত্যুর জন্য। কি ঐশ্বরিক এক আয়োজন তাঁর প্রিয়তমর কাছে যাবায় জন্য। মাসিমা বিধাতার কাছে প্রার্থনা করেন যেন তাঁকে পৃথিবীতে আর ফিরে আসতে না হয়, তিনি যেন পরম নিশ্চিন্তে স্বর্গে মেসোকে নিয়ে থাকতে পারেন। আমি জানতে চেয়েছিলাম কেন তিনি মেসোকে এত ভালবাসেন? মাসিমা বলেছিলেন মেসো তাকে কোনদিন বুঝতে দেননি অবহেলা কাকে বলে। কিন্তু একজীবনে শুধু সুখ থাকবে দুঃখ থাকবে না তাতো হয় না, তাই তিনি দুঃখ দিয়ে সেই ঘটি এখন পূর্ণ করছেন। মাসিমার কথা শুনলে মনে হয় মৃত্যুটা এমন খারাপ কিছু নয়, কিন্তু পরক্ষণে আবার ভাবি ওপারে তো আর মেসোর মত আমার জন্য কেউ অপেক্ষায় নেই; নাকি আছে? জর্জ পরম যত্নে মাসিমাকে দেখে রাখে আর মাসিমাও এখন জর্জের প্রতি অনেক সহজ এবং নির্ভরশীল। ওদের এই সম্পর্কের কোন নাম হয় না। আমি ভাবি এ অনেক ভাল হয়েছে যে অরুণ মাসিমাকে হোমে রেখেছে, এখানে তিনি অনেক যত্নে অনেক আদরে আছেন। মাসিমাও বলেন যে এখানে সবার ভালবাসায়, যত্নে তিনি অনেক ভান আছেন। অরুণের কথা এলে মাসিমা বলেন যে এটা জীবনের এক প্ররিক্রমা, জীবন এভাবেই চক্রাকারে ঘুরে সব ফিরিয়ে দেয়। অরুণের প্রতি মাসিমার কোন রাগ নেই তিনি শুধু বলেন যে বিদায় ক্ষণে অরুণ তাঁর হাতটা ধরে রাখলেই তিনি আর কিছু চান না। অরুণের কোন সন্তান নেই, মাসিমা মনে প্রাণে আশীর্বাদ করেন যে কোল জুড়ে ওদের সন্তান আসুক, অরুণ যেন বুঝতে পারে সন্তান বুকে নেবার কি আনন্দ। বলতে ভুলে গিয়েছি যে অরুণ এসে আমাকে একটা ছোট্ট ক্যাসেট প্লেয়ার দিয়ে গিয়েছিল। আমি মাসিমার পছন্দের ৫০/৬০ এর দশকের বাংলা হিন্দি সিনেমার গানের কয়েকটা ক্যাসেট মাসিমাকে দিয়েছিলাম। রোজ সকাল বিকেল মাসিমা তাঁর প্রিয় চেয়ারে বসে গানগুলো শোনেন আর বাইরে তাকিয়ে মাথা দুলান। আমি ঘরে ঢুকলেই তিনি গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন আর আমাকেও গলা মিলাতে বলেন। আমরা দু’জনে তখন মনের আনন্দে গান গাই আর হেসে কুটিকুটি হই।

জর্জ এসে তাঁর স্বভাব মত হই চৈ করে মাতিয়ে ফেলল আমাদের ছোট্ট নার্সিং স্টেশন, আমাকে বলল – “ইয়াং লেডি দিনে দিনে সুন্দর হচ্ছ কেন এত? ব্যাপার কি? শেষে আমি প্রেমে পড়লে তোমার বর আমাকে মার দেবে সেই ভয়ে আছি!” আমি বললাম – “জর্জ যতদিন বেলা আছে ততদিন আর অন্যদিকে মনোযোগ দিও না”, বলেই আমি থেমে দিয়েছিলাম, আমার কথাটার মানে হয় যে বেলা আর আমাদের মাঝে বেশীদিন নেই! আসলেই কি তাই? আমরা যে কেউ যে কোন সময়ে চলে যেতে পারি! এত নিশ্চিত আমি হলাম কি করে যে মাসিমাই আগে চলে যাবেন? জর্জ অবশ্য এর ধার কাছ দিয়েও গেল না, সে হেসে মাসিমার হাতে একটা চুমু খেল। মাসিমা একটু লাল হলেন লজ্জায়। আমাকে জানালেন যে আজ অরুণ আসবে দুপুরে এবং খাবার নিয়ে আসবে তাই তিনি দুপুরে ডাইনিংএ যাবেন না খেতে আর এটা যেন আমি জর্জকে বুঝিয়ে বলি একটু। সাথে এও জানতে চাইলেন যে রুমে ২টা প্লেট আনা যাবে কিনা, কারণ অরুণ খাবে ওঁর সাথে। আমি শুনে ভীষণ খুশী হলাম যে অবশেষে মাসিমার ভাত, মাছ আসছে। আমি ফোন করে অরুণকে কয়েকটা ভাল বাঙালি রেস্টুরেন্টের নাম আর ফোন নাম্বার দিয়েছিলাম কিন্তু মাসিমাকে সেটা বলিনি আর অরুণকেও বারণ করেছিলাম বলতে। দুপুরের ঠিক আগখানে অরুণ এল, হাতে একটা দেশী টিফিন ক্যারিয়ার, এসে আমায় হাই বলল সাথে একটু লাজুক হেসে জানাল যে, মাসিমার পছন্দের সব খাবার সে নিয়ে এসেছে। অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বলল যে এখানে এত ভাল দেশী খাবারের দোকান আছে সে জানত না। আমি বললাম এখন থেকে সে প্রায়ই মাসিমার জন্য খাবার নিয়ে এলে আমি খুব খুশী হব। দৌড়ে গেলাম ডাইনিং হলে প্লেট, ওয়াটার বটল এগুলো আনতে। মাসিমার রুমে গিয়ে দেখি জানলার ধারে টেবিল টেনে দু’টো চেয়ার মুখোমুখি বসে দু’জন, সামনে খাবারের বাটিতে সাজানো ইলিশ মাছ, কয়েক রকম ভর্তা, ডাল, ভাত। খুশীতে মাসিমার চোখ চকচক করছে। আমি দু’জনার সামনে প্লেট সাজিয়ে দিয়ে বললাম “এনজয় ইওর মিল”, মাসিমা অনুরোধ করলেন ওদের সাথে খেতে, আমি বুঝিয়ে বললাম যে সেটা সম্ভব নয়, মাসিমা যেন কিছু মনে না করেন, বলে আস্তে বেড়িয়ে যাবার সময় ফিরে তাকিয়ে দেখলাম বাইরে অঝোরে স্নো পড়ছে আর ভেতরে জনালার ধারে মুখোমুখি বসে দুটি ছায়া – মা আর সন্তান অসীম আনন্দে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে পরম মায়ায়, পরম ভালবাসায়। (ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা