শারমীন শরীফ : বৃহত্তর ঢাকার মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া থানার উত্তর ফুলদী গ্রামে ৬২ সালের পহেলা আসার পৈত্রিক নিবাসে ল²ী চক্রবর্তীর জন্ম। বাবা শ্রী নলনিরঞ্জন কর মা আশালতা কর। ল²ী বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।
বাবা রাজনীতি করতেন। তৎকালীন পাক ভারত উপমহাদেশে কংগ্রেসের ভারত ছাড়ো, সত্যাগহ ও আইন অমান্য আন্দোলনের জন্য তাঁর বাবাকে অনেকবার জেল খাটতে হয়েছে । ভারতের আলিপুর জেল, বহরমপুর জেল, দমদম প্রেসিডেন্সি জেল সমূহে তিনি বহুবার বন্দী ছিলেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, রবি নাগ, নেপাল নাগ, মুক্তির সংগ্রাম চলাকালে আগরতলার মুখ্যমন্ত্রী একসাথে জেল খেটেছেন।
ল²ী চক্রবর্তীর জন্মের পর বাবা চাকরি নেন পূর্ব বাংলার কয়েকটি সুতা কলের মধ্যে অন্যতম ‘ঢাকেশ্বরী কটন মিলে’। মিল্টির মালিক ছিলেন সূর্য কুমার বসু। তিনি স্বদেশী আন্দোলনে শহীদ বিনয় বসুর কাকা। দীর্ঘ সময় বড়বাবু পদে চাকরি করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মা আশালতা কর স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। তিনি স্বদেশী কাপড় তৈরির জন্য চরকায় সুতো কাটতেন। স্বদেশী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য গান গাইতেন।
পারিবারিক ঐতিহ্যের সূত্রেই ল²ী চক্রবর্তী ছাত্র ইউনিয়নের যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালের দিকে ঢাকেশ্বরী অঞ্চল ছাড়াও নারায়ণগঞ্জে ছাত্র ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। কামাল, মতিন, মিন্? নুপুর, মমতা, জয়শ্রী, মঞ্জুশ্রী ও মাসুদাসহ অনেকে।
লক্ষী চক্রবর্তীর নিজের কথনে আমি তাঁর কাহিনী তুলে ধরছি;
’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, এরপর ’৭০-এর নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়লাভ করে। তখন এই ফলাফলে শাসক প্রধান ইয়াহিয়া খানের মাথা গরম হয়ে গেলো। ১৯৭১ এর মার্চ উত্তাল হয়ে উঠলো – জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হলো। সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। ঢাকা শহর, নারায়ণগঞ্জ মিছিলের নগরীতে পরিণত হলো। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সব বন্ধ হয়ে গেলো।
সে সময় ঢাকেশ্বরী থেকে কারখানা বন্ধ করে শ্রমিক, যুবক, নারী- সকলে মিছিল করে ল²ণখোলা চৌরাপাড়া হয়ে বন্দর পর্যন্ত যেত। নারায়ণগঞ্জের প্রধান সড়কেও মিছিল হতো। তখন হাজার কণ্ঠে ¯েøাগান উচ্চারিত হতো- তোমার আমার ঠিকানা – পদ্মা মেঘনা যমুনা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর – বাংলাদেশ স্বাধীন কর, পিন্ডি না ঢাকা – ঢাকা ঢাকা, আইয়ুব-মোনায়েম দুই ভাই – এক রশিতে ফাঁসি চাই, মাগো তোমায় কথা দিলাম – স্বাধীনতা আনবো ইত্যাদি ¯েøাগানে মুখরিত ছিলো। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে বাঙালিরা আর ঘরে থাকলো না। দেশ আন্দোলনে আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠলো।
নারায়ণগঞ্জ আন্দোলনের সূতিকাগার। শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। ১০ মার্চ সকাল ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত নৌ-মিছিলের আয়োজন হলো। ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলের পাশে ছিল সোনাচরা ডকইয়ার্ড, জাহাজ মেরামতের কারখানা। সকল জাহাজ, ছোট লঞ্চ, ঢাকেশ্বরী মিলের লঞ্চ, অসংখ্য নৌকায় নদী ভরে গেলো। আমাদের মিলের শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, নারী, তাঁতী, গোয়ালা, চাষী- সকলে গিয়ে জাহাজে উঠলো। আয়োজকদের মধ্যে মতিন মেম্বার, ধামগড়ের রশিদ ভাই, কামাল ভাই, হাশেম ভাই, ২নং ঢাকেশ্বরীর নেতৃবৃন্দ। নারায়ণগঞ্জ শহরের টার্মিনালে সভা আহŸান করা হলো। জাহাজী শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক আলী আহাদ, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আফজাল হোসেন ছিলেন। উল্লেখ করার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে তখন সবার হাতেই স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে কিছু না কিছু ছিলো। আমি ঘর থেকে রামদা হাতে বেরিয়ে পড়ি। সেদিনের নৌ-মিছিলের সবচেয়ে বড় জাহাজ ছিল গাজী ও টার্ন। মতিন ভাই আমার এ অবস্থা দেখে আমাকে গাজী জাহাজের শীর্ষে উঠিয়ে দিলো। আমার সাথে আরেকজন মেয়ে ছিলো, ওর নাম ভ‚ষণ। আমি পরেছিলাম খদ্দরের ফ্রক, মাথায় বাবার খদ্দরের টুপি। হাত উঁচুর করে লম্বা দাটি হাতে নিয়ে পুরো মিছিল দাঁড়িয়ে ছিলাম জাহাজের শীর্ষভাগে। ¯েøাগানে নদী তীরের আকাশ-বাতাস কম্পিত হয়ে উঠেছিলো। এই ছবি পরদিন পূর্বদেশ, সংবাদ, দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো। টেলিভিশনেও ছবি দেখিয়েছিলো।
১৯৭১ সালের মার্চেই স্বাধীনতা আন্দোলনের প্র¯‘তি হিসেবে নানা প্রক্রিয়া শুরু হয়। শীতলক্ষ্যা নদীর দুই তীরেই আন্দোলন শক্তিশালী হতে থাকে। ঢাকা থেকে খবর এলো ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে অস্ত্র চালনার ট্রেনিং নিচ্ছে। আমাদের ঢাকেশ্বরী মিলের পাহারা ও নিরাপত্তার জন্য কন্ট্রোল রুম ছিলো। সিকিউরিটি অফিসার ছিলেন আলী আকরাম সাহেব ও কন্ট্রোলার ছিলেন জিতেন চ্যাটার্জী। তারা মিলের রাইফেলগুলো ট্রেনিংয়ের জন্য প্রতিদিন বিকেলে দিতেন। এভাবে আমরা মন্দিরের মাঠে ঢাকেশ্বরী হাই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ও যুবকেরা প্রশিক্ষণ নিতে থাকি।
বাবা অফিস থেকে ঘরে এসে বললেন, নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটী ও ফতুল্লায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে ঢাকার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বিকেলে আমি, প্রীতিকণা, ভ‚ষণ, জয়শ্রী, মঞ্জুশ্রী, অশ্রুকণা, আলয়দা, কামাল ভাই, বামপদদা, করিম ভাই, জিয়াউল, নারায়ণ, বাবলু, সন্তোষ, সুনীল আরও অনেকে মাঠে ছিলাম। পরিস্থিতি দ্রুতই খুব খারাপ হতে থাকে। যে কোন মুহূর্তে একটা কিছু ঘটতে পারে। সকলকে সতর্ক থাকতে বলা হলো।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকার পরিস্থিতি খারাপ হলো। প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে। পাকিস্তানি মিলিটারি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের হলগুলোতে আক্রমণ করেছে। নদীর পশ্চিম পাড়ে তখনকার সবচেয়ে বড় তেলের ডিপো বার্মা ইস্ট্রার্ন দখল করেছে। ভোর রাতে গুলি ছুঁড়তে শুরু করলো। বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ছে।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হলো। আরম্ভ হলো বাঙালির ওপর নির্মম নির্যাতন। মিলের তাঁত ঘর, স্পিনিং, উইভিং, ডাইং- সব সেকশন মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেলো। বাবাকে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু টাকা দিলেন অ্যাডমিন মনোয়ার হোসেন। বললেন, বাবু পরিস্থিতি খারাপ, গ্রামে চলে যান। ২৬ মার্চ মিল প্রায় খালি হয়ে গেছে। রাস্তায় একটা কুকুরের ডাকও শোনা যাচ্ছে না। আমরা ভয়ে ভয়ে কয়েকটি ফ্যামিলি কোয়ার্টারে রয়ে গেছি। বন্দর থানার ওসি মিল টহল দিয়ে গেলো। ২৭ মার্চ সকালবেলায় আমরা চলে গেলাম আমাদের গ্রামের বাড়ি মুন্সগীঞ্জের গজারিয়াতে।
এপ্রিল মাসের মধ্যেই গজারিয়ায় পাকিস্তানি মিলিটারি আক্রমণ করলে আমরা জীবন রক্ষার জন্য দাউদকান্দি, ফুলতলা, দেবীদ্বার, কুমিল্লায় চলে যাই। যাযাবর জীবন শুরু হয়। সেখান থেকে বক্সনগর বর্ডার হয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের বিশালগড় হাই স্কুলে গিয়ে উঠি। যে দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে বিশালগড়ে পৌঁছাই তা অবর্ণনীয়। বিশালগড় থেকে আমাদের শরণার্থী কার্ড দেওয়া হয় এবং সূর্যমণি নগর ক্যাম্পে পাঠানো হয়। বাবা আগরতলা থেকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি লিখেন বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের পরিচয় দিয়ে। এর কিছুদিন পর ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন সিংহের কাছে চিঠির উত্তর আসে। মুখ্যমন্ত্রী শচীন সিংহ সরকারি লোক পাঠিয়ে দ্রæততার সাথে আমাদের স্পেশাল ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
এক পর্যায়ে নারায়ণগঞ্জের খাজা মহিউদ্দিনের সাথে এবং ফরিদা মহিউদ্দিনের সাথে আমাদের দেখা হলো। এই ক্যাম্পেই তাঁরা উঠেছেন। আরো অনেকের সাথে এখানে দেখা হলো। এই ক্যাম্পে রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, শিক্ষকসহ বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ থাকার জায়গা পেয়েছেন।
সূর্যমণি নগর স্পেশাল ক্যাম্পে প্রতিদিনই সন্ধ্যায় সংগীত, আবৃত্তি, নৃত্য ইত্যাদি পরিবেশনা হতো দুই লাইনের ক্যাম্পের উঁচু জায়গাটি ব্যবহার করে। চট্টগ্রাম কারিগরি কলেজের এক দাদা মোস্তফা ভাই এটি পরিচালনা করতেন।
এদিকে ফরিদা আক্তার, ফিরোজা আতিক মিতা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের কাজে নারীর অংশগ্রহণ বেগবান করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলের অফিস আগরতলা শহরে ছিলো। জহুর আহম্মেদ চৌধুরী এর প্রধান ছিলেন। নারীদের জন্য রাইফেল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্ত দ্রুত করার সমস্যা থাকায় বিশেষ প্রয়োজনে নার্সিং স্কোয়াড গঠন করা হয়। কাজগুলোকে পরিচালনা করার জন্য স্বেচ্ছাসেবিকা টিম ছিলো। জাহানারা বেগম সভানেত্রী, ফরিদা মহিউদ্দিন (ফরিদা আক্তার) সাধারণ সম্পাদিকা এবং আম্বিয়া আজম সহ-সভানেত্রী, রিজিয়া বেগম কোষাধ্যক্ষ, ফিরোজা আতিক মিতাসহ আরও অনেকে ছিলেন এই কমিটিতে। ফরিদা আক্তার ক্যাম্পগুলোতে যখন মেয়েদের সংগঠিত করতে যেতেন তখন আমাদের সাথে নিয়ে যেতেন।
পূর্বাঞ্চলীয় অংশে বহু ক্যাম্প স্থাপিত হলো। ইন্দিরা গান্ধী তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। শরণার্থী জীবনে তাঁদের সহযোগিতা সশ্রদ্ধ চিত্তে আজও আমরা স্মরণ করি। আমরা তালিকাভুক্ত হলাম নার্সিং ট্রেনিংয়ের জন্য। আমার ট্রেনিং হলো জিবি (গোবিন্দ বল্লভ) হাসপাতালে। জিবি ও ভিএম হাসপাতালের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন রথীন দত্ত। নির্বিঘ্নে আমরা মেয়েরা ট্রেনিং নিতে পেরেছিলাম। ট্রেনিংয়ের পর আমাদের জিবি এবং ভিএম হাসপাতালে পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া হয়।
আমাদের কাজ ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক পরিচর্যা করা। আহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে গেলে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হতো। যুদ্ধে আহত হয়ে কেউ দুই পা হারিয়েছে, কেউ এক হাত পা, কেউ দুই হাত- সে যে কী মর্মান্তিক দৃশ্য- আমি বলে বোঝাতে পারবো না। আমাদের দেখেও তাঁদের দুই চোখ বেয়ে নামতো জলের ধারা, কাঁদতে কাঁদতে বলতেন, কবে দেশ স্বাধীন হবে?
একদিন আমরা ডিউটি শেষ করে চলে আসবো; ঠিক সে সময় যুদ্ধাহত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক সৈন্যকে আনা হলো। তাঁর ফুসফুস মর্টারের আঘাতে বেরিয়ে পড়েছে। সে চিৎকার করে বলছিল, আমি ডাবের পানি খাবো। আমরা মেয়েরা পরদিন নিজেরা চাঁদা তুলে ৬টি ডাব নিয়ে গেলাম; কিš‘ হাসপাতালে গিয়ে দেখি তাঁর মৃতদেহটি সাদা চাদরে ঢাকা। আমরা সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে এই বীর যোদ্ধাকে স্যালুট করলাম। আমরা মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করছি, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী; কিন্তু আজও বীর যোদ্ধার কণ্ঠটি আমার কানে বাজে। আমি সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ডাবের পানি পান করি না। এটি আমার ভাই বীর যোদ্ধার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
জিবি হাসপাতালে আমরা কর্মরত, তখন নভেম্বর মাস। কে ফোর্সের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন আলী (অব.) কসবার যুদ্ধে আহত হলে জিবি হাসপাতালে আনা হয়। খালেদ মোশাররফের অবস্থার অবনতি হওয়াতে তাঁকে দেরাদুন সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয়।
শরণার্থীদের জন্য আগরতলার বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্প গড়ে উঠেছিলো। কোণাবন, সূর্যমণি নগর সাধারণ ক্যাম্প ও স্পেশাল ক্যাম্প, হাফানিয়া ক্যাম্প, আমতলী ক্যাম্প, গকুলনগর ক্যাম্প, ডুলাইবাড়ী রানী ক্যাম্প, বিশালগড়, বরদোয়ালী ক্যাম্প ইত্যাদি ক্যাম্প তৈরি করা হয়। ক্যাম্পগুলোতে রেশন দেওয়া হতো- চাল, ডাল, সব্জি, শুঁটকি মাছ, বিস্কুট, তেল, লবণ, সাবান ইত্যাদি।
এদিকে ডিসেম্বর মাস চলে এলো। ১৩, ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বরে যুদ্ধ মারাত্মক রূপ লাভ করলো। ১৬ ডিসেম্বর আমরা জানতে পারলাম মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টায় যুদ্ধে জয়ী হয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। বাঙালি জাতি একটি লাল-সবুজের পাতাকা, একটি জাতীয় সংগীত প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বিজয়ের আনন্দ মিছিল বের করে আগরতলার কংগ্রেস ভবন ও বাংলাদেশের প্রশাসনিক অস্থায়ী অফিসে যাই। সকলে আমরা দেশাত্মবোধক গান গাইছিলাম- ‘আগে চল বাহিনী; আগে চল বাহিনী/মিছে ভয় পিছে পরে রয়।’ ‘ধন্য ধান্যে পুষ্পে ভরা’, ‘ভয় কি মরণে’ ইত্যাদি গান। ¯েøাগান মুখরিত মিছিল থেকে গগণবিদারী কণ্ঠে সকলে সমস্বরে আওয়াজ তোলে- জয় বাংলা!
আমরা ১৬ ডিসেম্বর মিছিল শেষে জিবি হাসপাতালে যাই। সেখানে আরেক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। কুমিল্লার ময়নামতি ক্যাম্পে নারীদের আটকে রেখে নির্যাতন করতো পাকিস্তানি মিলিটারি। মিত্রবাহিনী সেই ক্যাম্প দখল নেয় এবং নির্যাতিত নারীদের উদ্ধার করে মিলিটারি ভ্যানে করে জিবি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় চিকিৎসার জন্য। তাঁদের চিৎকারে পুরো হাসপাতাল বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। বিবস্ত্র অবস্থায় তাঁদের রাখা হয়েছিলো সেই ক্যাম্পে। তাঁরা বলছিলো, আমাদের বিষ দাও, আমরা আর বাঁচতে চাই না! এই বীভৎসতার চিত্র আমি বলে বোঝাতে পারবো না! এই হচ্ছে আমার স্বাধীনতা চিত্র।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশমাতৃকার মহান ব্রতে যুক্ত হয়ে আজও গর্ববোধ করি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, এটি রক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য’।
১৯৭৬ সালের ১২ জুন লক্ষী চক্রবর্তী, রথীন চক্রবর্তীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। রথীন চক্রবর্তীর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা মহানগর কমিটির সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ছিলেন এবং পরবর্তীকালে নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি দায?িত্ব পালন করেন। তিনি উদীচি শিল্প গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা লগ্নে সত্যেন সেনের সাহচর্যে ছিলেন। ল²ী চক্রবর্তীর শ্বশুর বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া থানার বাকলিয়া গ্রামে। তার শশুর ডাঃ শ্রী মনীন্দ্রলাল চক্রবর্তী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ল²ী চক্রবর্তী বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জন্ম লগ্ন থেকেই এই সংগঠনের সাথে জড়িত। তিনি পরবর্তীকালে নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। তিনি মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদিকার পাশাপাশি মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদকের দায?িত্ব পালন করেছেন এবং পাশাপাশি শিক্ষকতা করছেন।